পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত পণ্ডিত শিবনারায়ণ রায় একবার আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, পঁচিশে বৈশাখের পূজা অনুষ্ঠান আড়ম্বরে এবং সংখ্যাধিক্যে দুর্গাপূজাকেও হার মানাতে বসেছে। দুর্গাপূজার ব্যাপ্তি ও গম্ভীরতাকে এখন ছাড়িয়ে গেছে ‘সর্বজনীন’ রবীন্দ্রোত্সবের ঘটা। এই কারণে রবীন্দ্রপূজার যারা সনদপ্রাপ্ত পুরোহিত (লেখক, অভিনেতা, গাইয়ে কিংবা আবৃত্তিকার) তাদের বাজার সরগরম।
তাই বলে শিবনারায়ণ রায় রবীন্দ্রের শক্তিশালী প্রতিভাকে মোটেই খাটো করে দেখাতে চাননি। তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রকে উচ্ছ্বাসপ্রবণ বাঙালির ছাঁচে ফেলে নিজেদের বাঙালিত্ব প্রমাণের চেয়ে সম্পূর্ণ আধুনিক মন নিয়ে তার সৃষ্টির বিশ্লেষণ করা উচিত। হুজুগবাজ রবীন্দ্র পূজারিদের স্থূলতা ও মূঢ়তার কারণে শিল্পী রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেবতায় পর্যবসিত হয়েছেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে শিবনারায়ণের কী অবস্থা হয়েছিল তা এখানকার সংস্কৃতির জগতের কেউ কেউ হয়তো জানেন। পাণ্ডাগোছের রবীন্দ্র পূজারিরা তার উপর রীতিমত হামলে পড়েছিল এবং জীবননাশেরও শঙ্কা জেগেছিল।
যে দেশে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর ছড়াছড়ি, সেখানে আরও একজন দেবতার আগমন জনতার ভালো না লাগার কথা নয়। কারণ, দেশের মানুষ দেব-দেবীতেই অভ্যস্ত। কিন্তু যারা নিরাকার খোদায় বিশ্বাস করে, আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য স্বীকার করে না তাদের জন্য দেবতার ধারণাটা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার বৈকি! কিছুদিন হলো বাঙালি মুসলমান সমাজের একাংশ (সংখ্যায় কম হলেও শক্তিমান) যারা সংস্কৃতির দিক দিয়ে সম্ভবত ইসলাম ছেড়ে দিয়েছেন এবং নিজেদের জন্য এক সেক্যুলার ধর্মের প্রবর্তন করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভক্তিতে গদগদ হয়ে উঠছেন। এখন বুঝিবা রবীন্দ্রের চরণামৃত পানে মোক্ষপ্রাপ্তিই তাদের একমাত্র কাম্য। এসব সেক্যুলারবাদী রবীন্দ্র চর্চার নামে যা করেন তা রীতিমত দেবপূজা ও আরাধনার পর্যায়েই পড়ে। বাংলাদেশের একজন মহিলা কবি সুফিয়া কামাল রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রবণকে একবার ইবাদতের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এ দেশে ঘটা করে রবীন্দ্রোত্সব উদযাপনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ওয়াহিদুল হক সাহেবকে দেখেছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি ধুতি পরতেন, গড় হয়ে প্রণাম করতেন। শুধু তাই নয় মৃত্যুর পর নিজের লাশটি পর্যন্ত বাঙালি মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি অনুযায়ী ইসলামী মতে দাফন করার অনুমতি দেননি। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে খবর এসেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সরকারি অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াতের পরিবর্তে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেছেন। শুনেছি গভর্নর সাহেব বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে রাখাল ছেলে বলে পরিচয় দিতে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ পান। কেননা তিনি কৃষক পরিবারের সন্তান। রাখাল ছেলের এই রবীন্দ্র বিলাস বেশ কৌতুককর বৈকি!
