বাংলাদেশে রবীন্দ্র-বিরোধিতার নবরূপ
হাবিব রহমান
রবীন্দ্র-বিরোধিতা ও বিদূষণ নতুন নয়৷ তাঁর জীবদ্দশায় এবং পরেও অনেকবার তা ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে৷ এই বিরোধিতা ও বিদূষণের প্রকৃতি এক রকম নয়৷ পুরো বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে গেলে দীর্ঘকলেবর একখানা গ্রন্থই হয়ে যাবে৷ বস্তুত এ নিয়ে বই লেখাও হয়েছে৷ আমরা বর্তমান আলোচনায় বাংলাদেশে রবীন্দ্র-বিরোধিতার স্বরূপ-প্রকৃতির দিকেই কেবল তাকাব৷ কিন্তু বাংলাদেশে এই বিরোধিতার স্বরূপ সঠিকরূপে বুঝতে গেলে এর সমগ্রতার দিকে তাকানো দরকার৷ কেননা এর একটি পরিপ্রেক্ষিত আছে, রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায় সন্ধ্যেবেলা প্রদীপ জ্বালানোর আগে সকাল বেলা সলতে পাকানোর মতো৷
বলা দরকার পূর্ব পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে যাঁরা রবীন্দ্র-বিরোধিতা করেছেন ও করছেন তাঁরা ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে মুসলমান কিন্তু জাতিতাত্তি্বকভাবে বাঙালী৷ এদের পূর্বপুরুষেরা পাকিস্তানের জন্মের আগেও রবীন্দ্রনাথকে ভালো চোখে দেখেনি৷ না দেখার প্রধান কারণটি ছিল ধর্মবিশ্বাসগত৷ শিল্প-সাহিত্যের আস্বাদন ও বিচারের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের প্রয়োগ সঙ্গত কিনা এ প্রশ্ন উঠবেই৷ বস্তুত প্রশ্ন উঠেছিলও৷ আর সে-প্রশ্ন উঠিয়েছিলেন মুসলমান সমাজেরই আরেকটি অংশ৷ কিন্তু এ আলোচনা আমরা সীমাবদ্ধ রাখব মূলত শিরোনামকে কেন্দ্র করে৷
যাঁরা রবীন্দ্র-বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের মূল অভিযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথে প্রধানত হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতিরই জয়জয়কার; যে-প্রাচীন ভারতের স্বপ্ন তিনি রচনা করেছেন তা ইসলামের তাওহিদবাদের পরিপন্থী, এমনকি তাঁর কবিতায় স্পষ্টত মুসলিম-বিদ্বেষিতা আছে৷ ধমর্ীয় দর্শনজাত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব_যা পাকিস্তান প্রস্তাব নামে বহুল পরিচিতি পায়_গৃহীত হলে ওই মানসিকতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়৷ তখন থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপ-প্রকৃতি কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়৷ ১৯৪২ সালে কলকাতায় ও ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি ও পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের মতাদর্শে সেই চিন্তা-ভাবনার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে৷ সংগঠন দুটির লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করা৷ সংশ্লিষ্টরা বিশ্বাস করতেন যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যদি না-ও হয় তাহলেও অন্তত্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান তর্কাতীতভাবে দুটি আলাদা জাতি৷ একথা স্বীকার্য যে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে মিল আছে, কিন্তু অমিলও কম নেই৷ যেখানে সেই অমিল অর্থাত্ মুসলিম সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য, তার বিকাশের মধ্যেই রয়েছে 'তমদ্দুনী আজাদী বা কালচারেল অটনমী'৷ বোঝা যায় পাকিস্তানে, মূলত পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা ইসলামী বা মুসলিম সংস্কৃতি চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন৷ আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কণ্ঠে এঁদের সকলের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, 'বিজাতীয় ভাবধারা, বিজাতীয় উপমা রূপক শব্দ কোন কিছুই আর নতুন পোষাক পরে পাকিস্তান সাহিত্যে চালু হতে পারবে না৷' (মাহে-নও, ১৩৫৬)
