Thursday, September 16, 2010

মিশেল ফুকোর দর্শন: উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত


আ নো য়া রু ল্লা হ ভূঁ ই য়া||


ফুকোর গোটা রচনাবলির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল ঐতিহাসিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক পর্যায় থেকে সকল কিছুর প্রাতিষ্ঠানিক স্বরূপ ও উৎস বিশ্লেষণ করা। তাঁর দার্শনিক ভাবনাকে মোট তিনটি পরিসরে আলোচনা করা যায় : এক. প্রথমেই লক্ষ করব ফুকোর পাগলের ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রয়াস। নানান ধরন-প্রকৃতির মধ্য দিয়ে গধফহবংং ধহফ ঈরারষরুধ:রড়হ: অ ঐরং:ড়ৎু ড়ভ ওহংধহর:ু রহ :যব অমব ড়ভ জবধংড়হ (১৯৬১) গ্রন্থে তিনি দ্বাদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাসের একটি রূপরেখা প্রদান করেছেন।
এর পর দশ বছর তিনি আর কোনো পরিপূর্ণ গ্রন্থ লেখেননি। ১৯৭১ সালে তিনি লিখেন ঞযব ঙৎফবৎ ড়ভ ঞযরহমং । ১৯৭২ সালে তিনি দার্শনিক পদ্ধতি তত্ত্ব নিয়ে লিখেন অৎপযধবড়ষড়মু ড়ভ কহড়ষিবফমব। প্রচলিত ধারায় একে আবার ধারণার পদ্ধতিবিষয়ক আলোচনাও বলা হয়। ১৯৭৪ সালে লিখিত ঞযব ইরৎ:য ড়ভ :যব ঈষরহরপ গ্রন্থে আমরা পাই আধুনিক মেডিসিনের উদ্ভব প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা পাই : ফুকোর আলোচনার ধরন-প্রকৃতিতে যে এক ও অন্যন্যতা রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা। তৃতীয় পর্যায়টি হল শিল্প ও সাহিত্যে ফুকোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রভাব। এসবকিছুর মধ্যে যে নিয়ামকটি তাঁর চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে তাহলো জ্ঞানাংশ বা এপিস্টিম এবং প্রত্ন-জ্ঞানতত্ত্ব। গুরুত্বেও বিবেচনায় তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারকারী। এ বিষয় বিবেচনায় রেখে উক্ত প্রবে আমরা ফুঁকোর জ্ঞানতত্ত্ব-বিষয়ক ভাবনা নিয়ে পর্যালোচনা করব। আলোচনার শুরুতে জ্ঞানতত্ত্বের দার্শনিক প্রচেষ্টাসমূহ সম্পর্কে জানব। এই প্রচেষ্টায় ফুকোর অবস্খানও জানার প্রয়াস নেব।
২. জ্ঞানতত্ত্ব : দার্শনিক বিবর্তন
জ্ঞান কীভাবে হয়? কিংবা জ্ঞানের স্বরূপ কী? এসব প্রশ্নের উত্তর দার্শনিকগণ বিভিন্নভাবে অনুসান করার প্রয়াস নিয়েছেন। তন্মধ্যে সব থেকে প্রাচীন প্রচেষ্টা হলো ‘যথার্থ জ্ঞানের’ অনুসান করা। ’যথার্থ জ্ঞান’ বলতে বোঝানো হতো ‘বিশুদ্ধ জ্ঞান’কে । আর ‘বিশুদ্ধ জ্ঞান’ হলো পরম সত্তা সম্পর্কিত জ্ঞান। ‘বিশুদ্ধ জ্ঞানের’ দার্শনিক অনুসান শুরু হয় প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। গোটা গ্রন্থে তিনি বস্তুজগতের জ্ঞানকে মিথ্যা-অধ্যাস হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, আর অতীন্দ্রিয় জ্ঞান কিংবা ভাবের জ্ঞান হয়ে উঠেছে বাস্তব বা চূড়ান্ত। আর এভাবেই ‘বিশুদ্ধ জ্ঞান’ জগত অপেক্ষা অতিজগত নির্ভর হয়ে পড়েছে, এতে করে দর্শনের জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় মানুষ, মানুষের উদ্বাবনী সক্ষমতা এবং প্রকৃতি অপেক্ষা ‘ভাব বা মনই’ মূল হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। এই মন নির্ভরতার কারণেই চেতনাকে ধরা হয়েছে বস্তু থেকে স্বতন্ত্র কোনোকিছু হিসাবে। আর স্বতন্ত্র মন দাবি করে বস্তুজগতের উর্ধ্বে কিছু একটা রয়েছে। জ্ঞানতাত্ত্বিক এই নির্মাণের উপর দাঁড়িয়ে ভাববাদ ‘অন্তর্জীবন’ এবং ‘পুনরুজ্জীবন’কে অপরিহার্য করে তোলে। এই দুইয়ের মধ্যে তারা অনুসান করে জীবন, জগত এবং মানবিক সংকটের সমাধান। ‘বাস্তব জগত’ এবং ‘ভাবজগত’ নিয়ে যে বিতর্ক এ বিতর্কের একটি দার্শনিক রূপায়ন লক্ষ করি আঠারো শতকে এসে। এ পর্যায়ে দার্শনিকদের মূল জিজ্ঞাসা শুরু হয় : জ্ঞান কী বিষয়ীগত না বিষয়গত? এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে দর্শনে ভাববাদ বনাম বস্তবাদ বিতর্ক শুরু হয়। উল্লিখিত বিতর্কের কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা হলো : জগত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কী মন বা চেতনার ওপর নির্ভরশীল, নাকি বস্তু বা বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল? ভাববাদ দাবি করে আমাদের জ্ঞান চেতনার ওপর নির্ভরশীল, চেতনার বাইরে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। দার্শনিক বার্কলের দর্শনে এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। আবার ডেভিড হিউম মনে করেন প্রত্যক্ষণের বাইরে বস্তর কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। জ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয় জ্ঞানই মুখ্য। এই