শিব নারায়ণ রায় তার ওই প্রবন্ধে লিখেছিলেন হুজুগবাজ, হৈহুল্লোড়লোভী রবীন্দ্র পূজারিদের কাজ-কর্মের সঙ্গে আধুনিক মন, মনন ও যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের সেক্যুলার রবীন্দ্র পূজারিদের সম্পর্কেও কথাটা একই রকম সত্য।
মজার ব্যাপার হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় সেক্যুলারিজমের স্থান তেমন একটা ছিল না। তার অধিকাংশ গানে ও দার্শনিক রচনার মধ্যে ঔপনিষদিক ধারার প্রভাব খুব স্পষ্ট। প্রাচীন ভারতের ঋষিদের মতো তিনিও অনুভব করতেন যে বিশ্বজগত কোনো কল্যাণময় উপস্থিতির বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সংসারের সমস্ত দুঃখ, সংঘাত, ভাঙাচোরার অন্তরালে এমন কোনো চৈতন্যময় পুরুষ বর্তমান, যিনি সবকিছুতেই সুষমা ও সঙ্গতি দান করে চলেন। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ একালের আধুনিক যুগে বসেও প্রাচীন ভারতের আর্যঋষিদের তপোবনকে ফিরিয়ে আনার ভাবনায় ব্যাকুল হতেন। অনেকেই জানেন কবি তার শান্তি নিকেতনকে ঋষীদের তপোবনের আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কবির এই তপোবন ফিরিয়ে আনার চিন্তাকে আর যাই হোক অগ্রসর মনের পরিচয় বলা যায় না।
রবীন্দ্রনাথের একটি প্রিয় শব্দ ছিল মহাভারত। এই মহাভারত কিন্তু ইউরোপের নেশন স্টেটের আদর্শে গড়ে ওঠেনি। এই মহাভারতের ভিত্তি হচ্ছে হিন্দুত্ব। এটা সত্য রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় ধর্মের নামে ধর্মতন্ত্র, সংস্কার, অন্ধ বিশ্বাসকে আঘাত করেছেন। জীবনের শেষদিকে এসে তিনি হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের ব্যাপারটা বোঝারও চেষ্টা করেছিলেন। কালান্তরের লেখাগুলো তার প্রমাণ। তারপরও হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্বের সমীকরণও তিনি একই সঙ্গে করেছেন। তার আত্মপরিচয় প্রবন্ধটিতে সেই জাত্যাভিমানী হিন্দুর পরিচয়ই আমরা দেখতে পাই ঃ
আমি হিন্দু এ কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে তাতে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতেই হইবে।
অন্যত্র একই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন ঃ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যদি কোনো বিরোধ থাকে, তা মেটাবার জন্য ‘হিন্দু পরিচয়’ বিসর্জন দিতে হবে এ কখনও সুস্থমস্তিষ্ক কল্পনা হতে পারে না। ...আর আমি হিন্দু নই বলিলেই হিন্দু-মুসলমানের বিরোধটা যেমন তেমনই থাকিয়া যায়, কেবল আমিই তাহা হইতে পাশ কাটাইয়া আসি। এ জাতীয় বিশ্বাসের কথাবার্তাকে আর যাই হোক সেক্যুলার চেতনামণ্ডিত বলা যাবে না। তার পরেও আমাদের এক শ্রেণীর প্রগতিশীল ভাবুক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী সেক্যুলারিজমের আড়ালে রবীন্দ্রচর্চা করছেন। এসব চর্চার আশু উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনীতি। বিপুলায়তন রবীন্দ্র সাহিত্যের শৈল্পিক ও নান্দনিক বিশ্লেষণ নয় মোটেই। এই রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে এ দেশের ইসলামভিত্তিক সংস্কৃতিকে বদলে ফেলে সেখানে কলকাতার বাবু কালচারকে প্রতিস্থাপিত করা, যাতে বাঙালি মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায় এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের আধিপত্যের জোয়াল আরও মজবুত হতে পারে।
২.
