রবীন্দ্রজন্মের দেড়শ বছর
সন্ জীদা খাতুনের সঙ্গে আলাপচারিতা
[বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি সন্জীদা খাতুন। তিনি ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে তাঁকে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি দেয়। সন্ জীদা খাতুন তাঁর এই আলাপচারিতায় মূলত ছায়ানট ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি ভিডিও মাধ্যমে গৃহীত। লিখিত সংস্করণে কিছু সম্পাদনা করা হয়েছে। মোট পাঁচটি অংশে ভিডিও সাক্ষাৎকারটি নিচে লেখার মধ্যে বিন্যস্ত আছে। সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয় ২৬ এপ্রিল ২০১০ তারিখে, তাঁর বাসভবনে। - বি. স.]
সন্জীদা খাতুন (জন্ম. ৪/৪/১৯৩৩) ছবি. মুস্তাফিজ মামুন
বেবী মওদুদ: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পক্ষ থেকে আমরা আজ এসেছি আমাদের দেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী সন্জীদা খাতুনের বাসায়। আগামী ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। সামনে তাঁর দেড়শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কত কাছের মানুষ, বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত যেন একটা প্রাণের উদ্দীপনা এনে দেয় আমাদের কাছে। দেশকে, প্রকৃতিকে, মানব প্রেম, সব কিছুকে আমরা তখন উপলব্ধি করতে পারি। এই রবীন্দ্র সংগীতের মধ্য দিয়ে সন্জীদা খাতুন দীর্ঘদিন জীবনযাপন করেছেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে রবীন্দ্র সংগীত শিখছেন ও শুনছেন। তারপর তো ধীরে ধীরে গাইতে শিখলেন, সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগীতের শিক্ষকও ছিলেন। ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করেছেন। ছায়ানটের মাধ্যমে আজ সারা দেশে রবীন্দ্র সংগীতের যে চর্চা, শিক্ষা ও বিকাশ ঘটছে তা আমদেরকে একটি বিশেষ মাত্রা এনে দেয়। আমরা আজ সন্জীদা খাতুনের কাছে থেকে শুনবো তাঁর শেখার কথা, তাঁর বড় হয়ে ওঠার কথা, তাঁর শিল্পী হওয়ার কথা। তিনি যে ছায়ানটের মাধ্যমে কাজ করছেন সারা দেশে, আমরা সেইসব কথাও শুনবো আজ তাঁর কাছে।
[প্রশ্ন] ষাটের দশকে আপনারা সারা দেশে ঘুরে ঘুরে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী খুঁজে বেড়িয়েছেন। আপনাদের সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছিল?
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ১
সন্জীদা খাতুন: ছায়ানটের জন্ম হয়েছিল ১৯৬১ সালে, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে। আর এই ছায়ানট থেকে আমরা বিদ্যায়তন করে চেষ্টা করছি যে নতুন নতুন শিল্পী তৈরি করবো। আমাদের বিদ্যায়তনে যারা ভর্তি হয়েছে তার মধ্য থেকে দেখা যায় এখনও অনেকেই শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আমরা হিসেব করে দেখেছি অন্তত ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী এ পর্যন্ত ছায়ানটে ভর্তি হয়েছে এবং গেছে। সবাই যে পাশ করে গেছে তা নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে তারা পাশ করেছে কেউ। কেউ কেউ হয়তো ছেড়ে গেছে। তিন বছর শিখেছে, দুই বছর শিখেছে, এরকম হয়েছে। আমরা এভাবে শিল্পী তৈরির কাজে ছিলাম। আর ছায়ানটের মূল যে উদ্দেশ্যটা ছিল সেটা হচ্ছে ছায়ানট চেয়েছিল বাঙালিকে তার সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করতে। ছায়ানটের জন্মই হয়েছে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান আমলে যখন অস্বীকার করা হচ্ছে তখন আমরা রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে কাজ শুরু করেছি। আর রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করার কারণ হলো তার চারপাশে অন্যান্য যারা রয়েছেন, গীতস্রষ্টা, সংস্কৃতিকর্মী, সংস্কৃতিসেবী, শিল্পী, সবাই… রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাদের মধ্যমণি হয়ে আছেন। এই জন্য আমরা রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করেছিলাম। আমরা বাঙালী সংস্কৃতির উজ্জীবনের কথা ভেবেছি। আমরা ‘শ্রোতার আসর’ বলে একটা আসর করতাম। যাতে ঘরোয়া আসর হতো, কখনো রবীন্দ্র সংগীত, কখনো নজরুলের গান, কখনো রাগ সংগীত, কখনো যন্ত্র সংগীত নানান কিছু হতো। এইগুলোর ভেতর দিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি যেন লোকে ঐতিহ্য সচেতন হয়। দ্বিজেন্দ্রলালের গান, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ আর নজরুল সবার গান আমরা সেই সময় পরিবেশন করবার চেষ্টা করেছি। কিছু দিনের মধ্যেই যখন বুঝলাম যে এভাবে হবে না, রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী সেরকম নেই, গুটিকয়েক মাত্র আছে, তখন আমরা সংগীত বিদ্যায়তন খুললাম ১৯৬৩ সালে। তারপরে দিনের পর দিন গানের শিক্ষা চলেছে, সোহরাব ভাই নজরুল গীতি শিখিয়েছেন।
—————————————————————–
ছায়ানটের মূল সাধনাটা বাঙালী হবার এবং চতুর্দিকে আমাদের যারা রয়েছেন, আমাদের সমাজের, আমাদের দেশের সবাইকে খাঁটি বাঙালি করে তোলা।… রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী, নজরুলের মৃত্যুর পর মৃত্যুবার্ষিকী এগুলো আমরা করেছি। এখন তো শুরু হয়েছে নানা উৎসব। যেটা আমরা প্রথমে করেছিলাম লোক উৎসব। তারপরে হয়েছে শুদ্ধ সংগীতের উৎসব, তারপরে হয়েছে নজরুলের গানের উৎসব, তারপরে রবীন্দ্র উৎসব। এই উৎসবগুলোর পরে আমাদের ইচ্ছা আছে আমরা নৃত্য উৎসবে যাবো।
—————————————————————-
বেবী: সব ধরনের গান আপনারা শেখাতেন?
সন্জীদা: হ্যাঁ সব ধরনের গানই শেখানো শুরু হয়। প্রধানতঃ রবীন্দ্র সংগীত; আর নজরুল গীতি, শুদ্ধ সংগীত আরম্ভ হয়েছিল… পরে হয়, সেটা হলো বেশ পরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। পল্লীগীতি বিভাগটা খুলি, নৃত্য ছিল, সেতার, তবলা এই সব জিনিসগুলো ছিল সে সময়। যাই হোক, আমাদের বড় যে কাজটি সেটা হচ্ছে ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার জন্য মিলনস্থান তৈরি করা। কিছু কিছু এমন অনুষ্ঠান করা যেখানে সবাই এসে মিলতে পারে। প্রথম অনুষ্ঠান হয়েছিল বসন্ত উৎসব, শারদীয় উৎসব, তার পরে বর্ষার গান হয়েছে। পহেলা বৈশাখ, এই যে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পহেলা বৈশাখ—এ হচ্ছে ছায়ানটের সবচেয়ে বড় কাজ, আমরা বলতে পারি। কারণ এই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূল যেটাকে আমরা বলি, সেখানে আমরা যেটা করতে চেয়েছিলাম যে মানুষ আসুক। মানুষ এসে বাঙালি হিসাবে সম্মিলিত হউক। তাদের এই প্রীতি সম্মেলনের ভেতর দিয়ে ঐতিহ্যপ্রীতি জাগ্রত হউক। এই জিনিসগুলোর জন্য আমরা পহেলা বৈশাখ শুরু করি। যাই হোক, তো ছায়ানট এভাবে দীর্ঘ দিন চললো। তার পরে যখন দেশে আন্দোলন চলছে তখন আমরা গণসংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলাম। শেখ লুৎফর রহমান সাহেব এসে প্রধানত গণসংগীত শেখাতেন। আলতাফ মাহমুদকে ধরে আনতাম কখনও কখনও। গণসংগীতগুলো এভাবে শিখেছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। আন্দোলনের সময় এসব গান তারা গেয়েছিল শহীদ মিনারে। ব্রতচারী আন্দোলনের যে গানগুলো, “মানুষ হ, মানুষ হ আবার তোরা মানুষ হ”—এসব গান গাওয়া হতো। বিশেষ করে বলা আছে ‘অনুকরণ খোলস ভেঙে কায়মনে বাঙালী হও।’
ছায়ানটের মূল সাধনাটা বাঙালী হবার এবং চতুর্দিকে আমাদের যারা রয়েছেন, আমাদের সমাজের, আমাদের দেশের সবাইকে খাঁটি বাঙালি করে তোলা। এইভাবেই আমরা অগ্রসর হয়েছি। এবং দেখা যায় যে ১৯৭১ সালে আমরা পহেলা বৈশাখ করতে পারিনি বটমূলে। কিন্তু তার পরেই আবার যখন দেশ স্বাধীন হলো, আমাদের শুরু হলো পহেলা বৈশাখ… ঠিক মতো হয়ে গেছে। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী, নজরুলের মৃত্যুর পর মৃত্যুবার্ষিকী এগুলো আমরা করেছি। এখন তো শুরু হয়েছে নানা উৎসব। যেটা আমরা প্রথমে করেছিলাম লোক উৎসব। তারপরে হয়েছে শুদ্ধ সংগীতের উৎসব, তারপরে হয়েছে নজরুলের গানের উৎসব, তারপরে রবীন্দ্র উৎসব। এই উৎসবগুলোর পরে আমাদের ইচ্ছা আছে আমরা নৃত্য উৎসবে যাবো।
ছায়ানটের নিজস্ব ভবন হবার পরে সর্বসাধারণের অর্থে এটার নির্মাণ কাজ হয়েছিল; এটা একটা মস্তবড় ঘটনা। আমরা ভাবতে পারিনি যে মানুষ আমাদের কত ভালোবাসে। মানুষ ছায়ানটের সূত্রে সংস্কৃতির চর্চার দিকে কতটা আগ্রহী এইটা দেখতে পেয়েছি যখন তারা এসে আমাদের দিনের পর দিন অর্থ দিয়ে গেল। শিল্পীরা আমাদের জন্য গান গাইলেন, নৃত্য শিল্পীরা নাচলেন, আবৃত্তি শিল্পীরা আবৃত্তি করলেন, নাট্য শিল্পীরা নাটক করলেন এইভাবে এমনকি ছোট পত্রিকা যাদেরকে বলে মিনি পত্রিকার বিক্রয়লব্ধ পুরো টাকাটা ছায়ানটকে দিয়েছে। এই ভাবে আমরা ভবন করলাম।
এই ভবনটা হওয়ার পর আমাদের কার্যক্রম খুব বেশি বেড়ে গেছে। এখন আমরা আমাদের গানের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের… মানে বুধবারে ছাড়া সব দিন ক্লাস হচ্ছে; চার হাজারের উপরে শিক্ষার্থী। প্রধান শিক্ষাটা বৃহস্পতি, শুক্র, শনি এবং অন্যান্য দিন ছড়ানো থাকে। ‘সংগীত পরিচয়’ নামে একটা শিক্ষা আর ‘সংগীত সূচনা’র দু’ বছরের কোর্স করছি আমরা ১৪১৮ সাল থেকে। দু বছর পার হলে যারা খুব ভালো করবে তাদেরই শুধু উপরের ক্লাসে নেবো। সেখানে গিয়ে এরা চার বছর গান শিখে ‘সংগীত প্রবেশ’ অভিজ্ঞানপত্র পাবে। আমাদের এখানে এখন ‘শিকড়’ নামে একটি কাজ চলছে। ‘শিকড়ে’ যে ক্লাস হয় সে ক্লাসে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরাই আসে। তারা সবাই বাঙালী রীতিনীতিগুলো শেখে, ব্রতচারী শেখে। তারপরে ‘আটকড়াই’ নামে গ্রামের দিকে প্রচলিত ‘কড়াই ভাজা’ খাওয়া নামে একটি দিন আছে। আট রকমের কড়াই ভাজা ওরা খায়, সেই আটটি শস্যের নাম তারা জানে। তারা গান শেখে, ছবি আঁকে ও শরীরচর্চার নানা কিছু করে এবং তার সঙ্গে ভাষাও শেখে। আর এখন তো ‘শিকড়’… আমরা ‘ভাষার আলাপ’ নামে আর একটি নতুন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছি। এটা খুব শীঘ্রই চালাবো, আষাঢ় মাসে। সব তৈরি হয়ে গেছে। পাঠ্ক্রম কারা শেখাবেন সব তৈরি হয়েছে। সেখানে ‘ভাষার আলাপ’ বলতে পরস্পর বিনিময়ের ভেতর দিয়ে ভাষা নিয়ে আলাপ। তবে প্রত্যেক ক্লাসের আলোচ্য সূচি থাকবে, আলোচ্য বিষয় থাকবে। কখনও হয়তো আমরা উচ্চারণ নিয়ে আলাপ করবো, কখনও আমরা ভাষার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবো। যেমন বানান নিয়ে, বাক্যগঠন নিয়ে, আর উচ্চারণের পরে যেটা আসবে—পাঠের ভেতর দিয়ে আমরা যাব বাচনভঙ্গিতে। এই পাঠগুলো হবে কিন্তু সাহিত্যের পাঠ। তার ফলে হবে কী, একই সঙ্গে সাহিত্যের দিকেও সবার মনটা যাবে। সু-সাহিত্য যাকে বলা যায়। এইভাবে আমরা মোটামুটি পাঠ্ক্রমটা তৈরি করেছি।