ইন্দ্রিয়জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে তিনি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন উথাপন করেন। কান্ট দেখালেন এককভাবে মননির্ভরতা কিংবা প্রত্যক্ষণনির্ভরতা পরিপূর্ণ জ্ঞানের উপাদান নয়। বস্তুত প্রত্যক্ষণশক্তি এবং বোধশক্তি উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে মন প্রকৃত জ্ঞান লাভ করে। তিনি বলেন মানব-প্রজ্ঞায় যা সত্য হিসাবে প্রতীয়মান হয় তা-ই সমাজের কাছে সত্য হিসাবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ সমাজের আবশ্যিক প্রয়োজনসমূহ মানব-প্রজ্ঞার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কান্টের পরে হেগেল মানব-জ্ঞানকে সমাজবহির্ভূত করে দেখেছেন, আর এই ভাবসত্তা হয়ে উঠেছে সকলকিছুর কেন্দ্র।
কান্টের জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারা এবং হেগেলের বিষয়গত-ভাববাদে (ড়নলবপ:রাব রফবধষরংস) ব্যবহৃত দ্বান্দ্বিকতা উভয়ের তাত্ত্বিক প্রতিফলন লক্ষ করা যায় মার্কসীয় জ্ঞানতত্ত্বে। জ্ঞানতত্ত্বের এই ধারাটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (ফরধষবপ:রপধষ সধ:বৎরধষরংস) সমধিক পরিচিত। জ্ঞানতত্ত্ব এখানে এসে সামাজিক চরিত্র লাভ করে। জ্ঞান শুধু সংবেদনের সাহায্যে বস্তজগতকে কিংবা মনের সাহায্যে ধারণার জ্ঞান লাভের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। জ্ঞান সামাজিক পরিবর্তনকেও ত্বরান্বিত করে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী-জ্ঞানতত্ত্ব জ্ঞানকে বিবেচনা করে একটি ‘অব্যাহত চিন্তন প্রক্রিয়া’ হিসাবে। অব্যাহত চিন্তন প্রক্রিয়ার সঙ্গে রয়েছে ‘মানুষের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত জ্ঞান’। আর মানুষের ক্রিয়াকলাপ তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানতত্ত্ব বস্তুজগতকে ধরা হয় জ্ঞানের মূল উৎস হিসাবে। এই উৎসই মানুষের মধ্যে তৈরি করে বোধ-বুদ্ধি, ধারণা এবং সংবেদনশীলতা। আর বস্তজগত সম্পর্কিত এই জ্ঞানকে সে বাস্তবায়ন করে অনুশীলনের (ঢ়ৎধীরং) মাধ্যমে। এভাবে ‘বিষয় ও বিষয়ী’ এবং ‘তত্ত্ব ও অনুশীলন’ সমন্বিত থেকে জ্ঞান নির্মাণের ধারা সৃষ্টি করে। এভাবেই মার্কসের দার্শনিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জ্ঞানতত্ত্ব সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত লাভ করে। মার্কসীয় জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারা যেখানে সামাজিক চারিত্র্যসহ উৎসারিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে ইতিহাস, মানব ঐতিহ্য এবং মানুষের আধিপত্যবাদী চরিত্রসমূহের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বে। পরবর্তী অনুচ্ছেদে আমরা উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বের বিভিন্ন ধারা নিয়ে আলোচনা করব।
৩. উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব
উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবনায় একটি সুনির্দিষ্ট বিবর্তনের ধারা রয়েছে। এই ধারায় আমরা লক্ষ করে দেখব : আধুনিকতাবাদ জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আঠারো শতকের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, গণিতের ধারণাগত অর্জনসমূহ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অর্থাৎ আঠারো শতকের ‘ভাব’ এবং ‘অনুধ্যানের’ জায়গায় ‘বিষয়গত তথ্যাদি’ জায়গা করে নেয়। আবার উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চায় সত্যাসত্যি যাচাইবাছাইকরণে ‘পরখনীতির’ শর্তকে অপরিহার্য করে তোলে। এই পর্যায়ে এসে বিজ্ঞানের প্রভাবে আরো প্রকট আকার ধারণ করে। কিন্তু উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা বিগত দিনের দার্শনিক ধারায় ব্যাপক ছেদ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ক্যারোলিন মিলার উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব প্রসঙ্গে বলেন : উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব চিরায়ত যুগের জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনার মূলসূত্র বস্তুনিষ্ঠতা বা স্বত:সত্যকে প্রত্যাখানের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। এ ধারার জ্ঞানতত্ত্ব অনুসারে মনে করা হয় : আমরা যে সত্তাকে জানি তা ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড এবং সম্প্রদায়গত সম্মতির ভিত্তিতে হয়ে থাকে। তারা মনে করেন ‘জ্ঞাতা’, ‘জ্ঞান’, ‘সত্তা’ এবং ‘সম্প্রদায়’ অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। এরকম দার্শনিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তাঁরা