পারবে না তো ভবিষ্যত্ কালের কথা, কিন্তু অতীতে যা লেখা হয়েছে তার কী হবে? যেমন চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তণ, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, এমনকি নজরুল ইসলাম? সম্ভব হলে সব বাদ দেয়াই হতো৷ কিন্তু বাস্তব কারণেই তা পারা যায়নি৷ তবে পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রশ্নে, তার সংহতির প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের মতো দিগ্বিজয়ী প্রতিভাকে বর্জন করতেও কসুর করা হবে না_এ জাতীয় কথা বলেছিলেন গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আলী আহসান এবং আরও কেউ কেউ৷ অথচ ধমর্ীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গোলাম মোস্তফা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একদা লিখেছিলেন, 'কবি-সম্রাট রবীন্দ্রনাথ তাঁহার গীতিকবিতায় যে ভাব ও আদর্শ ব্যক্ত করিয়াছেন তাহার সহিত ইসলামের চমত্কার সৌসাদৃশ্য আছে৷ তাঁহার ভাব ও ধারণাকে যে কোন মুসলমান অনায়াসে গ্রহণ, অন্তর দিয়া গ্রহণ করিতে পারে৷... শুধু বাংলা ভাষায় কেন, জগতের কোন অমুসলমান কবির হাত দিয়া এমন লিখা বাহির হয় নাই৷' ('ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ', বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৯)৷ তাহলে পরে গোলাম মোস্তফার কেন রবীন্দ্র-বিরোধিতা? কারণটি একান্তভাবে রাজনৈতিক অর্থাত্ কিনা ব্যক্তিগত সুযোগ লাভের প্রত্যাশা৷ সরকার চাইছিল 'হিন্দু' কবি রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করতে আর 'মুসলমান' কবি ইকবালকে প্রতিষ্ঠা দিতে৷ রবীন্দ্রনাথের শূন্যস্থানে ইকবালকে ছাড়া আর কাউকে তো বসানো যায় না৷ তাছাড়া ইকবাল উদর্ু ও ফারসি ভাষার কবি৷ বাংলার চেয়ে এ দুটি ভাষার সঙ্গে মুসলমান 'জাতি'র সত্তার যোগ অধিক৷ অবশ্য বাংলা ভাষার 'মুসলমান' কবি নজরুল ইসলাম আছেন৷ তবে তাঁকে গ্রহণ করা যায় কাটা-ছেঁড়া করে৷ সরকারের এই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছিল রবীন্দ্র-বিরোধীদের বক্তব্যে৷ তা না হলে অন্তত গোলাম মোস্তফা ও সৈয়দ আলী আহসান যে রবীন্দ্র-প্রতিভাকে চিনতেন না তা তো নয়৷
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি সত্যিই পাকিস্তানের সংহতির ক্ষেত্রে হুমকি ছিলেন? এটি একটি নির্বোধ প্রশ্ন৷ একাধিক প্রদেশ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্টের কারণ থাকে অন্যত্র_ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে৷ পাকিস্তানের মৃতু্যর কারণটা ছিল সেখানেই৷ সুতরাং পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন-প্রচেষ্টার কোনো হেতুই ছিল না৷ মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর একটি বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করি : 'রুদ্র নজরুল দেন নতুনের পথ করতে পুরাতনকে ভাঙার প্রেরণা, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ভাঙার দিকে মানুষের অভিমত জাগিয়ে তোলেন পুরাতন অন্যায়ের পীড়নের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে, আর সংগঠনপন্থী ও দার্শনিক ইকবাল দেন ভাঙার পর গঠন-পন্থার নির্দেশ৷ যেন মানুষের ভাগ্য গঠনের কাজে তিনজন স্থপতি পর পর সাহায্য করছেন৷ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও ইকবাল মূলত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে৷ এইজন্যে নতুন অদৃষ্ট-রচনার সাধনায় অন্তত বাংলাভাষী পাকিস্তানী রবীন্দ্রনাথকে অনুভব না করে পারে না৷' তাছাড়া পাকিস্তান-পূর্ব গোলাম মোস্তফার মতো ওয়াজেদ আলীও রবীন্দ্রনাথের 'মনোগঠনের পশ্চাদভূমিতে ইসলামের প্রভাব ও অণুরঞ্জন' অনুভব করেছিলেন৷ তাই সঙ্গত কারণে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা হবে কেন? ('নজরুল-ইকবাল-রবীন্দ্রনাথ', মাহে-নও, জ্যৈষ্ঠ ১৩৬০)