আমাদের এখানে আরো একটি ক্লাস হয় সেটি হচ্ছে অটিস্টিক শিশুদের। এটা বেশ ছোট্ট থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত আছে। এদের শিক্ষা কার্যক্রমের নাম হচ্ছে ‘সুরের জাদু, রং এর জাদু’। সুর আর রং নিয়ে তাদের কাজ এবং এখন আবার ব্রতচারী নৃত্যকেও তাতে দেওয়া হয়েছে। এদের গান শেখানো হয়, এদের ছবি আঁকানো হয়। এদের এখন ব্রতচারীও শেখানো হবে। একটু অঙ্গচালনা… কারণ অটিস্টিক শিশুদের স্নায়বিক সমন্বয়টা হয় না বলেই তাদের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে, কীভাবে তাদের সাহায্য করতে পারি। এটি বলা যেতে পারে যে এতে আমাদের কোনো টাকা আসে না, আমরা বরং ভর্তুকি দেই। কিন্তু আমরা মনে করি দেশের অটিস্টিক শিশুদের দিকে লক্ষ্য রেখে এ রকম কাজ আমাদের করা উচিত।
বেবী: আপানাদের প্রতিষ্ঠানটি আমাদের দেশে যে সব কাজ করে যাচ্ছে, আপনি কি মনে করেন যে এগুলোর জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বা আর্থিক বা অন্যান্য সহযোগিতা থাকা উচিত।
সন্জীদা: স্বাধীনতার পরে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন, নিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল প্রথমবার দেওয়া হলো ৪০ হাজার, তার পরে ৩৫ হাজার, তার পরে ২৫ হাজার, তার পরে কমতে থাকল এবং তার পরে বলা হলো ১০ হাজার টাকা। তখন সুফিয়া খালাম্মাকে (কবি সুফিয়া কামাল) বললাম, বলুন খালাম্মা কী করি? আমার তো ইচ্ছে নেই এরকম সাহায্য নেওয়া। খালাম্মা বললেন, ওদেরকে লিখে দাও যে ‘এ অর্থ গ্রহণে আমরা অপারগ’। এই কথাটি লিখে আমরা নেওয়া বন্ধ করে দেই এবং আমরা মনে করি সরকারের কাছে হাত পাতলে তা যে কোনো সরকার আসুক তার সঙ্গে চলতে হয়। আমরা এতে রাজি না। আমাদের নিজের একটা স্বাধীন সত্তা আমরা রাখতে চাই। আমরা চাই বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাটা যেন নিজেদের মতো করতে পারি। এখন তো আমাদের ছাত্র-ছাত্রী সূত্রে কিছুটা আয় হয়। তাতে আমাদের কিন্তু ভালই চলতে পারার কথা, কেবল এখনও ঠিকাদারের টাকা শোধ হয়নি। নির্মাণের কাজ এমনি যে, বাইরেটা হয়েছে। আমাদের যে মিলনায়তন তার মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা, বাতির ব্যবস্থা আর সাজঘরের ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ বাকি রয়েছে। সেগুলো করার সাধ্য আমাদের এখন নেই।
বেবী: আপা আপনার কাছে অনেক কথা শুনলাম…
সন্জীদা: আর একটি কাজের কথা বলি, ছায়ানটে আমরা কিন্তু সংস্কৃতিকে সার্বিকভাবে নিয়েছি, যার জন্যে আমরা একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকাও বের করছি। সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক এই ত্রৈমাসিক পত্রিকাটাও আমাদের খুব কষ্টের ধন, আমরা এটা করে যাচ্ছি। যাই হোক, বলো।
বেবী: তো আপা, একটা বিষয় আপনার কাছে জানতে চাই, আপনারাদের এখানে রবীন্দ্র সংগীতটাই বেশি প্রাধান্য পায়…।
সন্জীদা: না এটা খুব ভুল ধারণা, ঐ যে বললাম নজরুল গীতির সোহরাব ভাইকে নিয়ে স্কুল খুলেছি।
বেবী: আপনি কি মনে করেন যে রবীন্দ্র সংগীত শেখাচ্ছেন, নজরুল সংগীত শেখাচ্ছেন, পল্লীগীতি শিখাচ্ছেন, এই শিক্ষার সাথে সাথে সাহিত্যের সাথেও একটা পরিচয় থাকা উচিত?
…..
ছবি. মুস্তাফিজ মামুন
…….
সন্জীদা: স্কুলে সেটা আমরা ওইভাবে করতে পারছি না বলে ‘ভাষার আলাপ’-এ সে ইচ্ছা আছে। মানে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত শেখার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য শেখানোর সুযোগটা আমাদের খুব কম। আমি যেটা করতে চেষ্টা করছি, এখন শিশুদের ক্লাসে যে গানগুলো শেখে সেগুলো আবৃত্তি করাই। এগুলো আবৃত্তির জন্য আবৃত্তির লোক আসে, এসে আবৃত্তি করে ওদেরকে শেখায়, তাতে একটা কাজ হয়। আর আমরা যে বড় একটা কাজ করছি, সেটাই তো বলি নাই। সেটা হচ্ছে নালন্দা বিদ্যালয়। শিশুদের একটা বিদ্যালয়, এখন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আছে। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকদেরকে আমরা সাহিত্য পড়াই এবং আমি বাংলা পড়াই। আর একজন ইংরেজি পড়াচ্ছে। আর একজন বিজ্ঞান পড়াচ্ছে, আর একজন অংক নিয়ে আছেন। এইভাবে শিক্ষকরা সমৃদ্ধ হচ্ছে যাতে শিশুদেরকে তারা সমৃদ্ধ করতে পারেন। এই ‘নালন্দা’ কথাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর গানের সঙ্গে সাহিত্যের পাঠ দেওয়াটা খুব কঠিন, উঁচু ক্লাসে আমরা চেষ্টা করি গানের বাণীকে বিশ্লেষণ করে তার পটভূমির কথা বলতে।
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ২
বেবী: একজন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীর কাছে সাহিত্য পড়াটাও জরুরী।
সন্জীদা: কিন্তু স্কুলের মতো কার্যক্রমে করা কঠিন, সেটা আমরা হয়তো বলতে পারি যে, এই এই বই তোমাদের পড়তে হবে—এই পর্যন্ত। সঙ্গীত তত্ত্ব পড়ানো হয়, নানা কিছু আছে, আর এদের উঁচু ক্লাসে আমরা যেটা করি, গানের বিশ্লেষণ করে দেই। গানের তাৎপর্য ব্যাখ্যা বা কী প্রেক্ষিতে এটা লেখা হয়েছে সেটা বলা—এইগুলো করেছি।
বেবী: রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পী হতে হলে কণ্ঠটা তো খুব জরুরি…
সন্জীদা: আসলে যে কোনো কণ্ঠই তার জন্য যথার্থ কণ্ঠস্বর। শিক্ষা নিয়ে সেই কণ্ঠটা বের করতে পারলে সব গানই তাতে হবে। আমার একটি ছাত্রের কথা আমি বলবো। তার নাম সুমন চৌধুরী। ও নজরুল গীতি শিখেছে, কিন্তু আমি ওকে ধরে কিছু রবীন্দ্র সংগীত শেখাই। যেমনি চমৎকার সে রবীন্দ্র সংগীত গায়, তেমনি চমৎকার সে নজরুল গীতি গায়। দুটি যখন গাইছে দুটোর স্টাইল আলাদা। এরকম কোনো কথা নেই কিন্তু যে এরা ওটা গাইতে পারবে না, আর ওরা এটা গাইতে পারবে না। তবে আমাদের কথা বলতে গেলে একটু মুশকিল আছে। আমরা এত দিন ধরে রবীন্দ্র সংগীত গাইছি, এখন নজরুল গীতি গাইলে কেউ কেউ বলে, ওতো রবীন্দ্র সংগীতের মতো শোনাচ্ছে। এটা আমাদের ক্ষেত্রে বলে। কিন্তু ছোট থেকে আমাদের শিশুরা কিন্তু সব কিছু শেখে, আস্তে আস্তে ওপরে উঠে থার্ড ইয়ার থেকে আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে সরে যায়। এ রকম একটা আছে, যার যেটা পছন্দ, যে যেটা পারে এভাবে করিয়ে দেওয়া হয়।
বেবী: আপা আপনি তো নিজেও সংগীত শিল্পী ছিলেন, শিক্ষকতা করেছেন, এখন কোথায় কাজ করে আপনি সন্তুষ্ট।
সন্জীদা: আমার শিক্ষকতা অত্যন্ত প্রিয় কাজ। আমি এখনও ‘নালন্দা’য় পড়িয়ে সে আনন্দটা পাই। ‘কণ্ঠশীলন’ বলে একটি আবৃত্তি প্রতিষ্ঠান আছে তাদের গিয়েও অনেক সময় পড়িয়েছি। আমি পড়িয়ে আনন্দ পাই। পড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু শুধু তাই না, আমার গান গাওয়ার খুবই নেশা ছিল। গান ছাড়া থাকতে পারতাম না। এখন তো এই ৭৭ বছর বয়সে গান আর গাইতে পারি না।
বেবী: আপনি সংগীত শিখলেন কীভাবে, কার কাছে শিখেছেন?
সন্জীদা: আমি পাঁচ বছর বয়সে যখন গান শিখেছি প্রথম, তখন শোনা-টোনা—মানে বড়দি গান করছেন, সেজো চাচি গান করছেন বা বাবা (ড. কাজী মোতাহার হোসেন) বারান্দায় পায়চারী করতে করতে গান করছেন, এগুলোই আমার সব স্মৃতি। বড়দির গান খুব শুনতে ভালোবাসতাম। বড়দি বারান্দায় বসে মাদুর পেতে গান গাইতেন, আমি সামনে গিয়ে শুয়ে শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে যেতাম। তখন থেকে এভাবে গান শুনি। আমাদের বাড়িতে খুব অল্প বয়সে আমরা রেডিও পেয়েছি। যুদ্ধের সময় বাবা রেডিও কিনেছিলেন। এই রেডিওতে গান শুনেছি। তাছাড়া গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল, বাজানো হতো। অনেক আগে সেই যে বক্স গ্রামোফোন ছিল, চাবি দিতে হতো, কলের গান যাকে বলতো, তাতে রেকর্ড বাজানো হতো। কাজেই গানের পরিবেশটা আমাদের ছিল আর বড়দি গান শিখতেন। বড়দির ওস্তাদের কাছে একদিন আমার হাতেখড়ি হয়ে গেল। সেই একটা গান মানে রাগ সংগীত, কিছু একটা ইমনের ওপর। আমি কিছু শিখলাম একটা। এইভাবে গান শুরু হয়েছে। তার পরে শিক্ষক থেকে শুধু উনি না আমি কার কার কাছে শিখেছি বলতে গেলে বলতে হবে, এর পরে খগেন চক্রবর্তী নামে একজন শিক্ষক… আসলে নাট্য শিল্পী। তার ভাইয়ের নাম ছিল গিরিণ চক্রবর্তী। ভালো পল্লীগীতি গাইতেন, রেকর্ড-টেকর্ড আছে। এই খগেন চক্রবর্তী আমার ঠিক ওপরের বোনকে গান শেখাতেন। আর আমি সারাক্ষণ পাশে বসে গানগুলো শিখে ফেলতাম। উনি চলে গেলে আমার বোন লাফ দিয়ে উঠে চলে যেত, আর আমি বসে বসে হারমোনিয়াম টিপে টিপে গানগুলো তুলতাম, আমার এত আগ্রহ ছিল গানে। আর গান না শুনে গান না গেয়ে একদম থাকতে পারতাম না। সারাক্ষণ খালি গলায় চিৎকার করে করে গান গাইতাম। গান গাইতে ভালো বেসেছি, গান শেখাতেও ভালো লেগেছে, যতদিন শেখাতে পেরেছি।
বেবী: আপনি তো অনেক দিন গান গেয়েছেন।
সন্জীদা: গান গেয়েছি আজ থেকে অন্তত ১৮ বছর আগেও। এমন কি মাঝে মাঝে এমন ঘটেছে কলকাতায় গিয়েছি কোনো একটা কাজে, বললো সংবর্ধনা দেব। আর কলকাতার সংবর্ধনা মানে যে গান গাওয়া তখনও বুঝি নাই। জামসেদপুরে নিয়ে গেল সংবর্ধনা দিল, সবই হলো। বললো, এবার একটা গান করুন। আট খানা গান গাই।
বেবী: আপা, আপনার তো রবীন্দ্র সংগীত প্রিয় ছিল।
সন্জীদা: রবীন্দ্র সংগীত আমার প্রিয় গান হলে কী হবে, আমাকে যারা শিখিয়েছে তারা অনেকেই রাগ সংগীতের লোক। তারপরে সোহরাব হোসেন সাহেবের কাছে আমি তিন বছর গান শিখেছি এবং তখন শুধু নজরুল গীতি না আধুনিক, পল্লীগীতি, নজরুল গীতি সবই গাইতাম। আমিও শিখতাম সবকিছু। তিন বছর শিখে ওঁর গান ফুরিয়ে ফেলি। তারপরে উনি আমাকে বলেন, আমি তোমাকে আর শেখাবো না। তারপরে যেটা হলো, সাহিত্য পড়তে গিয়ে বাংলা সাহিত্য ও কবিতা পড়ে রবীন্দ্র সংগীত শিখবার ঝোঁক হলো। তখন আমি ওই সেগুনবাগিচা থেকে প্রেসক্লাব এসে, (বাসে চড়ে, তখনকার টাউন সার্ভিস বাস, যাকে ‘মুড়ির টিন’ বলা হতো) সেই আজিমপুরে হুসনা বানু খানম ছিলেন, তার কাছে গিয়ে গান শিখতাম। তিনি যে স্বরলিপি দেখে দেখে শেখাতেন আমার খুব ভালো লাগতো। একসময় আমার প্রয়োজনে আমার জানা গান স্বরলিপি দেখে দেখে তুললাম, তুলে তুলে আমি স্বরলিপি তোলা শিখে ফেললাম। এই করে আমার নিজে নিজে রবীন্দ্র সংগীত চর্চা শুরু। আসলে আমি একভাবে বলি, আমি কিন্তু সু-শিক্ষিত না, রবীন্দ্র সংগীতে আমি স্ব-শিক্ষিত। এই হলো ব্যাপারটা। তবে নানা ধরনের গান আমি টেলিভিশনেও গেয়েছি। কিন্তু প্রথমে নজরুল গীতি গেয়েছি। নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত এক সঙ্গে তখন দুবার দুটো বৈঠকে গান গাইতে হতো। প্রথমে নজরুল গীতি গাইলাম, তারপর রবীন্দ্র সংগীত গাইলাম, এই সব করেছি। রেডিওতেও আরম্ভ করেছি আধুনিক গান গেয়ে, তার থেকে চলে এসেছি রবীন্দ্র সংগীতে—এই রকম।
বেবী: আমি জানতে চাচ্ছিলাম আপনারা যখন শিখেছিলেন বা গাইছিলেন শুরুর দিকে, তখন তো এদেশের মেয়েদের সংগীত শেখানোর খুব একটা প্রচলন ছিল না এবং মেয়েরা সুযোগও পায়নি। আপনাদের পরিবার তো একটা সংস্কৃতি মানের পরিবার ছিল, তো আপনারা কীভাবে ঘরে এবং বাইরে… কোনো বাধার সম্মুখীন তো কখনো হননি?