একদিকে যেমন বাস্তববাদী জ্ঞানতত্ত্বকে প্রত্যাখান করেন, অন্যদিকে ভাববাদী প্রয়াসকেও বাদ করে দিয়েছেন। বাস্তববাদী জ্ঞানতত্ত্বে তথ্য বা ঘটনাকে নৈর্ব্যক্তিক হিসাবে ধরা হয়। আবার ভাববাদী জ্ঞানতত্ত্ব ‘জ্ঞানের বিষয়কে’ মানব মনের অভিপ্রায়ের সঙ্গে এক করে দেখে থাকে। কিন্তু উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব ‘তথ্য’ বা ‘ঘটনার’ নৈর্ব্যক্তিকতার স্খলে মানুষের অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আমরা যে ‘তথ্যের’ কথা বলি তা মানুষই গঠন-বিগঠনের মধ্য দিয়ে বিন্যস্ত করে। এই বিন্যস্ত করার সঙ্গে মানুষের সমাজ, সভ্যতা এবং তার বৈষয়িক জীবনের ভাবনাসমূহ সমন্বিত হয়ে রয়েছে। জ্ঞানের জন্য তাই ‘তথ্য’ বা ‘ভাব’ অপেক্ষা ‘সমাজ’ ‘সভ্যতা’র শর্তসমূহও প্রয়োজন।
আমরা লক্ষ করে দেখব আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারার মূল বৈশিষ্ট্য সবকিছুকে মানবীয় করে তোলা। উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব কিন্তু তা থেকে ভিন্ন। উত্তর-আধুনিকতাবাদী ফুকোও এই স্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, মানবজ্ঞান সকল বিচার-বিবেচনার মানদণ্ড নয়। এ বক্তব্য নি:সন্দেহে আধুনিকতাবাদী কান্টের ভাববাদী-জ্ঞানতত্ত্বের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা। কান্ট যেখানে মনে করেছেন মানবজ্ঞানই মুখ্য। সেক্ষেত্রে ফুকো মনে করেন সমাজের সকল আবশ্যিক সত্যসমূহ মানবজ্ঞানের সঙ্গে অনিবার্যভাবে সংশ্লিষ্ট। কারণ এরকম সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে যেসব আপাতত সত্য মানুষের সামনে তুলে ধরা হয় তাতে ‘ক্ষমতা’ ও ‘আধিপত্যেও’ ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়। উনিশ শতকের প্রভাবশালী দার্শনিক কান্টকে তিনি এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রত্যাখান করেন। আবার মার্কসীয় জ্ঞানতত্ত্বে বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর যে টানাপোড়েন তাও ফুকো লক্ষ করেছেন। সীমাবদ্ধতার এই দিকসমূহই তাকে নতুন করে ভাবতে প্রলুব্ধ করে।
উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারার এই বৈশিষ্ট্যটির আঙ্গিকে মিশেল ফুকোও জ্ঞানতত্ত্বকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। ফুকো বিশেষজ্ঞ বেরি এলেন বলেন, ফুঁকো মনে করতেন মানুষের বোধ-উপলব্ধিসমূহ সমাজ-নিরপেক্ষ নয়। অন্যত্র জ্ঞান হবার জন্য জ্ঞান-বাক্যটির জ্ঞানবিনিময় করার সক্ষমতা থাকতে হবে। বহু শ্রোতার মধ্যে উভমাত্রিক এবং সম্পূরক সম্পর্ক থাকতে হবে। একক কিংবা বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। একদিকে যেমন জ্ঞানের বিষয় থাকতে হবে, অন্যদিকে জ্ঞানের বিষয়টিকে বোঝার জন্য ‘অন্যসত্তা’ বা যিনি জ্ঞানবাক্যটিকে জ্ঞান হিসাবে বিবেচনা করবেন সেরকম ব্যক্তির উপস্খিতিও থাকতে হবে। নানামাত্রার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জ্ঞান নির্মাণ-বিনির্মাণের খেলাটি বোঝতে হবে। এ খেলা যেনোবা আলো-আঁধারির খেলা। আলো থেকে বাদ দিয়ে যেমন অকারের উপলব্ধি হয় না, তেমনি অকারই আলোর সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করে। ফুকো জ্ঞান নির্মাণের ক্ষেত্রে এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
ফুকোর জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবনাকে আরো তিনটি দিক থেকে বোঝা যেতে পারে :
এক. ফুকো জ্ঞানের মানদণ্ড হিসাবে সংগতিবাদকে ‘সত্য-প্রতিপাদনের’ কৌশল হিসাবে বিবেচনা করেছেন, দুই. বিজ্ঞানবাদ এবং আদর্শবাদের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ধারণাগত-জ্ঞানকে (পড়হপবঢ়:ঁধষ শহড়ষিবফমব) স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রতত্ত্ব এবং জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে কীভাবে উৎকৃষ্ট সম্পর্ক স্খাপন করা যায় তা নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তিন. তিনি জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাসের পদ্ধতি’ (সব:যড়ফ ড়ভ নবষরবভ) এবং ‘সংগতিপূর্ণ সম্ব’ (ৎবষধ:রড়হ ড়ভ পড়যবৎবহপব) উভয়কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জ্ঞানের ‘সংগতিপূর্ণ মানদণ্ড’ দাঁড় করিয়েছেন। এই ত্রিমাত্রিক দিক থেকে তিনি জ্ঞানকে দেখবার চেষ্টা করেছেন। চরিত্রগত দিক থেকে ফুকো জ্ঞানতত্ত্ব একাধারে ঐতিহাসিক ও সামাজিক। যে কারণে লক্ষ করা যায় তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় ‘বিশ্বাস’, ‘যাচাইকরণ’, ‘সত্য’, ‘মূল্য’ এবং ‘সামাজিক ক্ষমতার’ শর্তাদি অভিন্নভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে। আর