Wednesday, May 22, 2013

এই ভয়ংকর দানবকে রুখতে হবে


হায়দার আকবর খান রনো 

Haidar.Akbar.Khan.Rono's pictureজামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম ইসলাম নাম ব্যবহারকারী দুই সংগঠন এবং এর সঙ্গে এখন বিএনপি যুক্ত হয়ে যে রাজনৈতিক বীভৎসতা প্রদর্শন করেছে, তাকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখা যায় না। গত ৫ মে মতিঝিল-পল্টন এলাকাজুড়ে যে সহিংসতা দেখলাম, তা আমাদের দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। আমি যখন নজিরবিহীন কথাটা উচ্চারণ করি, তখন অবশ্যই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনাবলিকে বাইরে রাখি। কারণ ১৯৭১ সালের ৯ মাসে যা ঘটেছিল, এর সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না।
সেটি ছিল একটি বিজাতীয় হানাদার বাহিনীর বর্বরতম সামরিক আগ্রাসন, যা হিটলার, নাদির শাহের সঙ্গে তুলনীয়। অথবা তার চেয়েও অধিক বর্বর। আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, অমুক ঘটনা ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। এই রকম বিবৃতি শুধু যে সঠিক নয়, তাই-ই নয়। তাতে ১৯৭১ সালের ভয়াবহতাকে ছোট করে দেখানো হয়। এই ধরনের বিবৃতি বন্ধ হওয়া দরকার।
হেফাজতের সহিংস তৎপরতা বন্ধ করার জন্য সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হয়েছিল। ৫ ও ৬ মের মধ্যরাতে। তাতে বেশ কিছুসংখ্যক মানুষ মারা গেছেন। এর আগে ও পরে পুলিশ-র‌্যাবও মরেছে। বিএনপি-এরশাদ সবাই এক সুরে বলতে শুরু করলেন, এটা নাকি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার শামিল। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরও একই সুরে কথা বলেছেন। অথচ সারা দিন ধরে যে হেফাজত প্রচণ্ড তাণ্ডব চালিয়েছিল, নির্বিচারে হত্যা ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটিয়েছিল, সিপিবির অফিস পুড়িয়েছিল, ব্যাংক আক্রমণ করেছিল, দোকানপাটে এবং পবিত্র কোরআনে আগুন দিয়েছিল, সোনার দোকান লুট করেছিল- এসব যেন বিএনপি-এরশাদ-বদরুদ্দীন উমরদের কাছে কিছুই না। যারা হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারি আক্রমণের নিন্দা করছেন, তাঁরা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এমন কথা বলছেন অথবা আওয়ামী লীগের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকে একচোখা হয়ে গেছেন। ঠিক একই কারণে জনাব বদরুদ্দীন উমর এবং আরো কিছু বিভ্রান্ত তথাকথিত বাম বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ ১৯৭১ সালের সময় সঠিক মূল্যায়ন করতেও পদক্ষেপ নিতে পারেননি। এখনো আদর্শহীন বিএনপি, মতলববাজ এরশাদ, ক্ষুব্ধ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও বিভ্রান্ত চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর, একেকজন একেক জায়গা থেকে অবস্থান নিলেও তাঁরা এক জায়গায় এসে মিশে গেছেন। হেফাজতের সন্ত্রাসকে ছোট করে দেখা এবং সরকারি অ্যাকশনকে গণহত্যা বলে অভিহিত করা।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। সরকার যে অ্যাকশন নিয়েছিল তা ছাড়া আর কী করা যেত? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ ৫ তারিখ বিকেল বেলায় বলেছিলেন, 'এরপর হেফাজতকে বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হবে না।' এই কথা আরো আগে বললে এবং সেই মতো ব্যবস্থা নিলে ভালো হতো। তাহলে হেফাজতের হাতে এত নিরীহ মানুষ ও পুলিশ মারা যেত না। এত ধন-সম্পদ নষ্ট হতো না। যেসব এতিম শিশু, মাদ্রাসার কিশোর বালক যাদের জোর করে ঢাকায় এনে বিপদের মুখে ফেলে হেফাজতের বীর নেতারা পলায়ন করেছিলেন সেই কচি ছেলেগুলো এত কষ্ট ভোগ করত না।