সন্জীদা: তখন হইনি। তখন অল্প বয়সে চারপাশে হিন্দু পরিবার ছিল অনেক। সব বাড়িতেই গান হতো। আমাদের এই বাড়িতে গান হতো এবং সেটা নিয়ে কখনও কথা ওঠেনি। উঠেছিল যখন আমরা ফজলুল হক হলে থাকি। আমার বাবা হাউজ টিউটর ছিলেন। ওই যে বলছিলাম না যে সারাক্ষণ খুব চেঁচিয়ে গান গাইতাম আর গলা সাধতাম। ছাত্ররা আমার বাবার কাছে নালিশ দিত যে সারাক্ষণ “আ..” “আ..” করে, আমরা পড়তে পারি না। এইটা নিয়ে বাবার খুব কষ্ট হলো, কিন্তু বাবা আমাকে কিছু বলতে পারলেন না। কেমন করে বলবেন যে, তুই গান করবি না। এটা তো বলতে পারেন না। আর মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা গান গাইতে বসলে হল থেকে চিৎকার করতো “আ..” “আ..” চাই না। এইগুলো হয়েছে কিছু কিছু, কিন্তু আর কোনো বাধা আমি পাইনি। আর আমার বাবা তো অত্যন্ত মুক্তমনের মানুষ ছিলেন, উনি মেয়েদের পড়াতে চেয়েছেন, গান শেখাতে চেয়েছেন। কাজেই আমাদের সে দিক থেকে বাধা হতো না।
বেবী: আপনি যখন গান গাইছিলেন বা শিখছিলেন তখন আপনার সাথে আর কে কে ছিলেন? আপনার আশেপাশে তো অনেকেই ছিলেন, যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
সন্জীদা: হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠিত যারা হয়েছে যেমন মালেকা আজিম খান একজন ছিলেন, আফসারি খানম একজন ছিলেন, কাজী শাহজাহান হাফিজ ছিলেন, সুলতান আলম ছিলেন, লায়লা আর্জুমান্দ বানু তখন রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন, ফিরোজা বেগমও রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন। অনেক ব্যাপার ছিল, তখন সবাই গাইতো। অঞ্জলী মুখোপাধ্যায় নামে একজন গাইতেন, তিনি বিয়ের পরে অঞ্জলী রায় হয়ে যান। পরে তিনি নজরুল গীতিতেই চলে গিয়েছিলেন। এ রকম অনেক ছিল। ঝুনু ভৌমিক নামে একটি মেয়ে গান গাইতো, অনিমা দাস, নিলিমা দাস, বিমল রায় এঁরা সব রেডিওর শিল্পী ছিল।
বেবী: জাহিদুর রহীম আপনার পরে আসেন?
সন্জীদা: অনেক পরে। যদিও সে মফস্বলে থাকতো। ঢাকায় যখন এলো আমাদের পাড়াতেই ওর বাবা বাড়ি কিনলেন। আমার বাবার বন্ধু ছিলেন ওর বাবা। ওকে সবাই বলতো হেমন্ত। জাহিদুর রহিম গান গাইতো বাফায়। বাফা (বুলবুল ললিতকলা একাডেমি) থেকে পাস করে—এরকম অনেক আছে—পরে ছায়ানটে চলে এসেছিল। পরিবেশটা তার ভালো লেগেছিল বলে। ছায়ানটে আসবার পরে সে ছায়ানটেই ছিল অনেক দিন পর্যন্তু। জাহিদুর রহিমের কথায় আমি আমাদের আর একটি আন্দোলনের কথা বলি, ঐ যে গিয়ে গিয়ে গান শেখানো, এটা হয় কখন? জাহিদুর রহিমের মৃত্যু হলো ১৯৭৮ সালে। তার মৃত্যুর পরে আমরা প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলাম। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে একজন ভদ্রলোক ছিল, আমি কিন্তু নাম বলবো—শামছুল হুদা চৌধুরী—জাহিদুর রহিম জানতো যে উনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিন্তু অন্য দলগুলোর সঙ্গে চলাফেরা করেছেন। সে জন্য জাহিদুর রহিম একদিন প্রেসক্লাবের সামনে তাকে ধাওয়া করেছিল রাজাকার বলে। এর আগে উনি কয়েকজনের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে রেডিওতে জাহিদুর রহিম যে চাকুরি করতো সেই চাকুরিটা নাকচ করে দেয়। এর কিছু দিন বাদেই জাহিদের হার্ট এ্যাটাক হয়। সে হাসপাতালে ছিল। ও আবার বড্ড বেশি ফোন-টোন করতো। এ সব নিয়ে হয়তো নার্সের সাথে ওর কিছু বাদানুবাদ হয়েছিল, রেগে গিয়েছিল। তখন কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠছে বাড়ি যাবে, হঠাৎ বিছানার উপরে পড়ে মরে গেল। এটাকে আমরা মনে করলাম, ঐ যে ঐ চাকুরিটা খেয়েছে যারা তাদেরই দোষ। সেই ভাবেই আমরা দেখেছি।
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ৩
আর জাহিদুর রহিমকে আমাদের বঙ্গবন্ধু তার জনসভায় নিয়ে যেতেন স্বাধীনতার আগেই, ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য। জাহিদের এই একটা সাংঘাতিক বড় অবদান, কিন্তু বঙ্গবন্ধুরও বড় অবদান যে তিনি সাধারণ মানুষের কানে সোনার বাংলা সুরটা সেই পাকিস্তান আমলেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাই হোক তো জাহিদের মৃত্যুর পরে একবছর তো শোকসভা করলাম কিন্তু জামিল চৌধুরী একজন যে টেলিভিশনের সঙ্গে ছিল, আমার বন্ধু জামিল চৌধুরী আমাকে বললো, দেখো এই কান্নাকাটি করে তো কিছু হবে না। চলো আমরা অন্য কিছু করি। আমরা একটা রবীন্দ্র সংগীত প্রতিযোগিতা করি।
রবীন্দ্র সংগীত প্রতিযোগিতা প্রথমবার যেটা হলো, সেটা ঢাকা মহানগর, ঢাকা বিভাগ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম আর খুলনা তখনকার সেই চারটি বিভাগে হলো । তার পরের বছর গেল ওরকমই, প্রতিযোগিতা হলো ঢাকায়। তারপরে আমরা নাম রেখেছিলাম প্রতিষ্ঠানটার ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’। তখন আমরা কিছু কিছু কথা শুনতে লাগলাম যে জাহিদুর রহিম এত বড় শিল্পী নয় যে সমস্ত দেশের মানুষ তাকে চেনে, আর তার নামে কেন এত বড় প্রতিষ্ঠান চলবে? বিশেষ করে কলিম শরাফীকে আমরা আহবায়ক করেছিলাম, ওঁরই আপত্তি ছিল। তখন আমরা ভাবনা চিন্তা করে দেখলাম যে ঠিকই তো বৃহত্তর পটভূমিতে এই কাজটাকে স্থাপন করতে হলে রবীন্দ্রনাথের নাম ছাড়া পথ নাই। আমরা তখন এর নাম করলাম ‘জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ’। তবে প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হত তাকে আমরা ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি ফলক’ উপহার দিতাম, এখনও দিয়ে যাচ্ছি। এই জিনিসটা করতে গিয়ে জেলায় জেলায় শাখা হলো। এখন ৬৩টি শাখা আছে ‘রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদে’র। এক বছর ঢাকায় সম্মিলন হয়, এক বছর ঢাকার বাইরে হয়। ঢাকায় যখন হয় তখন কিন্তু প্রতিযোগিতাটাও হয় এবং সম্মিলনে কী কী হয় সেটাও একটা জানবার বিষয়। আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে ঘুরে বেড়াই সারা দেশে।
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ৪
বেবী: আপা আপনি তো এখনও সারা দেশে ঘোরেন। আপনার কি মনে হয় যে রবীন্দ্র সংগীতকে আমরা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গেছি।
সন্ জীদা: অনেক নিতে পেরেছি। জয়পুর হাটের সম্মেলনে যদি যেতে দেখতে পেতে স্টেডিয়ামে রাত্রি ১২টা পর্যন্ত গান হচ্ছে। সবাই আসছে, আসছে স্রোতের মতো গ্রাম থেকে। কারও সিঁদুর পরা, কারও বিধবার সাজ, কারো বোরখা পরা। এসে সেখানে বসে, মানে মেয়েদের কথা বললাম। ছেলেরা তো আছেনই। এখানে একটা বিরাট প্রদর্শনী হয়েছিল সে প্রদর্শনী দেখেছে তারা। তারপর প্রদর্শনীতে দেশের কৃতি সন্তানদের ছবি আছে, সেগুলো দেখেছে। দেশের বলতে বাঙালি কৃতি সন্তানদের ছবি সেগুলো দেখেছে। তারা ব্যানারে বাণী লেখা ছিল, সেগুলো পড়েছে। এগুলোর ভিতর দিয়েই আমরা মানুষের কাছে যাই। এবারে যশোরে সম্মেলন হলো। যশোরে যখন সেমিনার হচ্ছে, আমরা মনে করি যে বন্ধ ঘরে বিজ্ঞ লোকেরা শুনবে। সাধারণের সামনে সেমিনার হলো, মাটিতে বসে থাকা মানুষ শুনছে, হাত তালি দিচ্ছে। কখনও খুশি হয়ে হাসছে। এই রকম অবস্থা। আমি তো বিস্মিত হয়েছি। আমি শুনেছি যে যশোরে নাকি এটা একটা ঐতিহ্য। যশোরের মানুষ নাকি এরকম সেমিনার শুনে থাকে। তা ছাড়া আমরা যেটা করি ‘রবি রশ্মি’ নামে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে বলা হয়। এইটাতে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পরিচিতিটা বাড়ে। তা ছাড়া ‘রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ’ বলে যে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান তা তো না। নজরুল, ডি.এল.রায়, অতুলপ্রসাদ সবরকম পঞ্চভাস্করের গান। এটা ঠিকই, এখানে রবীন্দ্র সংগীতটা বেশি হয়। আর তার পরে লোক সংগীত হয়, শুদ্ধ সংগীত কিংবা রাগপ্রধান গানগুলো হয়। এর ভেতর দিয়ে আমরা সার্বিক ভাবে এই জিনিসটা করছি।
আর একটা বড় কথা একজন দানশীল ব্যক্তি তিনি ঘুরে ঘুরে গান শেখানোর খুবই অনুরাগী। তিনি তো ‘ওয়াহিদুল হক সংগীত প্রব্রজ্যা’ নাম নিয়ে একটা একটা কার্যক্রম করেছেন। তার বাবা ও মায়ের নামে ফাউন্ডেশনটা। আর এই কার্যক্রম চালাতে ছায়ানটকে টাকা দিচ্ছেন। কিন্তু ছায়ানট রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন পরিষদকে এক বছরে কতজনকে শেখানো হবে, কীভাবে হবে—হিসেব দিলে সেই অনুযায়ী ওঁরা টাকা দিচ্ছেন। সম্মিলন পরিষদ থেকে গিয়ে গিয়ে শুধু রবীন্দ্র সংগীত না নজরুল গীতি, অতুল প্রসাদ সব রকমের গান শেখাচ্ছে। আমি কদিন আগে কুমিল্লায় নাদিরা বেগমকে লোক সংগীত শেখাতে নিয়ে গিয়েছি। এগুলো আমরা করেছি।
বেবী: আপা আপনি একটা জিনিশ আমাকে বলেন, শান্তিনিকেতনে যে রবীন্দ্র সংগীত শেখানো হয় বা ওখানে যারা চর্চাটা করে পশ্চিমবঙ্গে, আর আমাদের এখানে যে চর্চাটা বা শেখানোটা হয়, গান গাওয়া—এর মধ্যে কি খুব বেশি পার্থক্য আছে?