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রবীন্দ্র-বিরোধিতা আবার যে নতুন করে শুরু হবে তা ভাবা যায়নি৷ ভাবা যায়নি শুধু এ কারণে নয় যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের পেছনে অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বাঙালীত্বের চেতনা, বরং এই ভাবনায় এ বিশ্বাসও ছিল যে রাষ্ট্রে ও রাজনীতিতে ধর্মের কোনো অপব্যবহার ঘটবে না৷ কিন্তু সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মান্ধতার পুনরুভু্যদয় ঘটেছে৷ এর একটি সমাজতাত্তি্বক কারণ আছে৷ সেই কারণের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে একালের একজন ইসলামী চিন্তাবিদ আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ারের এই উক্তিতে : 'এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহের যেখানে পশ্চাত্পদতা আর দারিদ্র্য ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে ধর্মের আবেগাশ্রিত এক আদল পুনরুত্থিত হতে দেখা যায়৷ ধর্ম এসব ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত শূন্যতাবোধ এবং নাগরিক জীবনের টানাপোড়েনে বিভিন্ন রকম টেনশনের সঙ্গে লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠছে যেন৷' বাংলাদেশের মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অবস্থার সঙ্গে সংযুক্তি ঘটেছে অন্য দুটি বিষয়_একটি স্বরূপের সংকট, অন্যটি ভারত তথা হিন্দু বিরোধী মনোভাব৷ ফলে রবীন্দ্রনাথও আক্রান্ত হচ্ছেন৷
বাংলাদেশে রবীন্দ্র-বিরোধিতার যে-স্বরূপ তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির কৌশল৷ তাই মুসলিম ভাবাবেগ জাগিয়ে তোলার জন্য তাকে প্রকাশ করা হচ্ছে ধর্মবিশ্বাসের আবরণ দিয়ে৷ নিম্নোদ্ধৃত উক্তিটি এ ব্যাপারে একাই একশ :
'...একজন মুসলমান কি কখনো পূজারীর মতো রবীন্দ্রবিশ্বাসী হতে পারে? পারে না কারণ প্রথমত তিনি মুসলমানদের জন্য কোন কথাই লেখেন নি; দ্বিতীয়ত এটা সুস্পষ্ট যে, তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে ভুলক্রমেও কখনো মুসলমানের হিতসাধক ছিলেন এমন প্রমাণ নেই; এবং তৃতীয়ত, তার ঔপনিষদিক হিন্দুত্ববাদী জীবনদর্শন মুসলিম উম্মাহর তাওহিদী চেতনার সঙ্গে একেবারে ষোলকলা সাংঘর্ষিক৷ আমরা রবীন্দ্রবিদ্বেষী নই, তিনি যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধানতম কৃতী পুরুষ, একথা আমরাও অন্য অনেকের মতোই সশ্রদ্ধচিত্তে স্বীকার করি৷ কিন্তু এতদসঙ্গে এটা বলা আমাদের জন্য ওয়াজিব যে, অন্ধ রবীন্দ্রভক্তি ও রবীন্দ্রসংস্কৃতির অবাধ প্রসারের মধ্যে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিপজ্জনক গহ্বর বিদ্যমান৷ আমাদের সৌভাগ্য যে, মুসলমানের জন্য রবীন্দ্রনাথ ভুলক্রমেও একটি কবিতা কি গান রচনা করেননি৷ করলে আমাদের কিছু চতুর সংস্কৃতিপ্রেমীর কষ্ট ও ক্লেশ লাঘব হতো৷ সেই দু'একটা বিড়ালছানা দেখিয়ে তাঁরা বলতে পারতেন, 'তিনি আমাদেরই লোক';... আমরা আনন্দিত যে, আমাদের রবীন্দ্রপূজারী বুদ্ধিজীবীদের জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজে এই সহজ পথটি বন্ধ করে গিয়েছেন৷' (আবু জাফর, 'একজন অসহিষ্ণু মৌলবাদীর সংস্কৃতি-চিন্তা', দৈনিক ইনকিলাব, ৩১ জানুয়ারি ২০০৩)
এই উদ্ধৃতির ভেতর থেকে কয়েকটি গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা যায়৷ বিশ্লেষণের দ্বারা লেখকের ছদ্ম রবীন্দ্রানুরাগের আবরণও উন্মোচন করা যায়৷ কিন্তু আমি সেদিকে যাব না; বিষয়টি উদার, যুক্তিশীল ও সচেতন বোদ্ধা পাঠকের হাতে ন্যস্ত করে প্রাসঙ্গিক অন্য বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই৷