বাংলাদেশে এখন প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন আমাদের জাতীয় চেতনার উত্স। বাংলাদেশের অনেক পণ্ডিত ও সংস্কৃতি সেবীরা মনে করেন তিনি হচ্ছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাণশক্তি। আমাদের জাতীয় চেতনার অন্যতম উত্স হলো বাংলা ভাষা। আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা ভাষার মহান কবি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো তার বিশালায়তন সাহিত্য সৃষ্টিতে এমন কিছু নেই যা বিশেষভাবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ কখনও বাঙালিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র চাননি। তিনি যা চেয়েছিলেন তা হচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আওতায় বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মুক্তি। এই কারণে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতিও ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ বহু জায়গায় খোলামেলা বলেছেন, হিন্দি হওয়া উচিত নিখিল ভারতের রাষ্ট্রভাষা। শান্তি নিকেতনের এক অনুষ্ঠানে হিন্দির পক্ষে রবীন্দ্রনাথের এরকম মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন ড. শহীদুল্লাহ। এটা ঠিক পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। বাংলাদেশের অনেক গুণীজন সে ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এসব বিতর্কের কারণও ছিল হয়তো। রবীন্দ্র চর্চার আড়ালে রবীন্দ্র রাজনীতি। রবীন্দ্র সাহিত্য আর রবীন্দ্র রাজনীতি ঠিক এক জিনিস নয়। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র বিরোধিতা হয়েছিল, শুধু সে কারণেই বলা যায় না রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু।
আবুল ফজল, মোতাহার হোসেন চৌধুরীর মতো প্রগতিশীল ভাবুকরা বহুবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নানা সূত্রে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছেন, মুসলমান সমাজ নিয়ে তার উদাসীনতার কথা। এর সদুত্তর তারাও পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। এ কারণেই আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যাতা আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন ‘বিশ্বকবির বিশ্ব ভারতীর বিশ্বে কতবার শারদীয় পূজায় আনন্দময়ী মা এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ-মোহ্ররমের চাঁদ ওঠেনি।’ আবুল মনসুর সাহেবের তাই সুস্পষ্ট মতামত ছিল, মেজরিটি বাঙালির সঙ্গে নাড়ীর যোগ না থাকলে কেউ জাতীয় কবি হতে পারে না—হতে পারে না জাতীয় চেতনার উত্স। এ কারণেই তিনি মেজরিটি বাঙালির জন্য জাতীয় সাহিত্য নির্মাণের ডাক দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্ম সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় এই ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্মরা ছিলেন মূর্তি পূজার বিরোধী। রাম মোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজ দুর্বল হয়ে যায় এবং দু’ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর একাংশের নেতৃত্ব দিতেন রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ। ব্রাহ্ম সমাজের এই অংশ রাম মোহনের চিন্তা-চেতনা থেকে কিছুটা সরে আসে এবং এরা হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তা-ভাবনার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল হিন্দু মেলার। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রসারে হিন্দু মেলার অবদান ছিল অনেকখানি। মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক যখন শিবাজী উত্সব চালু করেন বাংলাদেশে তা জনপ্রিয় করতে এগিয়ে আসেন ঠাকুরবাড়ির প্রভাবশালী সদস্যরাই। এর প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনার উপর। এই প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর গৌরবগাথা রচনা করেন এবং ভারতজুড়ে এক ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা বলতে পারেন। এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ কি এই ভাবপ্রবাহের অংশ।
অনেক রবীন্দ্র পুরোহিতের লেখা পড়ে বিস্মিত হই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পরিবেশ নাকি ছিল উদার, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। হিন্দু মেলা, শিবাজী উত্সবের মতো ব্যাপার প্রগতিশীলতার কোন মাপকাঠিতে দাঁড়ায় তা জানি না।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীত গাওয়া হতো। এই সঙ্গীতটিকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনেক তিক্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এটি ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিখ্যাত সঙ্গীত। কংগ্রেস এটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা দিয়ে মুসলমানদের গাইতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল। যার পরিণতি সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগ। রবীন্দ্রনাথ এই গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে তাই এদিক থেকেও আজকের বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার উত্স হিসেবে বিবেচনা করা ইতিহাসসম্মত নয়।
রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন বঙ্গভঙ্গের কালে। বাঙালি হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে তার সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। এ আন্দোলনকে তীব্র করার জন্য তিনি লিখেছিলেন অনেক গান, যার মধ্যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত অন্যতম। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কোনো সেক্যুলার আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল পুরোপুরি হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এর নেতৃত্বে ছিলেন শ্রী অরবিন্দ ঘোষ ও তার ভাই বারীন ঘোষ। এরা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গের ফলে ব্রিটিশরা পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে মুসলমান অধ্যুষিত এক প্রদেশ সৃষ্টি করে। এর রাজধানী হয় ঢাকা। এর পেছনে ব্রিটিশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উভয় রকমের স্বার্থ ছিল। পূর্ব বঙ্গেই ছিল হিন্দু জমিদারদের বড় বড় জমিদারি। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গে তাদের জমিদারি লোপ পেতে পারে। এসব জমিদার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে টাকা-পয়সা দিয়ে জোরদার করে তোলে। আন্দোলনকে সামনে রেখে বাঙালি ও বাঙালিত্বের স্লোগান ছিল বড় রকমের ভাঁওতা। বঙ্গভঙ্গ না হলে বাঙালি হিন্দুরা ওরকম করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কখনোই ঝাঁপিয়ে পড়তেন না। জমিদারি হারানোর ভয় হয়তো রবীন্দ্রনাথকেও পেয়ে বসেছিল।
অবশ্য একটা পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ এ আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সমালোচনা শুরু করেন। যেসব তরুণ বল প্রয়োগ করে ব্রিটিশকে তাড়াতে চান তাদের সমালোচনা করে তিনি চার অধ্যায় উপন্যাস লেখেন। ব্রিটিশ সরকার এ উপন্যাসের হাজার হাজার কপি বিলি করে জেলে আটক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের তরুণদের কাছে তাদের মাথা ধোলাইয়ের জন্য। শরত্চন্দ্র ছিলেন বিপ্লবীদের পক্ষে। তিনি লিখেছিলেন পথের দাবি উপন্যাস। এখানে তিনি বিপ্লবীদের সমর্থন করেছিলেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার পথের দাবি বাজেয়াপ্ত করে। অনেকে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদ করবেন। তিনি এটা না করে শরত্চন্দ্রকে কিছুটা ভর্ত্সনা করে বলেছিলেন, তার উচিত হয়নি এ উপন্যাস লেখা।
মোটের উপর রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে। অনেক সময়ই তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে ঈশ্বরের শাসনের সঙ্গেও তুলনা করতেন। এ কোনো দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীর কথা হতে পারে না। যাই হোক রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল ব্যক্তিকে হারিয়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। আর ব্রিটিশের লাভ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও খাড়া করে দিতে। কবির এ মনোপরিবর্তনে ব্রিটিশের হাত থাকলেও থাকতে পারে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন খুব তীব্র হওয়ার কারণে কার্জনের বঙ্গভঙ্গ এক সময় রদ হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার তখন পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এতেও বাঙালি হিন্দুরা ক্ষেপে যায়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও চায়নি ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় হোক। তারা মনে করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটা মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় আর মুসলমানের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে তাদের পাতে ভাগ বসাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বকবিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। আজ যেসব রাখাল ছেলেদের রবীন্দ্র বিলাস পেয়ে বসেছে তারা জানে না তাদের দেবতাতুল্য মানুষটি রাখাল ছেলেরা লেখাপড়া শিখে সমাজের উপর তলায় উঠে আসুক এটা কখনোই চাননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী প্রায় একই