সন্ জীদা: আছে একভাবে শান্তিনিকেতন এবং কোলকাতার উচ্চারণ মানে কী বলবো, সেটা কিন্তু একটা অ্যাফেক্টেড উচ্চারণ এবং গানে ওরা খুব দক্ষ। ক্লাসিকাল শিখে-টিখে অত্যন্ত চমৎকার গায়। কিন্তু তাতে প্রাণ থাকে না। ওরাই বলে আমাদের এখানে বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীতে প্রাণ আছে। এরা রবীন্দ্র নামটা উচ্চারণ করে না, এরা গান গায় প্রাণ দিয়ে। এ কথাটা তারা বলে এবং খুব পছন্দ করে।
বেবী: আমাদের ছায়ানটে যে রবীন্দ্র সংগীত শেখানো হয় অনেকে বলে যে, শেখানোটা প্রাণখোলা না। আপনার কাছে তাই মনে হয় যে কেউ কেউ চিবিয়ে গায়?
সন্ জীদা: ছায়ানটে কেউ চিবিয়ে তো কখনো গায় না। ঐ চিবিয়ে গান-টান তো বাইরে হয়। ছায়ানটে কোনোদিন হয় নি। আমরা খোলা গান গেয়েছি, এভাবে শিখিয়েছি যে গান হচ্ছে খোলা গলায় গাইবে। তবে চিৎকার করে নয়। এইভাবে আমরা করিয়েছি।
—————————————————————–
শান্তিনিকেতন এবং কোলকাতার উচ্চারণ মানে কী বলবো, সেটা কিন্তু একটা অ্যাফেক্টেড উচ্চারণ এবং গানে ওরা খুব দক্ষ। ক্লাসিকাল শিখে-টিখে অত্যন্ত চমৎকার গায়। কিন্তু তাতে প্রাণ থাকে না। ওরাই বলে আমাদের এখানে বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীতে প্রাণ আছে। এরা রবীন্দ্র নামটা উচ্চারণ করে না, এরা গান গায় প্রাণ দিয়ে। এ কথাটা তারা বলে এবং খুব পছন্দ করে।… ছায়ানটে কেউ চিবিয়ে তো কখনো গায় না। ঐ চিবিয়ে গান-টান তো বাইরে হয়। ছায়ানটে কোনোদিন হয় নি। আমরা খোলা গান গেয়েছি, এভাবে শিখিয়েছি যে গান হচ্ছে খোলা গলায় গাইবে। তবে চিৎকার করে নয়। এইভাবে আমরা করিয়েছি।>
—————————————————————-
বেবী: গ্রামারটা শিখিয়ে গানটা ভালো করার চেষ্টা।
সন্ জীদা: ক্লাসিকাল শিখছে থার্ড ইয়ার ওঠার পর। আমরা বলি একটু স্বরলিপি দেখ, স্বরলিপি দেখে দেখে ভবিষ্যতে তুলতে হবে মনে রেখে সেইভাবে চর্চা করো।
বেবী: আমাদের এখানে এখন টেলিভিশনে এত চ্যানেল, তারপর রেডিও—সব জায়গা য়তো গান প্রচারিত হচ্ছে। এটা আপনার কাছে কেমন লাগে।
সন্ জীদা: ভাল! ভাল, তবে টেলিভিশনগুলোর একটা প্রবণতা হচ্ছে তারা বয়স দেখে গান গাইতে ডাকে। যাদের বয়সটা কম।
বেবী: যারা অভিজ্ঞ শিল্পী…?
সন্ জীদা: না তাদেরকে ডাকে না। এই যে ফাহমিদা খাতুন, তাকে কম ডাকে। মাহমুদা খাতুনকে ডাকেই না এবং ইয়ং যারা আর গিয়ে একটু লাইন দেয়। একটা খারাপ কথা বললাম।
বেবী: কিন্তু বলতে গেলে শোনা যায় যে আজকাল রবীন্দ্র সংগীত অনেক আসরে পয়সা নিয়ে গায়।
সন্ জীদা: হ্যাঁ পয়সা নিয়ে গায়। এটা ছিল ভারতের জিনিস। ওরা পয়সা নিয়ে গাইতো। আমি একবার গর্ব করে বলেছিলাম ওদের প্রেস ক্লাবকে। আমাকে বলেছিল কত দিতে হবে আপনাকে, চিঠি লিখেছিল। আমি বলেছি, আমাদেরকে দিতে হয় না। বাংলাদেশের লোক পয়সা নিয়ে গান গায় না। ওরা নিশ্চয়ই আমার উপরে চটেছে। তার পরেই দেখলাম এখান থেকে গিয়ে গিয়ে পয়সা নিয়ে গায়, এখানেও পয়সা নেয়। এরকম প্রবণতাটা এসেছে ওখান থেকে। পয়সা না নিলে অনেকে বলে, আমরা খাবো কী, আমাদেরও তো চলতে হবে?
বেবী: আমাদের অনেক নতুন নতুন শিল্পী আসছে। অনেকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে শিখে আসছে। আপনাদের এখানেও শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। নতুন শিল্পীদের প্রতি আপনার অনুভূতিটা কী?
সন্ জীদা: নতুন শিল্পীদের মধ্যে একজন যেমন লাইসা আহমেদ লিসা, রাজশাহীতেই গান শিখেছে। ও ভালো গান গাইছে ।
বেবী: সুমা শান্তিনিকেতনে শিখেছে।
সন্ জীদা: সুমাও বেশ ভালো গান শিখেছে। গাইতেও পারে ভালো। কিন্তু আজকাল আমরা দেখছি শান্তিনিকেতনে শেখানোর মধ্যে একটা ভেজাল ঢুকে গেছে। এ ভেজালটা কী রকম—যারা ওখানে গান গায় তাদের কেউ কেউ আড়ি দিয়ে গান গায়, ঠিক ছন্দে ছন্দে না গেয়ে, মাত্রায় মাত্রায় না গেয়ে আড়ি দেয়। তালটা চলে গেল, তারপরে ধরলো। কাত করে ধরলো আর কি! এই জিনিশটা ওদিকে এখন শেখানো হচ্ছে। সুমার গানে সেটা শুনেছি। এটা অনেকের গানে আছে। এমন কি মিতা যাদের গান শেখায় এখানে, মিতার কাছে শিখলো ঠিকই, আসলে রেকর্ড বা সিডি শোনে ওখানকার—এখন অনুসরণ করে। এটা নিয়ে আমার খুব কষ্ট হয়। ওরা ভাবের দিকে যায় না, কেতা কায়দার দিকে যায়। আর বাজনা সবচেয়ে খারাপ লাগে। এই যে রেকর্ডে আমার নিজের বোধহয় গোটা দুই সিডি আছে। কোলকাতায় গিয়ে রেকর্ডিং করেছি এবং এমন বাজনা বাজিয়েছে! আমাকে বলেছে যে, দিদি যা মিউজিক করেছি ওখানে গিয়ে, শোনাবেন সবাইকে। এইবারে ভয়েজটা দিন। ওদের কাছে মিউজিকটাই আগে ভয়েজটা পরে। এই ট্রেন্ড চলছে। এটা খুব খারাপ লাগে আমার কাছে।
বেবী: আপা আর একটা কথা আপনার কাছে জানতে চাই যে, আমাদের এখানে রবীন্দ্র সংগীতের যে চর্চা হয়, শিল্পীরা যারা উঠে আসছে তারা চর্চার দিকে না গিয়ে গান গাওয়ার প্রতি ঝোঁকটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ৫
সন্ জীদা: এটা হয় বিশেষ করে বাইরে। আর ছায়ানটে এটা নিয়ে আমরা বকাবকি করি সারাক্ষণ। তোমরা আগে শিখবে, শিল্পী হওয়া পরের কথা—এটাই আমরা বলি। কাজেই এটা নিয়ে খুবই কড়াকড়ি করি।
বেবী: আর এখানে যে সব সিডি বের হচ্ছে, ঐ সিডি বের হওয়া সম্পর্কে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি?
সন্ জীদা: আমি একটা কথা বলি, বিশেষ একটা ছেলে তার নাম আমি করতে চাই না। এরা যা করেছে, কী-বোর্ড আর কী একটা যন্ত্র নিয়ে কতগুলো মিউজিক করে ফেলেছে এবং সেই মিউজিকের সাথে গান গাইতে দেয় ভালো শিল্পীদেরকেও এবং তারাও রেকর্ড করতে পেরে মহা খুশি হয়ে যায়। যেটা অত্যন্ত বাজে হয়। কী-বোর্ডের সুরের মধ্যে একটুখানি ঘাটতি আছে। সেই সুরটার সাথে গান গাওয়া, ওটা ভালো হচ্ছে না এবং যে রেকর্ড করছে সে রেকর্ড করে ৭০ হাজার টাকা নিচ্ছে। একই মিউজিক দিয়ে সবাইকে গান গাওয়াচ্ছে, এই সমস্ত চলছে।
বেবী: আপনি তো অনেকের গান শুনেছেন, আপনার প্রিয় শিল্পী কে?
সন্ জীদা: আমার প্রিয় শিল্পী ভাবের গভীরতার দিক দিয়ে নীলিমা সেন। আর সাংগীতিক গুণে, ভাবের গভীরতাও আছে কণিকা বন্দোপ্যাধায় আর সুচিত্রা মিত্রের কিছু দেশাত্মবোধক গান আমার খুবই ভালো লেগেছে অল্প বয়সে। সুবিনয় রায়ের গানো ভালো লাগে এবং তিনি চমৎকার গেয়েছেন। দেবব্রত বিশ্বাসের কিছু কিছু গানও বেশ ভালো, আর কার নাম বলবো জানি না।
বেবী: আমি আজ সকলে শুনলাম কে. এল. সায়গলের একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত।
সন্ জীদা: কে. এল. সায়গলরা তো হচ্ছে দলছুট মানে ঠিক এখানকার না। কে. এল. সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক এরা তো রবীন্দ্র সংগীত শিখে শিখে গেয়েছেন।
বেবী: আর একটা বিষয় আপনার কাছে জানতে চাই যে, সামনে তো দেড়শ বছর হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথ তো আরও অনেক দিন আমাদের মধ্যে থাকবেন। রবীন্দ্র সংগীত আমাদের অনেক দিন প্রজ্জ্বলিত করবে। তো রবীন্দ্রনাথের এই দেড়শত বছর জন্মদিনে আপনার কোনো চিন্তা।
সন্ জীদা: দেড়শত বছর জন্ম দিনে ছায়ানট যেটা চিন্তা করেছে, কিছু দিন আগেই সভা হলো। আমরা মনে করেছি আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে সমস্ত যে প্রতিষ্ঠান আছে তাদেরকে নিয়ে আমরা বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করবো। তাসের দেশ একটা নৃত্যনাট্য হবে। আরো কিছু হবে বলে আশা করছি। এগুলো আমরা করছি যেখানে নানা রকমের গান হবে। আর এর ভেতর দিয়ে তাসের দেশটা করলে আমরা শুধু ঢাকায় করবো না, ঢাকার বাইরে গিয়েও করবো। বাইরের মানুষ কিন্তু সংস্কৃতির ব্যাপারে খুবই উপবাসী হয়ে থাকে। তাদের জন্য এগুলো দিতে চাই। দেখা যাক, কি হয় আবৃত্তি থাকবে, গান থাকবে,পাঠ থাকবে। অনেক রকমের জিনিশই থাকবে কেমন করে কতটা কি করতে পারি তার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বেবী: আপা আপনি তো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। সেই পাঁচ বছর বয়সে প্রথম গান শোনেন এবং শিখতে থাকেন, এই দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা—সেই অভিজ্ঞতা থেকে আপনি কিছু বলেন।
সন্ জীদা: এ তো অনেক লম্বা অভিজ্ঞতা। গান আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, জীবন তো বড় সহজ জায়গা নয়। নানা আঘাত, নানা রকমের বিশৃঙ্খলা-বিপর্যয় ঘটে যায়। আমি তো গান নিয়ে বেঁচে আসলাম এবং গান যখন শুনি সব ভুলে যাই। এই কদিন আগে মঞ্চে বসে পহেলা বৈশাখের গান শুনছিলাম, অনেকক্ষণ পরে আমার খেয়াল হয়েছে যে আমাকে কিছু বলতে হবে। কী বলবো, সেগুলো অবশ্য গুছানো থাকে। কিন্তু আমি তখন চমকে উঠেছি কারণ গান শুনতে শুনতে আমি এত মগ্ন হয়ে গেছি, এই জিনিসটা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে এবং এইটাই আমার পাওনা। তবে আমি সব গান যে শুনতে পারি, সব গান যে শুনে খুশি হই এমন কথা বলতে পারবো না। আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে ।
বেবী: আপনার পছন্দসই গান।
সন্জীদা: পছন্দসই ধরনের গাইতে হবে তো, ঐ আড়ি সহ্য করতে পারি না। উচ্চারণের একটা কি রকম থাকে। গানে আন্তরিকতা না থাকলে সে গান আমি নিতে পারি না।
বেবী: আপা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বিডিনিউজ-এর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ আপনার কাছে যে আপনি আমদের সময় দিয়েছেন।
—
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: বেবী মওদুদ
সন্জীদা খাতুন (জন্ম. ৪/৪/১৯৩৩) ছবি. মুস্তাফিজ মামুন
বেবী মওদুদ: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পক্ষ থেকে আমরা আজ এসেছি আমাদের দেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী সন্জীদা খাতুনের বাসায়। আগামী ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। সামনে তাঁর দেড়শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কত কাছের মানুষ, বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত যেন একটা প্রাণের উদ্দীপনা এনে দেয় আমাদের কাছে। দেশকে, প্রকৃতিকে, মানব প্রেম, সব কিছুকে আমরা তখন উপলব্ধি করতে পারি। এই রবীন্দ্র সংগীতের মধ্য দিয়ে সন্জীদা খাতুন দীর্ঘদিন জীবনযাপন করেছেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে রবীন্দ্র সংগীত শিখছেন ও শুনছেন। তারপর তো ধীরে ধীরে গাইতে শিখলেন, সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগীতের শিক্ষকও ছিলেন। ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করেছেন। ছায়ানটের মাধ্যমে আজ সারা দেশে রবীন্দ্র সংগীতের যে চর্চা, শিক্ষা ও বিকাশ ঘটছে তা আমদেরকে একটি বিশেষ মাত্রা এনে দেয়। আমরা আজ সন্জীদা খাতুনের কাছে থেকে শুনবো তাঁর শেখার কথা, তাঁর বড় হয়ে ওঠার কথা, তাঁর শিল্পী হওয়ার কথা। তিনি যে ছায়ানটের মাধ্যমে কাজ করছেন সারা দেশে, আমরা সেইসব কথাও শুনবো আজ তাঁর কাছে।
[প্রশ্ন] ষাটের দশকে আপনারা সারা দেশে ঘুরে ঘুরে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী খুঁজে বেড়িয়েছেন। আপনাদের সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছিল?