প্রথমে আরবী সাহিত্যের কথা বলি৷ এই সাহিত্য সম্পর্কে আমার প্রায় কিছুই জানা নেই৷ কিন্তু এটুকু জানি যে, যাঁরা ওই সাহিত্য পঠন-পাঠন করেন তাঁরা রসাস্বাদন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাস ও তত্জাত নীতি-নৈতিকতা দ্বারা চালিত হন না, চালিত হন সাহিত্যশিল্পের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ দ্বারা৷ ইসলামপূর্ব আরবী সাহিত্যে তখনকার ধর্ম-দর্শনের বোধ, বিশ্বাস ও জীবনাচরণের প্রতিফলন থাকাই স্বাভাবিক৷ তাছাড়া শ্লীলতা-শোভনতার সীমা অতিক্রম করে এমন বিষয়ও তাতে আছে৷ ইমরুল কায়েস বোধকরি তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ৷ ইসলাম ধর্ম প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এসব সাহিত্য নিষিদ্ধ করেননি৷ তবে সাহিত্যে মন্দ কিছু না লেখার জন্য তিনি তাঁর অনুসারীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ মনে প্রশ্ন জাগে সফোক্লিসের ইডিপাস নাটকটির আরবী অনুবাদ একালে তাহলে কেন করা হলো এবং কেনই বা আরবী সাহিত্যের শিক্ষাথর্ীদের তা পড়ানো হয়? নাটকটি তো একটি ভয়ংকর পাপের নাটক৷ নিয়মিত কুটিল চক্রান্তে নাটকের নায়ক ইডিপাস অজান্তে নিজের গর্ভধারিণীকে বিয়ে করে ও চারটি সন্তানের জনক হয়৷ কথিত ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এই নাটকটি পড়া ও পড়ানো মুসলমানের পক্ষে কি ধর্মবিরুদ্ধ কাজ বলে গণ্য হয় না? মনে পড়ে বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়ে সৈয়দ আলী আহসানের অনুবাদে এই নাটকটি আমাদের পড়তে হয়েছিল৷ নাটকটি পড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের একজন শিক্ষকের ঘোরতর আপত্তি ছিল৷ আপত্তির কারণ মুসলমানের ধর্মবিশ্বাস৷ কিন্তু আরবী সাহিত্যের শিক্ষকরা এটি পাঠ্যতালিকায় রাখছেন কেন? তাঁদের ধর্মবিশ্বাস তো অন্য মুসলমানের চেয়ে কম নয়৷ অথচ মজার ব্যাপারে হচ্ছে আরবী সাহিত্যের বাঙালী শিক্ষকদের অনেকে আবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপত্তি তোলেন৷ কেন এমনটি ঘটছে? এর একটা উত্তর খোঁজা যাক৷
বাঙালী মুসলমান বহুকাল যাবত্ কালচারাল আইডেনটিটি বা স্বরূপের সংকটে ভুগেছে৷ তার দেশ কোনটি, তার ভাষা কোনটি, তার জাতি পরিচয় কী এসব নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক তারা করেছে৷ পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে আসতে এসব সমস্যার একটা সমাধানে তারা পৌঁছতে পেরেছিল৷ কিন্তু এখন আবার নতুন করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে৷ রবীন্দ্রনাথও ওই প্রশ্নের মধ্যে পড়ে গেছেন৷ গেছেন এ কারণে যে, তিনি মুসলমান সমাজে জন্মাননি৷ তা না হলে যে-তৌহিদি বিশ্বাসের কথা বলা হচ্ছে তা নজরুল ইসলামের অনেক রচনাতেও ক্ষুণ্ন হয়েছে বৈকি৷ রবীন্দ্রনাথ যদি মুসলমানদের জন্য বিপজ্জনক হন, তবে নজরুলও কম বিপজ্জনক নন; অবশ্য যদি তাঁকে কাটাছেঁড়া করা না হয়৷ আসলে বাংলাদেশে অনেকদিন ধরে রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় মুসলমানিত্বের আবেগ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে৷ এই চেষ্টারই একটা অংশ রবীন্দ্র-বিরোধিতা ও বিদূষণ৷ তা না হলে তাঁরা দেখতে পেতেন জীবনের প্রথম পর্বে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দুত্বের চেতনা ক্রিয়াশীল থাকলেও তিনি ওই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বজনীনতার বিশাল প্রান্তরে নীড় বেঁধেছিলেন৷ এর সবচেয়ে প্রোজ্জ্বল পরিচয় বোধকরি তাঁরই সৃষ্ট গোরা চরিত্র৷ গোরা উপন্যাসটি পড়া শেষ করে কি আমরা বলব গোরা আগাগোড়া হিন্দুত্ববাদী?