এ কথা কারোর অজানা নয় যে আমি বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচক এবং সিপিবি একটি বিরোধী দল। কিন্তু আমরা বিরোধিতা করছি বামপন্থী অবস্থান থেকে। বিএনপি করছে সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে। জামায়াত-হেফাজত করছে চরম দক্ষিণপন্থী অবস্থান থেকে। আর এরশাদ যে কোন দিকে, পক্ষে না বিপক্ষে সেটাই তো বোঝা মুশকিল। সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণকারী, লুটেরা ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি, শ্রমিক বিদ্বেষী, চরম দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, অপদার্থ ও অযোগ্য বর্তমান সরকারের পক্ষে সাধারণভাবে কথা বলার কোনো জায়গাই নেই। কিন্তু ৫ তারিখে শেষ পর্যায়ে সরকার যে অ্যাকশনে গেছে তাকে সমর্থন না করে পারছি না। সরকার প্রথমদিকে হেফাজতকে নিয়ে আনাড়ির মতো খেলতে গিয়েছিল। ফলে হেফাজত এতটা সহিংস আচরণ করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে তাদের এই সহিংসতা বন্ধ করতে সরকার যা করেছে, এ ছাড়া আর কি করা যেত, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
হেফাজতিরা বিপ্লব করতে চেয়েছিল, ইসলামী বিপ্লব। যদিও তারা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে প্রথম প্রথম প্রচার করতে চেয়েছিল, আসলে তাদের ১৩ দফা দাবি ও কর্মপদ্ধতি পুরোপুরি রাজনৈতিক। তাদের বক্তাদের বক্তৃতা উদ্ধৃত করে বলা যেতে পারে, তারা সশস্ত্র পথে ইসলামী শাসন কায়েম করতে চেয়েছিল। যেকোনো বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে যে চরম খেসারত দিতে হয়, এটা কি 'বিপ্লবী' হেফাজতিদের জানা ছিল না? হয়তো না। কারণ তারা অনেকটা অবুঝের মতোই আন্দোলন করেছিল, সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালিয়েছিল। তাদের মধ্যে ঢুকে অথবা তাদের কাঁধে ভর করে জামায়াত চেয়েছিল তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা কার্যকর করতে। জামায়াত চেয়েছিল এমন এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে, যাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল হয়ে যায়। বিএনপি চেয়েছে এই সুযোগে সরকারকে কোণঠাসা করতে অথবা সরকারের পতন ঘটাতে।
আমি বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতকে নিশ্চয়ই এক করে দেখব না। কিন্তু তিন দলের বড় মিলের জায়গা রয়েছে। তারা এক স্রোতে মিলে যে রাজনীতি তুলে ধরেছে তা হচ্ছে চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। বিএনপি অবশ্য ইসলামী দল নয়, কিন্তু ভণ্ডামি করে হলেও এখন ওদের সঙ্গে মিশে গিয়ে পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের মতো দলে পরিণত হয়েছে।
মৌলবাদী গোষ্ঠীর রাজনীতি চারটি বিদ্বেষনীতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। ভারত বিদ্বেষ, হিন্দু বিদ্বেষ, বাঙালি বিদ্বেষ ও নারী বিদ্বেষ। ভারত প্রসঙ্গটি আমাদের দেশের রাজনীতিতে বারবার উঠে আসে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত সমস্যা, সীমান্তে নিরীহ মানুষকে বিএসএফ কর্তৃক হত্যা, ফারাক্কা সমস্যা, তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা, টিপাইমুখ বাঁধের ইস্যু ইত্যাদি সমস্যা আছে। সে ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে এবং দক্ষতার সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা ও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে আমাদের ন্যায্য অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু অন্ধ ভারত বিরোধিতা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে ভারত বিরোধিতা যে হিন্দু বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয় বাম ও প্রগতিশীল দলগুলোকে এই কথা ভুললে চলবে না। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালে ভারতের অবদানকে ভুলে গেলে তা হবে চরম অকৃতজ্ঞতা। না, আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি নই। এ দেশে মৌলবাদের আরেকটি দিক হলো হিন্দু বিদ্বেষনীতি।
পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে অভিজাত মুসলমানরা উর্দুতে কথা বলাকে আভিজাত্যের লক্ষণ বলে মনে করত। তারা তাদের জাতীয়তার উৎস খুঁজে পেত বাংলার মাটি থেকে নয়; বরং আরব, ইরান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ থেকে। বাংলার জনগণ তাদের চরমভাবে পরাজিত করেছিল ১৯৭১ সালের অনেক আগেই।