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ১
সন্জীদা খাতুন: ছায়ানটের জন্ম হয়েছিল ১৯৬১ সালে, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে। আর এই ছায়ানট থেকে আমরা বিদ্যায়তন করে চেষ্টা করছি যে নতুন নতুন শিল্পী তৈরি করবো। আমাদের বিদ্যায়তনে যারা ভর্তি হয়েছে তার মধ্য থেকে দেখা যায় এখনও অনেকেই শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আমরা হিসেব করে দেখেছি অন্তত ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী এ পর্যন্ত ছায়ানটে ভর্তি হয়েছে এবং গেছে। সবাই যে পাশ করে গেছে তা নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে তারা পাশ করেছে কেউ। কেউ কেউ হয়তো ছেড়ে গেছে। তিন বছর শিখেছে, দুই বছর শিখেছে, এরকম হয়েছে। আমরা এভাবে শিল্পী তৈরির কাজে ছিলাম। আর ছায়ানটের মূল যে উদ্দেশ্যটা ছিল সেটা হচ্ছে ছায়ানট চেয়েছিল বাঙালিকে তার সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করতে। ছায়ানটের জন্মই হয়েছে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান আমলে যখন অস্বীকার করা হচ্ছে তখন আমরা রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে কাজ শুরু করেছি। আর রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করার কারণ হলো তার চারপাশে অন্যান্য যারা রয়েছেন, গীতস্রষ্টা, সংস্কৃতিকর্মী, সংস্কৃতিসেবী, শিল্পী, সবাই… রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাদের মধ্যমণি হয়ে আছেন। এই জন্য আমরা রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করেছিলাম। আমরা বাঙালী সংস্কৃতির উজ্জীবনের কথা ভেবেছি। আমরা ‘শ্রোতার আসর’ বলে একটা আসর করতাম। যাতে ঘরোয়া আসর হতো, কখনো রবীন্দ্র সংগীত, কখনো নজরুলের গান, কখনো রাগ সংগীত, কখনো যন্ত্র সংগীত নানান কিছু হতো। এইগুলোর ভেতর দিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি যেন লোকে ঐতিহ্য সচেতন হয়। দ্বিজেন্দ্রলালের গান, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ আর নজরুল সবার গান আমরা সেই সময় পরিবেশন করবার চেষ্টা করেছি। কিছু দিনের মধ্যেই যখন বুঝলাম যে এভাবে হবে না, রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী সেরকম নেই, গুটিকয়েক মাত্র আছে, তখন আমরা সংগীত বিদ্যায়তন খুললাম ১৯৬৩ সালে। তারপরে দিনের পর দিন গানের শিক্ষা চলেছে, সোহরাব ভাই নজরুল গীতি শিখিয়েছেন।
—————————————————————–
ছায়ানটের মূল সাধনাটা বাঙালী হবার এবং চতুর্দিকে আমাদের যারা রয়েছেন, আমাদের সমাজের, আমাদের দেশের সবাইকে খাঁটি বাঙালি করে তোলা।… রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী, নজরুলের মৃত্যুর পর মৃত্যুবার্ষিকী এগুলো আমরা করেছি। এখন তো শুরু হয়েছে নানা উৎসব। যেটা আমরা প্রথমে করেছিলাম লোক উৎসব। তারপরে হয়েছে শুদ্ধ সংগীতের উৎসব, তারপরে হয়েছে নজরুলের গানের উৎসব, তারপরে রবীন্দ্র উৎসব। এই উৎসবগুলোর পরে আমাদের ইচ্ছা আছে আমরা নৃত্য উৎসবে যাবো।
—————————————————————-
বেবী: সব ধরনের গান আপনারা শেখাতেন?
সন্জীদা: হ্যাঁ সব ধরনের গানই শেখানো শুরু হয়। প্রধানতঃ রবীন্দ্র সংগীত; আর নজরুল গীতি, শুদ্ধ সংগীত আরম্ভ হয়েছিল… পরে হয়, সেটা হলো বেশ পরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। পল্লীগীতি বিভাগটা খুলি, নৃত্য ছিল, সেতার, তবলা এই সব জিনিসগুলো ছিল সে সময়। যাই হোক, আমাদের বড় যে কাজটি সেটা হচ্ছে ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার জন্য মিলনস্থান তৈরি করা। কিছু কিছু এমন অনুষ্ঠান করা যেখানে সবাই এসে মিলতে পারে। প্রথম অনুষ্ঠান হয়েছিল বসন্ত উৎসব, শারদীয় উৎসব, তার পরে বর্ষার গান হয়েছে। পহেলা বৈশাখ, এই যে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পহেলা বৈশাখ—এ হচ্ছে ছায়ানটের সবচেয়ে বড় কাজ, আমরা বলতে পারি। কারণ এই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূল যেটাকে আমরা বলি, সেখানে আমরা যেটা করতে চেয়েছিলাম যে মানুষ আসুক। মানুষ এসে বাঙালি হিসাবে সম্মিলিত হউক। তাদের এই প্রীতি সম্মেলনের ভেতর দিয়ে ঐতিহ্যপ্রীতি জাগ্রত হউক। এই জিনিসগুলোর জন্য আমরা পহেলা বৈশাখ শুরু করি। যাই হোক, তো ছায়ানট এভাবে দীর্ঘ দিন চললো। তার পরে যখন দেশে আন্দোলন চলছে তখন আমরা গণসংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলাম। শেখ লুৎফর রহমান সাহেব এসে প্রধানত গণসংগীত শেখাতেন। আলতাফ মাহমুদকে ধরে আনতাম কখনও কখনও। গণসংগীতগুলো এভাবে শিখেছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। আন্দোলনের সময় এসব গান তারা গেয়েছিল শহীদ মিনারে। ব্রতচারী আন্দোলনের যে গানগুলো, “মানুষ হ, মানুষ হ আবার তোরা মানুষ হ”—এসব গান গাওয়া হতো। বিশেষ করে বলা আছে ‘অনুকরণ খোলস ভেঙে কায়মনে বাঙালী হও।’
ছায়ানটের মূল সাধনাটা বাঙালী হবার এবং চতুর্দিকে আমাদের যারা রয়েছেন, আমাদের সমাজের, আমাদের দেশের সবাইকে খাঁটি বাঙালি করে তোলা। এইভাবেই আমরা অগ্রসর হয়েছি। এবং দেখা যায় যে ১৯৭১ সালে আমরা পহেলা বৈশাখ করতে পারিনি বটমূলে। কিন্তু তার পরেই আবার যখন দেশ স্বাধীন হলো, আমাদের শুরু হলো পহেলা বৈশাখ… ঠিক মতো হয়ে গেছে। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী, নজরুলের মৃত্যুর পর মৃত্যুবার্ষিকী এগুলো আমরা করেছি। এখন তো শুরু হয়েছে নানা উৎসব। যেটা আমরা প্রথমে করেছিলাম লোক উৎসব। তারপরে হয়েছে শুদ্ধ সংগীতের উৎসব, তারপরে হয়েছে নজরুলের গানের উৎসব, তারপরে রবীন্দ্র উৎসব। এই উৎসবগুলোর পরে আমাদের ইচ্ছা আছে আমরা নৃত্য উৎসবে যাবো।
ছায়ানটের নিজস্ব ভবন হবার পরে সর্বসাধারণের অর্থে এটার নির্মাণ কাজ হয়েছিল; এটা একটা মস্তবড় ঘটনা। আমরা ভাবতে পারিনি যে মানুষ আমাদের কত ভালোবাসে। মানুষ ছায়ানটের সূত্রে সংস্কৃতির চর্চার দিকে কতটা আগ্রহী এইটা দেখতে পেয়েছি যখন তারা এসে আমাদের দিনের পর দিন অর্থ দিয়ে গেল। শিল্পীরা আমাদের জন্য গান গাইলেন, নৃত্য শিল্পীরা নাচলেন, আবৃত্তি শিল্পীরা আবৃত্তি করলেন, নাট্য শিল্পীরা নাটক করলেন এইভাবে এমনকি ছোট পত্রিকা যাদেরকে বলে মিনি পত্রিকার বিক্রয়লব্ধ পুরো টাকাটা ছায়ানটকে দিয়েছে। এই ভাবে আমরা ভবন করলাম।
এই ভবনটা হওয়ার পর আমাদের কার্যক্রম খুব বেশি বেড়ে গেছে। এখন আমরা আমাদের গানের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের… মানে বুধবারে ছাড়া সব দিন ক্লাস হচ্ছে; চার হাজারের উপরে শিক্ষার্থী। প্রধান শিক্ষাটা বৃহস্পতি, শুক্র, শনি এবং অন্যান্য দিন ছড়ানো থাকে। ‘সংগীত পরিচয়’ নামে একটা শিক্ষা আর ‘সংগীত সূচনা’র দু’ বছরের কোর্স করছি আমরা ১৪১৮ সাল থেকে। দু বছর পার হলে যারা খুব ভালো করবে তাদেরই শুধু উপরের ক্লাসে নেবো। সেখানে গিয়ে এরা চার বছর গান শিখে ‘সংগীত প্রবেশ’ অভিজ্ঞানপত্র পাবে। আমাদের এখানে এখন ‘শিকড়’ নামে একটি কাজ চলছে। ‘শিকড়ে’ যে ক্লাস হয় সে ক্লাসে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরাই আসে। তারা সবাই বাঙালী রীতিনীতিগুলো শেখে, ব্রতচারী শেখে। তারপরে ‘আটকড়াই’ নামে গ্রামের দিকে প্রচলিত ‘কড়াই ভাজা’ খাওয়া নামে একটি দিন আছে। আট রকমের কড়াই ভাজা ওরা খায়, সেই আটটি শস্যের নাম তারা জানে। তারা গান শেখে, ছবি আঁকে ও শরীরচর্চার নানা কিছু করে এবং তার সঙ্গে ভাষাও শেখে। আর এখন তো ‘শিকড়’… আমরা ‘ভাষার আলাপ’ নামে আর একটি নতুন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছি। এটা খুব শীঘ্রই চালাবো, আষাঢ় মাসে। সব তৈরি হয়ে গেছে। পাঠ্ক্রম কারা শেখাবেন সব তৈরি হয়েছে। সেখানে ‘ভাষার আলাপ’ বলতে পরস্পর বিনিময়ের ভেতর দিয়ে ভাষা নিয়ে আলাপ। তবে প্রত্যেক ক্লাসের আলোচ্য সূচি থাকবে, আলোচ্য বিষয় থাকবে। কখনও হয়তো আমরা উচ্চারণ নিয়ে আলাপ করবো, কখনও আমরা ভাষার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবো। যেমন বানান নিয়ে, বাক্যগঠন নিয়ে, আর উচ্চারণের পরে যেটা আসবে—পাঠের ভেতর দিয়ে আমরা যাব বাচনভঙ্গিতে। এই পাঠগুলো হবে কিন্তু সাহিত্যের পাঠ। তার ফলে হবে কী, একই সঙ্গে সাহিত্যের দিকেও সবার মনটা যাবে। সু-সাহিত্য যাকে বলা যায়। এইভাবে আমরা মোটামুটি পাঠ্ক্রমটা তৈরি করেছি।
আমাদের এখানে আরো একটি ক্লাস হয় সেটি হচ্ছে অটিস্টিক শিশুদের। এটা বেশ ছোট্ট থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত আছে। এদের শিক্ষা কার্যক্রমের নাম হচ্ছে ‘সুরের জাদু, রং এর জাদু’। সুর আর রং নিয়ে তাদের কাজ এবং এখন আবার ব্রতচারী নৃত্যকেও তাতে দেওয়া হয়েছে। এদের গান শেখানো হয়, এদের ছবি আঁকানো হয়। এদের এখন ব্রতচারীও শেখানো হবে। একটু অঙ্গচালনা… কারণ অটিস্টিক শিশুদের স্নায়বিক সমন্বয়টা হয় না বলেই তাদের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে, কীভাবে তাদের সাহায্য করতে পারি। এটি বলা যেতে পারে যে এতে আমাদের কোনো টাকা আসে না, আমরা বরং ভর্তুকি দেই। কিন্তু আমরা মনে করি দেশের অটিস্টিক শিশুদের দিকে লক্ষ্য রেখে এ রকম কাজ আমাদের করা উচিত।
বেবী: আপানাদের প্রতিষ্ঠানটি আমাদের দেশে যে সব কাজ করে যাচ্ছে, আপনি কি মনে করেন যে এগুলোর জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বা আর্থিক বা অন্যান্য সহযোগিতা থাকা উচিত।
সন্জীদা: স্বাধীনতার পরে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন, নিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল প্রথমবার দেওয়া হলো ৪০ হাজার, তার পরে ৩৫ হাজার, তার পরে ২৫ হাজার, তার পরে কমতে থাকল এবং তার পরে বলা হলো ১০ হাজার টাকা। তখন সুফিয়া খালাম্মাকে (কবি সুফিয়া কামাল) বললাম, বলুন খালাম্মা কী করি? আমার তো ইচ্ছে নেই এরকম সাহায্য নেওয়া। খালাম্মা বললেন, ওদেরকে লিখে দাও যে ‘এ অর্থ গ্রহণে আমরা অপারগ’। এই কথাটি লিখে আমরা নেওয়া বন্ধ করে দেই এবং আমরা মনে করি সরকারের কাছে হাত পাতলে তা যে কোনো সরকার আসুক তার সঙ্গে চলতে হয়। আমরা এতে রাজি না। আমাদের নিজের একটা স্বাধীন সত্তা আমরা রাখতে চাই। আমরা চাই বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাটা যেন নিজেদের মতো করতে পারি। এখন তো আমাদের ছাত্র-ছাত্রী সূত্রে কিছুটা আয় হয়। তাতে আমাদের কিন্তু ভালই চলতে পারার কথা, কেবল এখনও ঠিকাদারের টাকা শোধ হয়নি। নির্মাণের কাজ এমনি যে, বাইরেটা হয়েছে। আমাদের যে মিলনায়তন তার মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা, বাতির ব্যবস্থা আর সাজঘরের ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ বাকি রয়েছে। সেগুলো করার সাধ্য আমাদের এখন নেই।
বেবী: আপা আপনার কাছে অনেক কথা শুনলাম…
সন্জীদা: আর একটি কাজের কথা বলি, ছায়ানটে আমরা কিন্তু সংস্কৃতিকে সার্বিকভাবে নিয়েছি, যার জন্যে আমরা একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকাও বের করছি। সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক এই ত্রৈমাসিক পত্রিকাটাও আমাদের খুব কষ্টের ধন, আমরা এটা করে যাচ্ছি। যাই হোক, বলো।
বেবী: তো আপা, একটা বিষয় আপনার কাছে জানতে চাই, আপনারাদের এখানে রবীন্দ্র সংগীতটাই বেশি প্রাধান্য পায়…।
সন্জীদা: না এটা খুব ভুল ধারণা, ঐ যে বললাম নজরুল গীতির সোহরাব ভাইকে নিয়ে স্কুল খুলেছি।
বেবী: আপনি কি মনে করেন যে রবীন্দ্র সংগীত শেখাচ্ছেন, নজরুল সংগীত শেখাচ্ছেন, পল্লীগীতি শিখাচ্ছেন, এই শিক্ষার সাথে সাথে সাহিত্যের সাথেও একটা পরিচয় থাকা উচিত?