জ্ঞানপদবাচ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে ফুকো ‘অভিজ্ঞতামূলক ব্যাখ্যা’ (বসঢ়রৎরপধষ বীঢ়ষধহধ:রড়হ) এবং ধারণাগত ব্যাখ্যা (পড়হপবঢ়:ঁধষ বীঢ়ষধহধ:রড়হ) উভয়ের সাহায্য নিয়েছেন। তিনি মনে করেছেন কীভাবে আমরা জানতে পারি সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। কিংবা জ্ঞান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার রীতিটিকেও তিনি অপ্রাসঙ্গিক, অনেকক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় হিসাবে বিবেচনা করেছেন। সুতরাং ফুকোর জ্ঞানতত্ত্বকে বোঝার জন্য প্রয়োজন প্রচলিত দৃষ্টিকোণের ঊর্ধ্বে ওঠা।
৪. ফুকোর দর্শন ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবনা
ফুকোর দার্শনিক চিন্তা নানান ভেদ-অভেদের মাত্রা, অধিমাত্রা দিয়ে পরিমণ্ডিত। সুনির্দিষ্ট কোনো ছাঁচে ফেলে দিয়ে তাঁর দার্শনিক চিন্তাকে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করা দুরূহ। কিংবা কোনো দার্শনিক চিন্তাধারা দিয়ে তাঁর অভিপ্রায়কে বোঝা যায় না। জীবন ও জগৎ ভাবনার এক তির্যক প্রতিফলন রয়েছে তাঁর দার্শনিক চিন্তা জুড়ে। এই ভাবনায় তিনি একেবারে স্বতন্ত্র আলাদা। তিনি জীবন ও সৃষ্টি এই দুইয়ের মধ্যে কোনো ছেদ বা বিচ্ছেদ খুঁজে ফেরেন নিন্ধ বরং এ দুয়ের মধ্যে তিনি দেখেছেন মেলবন। সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা খুঁজে পাই এর স্রষ্টাকে। কিংবা ইডিপাস থেকে যেমনটি আলাদা করা যায় না সফোক্লিসকে। এখানে দুই সত্তা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায়। একইভাবে কোনো চিত্রকর্ম থেকে আলাদা করা যায় না চিত্রকর্মীকে। আবার যে জীবন আমরা যাপন করি তাও অন্য কোনো শর্তের সঙ্গে আবদ্ধ। এরকম সম্পর্কের জালে আবদ্ধ হবার বিষয়টিকেই ফুকো হেঁয়ালি বয়ন (বহরমসধ:রপ ং:র:পযরহম) হিসাবে উল্লেখ করেন। বয়নের সুতো ও সুইয়ের ফোড়ে ফোড়ে রয়েছে শিল্প-কারুকাজ, বয়নশৈলি এবং বয়নকারীর প্রচেষ্টা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে ভাবা অসম্পূর্ণতাকেই আমন্ত্রণ করার নামান্তর। ফুঁকো গোটা দার্শনিক ভাবনাকে বিন্যস্ত করেছেন জীবন, জীবন-আলেখ্য ও বাস্তবতার নিরিখে। তাঁর জীবনেরই মাত্রিক প্রতিফলন লক্ষ করা যায় তাঁর দার্শনিক ভাবনায়। অন্যভাবে বলা যায় জীবনকে পাঠ করে, সেই পাঠ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে চিন্তার মধ্য দিয়ে তিনি বিমূর্ত করে তুলেছেন।
দার্শনিক ভাবনা জীবন ভাবনা দিয়ে প্রভাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক। ফুঁকোর এই ভাবনার স্বচ্ছতা আমরা আরো লক্ষ করি যখন তিনি প্রথাগত ধারার দার্শনিক ও রাষ্টনৈতিক ভাবনা থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখেন। তিনি মনে করেছেন প্রথাগত ধারার প্রতি আসক্তি কোনো তাত্ত্বিকের কাজ হতে পারে না। একজন তাত্ত্বিক একাধারে দার্শনিক ও স্রষ্টা উভয়ই। এরকম অভিব্যক্তির প্রতি তাঁর যে প্রতিশ্রুতি সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন নতুনতর ভাবনা। এজন্য তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে প্রথাগত ধারার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা। বস্তুত ফুঁকোর আগ্রহ ছিল মানুষ ও মানুষের বদলে যাবার পশ্চাতে যে বিষয়াদি রয়েছে সেসব বিষয়াদি এবং শর্তসমূহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। এই প্রত্ন-বিশ্লেষণের (ধৎপযবড়-ধহধষুংরং) মধ্য দিয়ে তিনি পেয়েছেন ক্ষমতা ও ভাবাদর্শের দ্বন্দ্বমুখর ইতিহাস। তিনি মনে করেছেন ক্ষমতা, ভাবাদর্শ ও সামাজিক বাস্তবতার পারস্পরিক অভিঘাতেই মূলত বদলে যাচ্ছে আমাদের মানবিক পরিপ্রেক্ষিতের ধরন-প্রকৃতি। এই বদলে যাবার মধ্যে তিনি অনুসান করেছেন চিন্তার মাত্রাগত অনুষঙ্গ। এই সম্পর্কের ধরন একেবারে জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির মতো। জ্ঞানতত্ত্বে জ্ঞাতা (শহড়বিৎ) ও জ্ঞেয়ের (শহড়রিহম ড়নলবপ:) সম্পর্ক ব্যতীত নিরপেক্ষ বা নৈর্ব্যক্তিক কোনো জ্ঞানকে স্বীকার করে নেওয়া হয় না। জ্ঞাতা যে মাত্রায় জ্ঞেয়’র উপর অভিঘাত করে -ঠিক সেই মাত্রায় জ্ঞেয় জ্ঞাতার জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি পাল্টে দেয়। জ্ঞানতত্ত্বের এই নির্মোহ অভিধাটিকে তিনি যথার্থ অর্থে পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সমকাল, বাস্তবতা, সমাজ ও সমাজস্খ মানুষকে যথোপযুক্তভাবে পাঠ করার মধ্য দিয়ে তিনি জ্ঞানকে চর্চা করেছিলেন। এই চর্চা ও পাঠ-রীতির নিরিখে তিনি কাল-মহাকালের, সমাজ ও সমাজস্খ মানুষের মিথস্ক্রিয়াকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