সময় কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু বিশ্বভারতী মুসলমান ছাত্রদের মোটেও আকর্ষণ করেনি। ঠাকুর পরিবারের অধিকাংশ জমিদারি ছিল পূর্ববঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথও পূর্ববঙ্গে কাটিয়েছেন বহুদিন। তার পরেও মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে তিনি তার শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠা করতে উত্সাহ পাননি। তিনি এটা গিয়ে তৈরি করেন বীরভূমে। প্রথমদিকে শান্তি নিকেতনে মুসলমান ছাত্রদের কোনো প্রবেশাধিকারই ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেকের কাছে চাঁদা চেয়েছিলেন। হায়দরাবাদের নিজাম তাকে সে আমলে এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সেই চাঁদার সূত্রেই কিছু মুসলমান ছাত্র সুযোগ পায় শান্তি নিকেতনে লেখাপড়া করার। সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন এদের একজন। মনে রাখা দরকার, বিশ্বভারতী নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে পূর্ববঙ্গে একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ বিকাশ হওয়ার সুযোগ পায় আর তা এ অঞ্চলের মানুষের জাগরণে বড় ভূমিকা রাখে। অর্থাত্ ইতিহাসের নিরিখে দেখতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ নয়, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিলেন তারাই এ অঞ্চলের মানুষের সত্যিকারের জাগরণে বড় ভূমিকা রাখেন। যা আজকের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি। তারাই পূর্ববঙ্গের মানুষের সত্যিকারের জাতীয় চেতনার উত্স হওয়ার দাবিদার। আজকের প্রজন্ম হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা নওয়াব সলিমুল্লাহর নামই শোনেনি। এদেশের মানুষের প্রতি এই মানুষটির আত্মত্যাগকে বোধ হয় আমরা ভুলতে চাচ্ছি। একটা আত্মবিস্মৃত জাতি কখ�
তাই বলে শিবনারায়ণ রায় রবীন্দ্রের শক্তিশালী প্রতিভাকে মোটেই খাটো করে দেখাতে চাননি। তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রকে উচ্ছ্বাসপ্রবণ বাঙালির ছাঁচে ফেলে নিজেদের বাঙালিত্ব প্রমাণের চেয়ে সম্পূর্ণ আধুনিক মন নিয়ে তার সৃষ্টির বিশ্লেষণ করা উচিত। হুজুগবাজ রবীন্দ্র পূজারিদের স্থূলতা ও মূঢ়তার কারণে শিল্পী রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেবতায় পর্যবসিত হয়েছেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে শিবনারায়ণের কী অবস্থা হয়েছিল তা এখানকার সংস্কৃতির জগতের কেউ কেউ হয়তো জানেন। পাণ্ডাগোছের রবীন্দ্র পূজারিরা তার উপর রীতিমত হামলে পড়েছিল এবং জীবননাশেরও শঙ্কা জেগেছিল।
যে দেশে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর ছড়াছড়ি, সেখানে আরও একজন দেবতার আগমন জনতার ভালো না লাগার কথা নয়। কারণ, দেশের মানুষ দেব-দেবীতেই অভ্যস্ত। কিন্তু যারা নিরাকার খোদায় বিশ্বাস করে, আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য স্বীকার করে না তাদের জন্য দেবতার ধারণাটা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার বৈকি! কিছুদিন হলো বাঙালি মুসলমান সমাজের একাংশ (সংখ্যায় কম হলেও শক্তিমান) যারা সংস্কৃতির দিক দিয়ে সম্ভবত ইসলাম ছেড়ে দিয়েছেন এবং নিজেদের জন্য এক সেক্যুলার ধর্মের প্রবর্তন করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভক্তিতে গদগদ হয়ে উঠছেন। এখন বুঝিবা রবীন্দ্রের চরণামৃত পানে মোক্ষপ্রাপ্তিই তাদের একমাত্র কাম্য। এসব সেক্যুলারবাদী রবীন্দ্র চর্চার নামে যা করেন তা রীতিমত দেবপূজা ও আরাধনার পর্যায়েই পড়ে। বাংলাদেশের একজন মহিলা কবি সুফিয়া কামাল রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রবণকে একবার ইবাদতের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এ দেশে ঘটা করে রবীন্দ্রোত্সব উদযাপনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ওয়াহিদুল হক সাহেবকে দেখেছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি ধুতি পরতেন, গড় হয়ে প্রণাম করতেন। শুধু তাই নয় মৃত্যুর পর নিজের লাশটি পর্যন্ত বাঙালি মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি অনুযায়ী ইসলামী মতে দাফন করার অনুমতি দেননি। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে খবর এসেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সরকারি অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াতের পরিবর্তে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেছেন। শুনেছি গভর্নর সাহেব বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে রাখাল ছেলে বলে পরিচয় দিতে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ পান। কেননা তিনি কৃষক পরিবারের সন্তান। রাখাল ছেলের এই রবীন্দ্র বিলাস বেশ কৌতুককর বৈকি!