রবীন্দ্রনাথের গুটি কয়েক লেখা পড়ে, তাঁর বাকি বিশাল রচনাসম্ভার না পড়ে বা গোপন রেখে যেভাবে এদেশে তাঁর বিরোধিতা করা হচ্ছে তা দুঃখজনক৷ একমাত্র বাঙালী মুসলমান ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশের মুসলমান তাদের দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের গায়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে কালিমা লেপন করে বলে আমার জানা নেই৷ তবে শঙ্কারও কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না৷ কেননা নিকট অতীতের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে৷ পাকিস্তানপর্বে রবীন্দ্র-বিরোধিতার প্রতিরোধ করেছিলেন এই মুসলমান সমাজেরই বৃহত্তর অংশ৷ তারা নিঃশেষিত-শক্তি নয়৷ তাছাড়া শক্তি রয়েছে রবীন্দ্রনাথের নিজের মধ্যেও৷ সে-শক্তি প্রতিভার শক্তি৷ তা আপনি জ্বলে৷ তাকে ফুঁত্কারে নেভানো যায় না৷ সুতরাং যারা ফুঁ দিচ্ছেন তারা যদি সত্যকে উপলব্ধি করতে অপারগ হন তবে দুর্ভাগ্য তাঁদেরই, রবীন্দ্রনাথের নয়৷
রবীন্দ্র-বিরোধিতা ও বিদূষণ নতুন নয়৷ তাঁর জীবদ্দশায় এবং পরেও অনেকবার তা ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে৷ এই বিরোধিতা ও বিদূষণের প্রকৃতি এক রকম নয়৷ পুরো বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে গেলে দীর্ঘকলেবর একখানা গ্রন্থই হয়ে যাবে৷ বস্তুত এ নিয়ে বই লেখাও হয়েছে৷ আমরা বর্তমান আলোচনায় বাংলাদেশে রবীন্দ্র-বিরোধিতার স্বরূপ-প্রকৃতির দিকেই কেবল তাকাব৷ কিন্তু বাংলাদেশে এই বিরোধিতার স্বরূপ সঠিকরূপে বুঝতে গেলে এর সমগ্রতার দিকে তাকানো দরকার৷ কেননা এর একটি পরিপ্রেক্ষিত আছে, রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায় সন্ধ্যেবেলা প্রদীপ জ্বালানোর আগে সকাল বেলা সলতে পাকানোর মতো৷
বলা দরকার পূর্ব পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে যাঁরা রবীন্দ্র-বিরোধিতা করেছেন ও করছেন তাঁরা ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে মুসলমান কিন্তু জাতিতাত্তি্বকভাবে বাঙালী৷ এদের পূর্বপুরুষেরা পাকিস্তানের জন্মের আগেও রবীন্দ্রনাথকে ভালো চোখে দেখেনি৷ না দেখার প্রধান কারণটি ছিল ধর্মবিশ্বাসগত৷ শিল্প-সাহিত্যের আস্বাদন ও বিচারের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের প্রয়োগ সঙ্গত কিনা এ প্রশ্ন উঠবেই৷ বস্তুত প্রশ্ন উঠেছিলও৷ আর সে-প্রশ্ন উঠিয়েছিলেন মুসলমান সমাজেরই আরেকটি অংশ৷ কিন্তু এ আলোচনা আমরা সীমাবদ্ধ রাখব মূলত শিরোনামকে কেন্দ্র করে৷
যাঁরা রবীন্দ্র-বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের মূল অভিযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথে প্রধানত হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতিরই জয়জয়কার; যে-প্রাচীন ভারতের স্বপ্ন তিনি রচনা করেছেন তা ইসলামের তাওহিদবাদের পরিপন্থী, এমনকি তাঁর কবিতায় স্পষ্টত মুসলিম-বিদ্বেষিতা আছে৷ ধমর্ীয় দর্শনজাত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব_যা পাকিস্তান প্রস্তাব নামে বহুল পরিচিতি পায়_গৃহীত হলে ওই মানসিকতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়৷ তখন থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপ-প্রকৃতি কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়৷ ১৯৪২ সালে কলকাতায় ও ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি ও পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের মতাদর্শে সেই চিন্তা-ভাবনার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে৷ সংগঠন দুটির লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করা৷ সংশ্লিষ্টরা বিশ্বাস করতেন যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যদি না-ও হয় তাহলেও অন্তত্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান তর্কাতীতভাবে দুটি আলাদা জাতি৷ একথা স্বীকার্য যে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে মিল আছে, কিন্তু অমিলও কম নেই৷ যেখানে সেই অমিল অর্থাত্ মুসলিম সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য, তার বিকাশের মধ্যেই রয়েছে 'তমদ্দুনী আজাদী বা কালচারেল অটনমী'৷ বোঝা যায় পাকিস্তানে, মূলত পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা ইসলামী বা মুসলিম সংস্কৃতি চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন৷ আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কণ্ঠে এঁদের সকলের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, 'বিজাতীয় ভাবধারা, বিজাতীয় উপমা রূপক শব্দ কোন কিছুই আর নতুন পোষাক পরে পাকিস্তান সাহিত্যে চালু হতে পারবে না৷' (মাহে-নও, ১৩৫৬)