…..
ছবি. মুস্তাফিজ মামুন
…….
সন্জীদা: স্কুলে সেটা আমরা ওইভাবে করতে পারছি না বলে ‘ভাষার আলাপ’-এ সে ইচ্ছা আছে। মানে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত শেখার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য শেখানোর সুযোগটা আমাদের খুব কম। আমি যেটা করতে চেষ্টা করছি, এখন শিশুদের ক্লাসে যে গানগুলো শেখে সেগুলো আবৃত্তি করাই। এগুলো আবৃত্তির জন্য আবৃত্তির লোক আসে, এসে আবৃত্তি করে ওদেরকে শেখায়, তাতে একটা কাজ হয়। আর আমরা যে বড় একটা কাজ করছি, সেটাই তো বলি নাই। সেটা হচ্ছে নালন্দা বিদ্যালয়। শিশুদের একটা বিদ্যালয়, এখন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আছে। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকদেরকে আমরা সাহিত্য পড়াই এবং আমি বাংলা পড়াই। আর একজন ইংরেজি পড়াচ্ছে। আর একজন বিজ্ঞান পড়াচ্ছে, আর একজন অংক নিয়ে আছেন। এইভাবে শিক্ষকরা সমৃদ্ধ হচ্ছে যাতে শিশুদেরকে তারা সমৃদ্ধ করতে পারেন। এই ‘নালন্দা’ কথাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর গানের সঙ্গে সাহিত্যের পাঠ দেওয়াটা খুব কঠিন, উঁচু ক্লাসে আমরা চেষ্টা করি গানের বাণীকে বিশ্লেষণ করে তার পটভূমির কথা বলতে।
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ২
বেবী: একজন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীর কাছে সাহিত্য পড়াটাও জরুরী।
সন্জীদা: কিন্তু স্কুলের মতো কার্যক্রমে করা কঠিন, সেটা আমরা হয়তো বলতে পারি যে, এই এই বই তোমাদের পড়তে হবে—এই পর্যন্ত। সঙ্গীত তত্ত্ব পড়ানো হয়, নানা কিছু আছে, আর এদের উঁচু ক্লাসে আমরা যেটা করি, গানের বিশ্লেষণ করে দেই। গানের তাৎপর্য ব্যাখ্যা বা কী প্রেক্ষিতে এটা লেখা হয়েছে সেটা বলা—এইগুলো করেছি।
বেবী: রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পী হতে হলে কণ্ঠটা তো খুব জরুরি…
সন্জীদা: আসলে যে কোনো কণ্ঠই তার জন্য যথার্থ কণ্ঠস্বর। শিক্ষা নিয়ে সেই কণ্ঠটা বের করতে পারলে সব গানই তাতে হবে। আমার একটি ছাত্রের কথা আমি বলবো। তার নাম সুমন চৌধুরী। ও নজরুল গীতি শিখেছে, কিন্তু আমি ওকে ধরে কিছু রবীন্দ্র সংগীত শেখাই। যেমনি চমৎকার সে রবীন্দ্র সংগীত গায়, তেমনি চমৎকার সে নজরুল গীতি গায়। দুটি যখন গাইছে দুটোর স্টাইল আলাদা। এরকম কোনো কথা নেই কিন্তু যে এরা ওটা গাইতে পারবে না, আর ওরা এটা গাইতে পারবে না। তবে আমাদের কথা বলতে গেলে একটু মুশকিল আছে। আমরা এত দিন ধরে রবীন্দ্র সংগীত গাইছি, এখন নজরুল গীতি গাইলে কেউ কেউ বলে, ওতো রবীন্দ্র সংগীতের মতো শোনাচ্ছে। এটা আমাদের ক্ষেত্রে বলে। কিন্তু ছোট থেকে আমাদের শিশুরা কিন্তু সব কিছু শেখে, আস্তে আস্তে ওপরে উঠে থার্ড ইয়ার থেকে আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে সরে যায়। এ রকম একটা আছে, যার যেটা পছন্দ, যে যেটা পারে এভাবে করিয়ে দেওয়া হয়।
বেবী: আপা আপনি তো নিজেও সংগীত শিল্পী ছিলেন, শিক্ষকতা করেছেন, এখন কোথায় কাজ করে আপনি সন্তুষ্ট।
সন্জীদা: আমার শিক্ষকতা অত্যন্ত প্রিয় কাজ। আমি এখনও ‘নালন্দা’য় পড়িয়ে সে আনন্দটা পাই। ‘কণ্ঠশীলন’ বলে একটি আবৃত্তি প্রতিষ্ঠান আছে তাদের গিয়েও অনেক সময় পড়িয়েছি। আমি পড়িয়ে আনন্দ পাই। পড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু শুধু তাই না, আমার গান গাওয়ার খুবই নেশা ছিল। গান ছাড়া থাকতে পারতাম না। এখন তো এই ৭৭ বছর বয়সে গান আর গাইতে পারি না।
বেবী: আপনি সংগীত শিখলেন কীভাবে, কার কাছে শিখেছেন?
সন্জীদা: আমি পাঁচ বছর বয়সে যখন গান শিখেছি প্রথম, তখন শোনা-টোনা—মানে বড়দি গান করছেন, সেজো চাচি গান করছেন বা বাবা (ড. কাজী মোতাহার হোসেন) বারান্দায় পায়চারী করতে করতে গান করছেন, এগুলোই আমার সব স্মৃতি। বড়দির গান খুব শুনতে ভালোবাসতাম। বড়দি বারান্দায় বসে মাদুর পেতে গান গাইতেন, আমি সামনে গিয়ে শুয়ে শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে যেতাম। তখন থেকে এভাবে গান শুনি। আমাদের বাড়িতে খুব অল্প বয়সে আমরা রেডিও পেয়েছি। যুদ্ধের সময় বাবা রেডিও কিনেছিলেন। এই রেডিওতে গান শুনেছি। তাছাড়া গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল, বাজানো হতো। অনেক আগে সেই যে বক্স গ্রামোফোন ছিল, চাবি দিতে হতো, কলের গান যাকে বলতো, তাতে রেকর্ড বাজানো হতো। কাজেই গানের পরিবেশটা আমাদের ছিল আর বড়দি গান শিখতেন। বড়দির ওস্তাদের কাছে একদিন আমার হাতেখড়ি হয়ে গেল। সেই একটা গান মানে রাগ সংগীত, কিছু একটা ইমনের ওপর। আমি কিছু শিখলাম একটা। এইভাবে গান শুরু হয়েছে। তার পরে শিক্ষক থেকে শুধু উনি না আমি কার কার কাছে শিখেছি বলতে গেলে বলতে হবে, এর পরে খগেন চক্রবর্তী নামে একজন শিক্ষক… আসলে নাট্য শিল্পী। তার ভাইয়ের নাম ছিল গিরিণ চক্রবর্তী। ভালো পল্লীগীতি গাইতেন, রেকর্ড-টেকর্ড আছে। এই খগেন চক্রবর্তী আমার ঠিক ওপরের বোনকে গান শেখাতেন। আর আমি সারাক্ষণ পাশে বসে গানগুলো শিখে ফেলতাম। উনি চলে গেলে আমার বোন লাফ দিয়ে উঠে চলে যেত, আর আমি বসে বসে হারমোনিয়াম টিপে টিপে গানগুলো তুলতাম, আমার এত আগ্রহ ছিল গানে। আর গান না শুনে গান না গেয়ে একদম থাকতে পারতাম না। সারাক্ষণ খালি গলায় চিৎকার করে করে গান গাইতাম। গান গাইতে ভালো বেসেছি, গান শেখাতেও ভালো লেগেছে, যতদিন শেখাতে পেরেছি।
বেবী: আপনি তো অনেক দিন গান গেয়েছেন।
সন্জীদা: গান গেয়েছি আজ থেকে অন্তত ১৮ বছর আগেও। এমন কি মাঝে মাঝে এমন ঘটেছে কলকাতায় গিয়েছি কোনো একটা কাজে, বললো সংবর্ধনা দেব। আর কলকাতার সংবর্ধনা মানে যে গান গাওয়া তখনও বুঝি নাই। জামসেদপুরে নিয়ে গেল সংবর্ধনা দিল, সবই হলো। বললো, এবার একটা গান করুন। আট খানা গান গাই।
বেবী: আপা, আপনার তো রবীন্দ্র সংগীত প্রিয় ছিল।
সন্জীদা: রবীন্দ্র সংগীত আমার প্রিয় গান হলে কী হবে, আমাকে যারা শিখিয়েছে তারা অনেকেই রাগ সংগীতের লোক। তারপরে সোহরাব হোসেন সাহেবের কাছে আমি তিন বছর গান শিখেছি এবং তখন শুধু নজরুল গীতি না আধুনিক, পল্লীগীতি, নজরুল গীতি সবই গাইতাম। আমিও শিখতাম সবকিছু। তিন বছর শিখে ওঁর গান ফুরিয়ে ফেলি। তারপরে উনি আমাকে বলেন, আমি তোমাকে আর শেখাবো না। তারপরে যেটা হলো, সাহিত্য পড়তে গিয়ে বাংলা সাহিত্য ও কবিতা পড়ে রবীন্দ্র সংগীত শিখবার ঝোঁক হলো। তখন আমি ওই সেগুনবাগিচা থেকে প্রেসক্লাব এসে, (বাসে চড়ে, তখনকার টাউন সার্ভিস বাস, যাকে ‘মুড়ির টিন’ বলা হতো) সেই আজিমপুরে হুসনা বানু খানম ছিলেন, তার কাছে গিয়ে গান শিখতাম। তিনি যে স্বরলিপি দেখে দেখে শেখাতেন আমার খুব ভালো লাগতো। একসময় আমার প্রয়োজনে আমার জানা গান স্বরলিপি দেখে দেখে তুললাম, তুলে তুলে আমি স্বরলিপি তোলা শিখে ফেললাম। এই করে আমার নিজে নিজে রবীন্দ্র সংগীত চর্চা শুরু। আসলে আমি একভাবে বলি, আমি কিন্তু সু-শিক্ষিত না, রবীন্দ্র সংগীতে আমি স্ব-শিক্ষিত। এই হলো ব্যাপারটা। তবে নানা ধরনের গান আমি টেলিভিশনেও গেয়েছি। কিন্তু প্রথমে নজরুল গীতি গেয়েছি। নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত এক সঙ্গে তখন দুবার দুটো বৈঠকে গান গাইতে হতো। প্রথমে নজরুল গীতি গাইলাম, তারপর রবীন্দ্র সংগীত গাইলাম, এই সব করেছি। রেডিওতেও আরম্ভ করেছি আধুনিক গান গেয়ে, তার থেকে চলে এসেছি রবীন্দ্র সংগীতে—এই রকম।
বেবী: আমি জানতে চাচ্ছিলাম আপনারা যখন শিখেছিলেন বা গাইছিলেন শুরুর দিকে, তখন তো এদেশের মেয়েদের সংগীত শেখানোর খুব একটা প্রচলন ছিল না এবং মেয়েরা সুযোগও পায়নি। আপনাদের পরিবার তো একটা সংস্কৃতি মানের পরিবার ছিল, তো আপনারা কীভাবে ঘরে এবং বাইরে… কোনো বাধার সম্মুখীন তো কখনো হননি?