আর নারী বিদ্বেষ হচ্ছে হেফাজত প্রমুখ মৌলবাদীদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাজনীতিতে ফায়দা নেওয়ার জন্য আদর্শবিহীন অপরিণামদর্শী খালেদা জিয়াও এর সঙ্গে সুর মেলান। তিনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, হেফাজতিরা মাথায় উঠলে তার পরিণাম কী হবে? তাঁর নিজের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাঁকেও তো এখন বোরকার আড়ালে আশ্রয় নিতে হবে এবং পরপুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করা অথবা প্রধানমন্ত্রিত্ব করা চলবে না।
জামায়াত-হেফাজত ও অন্যান্য ধর্মীয় মৌলবাদী দল ও সংস্থার কার্যপদ্ধতিও বিশ্লেষণ করা দরকার। মৌলবাদীদের কাজের ধরনটি হচ্ছে ফ্যাসিবাদী। তারা নিজেরা ধর্মের যে ব্যাখ্যা দেবে সেটাই সবাইকে মানতে হবে এবং তা মানানোর জন্য তারা বলপ্রয়োগ ও খুনের পথ নেবে। পৃথিবীর সব দেশে সব ধর্মের মৌলবাদীদের এটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশে মৌলবাদীরা বিশেষ করে জামায়াত মিথ্যাচারেরও আশ্রয় নেয়। ১৯৫৪ সালে মৌলবাদী পীররা ফতোয়া দিয়েছিল 'মুসলিম লীগের বিপক্ষে ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে।' ১৯৭১ সালে জামায়াত ফতোয়া দিয়েছিল 'এই ধর্মযুদ্ধে(?) নারী ধর্ষণ জায়েজ'। শাহবাগ চত্বর থেকে যখন কয়েকজন ব্লগার যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসির দাবি তুললেন, অমনি তখনই তারা বলল, ব্লগাররা নাকি নবীজি (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছেন এবং নাস্তিকতা প্রচার করেছেন। এর আগে কিন্তু এমন অভিযোগ কখনো শোনা যায়নি।
আসল কথা হচ্ছে এই যে সাধারণ মানুষের সরকারের ওপর থেকে আস্থা উঠে গেছে। যারা বিশ্বজিৎকে হত্যা করতে পারে, লিমনের পায়ে গুলি করতে পারে, সোনালী ব্যাংকের টাকা লুট করতে পারে, পদ্মা সেতুর নামে দুর্নীতি করতে পারে, তারা সবই পারে। এটা জনগণের ধারণা। আর অন্যদিকে একেকজন একেক জায়গা থেকে হেফাজতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত, আদর্শ বিবর্জিত বিএনপি, নীতিহীন সুযোগসন্ধানী এরশাদ, বিভ্রান্ত অধ্যাপক বি. চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী- সবই একই সুরে গণহত্যার অভিযোগ আনছেন। ওদের প্রোপাগান্ডার জবাব তেমন জোরে শোনা যাচ্ছে না। তার একটা বড় কারণ হলো এই যে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এত বেশি লুটপাটে ব্যস্ত অথবা শেষ সময়ে অর্জিত সম্পদ রক্ষায় ব্যস্ত যে অন্য কোনো দিকে তাদের নজর নেই। এমনকি জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে মিলমিশ করে চলতে চাচ্ছে তাদের একটা বড় অংশ।
বিএনপি ভেবেছিল, জামায়াত হেফাজতের কাঁধে চড়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে যাতে সরকারের পতন হয়। একদা জামায়াত বিএনপির ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন বিএনপিই জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল। জামায়াত ভেবেছিল হেফাজতকে কাজে লাগিয়ে চরম সন্ত্রাস সৃষ্টি করে সরকার পতনের অবস্থা তৈরি করবে। কিন্তু তা হয়নি। হলে কী হতো? আমরা কি তালেবান রাজত্ব দেখতে পেতাম?
না, এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে কোনো দিনই তালেবান শাসন হবে না। কারণ ইসলামী বিপ্লবই হোক বা যেকোনো ধরনের বিপ্লব হোক। কোনো বিপ্লবই কয়েকজন ক্যাডারের সশস্ত্র কারবার নয়, বিপ্লব মানে জনগণের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সক্রিয় অংশগ্রহণ। সৌভাগ্যক্রমে সশস্ত্র মৌলবাদীদের সেই জনসমর্থন এখনো নেই। তবু ধর্মের দোহাই দিয়ে মিথ্যাচার করা এবং সন্ত্রাসী কৌশল করে তারা যে তৎপরতা চালাচ্ছে তাকে আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না। সব গণতান্ত্রিক, উদার মুক্তচিন্তার মানুষ, শ্রমজীবী, নারীসমাজ ও অসাম্প্রদায়িক জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে এই অপশক্তিকে রোধ করার জন্য। সরকারকে হতে হবে কঠোর। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মতাদর্শগত সংগ্রামকেও জোরদার করতে হবে। পাকিস্তানি প্রেতাত্মাকে এখনই বধ করতে হবে।
দৈনিক কালের কণ্ঠ
২১ মে, ২০১৩। 

No comments:

Post a Comment