ফুকোকে যদি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে তাঁর গোটা দার্শনিক চিন্তার মধ্যে পাওয়া যায় এক দ্বন্দ্ব-মুখরতা। এই দ্বন্দ্ব-মুখরতার মধ্য দিয়ে তাঁর চিন্তা হয়ে উঠে দার্শনিক ও সামাজিক পরিবর্তনের এক বিশলায়তন অধিক্ষেত্র। চিন্তাকে তিনি প্রকাশ করেছেন নানান মাত্রায়, ধারায় চিন্তাকে তিনি কোথাও আত্মস্খ করেছেন, কোথাওবা বিগঠিত (ফবপড়হং:ৎরপ:রড়হ) আকারে, আবার কোথাওবা পুনর্নিমাণের (পড়হং:ৎঁপ:রড়হ) প্রয়াসের মধ্যে। কিন্তু কোনো তত্ত্ব, বা অভিসন্দর্ভের প্রভাব তার লেখার গতিপথকে প্রভাবিত করে না। তিনি নিজেও বলেন, ‘আমি কোনো পন্থী নই, ফন্সয়েড বা মার্কস কিংবা কাঠামোবদ্ধ কোনো কিছুই আমার চিন্তার ধারাকে পাল্টায় না।’ প্রশ্ন হতে পারে : আসলে কি কোনো দার্শনিক চিন্তায়ই ফুকোকে প্রভাবিত করে নি? নীটশে এবং হাইডেগারের দার্শনিক পদ্ধতির ধরন কী তাঁর দর্শনে নেই? অথবা প্রথাগত ধারাকে বাদ করে দেবার নিটশীয় প্রচেষ্টা তি তাঁর ঐরং:ড়ৎু ড়ভ ঝবীঁধষর:ু, অৎপযধবড়ষড়মু ড়ভ কহড়ষিবফমব নির্মাণে প্রেরণা জোগায় নি? বস্তুত নৃ-তাত্ত্বিক কাঠামোবাদী ক্লদ লেভি-স্ত্রস, সাহিত্য-কাঠামোবাদী রলা বার্ত, মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোবাদী জাক লাঁকা এবং মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আলথুজার প্রমুখের ভাবনা নানান মাত্রায়, আঙ্গিকে ও বৈশিষ্ট্যে ফুকোর দার্শনিক চিন্তাকে পথ দেখিয়েছে। তবে উল্লেখ্য অন্যান্য দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের থেকে ফুকোর পার্থক্য হল : তাঁরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে দর্শন ও সাহিত্যের মধ্যে মেলবন খুঁজেছেন। ফুকো এই মেলবনের শর্তটিকে অস্বীকার করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশ্ব-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে, ফন্সান্সের রাজনৈতিক ধারায় বিদ্যমান অস্খিরতা এবং দার্শনিক চিন্তার একমুখীনতাই তাঁর দার্শনিক চিন্তায় ভিন্নতর গতিধারা আনতে সক্ষম হয়েছে।


মিশেল ফুকোর দর্শন : উত্তর-আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত
আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া||
(পূর্ব প্রকাশের পর)

ফুঁকোর জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতি ও জ্ঞান-প্রত্নতত্ত্ব
ইতিহাস ও দার্শনিক চিন্তার আলোকে কাঠামোবাদ (ং:ৎঁপ:ঁৎধষরংস) এবং হারমিনিউটিক্স সম্বলিত অনুধ্যানকে কাজে লাগিয়ে ফুঁকো ‘নতুনতর পদ্ধতি’ উপস্খাপন করেন। ড্রেফিউজ এবং পল রবিনাউ ফুঁকোর এই পদ্ধতিকে ‘অভিব্যাখ্যান বিশ্লেষণী পদ্ধতি’ (সব:যড়ফ ড়ভ রহ:বৎঢ়ৎব:ধ:রড়হ) বলে উল্লেখ করেন। প্রথমত তাঁর পদ্ধতিটি বিশ্লেষণাত্মক। কারণ তিনি কান্টের বিশ্লেষণী রীতিকে অনুসরণ করে কোনো ধারণা বা বিষয়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত সমস্যার সমাধান দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাই বলে তাঁর এই বিশ্লেষণের ধরনকে কোনো ছকে ফেলে বিচার করার উপায় নেই। প্রশ্ন হলো তাহলে তিনি জ্ঞানের পদ্ধতির ধরন নিয়ে কী বলেছেন? বা জ্ঞান-পদ্ধতির ধরনইবা কী হবে? এ প্রসঙ্গে ফুকো স্পষ্ট করে বলেন, আমার আলোচনার পদ্ধতি ‘বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানসম্মত’ কোনোটিই নয়। কারণ জ্ঞানের পদ্ধতি হিসাবে তিনি ‘বৈজ্ঞানিকতাকে’ পরিহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে ফুকো থেকে উদ্ধৃতি টানা যাক : “আমি বিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহার না করে ‘প্রত্নতত্ত্ব’ (ধৎপযবধড়ষড়মু) শব্দটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ‘জ্ঞানের-প্রত্নতত্ত্ব’ শব্দটি বিজ্ঞানের মতো কোনোকিছু নয়। কিংবা ভবিষ্যত-বিজ্ঞানের প্রতিমাও নয়। আবার ‘প্রত্নতত্ত্ব’ শব্দটি পূর্বসংস্কার’ সম্পর্কিত কোনো ধারণাও বহন করে না। বরং শাব্দিক কর্মকুশলতার (াবৎনধষ ঢ়বৎভড়ৎসধহপব) বিশ্লেষণের ধারাকে আক্রান্ত করার কৌশলমাত্র এটি।”
তিনি জ্ঞানতত্ত্ব ব্যাখ্যায় তথাকথিত বিজ্ঞাননির্ভরতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জ্ঞান-ধারণাকে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি যে ‘প্রত্নতত্ত্ব-পরিভাষা’ ব্যবহার করেছেন। ফুকো মনে করেন জ্ঞানের চরিত্রকে কখনোই বৈজ্ঞানিক হবার প্রয়োজন নেই। কারণ বিজ্ঞান জ্ঞানকে জানার একটি কৌশল মাত্র। কিন্তু এটাই একমাত্র অনিবার্য কৌশল নয়। জ্ঞানের স্বরূপ বা চরিত্র নির্ধারণে এর ভূমিকা একান্তই নগণ্য। জ্ঞানের স্বরূপ বোঝার জন্য তাই ‘প্রত্নতাত্ত্বিক’ শব্দটি খুবই প্রাসঙ্গিক। এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে তার ‘প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা’ (ধৎপযধবড়ষড়মরপধষ :বৎৎর:ড়ৎু) এবং ‘বৈজ্ঞানিক অধিক্ষেত্র’ (ংপরবহ:রভরপ ফড়সধরহ) পরিভাষার মাধ্যমে। প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনায় আমরা মানব-ঐতিহ্যের নানামুখী ঐতিহাসিক সূত্র, তথ্য, ঐতিহ্য আবিষ্কার করি, একইভাবে ‘জ্ঞানের প্রত্নতত্ত্ব’ পরিভাষাটিও আমাদের চিন্তার প্রসারিত বহুমুখী শাখা-প্রশাখার জন্ম, বিস্তার ও বিকাশের ইতিবৃত্ত করে থাকে।