সন্জীদা: তখন হইনি। তখন অল্প বয়সে চারপাশে হিন্দু পরিবার ছিল অনেক। সব বাড়িতেই গান হতো। আমাদের এই বাড়িতে গান হতো এবং সেটা নিয়ে কখনও কথা ওঠেনি। উঠেছিল যখন আমরা ফজলুল হক হলে থাকি। আমার বাবা হাউজ টিউটর ছিলেন। ওই যে বলছিলাম না যে সারাক্ষণ খুব চেঁচিয়ে গান গাইতাম আর গলা সাধতাম। ছাত্ররা আমার বাবার কাছে নালিশ দিত যে সারাক্ষণ “আ..” “আ..” করে, আমরা পড়তে পারি না। এইটা নিয়ে বাবার খুব কষ্ট হলো, কিন্তু বাবা আমাকে কিছু বলতে পারলেন না। কেমন করে বলবেন যে, তুই গান করবি না। এটা তো বলতে পারেন না। আর মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা গান গাইতে বসলে হল থেকে চিৎকার করতো “আ..” “আ..” চাই না। এইগুলো হয়েছে কিছু কিছু, কিন্তু আর কোনো বাধা আমি পাইনি। আর আমার বাবা তো অত্যন্ত মুক্তমনের মানুষ ছিলেন, উনি মেয়েদের পড়াতে চেয়েছেন, গান শেখাতে চেয়েছেন। কাজেই আমাদের সে দিক থেকে বাধা হতো না।
বেবী: আপনি যখন গান গাইছিলেন বা শিখছিলেন তখন আপনার সাথে আর কে কে ছিলেন? আপনার আশেপাশে তো অনেকেই ছিলেন, যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
সন্জীদা: হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠিত যারা হয়েছে যেমন মালেকা আজিম খান একজন ছিলেন, আফসারি খানম একজন ছিলেন, কাজী শাহজাহান হাফিজ ছিলেন, সুলতান আলম ছিলেন, লায়লা আর্জুমান্দ বানু তখন রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন, ফিরোজা বেগমও রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন। অনেক ব্যাপার ছিল, তখন সবাই গাইতো। অঞ্জলী মুখোপাধ্যায় নামে একজন গাইতেন, তিনি বিয়ের পরে অঞ্জলী রায় হয়ে যান। পরে তিনি নজরুল গীতিতেই চলে গিয়েছিলেন। এ রকম অনেক ছিল। ঝুনু ভৌমিক নামে একটি মেয়ে গান গাইতো, অনিমা দাস, নিলিমা দাস, বিমল রায় এঁরা সব রেডিওর শিল্পী ছিল।
বেবী: জাহিদুর রহীম আপনার পরে আসেন?
সন্জীদা: অনেক পরে। যদিও সে মফস্বলে থাকতো। ঢাকায় যখন এলো আমাদের পাড়াতেই ওর বাবা বাড়ি কিনলেন। আমার বাবার বন্ধু ছিলেন ওর বাবা। ওকে সবাই বলতো হেমন্ত। জাহিদুর রহিম গান গাইতো বাফায়। বাফা (বুলবুল ললিতকলা একাডেমি) থেকে পাস করে—এরকম অনেক আছে—পরে ছায়ানটে চলে এসেছিল। পরিবেশটা তার ভালো লেগেছিল বলে। ছায়ানটে আসবার পরে সে ছায়ানটেই ছিল অনেক দিন পর্যন্তু। জাহিদুর রহিমের কথায় আমি আমাদের আর একটি আন্দোলনের কথা বলি, ঐ যে গিয়ে গিয়ে গান শেখানো, এটা হয় কখন? জাহিদুর রহিমের মৃত্যু হলো ১৯৭৮ সালে। তার মৃত্যুর পরে আমরা প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলাম। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে একজন ভদ্রলোক ছিল, আমি কিন্তু নাম বলবো—শামছুল হুদা চৌধুরী—জাহিদুর রহিম জানতো যে উনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিন্তু অন্য দলগুলোর সঙ্গে চলাফেরা করেছেন। সে জন্য জাহিদুর রহিম একদিন প্রেসক্লাবের সামনে তাকে ধাওয়া করেছিল রাজাকার বলে। এর আগে উনি কয়েকজনের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে রেডিওতে জাহিদুর রহিম যে চাকুরি করতো সেই চাকুরিটা নাকচ করে দেয়। এর কিছু দিন বাদেই জাহিদের হার্ট এ্যাটাক হয়। সে হাসপাতালে ছিল। ও আবার বড্ড বেশি ফোন-টোন করতো। এ সব নিয়ে হয়তো নার্সের সাথে ওর কিছু বাদানুবাদ হয়েছিল, রেগে গিয়েছিল। তখন কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠছে বাড়ি যাবে, হঠাৎ বিছানার উপরে পড়ে মরে গেল। এটাকে আমরা মনে করলাম, ঐ যে ঐ চাকুরিটা খেয়েছে যারা তাদেরই দোষ। সেই ভাবেই আমরা দেখেছি।
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ৩
আর জাহিদুর রহিমকে আমাদের বঙ্গবন্ধু তার জনসভায় নিয়ে যেতেন স্বাধীনতার আগেই, ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য। জাহিদের এই একটা সাংঘাতিক বড় অবদান, কিন্তু বঙ্গবন্ধুরও বড় অবদান যে তিনি সাধারণ মানুষের কানে সোনার বাংলা সুরটা সেই পাকিস্তান আমলেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাই হোক তো জাহিদের মৃত্যুর পরে একবছর তো শোকসভা করলাম কিন্তু জামিল চৌধুরী একজন যে টেলিভিশনের সঙ্গে ছিল, আমার বন্ধু জামিল চৌধুরী আমাকে বললো, দেখো এই কান্নাকাটি করে তো কিছু হবে না। চলো আমরা অন্য কিছু করি। আমরা একটা রবীন্দ্র সংগীত প্রতিযোগিতা করি।
রবীন্দ্র সংগীত প্রতিযোগিতা প্রথমবার যেটা হলো, সেটা ঢাকা মহানগর, ঢাকা বিভাগ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম আর খুলনা তখনকার সেই চারটি বিভাগে হলো । তার পরের বছর গেল ওরকমই, প্রতিযোগিতা হলো ঢাকায়। তারপরে আমরা নাম রেখেছিলাম প্রতিষ্ঠানটার ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’। তখন আমরা কিছু কিছু কথা শুনতে লাগলাম যে জাহিদুর রহিম এত বড় শিল্পী নয় যে সমস্ত দেশের মানুষ তাকে চেনে, আর তার নামে কেন এত বড় প্রতিষ্ঠান চলবে? বিশেষ করে কলিম শরাফীকে আমরা আহবায়ক করেছিলাম, ওঁরই আপত্তি ছিল। তখন আমরা ভাবনা চিন্তা করে দেখলাম যে ঠিকই তো বৃহত্তর পটভূমিতে এই কাজটাকে স্থাপন করতে হলে রবীন্দ্রনাথের নাম ছাড়া পথ নাই। আমরা তখন এর নাম করলাম ‘জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ’। তবে প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হত তাকে আমরা ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি ফলক’ উপহার দিতাম, এখনও দিয়ে যাচ্ছি। এই জিনিসটা করতে গিয়ে জেলায় জেলায় শাখা হলো। এখন ৬৩টি শাখা আছে ‘রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদে’র। এক বছর ঢাকায় সম্মিলন হয়, এক বছর ঢাকার বাইরে হয়। ঢাকায় যখন হয় তখন কিন্তু প্রতিযোগিতাটাও হয় এবং সম্মিলনে কী কী হয় সেটাও একটা জানবার বিষয়। আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে ঘুরে বেড়াই সারা দেশে।
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ৪
বেবী: আপা আপনি তো এখনও সারা দেশে ঘোরেন। আপনার কি মনে হয় যে রবীন্দ্র সংগীতকে আমরা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গেছি।
সন্ জীদা: অনেক নিতে পেরেছি। জয়পুর হাটের সম্মেলনে যদি যেতে দেখতে পেতে স্টেডিয়ামে রাত্রি ১২টা পর্যন্ত গান হচ্ছে। সবাই আসছে, আসছে স্রোতের মতো গ্রাম থেকে। কারও সিঁদুর পরা, কারও বিধবার সাজ, কারো বোরখা পরা। এসে সেখানে বসে, মানে মেয়েদের কথা বললাম। ছেলেরা তো আছেনই। এখানে একটা বিরাট প্রদর্শনী হয়েছিল সে প্রদর্শনী দেখেছে তারা। তারপর প্রদর্শনীতে দেশের কৃতি সন্তানদের ছবি আছে, সেগুলো দেখেছে। দেশের বলতে বাঙালি কৃতি সন্তানদের ছবি সেগুলো দেখেছে। তারা ব্যানারে বাণী লেখা ছিল, সেগুলো পড়েছে। এগুলোর ভিতর দিয়েই আমরা মানুষের কাছে যাই। এবারে যশোরে সম্মেলন হলো। যশোরে যখন সেমিনার হচ্ছে, আমরা মনে করি যে বন্ধ ঘরে বিজ্ঞ লোকেরা শুনবে। সাধারণের সামনে সেমিনার হলো, মাটিতে বসে থাকা মানুষ শুনছে, হাত তালি দিচ্ছে। কখনও খুশি হয়ে হাসছে। এই রকম অবস্থা। আমি তো বিস্মিত হয়েছি। আমি শুনেছি যে যশোরে নাকি এটা একটা ঐতিহ্য। যশোরের মানুষ নাকি এরকম সেমিনার শুনে থাকে। তা ছাড়া আমরা যেটা করি ‘রবি রশ্মি’ নামে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে বলা হয়। এইটাতে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পরিচিতিটা বাড়ে। তা ছাড়া ‘রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ’ বলে যে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান তা তো না। নজরুল, ডি.এল.রায়, অতুলপ্রসাদ সবরকম পঞ্চভাস্করের গান। এটা ঠিকই, এখানে রবীন্দ্র সংগীতটা বেশি হয়। আর তার পরে লোক সংগীত হয়, শুদ্ধ সংগীত কিংবা রাগপ্রধান গানগুলো হয়। এর ভেতর দিয়ে আমরা সার্বিক ভাবে এই জিনিসটা করছি।
আর একটা বড় কথা একজন দানশীল ব্যক্তি তিনি ঘুরে ঘুরে গান শেখানোর খুবই অনুরাগী। তিনি তো ‘ওয়াহিদুল হক সংগীত প্রব্রজ্যা’ নাম নিয়ে একটা একটা কার্যক্রম করেছেন। তার বাবা ও মায়ের নামে ফাউন্ডেশনটা। আর এই কার্যক্রম চালাতে ছায়ানটকে টাকা দিচ্ছেন। কিন্তু ছায়ানট রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন পরিষদকে এক বছরে কতজনকে শেখানো হবে, কীভাবে হবে—হিসেব দিলে সেই অনুযায়ী ওঁরা টাকা দিচ্ছেন। সম্মিলন পরিষদ থেকে গিয়ে গিয়ে শুধু রবীন্দ্র সংগীত না নজরুল গীতি, অতুল প্রসাদ সব রকমের গান শেখাচ্ছে। আমি কদিন আগে কুমিল্লায় নাদিরা বেগমকে লোক সংগীত শেখাতে নিয়ে গিয়েছি। এগুলো আমরা করেছি।
বেবী: আপা আপনি একটা জিনিশ আমাকে বলেন, শান্তিনিকেতনে যে রবীন্দ্র সংগীত শেখানো হয় বা ওখানে যারা চর্চাটা করে পশ্চিমবঙ্গে, আর আমাদের এখানে যে চর্চাটা বা শেখানোটা হয়, গান গাওয়া—এর মধ্যে কি খুব বেশি পার্থক্য আছে?