পারবে না তো ভবিষ্যত্ কালের কথা, কিন্তু অতীতে যা লেখা হয়েছে তার কী হবে? যেমন চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তণ, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, এমনকি নজরুল ইসলাম? সম্ভব হলে সব বাদ দেয়াই হতো৷ কিন্তু বাস্তব কারণেই তা পারা যায়নি৷ তবে পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রশ্নে, তার সংহতির প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের মতো দিগ্বিজয়ী প্রতিভাকে বর্জন করতেও কসুর করা হবে না_এ জাতীয় কথা বলেছিলেন গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আলী আহসান এবং আরও কেউ কেউ৷ অথচ ধমর্ীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গোলাম মোস্তফা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একদা লিখেছিলেন, 'কবি-সম্রাট রবীন্দ্রনাথ তাঁহার গীতিকবিতায় যে ভাব ও আদর্শ ব্যক্ত করিয়াছেন তাহার সহিত ইসলামের চমত্কার সৌসাদৃশ্য আছে৷ তাঁহার ভাব ও ধারণাকে যে কোন মুসলমান অনায়াসে গ্রহণ, অন্তর দিয়া গ্রহণ করিতে পারে৷... শুধু বাংলা ভাষায় কেন, জগতের কোন অমুসলমান কবির হাত দিয়া এমন লিখা বাহির হয় নাই৷' ('ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ', বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৯)৷ তাহলে পরে গোলাম মোস্তফার কেন রবীন্দ্র-বিরোধিতা? কারণটি একান্তভাবে রাজনৈতিক অর্থাত্ কিনা ব্যক্তিগত সুযোগ লাভের প্রত্যাশা৷ সরকার চাইছিল 'হিন্দু' কবি রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করতে আর 'মুসলমান' কবি ইকবালকে প্রতিষ্ঠা দিতে৷ রবীন্দ্রনাথের শূন্যস্থানে ইকবালকে ছাড়া আর কাউকে তো বসানো যায় না৷ তাছাড়া ইকবাল উদর্ু ও ফারসি ভাষার কবি৷ বাংলার চেয়ে এ দুটি ভাষার সঙ্গে মুসলমান 'জাতি'র সত্তার যোগ অধিক৷ অবশ্য বাংলা ভাষার 'মুসলমান' কবি নজরুল ইসলাম আছেন৷ তবে তাঁকে গ্রহণ করা যায় কাটা-ছেঁড়া করে৷ সরকারের এই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছিল রবীন্দ্র-বিরোধীদের বক্তব্যে৷ তা না হলে অন্তত গোলাম মোস্তফা ও সৈয়দ আলী আহসান যে রবীন্দ্র-প্রতিভাকে চিনতেন না তা তো নয়৷
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি সত্যিই পাকিস্তানের সংহতির ক্ষেত্রে হুমকি ছিলেন? এটি একটি নির্বোধ প্রশ্ন৷ একাধিক প্রদেশ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্টের কারণ থাকে অন্যত্র_ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে৷ পাকিস্তানের মৃতু্যর কারণটা ছিল সেখানেই৷ সুতরাং পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন-প্রচেষ্টার কোনো হেতুই ছিল না৷ মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর একটি বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করি : 'রুদ্র নজরুল দেন নতুনের পথ করতে পুরাতনকে ভাঙার প্রেরণা, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ভাঙার দিকে মানুষের অভিমত জাগিয়ে তোলেন পুরাতন অন্যায়ের পীড়নের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে, আর সংগঠনপন্থী ও দার্শনিক ইকবাল দেন ভাঙার পর গঠন-পন্থার নির্দেশ৷ যেন মানুষের ভাগ্য গঠনের কাজে তিনজন স্থপতি পর পর সাহায্য করছেন৷ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও ইকবাল মূলত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে৷ এইজন্যে নতুন অদৃষ্ট-রচনার সাধনায় অন্তত বাংলাভাষী পাকিস্তানী রবীন্দ্রনাথকে অনুভব না করে পারে না৷' তাছাড়া পাকিস্তান-পূর্ব গোলাম মোস্তফার মতো ওয়াজেদ আলীও রবীন্দ্রনাথের 'মনোগঠনের পশ্চাদভূমিতে ইসলামের প্রভাব ও অণুরঞ্জন' অনুভব করেছিলেন৷ তাই সঙ্গত কারণে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা হবে কেন? ('নজরুল-ইকবাল-রবীন্দ্রনাথ', মাহে-নও, জ্যৈষ্ঠ ১৩৬০)