সুতরাং এটাই স্পষ্ট যে ফুকো ‘জ্ঞান-প্রত্নতত্ত্বকে’ কোনো পদ্ধতি হিসাবে দেখেননি। ‘জ্ঞান-প্রত্নতত্ত্বকে’-এর সাহায্যে তিনি প্রথাগত ইতিহাস, ঐতিহাসিকতা এবং বিকাশকে শনাক্ত করেছেন। বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করা যাক : ‘প্রত্ন’ শব্দটির ইংরেজি পরিভাষা হল ধৎপযরাবং যেখানে সবকিছু পুঞ্জীভূত বা সংরক্ষিত থাকে। ঐতিহাসিক-আর্কাইভসে যেমন সমাজ, সংস্কৃতি এবং নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীর খণ্ডিত তথ্যাদি বিন্যস্ত থাকে, বিভিন্ন কাল-পর্বের নিদর্শনাসমূহ সংরক্ষিত অবস্খায় থাকে এবং সবকিছুর বৈচিত্র্য মিলিয়ে আর্কাইভসের ধারণা তৈরি করে। আর্কাইভের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ড খণ্ড পর্যায়কে একত্রিত করেই সমগ্রতার একটি পরিপূর্ণ জ্ঞান পাই। ধৎপযরাবং শব্দটি মূলত এক সামগ্রিকতারই রূপক হিসাবে বোঝায়। এখানে যেমন সবকিছু সংরক্ষিত থাকে তেমনি জ্ঞানের ধারাটিও সমগ্র কিছুকে সংরক্ষিত রেখেই জ্ঞানের পূর্ণতা অর্জন করে। অর্থাৎ আর্কাইভসে যেমন জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস সবকিছুর সং-মিলন থাকে, সামগ্রিকতা থাকে। সুতরাং এই ধারণাটির সাহায্যেই সম্ভব জ্ঞানের সমস্ত মাত্রাকে বোঝানো। দার্শনিক পদ্ধতির আলোচনায় ‘ধৎপযরাব’-এর ধারণা ব্যাখ্যায় তিনি দেখান : প্রথাগত ইতিহাস ও দর্শনচর্চায় অহরহ বিপরীত পদ্ধতি (ৎবাবৎংরধষ সব:যড়ফ) এবং রৈখিক পদ্ধতির (ষরহবধষ সব:যড়ফ) ব্যবহার হচ্ছে। ফুকো দুটি পদ্ধতিকেই অসম্পূর্ণতা দোষে দূষ্ট বলে অভিযোগ করেন। তাই বলে তিনি কখনোই বলেন নি খণ্ড থেকে অখণ্ডে অবরোহণ করা যায়। কারণ হিসাবে তিনি মনে করেন বহুল ব্যবহৃত এই পদ্ধতির ধারাটি দর্শনকে ‘অধিবিদ্যার’ যূপকাষ্ঠে নিপতিত করে। পদ্ধতির এই প্রথাগত ধারা থেকে ফুকো দর্শনকে মুক্ত করতে চেয়েছেন।
ফুকোর দার্শনিক চিন্তার বিশেষত্ব হল তিনি সাদামাটা বিশ্লেষণে সন্তুষ্ট নন। যেমন জাক লাঁকা এবং ফার্দিনান্দ দ্যা স্যোসুর ভাষার ধরন-প্রকৃতি ও মনো-সামাজিক সংস্কৃতির যে বিশেষ টাইপ বা কাঠামোর কথা বলেন, ফুঁকোর দর্শন সেদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্নতাটি ধরা পড়ে তাঁর বিপরীত পদ্ধতি (ৎবাবৎংরধষ সব:যড়ফ) এবং খণ্ডিত জ্ঞান-অনুশীলনের (ফরংপঁৎংরাব ঢ়ৎধপ:রপব ড়ভ শহড়ষিবফমব) মধ্যে। খণ্ডিত-জ্ঞান পদ্ধতি তাঁর গোটা চিন্তায় জায়গা দখল করে আছে। এই পদ্ধতিকে তিনি দার্শনিক আলোচনায় ব্যবহার করেননি। বরং প্রচলিত দার্শনিক আলোচনায় এই পদ্ধতিটির অবিবেচক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এই পদ্ধতির সাহায্যে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান-কাঠামোর গতায়াত চরিত্রটি তুলে ধরেছেন। জ্ঞানের গতায়াত চরিত্রটি হল সকল কিছুকে খণ্ড খণ্ড করে পর্যবেক্ষণ করা। আর খণ্ড খণ্ড দৃষ্টিকোণ বা পর্যবেক্ষণ থেকে যা কিছুই দেখা হোক না কেন, বা যে কোনো জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অন্যত্র তিনি বলেন : খণ্ড খণ্ড জ্ঞান আমাদের কোনো বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ কোনো জ্ঞান প্রদান করতে সক্ষম নয়। এ জ্ঞান অনেকটা অরে হাতি দেখার মতো। অ যেমন পরিপূর্ণ হাতির জ্ঞান পায় না, পায় অংশ বিশেষের জ্ঞান, তেমনি কোনো বিষয় বা ঘটনার খণ্ড-জ্ঞান তার অংশ বিশেষের জ্ঞান প্রদান করে । খণ্ডিত জ্ঞান সমগ্রের অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। এ জন্য ফুকো দাবি করেন, যথার্থ জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হতে হবে ‘অখণ্ডতা’। অখণ্ডের জ্ঞান পাবার জন্য প্রয়োজন ‘জ্ঞান-প্রত্নতত্ত্ব’ (ধৎপযধবড়ষড়মু ড়ভ শহড়ষিবফমব)। ফুকো তাঁর দর্শনে এই জ্ঞান-প্রত্নতত্ত্বকে নানানভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন।