সন্ জীদা: আছে একভাবে শান্তিনিকেতন এবং কোলকাতার উচ্চারণ মানে কী বলবো, সেটা কিন্তু একটা অ্যাফেক্টেড উচ্চারণ এবং গানে ওরা খুব দক্ষ। ক্লাসিকাল শিখে-টিখে অত্যন্ত চমৎকার গায়। কিন্তু তাতে প্রাণ থাকে না। ওরাই বলে আমাদের এখানে বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীতে প্রাণ আছে। এরা রবীন্দ্র নামটা উচ্চারণ করে না, এরা গান গায় প্রাণ দিয়ে। এ কথাটা তারা বলে এবং খুব পছন্দ করে।
বেবী: আমাদের ছায়ানটে যে রবীন্দ্র সংগীত শেখানো হয় অনেকে বলে যে, শেখানোটা প্রাণখোলা না। আপনার কাছে তাই মনে হয় যে কেউ কেউ চিবিয়ে গায়?
সন্ জীদা: ছায়ানটে কেউ চিবিয়ে তো কখনো গায় না। ঐ চিবিয়ে গান-টান তো বাইরে হয়। ছায়ানটে কোনোদিন হয় নি। আমরা খোলা গান গেয়েছি, এভাবে শিখিয়েছি যে গান হচ্ছে খোলা গলায় গাইবে। তবে চিৎকার করে নয়। এইভাবে আমরা করিয়েছি।
—————————————————————–
শান্তিনিকেতন এবং কোলকাতার উচ্চারণ মানে কী বলবো, সেটা কিন্তু একটা অ্যাফেক্টেড উচ্চারণ এবং গানে ওরা খুব দক্ষ। ক্লাসিকাল শিখে-টিখে অত্যন্ত চমৎকার গায়। কিন্তু তাতে প্রাণ থাকে না। ওরাই বলে আমাদের এখানে বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীতে প্রাণ আছে। এরা রবীন্দ্র নামটা উচ্চারণ করে না, এরা গান গায় প্রাণ দিয়ে। এ কথাটা তারা বলে এবং খুব পছন্দ করে।… ছায়ানটে কেউ চিবিয়ে তো কখনো গায় না। ঐ চিবিয়ে গান-টান তো বাইরে হয়। ছায়ানটে কোনোদিন হয় নি। আমরা খোলা গান গেয়েছি, এভাবে শিখিয়েছি যে গান হচ্ছে খোলা গলায় গাইবে। তবে চিৎকার করে নয়। এইভাবে আমরা করিয়েছি।>
—————————————————————-
বেবী: গ্রামারটা শিখিয়ে গানটা ভালো করার চেষ্টা।
সন্ জীদা: ক্লাসিকাল শিখছে থার্ড ইয়ার ওঠার পর। আমরা বলি একটু স্বরলিপি দেখ, স্বরলিপি দেখে দেখে ভবিষ্যতে তুলতে হবে মনে রেখে সেইভাবে চর্চা করো।
বেবী: আমাদের এখানে এখন টেলিভিশনে এত চ্যানেল, তারপর রেডিও—সব জায়গা য়তো গান প্রচারিত হচ্ছে। এটা আপনার কাছে কেমন লাগে।
সন্ জীদা: ভাল! ভাল, তবে টেলিভিশনগুলোর একটা প্রবণতা হচ্ছে তারা বয়স দেখে গান গাইতে ডাকে। যাদের বয়সটা কম।
বেবী: যারা অভিজ্ঞ শিল্পী…?
সন্ জীদা: না তাদেরকে ডাকে না। এই যে ফাহমিদা খাতুন, তাকে কম ডাকে। মাহমুদা খাতুনকে ডাকেই না এবং ইয়ং যারা আর গিয়ে একটু লাইন দেয়। একটা খারাপ কথা বললাম।
বেবী: কিন্তু বলতে গেলে শোনা যায় যে আজকাল রবীন্দ্র সংগীত অনেক আসরে পয়সা নিয়ে গায়।
সন্ জীদা: হ্যাঁ পয়সা নিয়ে গায়। এটা ছিল ভারতের জিনিস। ওরা পয়সা নিয়ে গাইতো। আমি একবার গর্ব করে বলেছিলাম ওদের প্রেস ক্লাবকে। আমাকে বলেছিল কত দিতে হবে আপনাকে, চিঠি লিখেছিল। আমি বলেছি, আমাদেরকে দিতে হয় না। বাংলাদেশের লোক পয়সা নিয়ে গান গায় না। ওরা নিশ্চয়ই আমার উপরে চটেছে। তার পরেই দেখলাম এখান থেকে গিয়ে গিয়ে পয়সা নিয়ে গায়, এখানেও পয়সা নেয়। এরকম প্রবণতাটা এসেছে ওখান থেকে। পয়সা না নিলে অনেকে বলে, আমরা খাবো কী, আমাদেরও তো চলতে হবে?
বেবী: আমাদের অনেক নতুন নতুন শিল্পী আসছে। অনেকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে শিখে আসছে। আপনাদের এখানেও শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। নতুন শিল্পীদের প্রতি আপনার অনুভূতিটা কী?
সন্ জীদা: নতুন শিল্পীদের মধ্যে একজন যেমন লাইসা আহমেদ লিসা, রাজশাহীতেই গান শিখেছে। ও ভালো গান গাইছে ।
বেবী: সুমা শান্তিনিকেতনে শিখেছে।
সন্ জীদা: সুমাও বেশ ভালো গান শিখেছে। গাইতেও পারে ভালো। কিন্তু আজকাল আমরা দেখছি শান্তিনিকেতনে শেখানোর মধ্যে একটা ভেজাল ঢুকে গেছে। এ ভেজালটা কী রকম—যারা ওখানে গান গায় তাদের কেউ কেউ আড়ি দিয়ে গান গায়, ঠিক ছন্দে ছন্দে না গেয়ে, মাত্রায় মাত্রায় না গেয়ে আড়ি দেয়। তালটা চলে গেল, তারপরে ধরলো। কাত করে ধরলো আর কি! এই জিনিশটা ওদিকে এখন শেখানো হচ্ছে। সুমার গানে সেটা শুনেছি। এটা অনেকের গানে আছে। এমন কি মিতা যাদের গান শেখায় এখানে, মিতার কাছে শিখলো ঠিকই, আসলে রেকর্ড বা সিডি শোনে ওখানকার—এখন অনুসরণ করে। এটা নিয়ে আমার খুব কষ্ট হয়। ওরা ভাবের দিকে যায় না, কেতা কায়দার দিকে যায়। আর বাজনা সবচেয়ে খারাপ লাগে। এই যে রেকর্ডে আমার নিজের বোধহয় গোটা দুই সিডি আছে। কোলকাতায় গিয়ে রেকর্ডিং করেছি এবং এমন বাজনা বাজিয়েছে! আমাকে বলেছে যে, দিদি যা মিউজিক করেছি ওখানে গিয়ে, শোনাবেন সবাইকে। এইবারে ভয়েজটা দিন। ওদের কাছে মিউজিকটাই আগে ভয়েজটা পরে। এই ট্রেন্ড চলছে। এটা খুব খারাপ লাগে আমার কাছে।
বেবী: আপা আর একটা কথা আপনার কাছে জানতে চাই যে, আমাদের এখানে রবীন্দ্র সংগীতের যে চর্চা হয়, শিল্পীরা যারা উঠে আসছে তারা চর্চার দিকে না গিয়ে গান গাওয়ার প্রতি ঝোঁকটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
সাক্ষাৎকারের ভিডিও ৫
সন্ জীদা: এটা হয় বিশেষ করে বাইরে। আর ছায়ানটে এটা নিয়ে আমরা বকাবকি করি সারাক্ষণ। তোমরা আগে শিখবে, শিল্পী হওয়া পরের কথা—এটাই আমরা বলি। কাজেই এটা নিয়ে খুবই কড়াকড়ি করি।
বেবী: আর এখানে যে সব সিডি বের হচ্ছে, ঐ সিডি বের হওয়া সম্পর্কে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি?
সন্ জীদা: আমি একটা কথা বলি, বিশেষ একটা ছেলে তার নাম আমি করতে চাই না। এরা যা করেছে, কী-বোর্ড আর কী একটা যন্ত্র নিয়ে কতগুলো মিউজিক করে ফেলেছে এবং সেই মিউজিকের সাথে গান গাইতে দেয় ভালো শিল্পীদেরকেও এবং তারাও রেকর্ড করতে পেরে মহা খুশি হয়ে যায়। যেটা অত্যন্ত বাজে হয়। কী-বোর্ডের সুরের মধ্যে একটুখানি ঘাটতি আছে। সেই সুরটার সাথে গান গাওয়া, ওটা ভালো হচ্ছে না এবং যে রেকর্ড করছে সে রেকর্ড করে ৭০ হাজার টাকা নিচ্ছে। একই মিউজিক দিয়ে সবাইকে গান গাওয়াচ্ছে, এই সমস্ত চলছে।
বেবী: আপনি তো অনেকের গান শুনেছেন, আপনার প্রিয় শিল্পী কে?
সন্ জীদা: আমার প্রিয় শিল্পী ভাবের গভীরতার দিক দিয়ে নীলিমা সেন। আর সাংগীতিক গুণে, ভাবের গভীরতাও আছে কণিকা বন্দোপ্যাধায় আর সুচিত্রা মিত্রের কিছু দেশাত্মবোধক গান আমার খুবই ভালো লেগেছে অল্প বয়সে। সুবিনয় রায়ের গানো ভালো লাগে এবং তিনি চমৎকার গেয়েছেন। দেবব্রত বিশ্বাসের কিছু কিছু গানও বেশ ভালো, আর কার নাম বলবো জানি না।
বেবী: আমি আজ সকলে শুনলাম কে. এল. সায়গলের একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত।
সন্ জীদা: কে. এল. সায়গলরা তো হচ্ছে দলছুট মানে ঠিক এখানকার না। কে. এল. সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক এরা তো রবীন্দ্র সংগীত শিখে শিখে গেয়েছেন।
বেবী: আর একটা বিষয় আপনার কাছে জানতে চাই যে, সামনে তো দেড়শ বছর হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথ তো আরও অনেক দিন আমাদের মধ্যে থাকবেন। রবীন্দ্র সংগীত আমাদের অনেক দিন প্রজ্জ্বলিত করবে। তো রবীন্দ্রনাথের এই দেড়শত বছর জন্মদিনে আপনার কোনো চিন্তা।
সন্ জীদা: দেড়শত বছর জন্ম দিনে ছায়ানট যেটা চিন্তা করেছে, কিছু দিন আগেই সভা হলো। আমরা মনে করেছি আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে সমস্ত যে প্রতিষ্ঠান আছে তাদেরকে নিয়ে আমরা বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করবো। তাসের দেশ একটা নৃত্যনাট্য হবে। আরো কিছু হবে বলে আশা করছি। এগুলো আমরা করছি যেখানে নানা রকমের গান হবে। আর এর ভেতর দিয়ে তাসের দেশটা করলে আমরা শুধু ঢাকায় করবো না, ঢাকার বাইরে গিয়েও করবো। বাইরের মানুষ কিন্তু সংস্কৃতির ব্যাপারে খুবই উপবাসী হয়ে থাকে। তাদের জন্য এগুলো দিতে চাই। দেখা যাক, কি হয় আবৃত্তি থাকবে, গান থাকবে,পাঠ থাকবে। অনেক রকমের জিনিশই থাকবে কেমন করে কতটা কি করতে পারি তার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বেবী: আপা আপনি তো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। সেই পাঁচ বছর বয়সে প্রথম গান শোনেন এবং শিখতে থাকেন, এই দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা—সেই অভিজ্ঞতা থেকে আপনি কিছু বলেন।
সন্ জীদা: এ তো অনেক লম্বা অভিজ্ঞতা। গান আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, জীবন তো বড় সহজ জায়গা নয়। নানা আঘাত, নানা রকমের বিশৃঙ্খলা-বিপর্যয় ঘটে যায়। আমি তো গান নিয়ে বেঁচে আসলাম এবং গান যখন শুনি সব ভুলে যাই। এই কদিন আগে মঞ্চে বসে পহেলা বৈশাখের গান শুনছিলাম, অনেকক্ষণ পরে আমার খেয়াল হয়েছে যে আমাকে কিছু বলতে হবে। কী বলবো, সেগুলো অবশ্য গুছানো থাকে। কিন্তু আমি তখন চমকে উঠেছি কারণ গান শুনতে শুনতে আমি এত মগ্ন হয়ে গেছি, এই জিনিসটা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে এবং এইটাই আমার পাওনা। তবে আমি সব গান যে শুনতে পারি, সব গান যে শুনে খুশি হই এমন কথা বলতে পারবো না। আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে ।
বেবী: আপনার পছন্দসই গান।
সন্জীদা: পছন্দসই ধরনের গাইতে হবে তো, ঐ আড়ি সহ্য করতে পারি না। উচ্চারণের একটা কি রকম থাকে। গানে আন্তরিকতা না থাকলে সে গান আমি নিতে পারি না।
বেবী: আপা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বিডিনিউজ-এর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ আপনার কাছে যে আপনি আমদের সময় দিয়েছেন।
—
- আরিফ জেবতিক
এই সময়ে বাংলা ও বাঙালির বিকাশে ছায়ানটের অবদান সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। আমরা আশা করবো ছায়ানট আবহমান বাংলায় আরো ব্যাপক ভাবে কাজ করবে। আমাদেরকে পুরোপুরি বিকশিত হতে হলে আদর্শ ও মানবিক বাঙালি হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সন্ জীদা খাতুনরা একটি মহৎ আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এই জয়যাত্রায় নিরবতার সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে লাখো মানুষ।
- পিনাকী তালুকদার
- শোহেইল মতাহির চৌধুরী
-চয়ন রাজা
- তারিক হাসান