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রবীন্দ্র-বিরোধিতা আবার যে নতুন করে শুরু হবে তা ভাবা যায়নি৷ ভাবা যায়নি শুধু এ কারণে নয় যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের পেছনে অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বাঙালীত্বের চেতনা, বরং এই ভাবনায় এ বিশ্বাসও ছিল যে রাষ্ট্রে ও রাজনীতিতে ধর্মের কোনো অপব্যবহার ঘটবে না৷ কিন্তু সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মান্ধতার পুনরুভু্যদয় ঘটেছে৷ এর একটি সমাজতাত্তি্বক কারণ আছে৷ সেই কারণের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে একালের একজন ইসলামী চিন্তাবিদ আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ারের এই উক্তিতে : 'এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহের যেখানে পশ্চাত্পদতা আর দারিদ্র্য ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে ধর্মের আবেগাশ্রিত এক আদল পুনরুত্থিত হতে দেখা যায়৷ ধর্ম এসব ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত শূন্যতাবোধ এবং নাগরিক জীবনের টানাপোড়েনে বিভিন্ন রকম টেনশনের সঙ্গে লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠছে যেন৷' বাংলাদেশের মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অবস্থার সঙ্গে সংযুক্তি ঘটেছে অন্য দুটি বিষয়_একটি স্বরূপের সংকট, অন্যটি ভারত তথা হিন্দু বিরোধী মনোভাব৷ ফলে রবীন্দ্রনাথও আক্রান্ত হচ্ছেন৷
বাংলাদেশে রবীন্দ্র-বিরোধিতার যে-স্বরূপ তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির কৌশল৷ তাই মুসলিম ভাবাবেগ জাগিয়ে তোলার জন্য তাকে প্রকাশ করা হচ্ছে ধর্মবিশ্বাসের আবরণ দিয়ে৷ নিম্নোদ্ধৃত উক্তিটি এ ব্যাপারে একাই একশ :
'...একজন মুসলমান কি কখনো পূজারীর মতো রবীন্দ্রবিশ্বাসী হতে পারে? পারে না কারণ প্রথমত তিনি মুসলমানদের জন্য কোন কথাই লেখেন নি; দ্বিতীয়ত এটা সুস্পষ্ট যে, তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে ভুলক্রমেও কখনো মুসলমানের হিতসাধক ছিলেন এমন প্রমাণ নেই; এবং তৃতীয়ত, তার ঔপনিষদিক হিন্দুত্ববাদী জীবনদর্শন মুসলিম উম্মাহর তাওহিদী চেতনার সঙ্গে একেবারে ষোলকলা সাংঘর্ষিক৷ আমরা রবীন্দ্রবিদ্বেষী নই, তিনি যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধানতম কৃতী পুরুষ, একথা আমরাও অন্য অনেকের মতোই সশ্রদ্ধচিত্তে স্বীকার করি৷ কিন্তু এতদসঙ্গে এটা বলা আমাদের জন্য ওয়াজিব যে, অন্ধ রবীন্দ্রভক্তি ও রবীন্দ্রসংস্কৃতির অবাধ প্রসারের মধ্যে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিপজ্জনক গহ্বর বিদ্যমান৷ আমাদের সৌভাগ্য যে, মুসলমানের জন্য রবীন্দ্রনাথ ভুলক্রমেও একটি কবিতা কি গান রচনা করেননি৷ করলে আমাদের কিছু চতুর সংস্কৃতিপ্রেমীর কষ্ট ও ক্লেশ লাঘব হতো৷ সেই দু'একটা বিড়ালছানা দেখিয়ে তাঁরা বলতে পারতেন, 'তিনি আমাদেরই লোক';... আমরা আনন্দিত যে, আমাদের রবীন্দ্রপূজারী বুদ্ধিজীবীদের জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজে এই সহজ পথটি বন্ধ করে গিয়েছেন৷' (আবু জাফর, 'একজন অসহিষ্ণু মৌলবাদীর সংস্কৃতি-চিন্তা', দৈনিক ইনকিলাব, ৩১ জানুয়ারি ২০০৩)
এই উদ্ধৃতির ভেতর থেকে কয়েকটি গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা যায়৷ বিশ্লেষণের দ্বারা লেখকের ছদ্ম রবীন্দ্রানুরাগের আবরণও উন্মোচন করা যায়৷ কিন্তু আমি সেদিকে যাব না; বিষয়টি উদার, যুক্তিশীল ও সচেতন বোদ্ধা পাঠকের হাতে ন্যস্ত করে প্রাসঙ্গিক অন্য বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই৷