ফুকো তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় ইতিহাসের জ্ঞানকেও মূল্যায়ন করার প্রস্তাব করেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন প্রথাগত ঐতিহাসিক জ্ঞান-চর্চার ক্ষেত্রে রৈখিক-পদ্ধতি (ষবহরধৎ সব:যড়ফ) ব্যবহার করা হয়। ইতিহাসের বিন্যাসকে কাল-পর্বের দিক থেকে বিচার করা এই পদ্ধতির একটি বিশেষ দিক। ইতিহাস ব্যাখ্যায় এই পদ্ধতির অনুসরণের ফলে ইতিহাসকে দেখা হয় কাল-ক্রম-বিন্যাস (ংঁপপবংংরড়হ ড়ভ :রসব) হিসাবে। আবার কখনোবা যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজা-রাজাধিরাজদের ক্ষমতায় আরোহণ ও জয় পরাজয়ের কাহিনী হিসাবে। কিন্তু ‘প্রত্ন-জ্ঞান পদ্ধতি’র অনুশীলন ইতিহাসকে ভিন্নভাবে চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু ইতিহাস চর্চার প্রথাগত ধারাটি খণ্ডিত জ্ঞানচর্চার ফসল হিসাবেই তিনি মনে করেন। জ্ঞানের যে কোনো শাখায় প্রত্ন-জ্ঞান অভীক্ষার অনুশীলন জ্ঞানকে পরিপূর্ণতা দিতে সক্ষম।
ফুকোর ‘প্রত্ন-জ্ঞান-তত্ত্বকে’ যদি আমরা মেনে নেই তাহলে আবার তার ব্যাখ্যান (রহ:বৎঢ়ৎব:ধ:রড়হ) ও বিষয়ী-জ্ঞানের (ংঁনলবপ:রাব শহড়ষিবফমব) প্রসঙ্গটিই চলে আসে। আমরা লক্ষ করেছি প্রত্ন-জ্ঞানের মূল নির্যাস হল সামগ্রিকতা (:ড়:ধষর:ু)। কিন্তু বিষয়ী যখন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নির্মাণ ও বিনির্মাণের খেলায় মত্ত থাকে তখন কি প্রত্ন-জ্ঞানের নির্যাস সামগ্রিকতা গুরুত্ব পায়? মোটেই না। এখানে এসেই ফুকোর ‘ব্যাখ্যান তত্ত্ব’ পথ হারিয়ে ফেলে। জ্যাক দেরদিা প্রথাগত দর্শনের সমালোচনায় এই সামগ্রিকতাবাদের অভিযোগ এনেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে একই অভিযোগে ফুকোও অভিযুক্ত হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা দেরিদার দর্শন-পদ্ধতিটি আলোচনা করা যাক। দেরিদা মনে করেন বিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কে কোনো প্রকার সার্বিক জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়। শিল্প, সমাজজীবন নিয়ে কোন অধি-বর্ণন (মৎধহফ হধৎৎধ:রাব) তৈরি করা যায় না। অর্থাৎ ‘যুক্তিবাদ’, পরিবর্তনতত্ত্ব’ তথা ‘মার্কসীয় তত্ত্ব’ যাই বলি না কেনন্ধ এদের নিয়েও প্রভূ-বয়ান ( সধং:বৎ ফরংপড়ঁৎংব) সম্ভব নয়। তাঁর মতে চরম বয়ান (ধনংড়ষঁ:ব ফরংপড়ঁৎংব) বলে কোনো কিছু নেই। পৃথিবীতে কোনো বিষয় প্রসঙ্গেই ‘প্রভু-বয়ান’ এবং ‘চরম বয়ান’ থাকতে পারে না। অর্থাৎ ‘যুক্তিবাদ’, পরিবর্তনতত্ত্ব’ তথা ‘মার্কসীয় তত্ত্ব’ যাই বলি না কেনন্ধ এদের নিয়েও প্রভু-বয়ান সম্ভব নয়। কিন্তু ফুকোর প্রত্ন-জ্ঞান তত্ত্ব কি আমাদেরকে প্রভু-বয়ান তৈরিতে উৎসাহিত করছে? এ প্রসঙ্গে ফুকোর ব্যাখ্যানের (রহ:বৎঢ়ৎব:ধ:রড়হ) বিষয়টি উল্লেখ করা যাক : এখানে ফুকো দাবি করছেন বাস্তবতার নিরিখে কোনো কিছুকে বিচার করার মানদণ্ডও এখানে অবলুপ্ত। এ যুক্তি দ্বারা যদি প্রথাগত দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করা হয় তাহলে ব্যাখ্যানের অধিক্ষেত্র হিসাবে যে সাহিত্যকে ধরা হয় সেই সাহিত্যিকদের আনন্দিত হবার অনেক সুযোগ থেকে যায়। কারণ বিষয়ী-মন মাধুরী মিশিয়ে সৃজনের যে বিস্তৃত-অবাদভূমি নির্মাণ করে তাতে বাস্তবতা হারিয়ে যায় নানান কথায়, নানান উপস্খাপনায়। লেখকের অজান্তে রচনার পাত্র-পাত্রিগণ হয়ে উঠে এমন একটা কিছু যাকে লেখক দেখেন নি, ভাবেননি, জানেন নি সেরকম এক কল্পনার ফানুষ। যদিও ফুকো দর্শনকে সাহিত্যের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করতে রাজি নন। কিন্তু ‘ব্যাখ্যান’ প্রসঙ্গে ফুঁকো যা বলেছেন বা যুক্তি আরোপ করেছেন তাতে যে বহুমাত্রিকতা, নান্দনিকতা স্খান পায় তাতে সাহিত্যই জায়গা করে নেয়। ফুকোর এ সম্পর্কিত ধারণা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে তাঁর এপিস্টিম বা জ্ঞানাংশের ধারণায়। পরবর্তি অনুচ্ছেদে এ বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হবে।

জ্ঞান (শহড়ষিবফমব) ও জ্ঞানাংশ (বঢ়রং:বসব)
ফুকোর জ্ঞানতত্ত্বে জ্ঞানাংশ (বঢ়রং:বসব) গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে। তাঁর জ্ঞানাংশ সম্পর্কিত ধারণা পাওয়া যায় ঞযব ঙৎফবৎ ড়ভ ঞযরহমং গ্রন্থে। ‘জ্ঞানাংশ শব্দটি’ প্রচলিত জ্ঞানতত্ত্বে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ফুকো ঠিক সেভাবে এই ধারণাটিকে দেখেন নি। অনেক সময় জ্ঞান বলতে বোঝায় কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে সত্য, সুনির্দিষ্ট ধারণাকে। জ্ঞানের এই অর্থটি যথার্থতা পেয়েছে আধুনিক কালের জ্ঞান-তাত্ত্বিক-দার্শনিক রেনে ডেকার্ত-এর পদ্ধতি বিষয়ক আলোচনা এবং অনুধ্যান নামক গ্রন্থের সুবাদে। তাঁর মতে, জ্ঞান হল সুনিশ্চিত, স্বত:সিদ্ধ, সুস্পষ্ট ও স্বত:প্রমাণিত ধারণা। জ্ঞানের এই সংজ্ঞার মধ্যে সমাজরহিত একটি আচ্ছন্নতা রয়েছে। কিন্তু ফুকো জ্ঞানের এই সমাজ রহিত চরিত্রটি নিয়ে উৎসাহিত ছিলেন না। এ কারণে