শিব নারায়ণ রায় তার ওই প্রবন্ধে লিখেছিলেন হুজুগবাজ, হৈহুল্লোড়লোভী রবীন্দ্র পূজারিদের কাজ-কর্মের সঙ্গে আধুনিক মন, মনন ও যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের সেক্যুলার রবীন্দ্র পূজারিদের সম্পর্কেও কথাটা একই রকম সত্য।
মজার ব্যাপার হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় সেক্যুলারিজমের স্থান তেমন একটা ছিল না। তার অধিকাংশ গানে ও দার্শনিক রচনার মধ্যে ঔপনিষদিক ধারার প্রভাব খুব স্পষ্ট। প্রাচীন ভারতের ঋষিদের মতো তিনিও অনুভব করতেন যে বিশ্বজগত কোনো কল্যাণময় উপস্থিতির বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সংসারের সমস্ত দুঃখ, সংঘাত, ভাঙাচোরার অন্তরালে এমন কোনো চৈতন্যময় পুরুষ বর্তমান, যিনি সবকিছুতেই সুষমা ও সঙ্গতি দান করে চলেন। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ একালের আধুনিক যুগে বসেও প্রাচীন ভারতের আর্যঋষিদের তপোবনকে ফিরিয়ে আনার ভাবনায় ব্যাকুল হতেন। অনেকেই জানেন কবি তার শান্তি নিকেতনকে ঋষীদের তপোবনের আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কবির এই তপোবন ফিরিয়ে আনার চিন্তাকে আর যাই হোক অগ্রসর মনের পরিচয় বলা যায় না।
রবীন্দ্রনাথের একটি প্রিয় শব্দ ছিল মহাভারত। এই মহাভারত কিন্তু ইউরোপের নেশন স্টেটের আদর্শে গড়ে ওঠেনি। এই মহাভারতের ভিত্তি হচ্ছে হিন্দুত্ব। এটা সত্য রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় ধর্মের নামে ধর্মতন্ত্র, সংস্কার, অন্ধ বিশ্বাসকে আঘাত করেছেন। জীবনের শেষদিকে এসে তিনি হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের ব্যাপারটা বোঝারও চেষ্টা করেছিলেন। কালান্তরের লেখাগুলো তার প্রমাণ। তারপরও হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্বের সমীকরণও তিনি একই সঙ্গে করেছেন। তার আত্মপরিচয় প্রবন্ধটিতে সেই জাত্যাভিমানী হিন্দুর পরিচয়ই আমরা দেখতে পাই ঃ
আমি হিন্দু এ কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে তাতে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতেই হইবে।
অন্যত্র একই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন ঃ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যদি কোনো বিরোধ থাকে, তা মেটাবার জন্য ‘হিন্দু পরিচয়’ বিসর্জন দিতে হবে এ কখনও সুস্থমস্তিষ্ক কল্পনা হতে পারে না। ...আর আমি হিন্দু নই বলিলেই হিন্দু-মুসলমানের বিরোধটা যেমন তেমনই থাকিয়া যায়, কেবল আমিই তাহা হইতে পাশ কাটাইয়া আসি। এ জাতীয় বিশ্বাসের কথাবার্তাকে আর যাই হোক সেক্যুলার চেতনামণ্ডিত বলা যাবে না। তার পরেও আমাদের এক শ্রেণীর প্রগতিশীল ভাবুক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী সেক্যুলারিজমের আড়ালে রবীন্দ্রচর্চা করছেন। এসব চর্চার আশু উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনীতি। বিপুলায়তন রবীন্দ্র সাহিত্যের শৈল্পিক ও নান্দনিক বিশ্লেষণ নয় মোটেই। এই রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে এ দেশের ইসলামভিত্তিক সংস্কৃতিকে বদলে ফেলে সেখানে কলকাতার বাবু কালচারকে প্রতিস্থাপিত করা, যাতে বাঙালি মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায় এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের আধিপত্যের জোয়াল আরও মজবুত হতে পারে।
২.