প্রথমে আরবী সাহিত্যের কথা বলি৷ এই সাহিত্য সম্পর্কে আমার প্রায় কিছুই জানা নেই৷ কিন্তু এটুকু জানি যে, যাঁরা ওই সাহিত্য পঠন-পাঠন করেন তাঁরা রসাস্বাদন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাস ও তত্জাত নীতি-নৈতিকতা দ্বারা চালিত হন না, চালিত হন সাহিত্যশিল্পের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ দ্বারা৷ ইসলামপূর্ব আরবী সাহিত্যে তখনকার ধর্ম-দর্শনের বোধ, বিশ্বাস ও জীবনাচরণের প্রতিফলন থাকাই স্বাভাবিক৷ তাছাড়া শ্লীলতা-শোভনতার সীমা অতিক্রম করে এমন বিষয়ও তাতে আছে৷ ইমরুল কায়েস বোধকরি তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ৷ ইসলাম ধর্ম প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এসব সাহিত্য নিষিদ্ধ করেননি৷ তবে সাহিত্যে মন্দ কিছু না লেখার জন্য তিনি তাঁর অনুসারীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ মনে প্রশ্ন জাগে সফোক্লিসের ইডিপাস নাটকটির আরবী অনুবাদ একালে তাহলে কেন করা হলো এবং কেনই বা আরবী সাহিত্যের শিক্ষাথর্ীদের তা পড়ানো হয়? নাটকটি তো একটি ভয়ংকর পাপের নাটক৷ নিয়মিত কুটিল চক্রান্তে নাটকের নায়ক ইডিপাস অজান্তে নিজের গর্ভধারিণীকে বিয়ে করে ও চারটি সন্তানের জনক হয়৷ কথিত ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এই নাটকটি পড়া ও পড়ানো মুসলমানের পক্ষে কি ধর্মবিরুদ্ধ কাজ বলে গণ্য হয় না? মনে পড়ে বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়ে সৈয়দ আলী আহসানের অনুবাদে এই নাটকটি আমাদের পড়তে হয়েছিল৷ নাটকটি পড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের একজন শিক্ষকের ঘোরতর আপত্তি ছিল৷ আপত্তির কারণ মুসলমানের ধর্মবিশ্বাস৷ কিন্তু আরবী সাহিত্যের শিক্ষকরা এটি পাঠ্যতালিকায় রাখছেন কেন? তাঁদের ধর্মবিশ্বাস তো অন্য মুসলমানের চেয়ে কম নয়৷ অথচ মজার ব্যাপারে হচ্ছে আরবী সাহিত্যের বাঙালী শিক্ষকদের অনেকে আবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপত্তি তোলেন৷ কেন এমনটি ঘটছে? এর একটা উত্তর খোঁজা যাক৷
বাঙালী মুসলমান বহুকাল যাবত্ কালচারাল আইডেনটিটি বা স্বরূপের সংকটে ভুগেছে৷ তার দেশ কোনটি, তার ভাষা কোনটি, তার জাতি পরিচয় কী এসব নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক তারা করেছে৷ পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে আসতে এসব সমস্যার একটা সমাধানে তারা পৌঁছতে পেরেছিল৷ কিন্তু এখন আবার নতুন করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে৷ রবীন্দ্রনাথও ওই প্রশ্নের মধ্যে পড়ে গেছেন৷ গেছেন এ কারণে যে, তিনি মুসলমান সমাজে জন্মাননি৷ তা না হলে যে-তৌহিদি বিশ্বাসের কথা বলা হচ্ছে তা নজরুল ইসলামের অনেক রচনাতেও ক্ষুণ্ন হয়েছে বৈকি৷ রবীন্দ্রনাথ যদি মুসলমানদের জন্য বিপজ্জনক হন, তবে নজরুলও কম বিপজ্জনক নন; অবশ্য যদি তাঁকে কাটাছেঁড়া করা না হয়৷ আসলে বাংলাদেশে অনেকদিন ধরে রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় মুসলমানিত্বের আবেগ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে৷ এই চেষ্টারই একটা অংশ রবীন্দ্র-বিরোধিতা ও বিদূষণ৷ তা না হলে তাঁরা দেখতে পেতেন জীবনের প্রথম পর্বে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দুত্বের চেতনা ক্রিয়াশীল থাকলেও তিনি ওই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বজনীনতার বিশাল প্রান্তরে নীড় বেঁধেছিলেন৷ এর সবচেয়ে প্রোজ্জ্বল পরিচয় বোধকরি তাঁরই সৃষ্ট গোরা চরিত্র৷ গোরা উপন্যাসটি পড়া শেষ করে কি আমরা বলব গোরা আগাগোড়া হিন্দুত্ববাদী?
রবীন্দ্রনাথের গুটি কয়েক লেখা পড়ে, তাঁর বাকি বিশাল রচনাসম্ভার না পড়ে বা গোপন রেখে যেভাবে এদেশে তাঁর বিরোধিতা করা হচ্ছে তা দুঃখজনক৷ একমাত্র বাঙালী মুসলমান ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশের মুসলমান তাদের দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের গায়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে কালিমা লেপন করে বলে আমার জানা নেই৷ তবে শঙ্কারও কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না৷ কেননা নিকট অতীতের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে৷ পাকিস্তানপর্বে রবীন্দ্র-বিরোধিতার প্রতিরোধ করেছিলেন এই মুসলমান সমাজেরই বৃহত্তর অংশ৷ তারা নিঃশেষিত-শক্তি নয়৷ তাছাড়া শক্তি রয়েছে রবীন্দ্রনাথের নিজের মধ্যেও৷ সে-শক্তি প্রতিভার শক্তি৷ তা আপনি জ্বলে৷ তাকে ফুঁত্কারে নেভানো যায় না৷ সুতরাং যারা ফুঁ দিচ্ছেন তারা যদি সত্যকে উপলব্ধি করতে অপারগ হন তবে দুর্ভাগ্য তাঁদেরই, রবীন্দ্রনাথের নয়৷
মূল লেখার লিংক-
No comments:
Post a Comment