বাংলাদেশে এখন প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন আমাদের জাতীয় চেতনার উত্স। বাংলাদেশের অনেক পণ্ডিত ও সংস্কৃতি সেবীরা মনে করেন তিনি হচ্ছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাণশক্তি। আমাদের জাতীয় চেতনার অন্যতম উত্স হলো বাংলা ভাষা। আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা ভাষার মহান কবি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো তার বিশালায়তন সাহিত্য সৃষ্টিতে এমন কিছু নেই যা বিশেষভাবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ কখনও বাঙালিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র চাননি। তিনি যা চেয়েছিলেন তা হচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আওতায় বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মুক্তি। এই কারণে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতিও ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ বহু জায়গায় খোলামেলা বলেছেন, হিন্দি হওয়া উচিত নিখিল ভারতের রাষ্ট্রভাষা। শান্তি নিকেতনের এক অনুষ্ঠানে হিন্দির পক্ষে রবীন্দ্রনাথের এরকম মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন ড. শহীদুল্লাহ। এটা ঠিক পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। বাংলাদেশের অনেক গুণীজন সে ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এসব বিতর্কের কারণও ছিল হয়তো। রবীন্দ্র চর্চার আড়ালে রবীন্দ্র রাজনীতি। রবীন্দ্র সাহিত্য আর রবীন্দ্র রাজনীতি ঠিক এক জিনিস নয়। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র বিরোধিতা হয়েছিল, শুধু সে কারণেই বলা যায় না রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু।
আবুল ফজল, মোতাহার হোসেন চৌধুরীর মতো প্রগতিশীল ভাবুকরা বহুবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নানা সূত্রে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছেন, মুসলমান সমাজ নিয়ে তার উদাসীনতার কথা। এর সদুত্তর তারাও পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। এ কারণেই আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যাতা আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন ‘বিশ্বকবির বিশ্ব ভারতীর বিশ্বে কতবার শারদীয় পূজায় আনন্দময়ী মা এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ-মোহ্ররমের চাঁদ ওঠেনি।’ আবুল মনসুর সাহেবের তাই সুস্পষ্ট মতামত ছিল, মেজরিটি বাঙালির সঙ্গে নাড়ীর যোগ না থাকলে কেউ জাতীয় কবি হতে পারে না—হতে পারে না জাতীয় চেতনার উত্স। এ কারণেই তিনি মেজরিটি বাঙালির জন্য জাতীয় সাহিত্য নির্মাণের ডাক দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্ম সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় এই ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্মরা ছিলেন মূর্তি পূজার বিরোধী। রাম মোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজ দুর্বল হয়ে যায় এবং দু’ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর একাংশের নেতৃত্ব দিতেন রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ। ব্রাহ্ম সমাজের এই অংশ রাম মোহনের চিন্তা-চেতনা থেকে কিছুটা সরে আসে এবং এরা হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তা-ভাবনার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল হিন্দু মেলার। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রসারে হিন্দু মেলার অবদান ছিল অনেকখানি। মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক যখন শিবাজী উত্সব চালু করেন বাংলাদেশে তা জনপ্রিয় করতে এগিয়ে আসেন ঠাকুরবাড়ির প্রভাবশালী সদস্যরাই। এর প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনার উপর। এই প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর গৌরবগাথা রচনা করেন এবং ভারতজুড়ে এক ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা বলতে পারেন। এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ কি এই ভাবপ্রবাহের অংশ।
অনেক রবীন্দ্র পুরোহিতের লেখা পড়ে বিস্মিত হই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পরিবেশ নাকি ছিল উদার, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। হিন্দু মেলা, শিবাজী উত্সবের মতো ব্যাপার প্রগতিশীলতার কোন মাপকাঠিতে দাঁড়ায় তা জানি না।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীত গাওয়া হতো। এই সঙ্গীতটিকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনেক তিক্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এটি ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিখ্যাত সঙ্গীত। কংগ্রেস এটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা দিয়ে মুসলমানদের গাইতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল। যার পরিণতি সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগ। রবীন্দ্রনাথ এই গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে তাই এদিক থেকেও আজকের বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার উত্স হিসেবে বিবেচনা করা ইতিহাসসম্মত নয়।
রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন বঙ্গভঙ্গের কালে। বাঙালি হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে তার সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। এ আন্দোলনকে তীব্র করার জন্য তিনি লিখেছিলেন অনেক গান, যার মধ্যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত অন্যতম। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কোনো সেক্যুলার আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল পুরোপুরি হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এর নেতৃত্বে ছিলেন শ্রী অরবিন্দ ঘোষ ও তার ভাই বারীন ঘোষ। এরা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গের ফলে ব্রিটিশরা পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে মুসলমান অধ্যুষিত এক প্রদেশ সৃষ্টি করে। এর রাজধানী হয় ঢাকা। এর পেছনে ব্রিটিশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উভয় রকমের স্বার্থ ছিল। পূর্ব বঙ্গেই ছিল হিন্দু জমিদারদের বড় বড় জমিদারি। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গে তাদের জমিদারি লোপ পেতে পারে। এসব জমিদার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে টাকা-পয়সা দিয়ে জোরদার করে তোলে। আন্দোলনকে সামনে রেখে বাঙালি ও বাঙালিত্বের স্লোগান ছিল বড় রকমের ভাঁওতা। বঙ্গভঙ্গ না হলে বাঙালি হিন্দুরা ওরকম করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কখনোই ঝাঁপিয়ে পড়তেন না। জমিদারি হারানোর ভয় হয়তো রবীন্দ্রনাথকেও পেয়ে বসেছিল।
অবশ্য একটা পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ এ আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সমালোচনা শুরু করেন। যেসব তরুণ বল প্রয়োগ করে ব্রিটিশকে তাড়াতে চান তাদের সমালোচনা করে তিনি চার অধ্যায় উপন্যাস লেখেন। ব্রিটিশ সরকার এ উপন্যাসের হাজার হাজার কপি বিলি করে জেলে আটক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের তরুণদের কাছে তাদের মাথা ধোলাইয়ের জন্য। শরত্চন্দ্র ছিলেন বিপ্লবীদের পক্ষে। তিনি লিখেছিলেন পথের দাবি উপন্যাস। এখানে তিনি বিপ্লবীদের সমর্থন করেছিলেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার পথের দাবি বাজেয়াপ্ত করে। অনেকে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদ করবেন। তিনি এটা না করে শরত্চন্দ্রকে কিছুটা ভর্ত্সনা করে বলেছিলেন, তার উচিত হয়নি এ উপন্যাস লেখা।
মোটের উপর রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে। অনেক সময়ই তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে ঈশ্বরের শাসনের সঙ্গেও তুলনা করতেন। এ কোনো দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীর কথা হতে পারে না। যাই হোক রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল ব্যক্তিকে হারিয়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। আর ব্রিটিশের লাভ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও খাড়া করে দিতে। কবির এ মনোপরিবর্তনে ব্রিটিশের হাত থাকলেও থাকতে পারে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন খুব তীব্র হওয়ার কারণে কার্জনের বঙ্গভঙ্গ এক সময় রদ হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার তখন পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এতেও বাঙালি হিন্দুরা ক্ষেপে যায়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও চায়নি ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় হোক। তারা মনে করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটা মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় আর মুসলমানের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে তাদের পাতে ভাগ বসাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বকবিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। আজ যেসব রাখাল ছেলেদের রবীন্দ্র বিলাস পেয়ে বসেছে তারা জানে না তাদের দেবতাতুল্য মানুষটি রাখাল ছেলেরা লেখাপড়া শিখে সমাজের উপর তলায় উঠে আসুক এটা কখনোই চাননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী প্রায় একই সময় কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু বিশ্বভারতী মুসলমান ছাত্রদের মোটেও আকর্ষণ করেনি। ঠাকুর পরিবারের অধিকাংশ জমিদারি ছিল পূর্ববঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথও পূর্ববঙ্গে কাটিয়েছেন বহুদিন। তার পরেও মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে তিনি তার শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠা করতে উত্সাহ পাননি। তিনি এটা গিয়ে তৈরি করেন বীরভূমে। প্রথমদিকে শান্তি নিকেতনে মুসলমান ছাত্রদের কোনো প্রবেশাধিকারই ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেকের কাছে চাঁদা চেয়েছিলেন। হায়দরাবাদের নিজাম তাকে সে আমলে এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সেই চাঁদার সূত্রেই কিছু মুসলমান ছাত্র সুযোগ পায় শান্তি নিকেতনে লেখাপড়া করার। সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন এদের একজন। মনে রাখা দরকার, বিশ্বভারতী নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে পূর্ববঙ্গে একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ বিকাশ হওয়ার সুযোগ পায় আর তা এ অঞ্চলের মানুষের জাগরণে বড় ভূমিকা রাখে। অর্থাত্ ইতিহাসের নিরিখে দেখতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ নয়, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিলেন তারাই এ অঞ্চলের মানুষের সত্যিকারের জাগরণে বড় ভূমিকা রাখেন। যা আজকের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি। তারাই পূর্ববঙ্গের মানুষের সত্যিকারের জাতীয় চেতনার উত্স হওয়ার দাবিদার। আজকের প্রজন্ম হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা নওয়াব সলিমুল্লাহর নামই শোনেনি। এদেশের মানুষের প্রতি এই মানুষটির আত্মত্যাগকে বোধ হয় আমরা ভুলতে চাচ্ছি। একটা আত্মবিস্মৃত জাতি কখ�
No comments:
Post a Comment