তিনি ‘জ্ঞানাংশ’ বলতে ‘বিষয়’ (ড়নলবপ:) ও ‘বিষয়ীর’ (ংঁনলবপ:) মধ্যকার সম্পর্ককে বোঝেন নি। ‘জ্ঞানাংশ’ বলতে তিনি কোনো যুগ-পর্ব সম্পর্কে ‘একক জ্ঞান-দেহকে’ বোঝেননি। কিংবা ‘জ্ঞানাংশ’ এমনকিছু নয়, যা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাহায্যে কিংবা কোনো কালের মনোভাব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে। পুঁজিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ কিংবা অন্য কোনো মতবাদ বা তত্ত্ব দিয়ে জ্ঞানাংশকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কোনো ব্যক্তির প্রভাব (সেটা হোক কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক, বা দমন-পীড়নের প্রভাব, যেমন হিটলার, স্টালিন, মাও, ফন্সাঙ্ক সিনাত্রা, লেনিন, কিংবা কোনো কবি বা দার্শনিক) দ্বারা এ বিষয়টিকে বুঝার কোনো জো নেই। তিনি জ্ঞানাংশ সম্পর্কিত ধারণাকে বুঝিয়েছেন ইতিহাস ও দর্শনের এক বিশাল পরিপ্রেক্ষিত থেকে। খুব সংক্ষেপে বলা যায় একটি ‘জ্ঞানাংশ’ (বঢ়রং:বসব) হল সুসংগঠিত কতগুলো নীতির পুনরুৎপাদন, যা আবার অর্থ, মূল্য ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি বস্তুর সঙ্গে অন্য একটি বস্তুর সম্পর্ক তৈরি করে। একে তিনি কখনো উল্লেখ করেছেন ‘খণ্ডিত গঠন’ (ফরংপঁৎংরাব ভড়ৎসধ:রড়হ) আবার কখনোবা ‘গঠন-রীতি’ (ৎঁষবং ড়ভ ভড়ৎসধ:রড়হ) হিসাবে। ব্যক্তির চৈতন্যের গভীরে ক্রিয়াশীল এই রীতিটি বিশেষ সময় এবং চিন্তাধারার ভূগোলটি কী রকম তা বলে দেয়। নানামাত্রায়, অভিধায় ফুকো জ্ঞানাংশ প্রত্যয়কে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। সেরকম কয়েকটি দিক আলোচনা করা যেতে পারে : এক. ফুকো তাঁর ঞযব ঙৎফবৎ ড়ভ ঞযরহমং : অহ অৎপযধবড়ষড়মু
ড়ভ :যব ঐঁসধহ ঝপরবহপবং গ্রন্থে জ্ঞানাংশ প্রত্যয়টিকে দেখেছেন ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে। এদিক থেকে কোনো কালের অভিজ্ঞতার নিরিখে সেই কালের জ্ঞানকে তিনি জ্ঞানাংশ হিসাবে উল্লেখ করেন। একেক যুগপর্বের জ্ঞানের চরিত্র একেক স্বরূপ ও প্রকৃতিতে ক্রিয়াশীল থাকে। একটি যুগপর্বের সঙ্গে দূরবর্তী কোনো যুগপর্বের মিল পাওয়া যায় না। একেক যুগপর্বে একেক রকম অভিজ্ঞতা কাজ করে। যে কারণে প্রাক-ধ্রুপদী যুগপর্ব এবং ধ্রুপদী যুগপর্বের মধ্যে একটি বিচিছন্নতা রয়েছে। ফুকো জ্ঞানাংশের চরিত্র উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন : ক. জ্ঞানাংশ হলো খাপছাড়া, পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা দোষে আড়ষ্ট। একটি কালের সঙ্গে অন্য একটি কালের অবিরাম, অবিচ্ছন্ন যুগসূত্র অনুসান করা যায় না। খ. জ্ঞানাংশ চিন্তার নিয়ামক হিসাবে কাজ করে, একটি যুগপর্বের গভীরে ক্রিয়াশীল ‘মানসিক-ভৌত অবকাঠামো’ হিসাবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
তবে ফুকো বিশ্বাস করেন চরিত্রগতভাবে জ্ঞানাংশ ‘স্বেচ্ছাচারি’ হলেও একটি যুগপর্বের সঙ্গে অন্য একটি যুগপর্বের মধ্যে অবিচ্ছিন্নতা এই জ্ঞানাংশের কারণে বজায় থাকে। জ্ঞানাংশ নিজে কোনো ইতিহাস বা ভাবাদর্শ নয়, কিন্তু এ দুটি (ইতিহাস বা ভাবাদর্শ) নির্মাণেই এ ভূমিকা রেখে থাকে। ফুকোর অন্য একটি ব্যাখ্যা লক্ষ করা যাক : আমরা কালের মধ্যে যে বিবর্তন লক্ষ করি তাকে তিনি বিবর্তন বা বিকাশ বলতে রাজি নন। তিনি মনে করেন সমাজের মধ্যস্খিত মৌলিক উপাদান তিনটি : ‘জীবন-যাপন ব্যবস্খা’, ‘শ্রমরীতি’ এবং ‘ভাষা-সংস্কৃতি’। সময়ের প্রবাহে এই তিনটি উপাদান পাল্টে যায়। এই পাল্টে যাবার মধ্য দিয়ে সমাজ অন্য একটি রূপ লাভ করে মাত্র। পরিবর্তিত রূপে এসে জ্ঞানাংশ যে চরিত্র লাভ করে তা আর পূর্বের মতো কাজ করে না। জীবন-যাপন যে জৈব চাহিদা সৃষ্টি করে, শ্রমরীতি যে আর্থ-সামাজিক বিনির্মাণ করে এবং ভাষারীতি যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সৃষ্টি করে তাতে কিছুটা পরিবর্তন অবশ্যই থাকে। কিন্তু এই পরিবর্তনটিকে বিকাশ বলার জো নেই। একেক কালের জ্ঞানাংশ যে একেক রীতিতে কাজ করে এটাই তার প্রমাণ।
দুই. জ্ঞানাংশ ধারণাটি দ্বারা তিনি ‘অনুসানের সম্বকে’ (ৎবষধ:রড়হ ড়ভ রহয়ঁরৎু) বুঝিয়েছেন। ‘অনুসানের সম্ব’ বিন্যস্ত হয় ক্রমান্বয়ে, ধাপে ধাপে। প্রত্যেকটি ধাপে ঐ সময়ের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ জন্য তিনি বিগত কয়েক শ’ বছরের ভাষা ও সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যা সাপেক্ষে দেখিয়েছেন জ্ঞানের প্রকৃতি কীভাবে পরস্পর থেকে ভিন্ন হয়। যেমন ষোল শতকের দিকে ভাষা-সংস্কৃতি ও সত্য অনুসানের জন্য যেভাবে ‘অনুসানের সম্ব’কে ব্যবহার করা হয়েছে চিরায়ত যুগে কিংবা আধুনিক যুগের ধারা থেকে তা আলাদা ও স্বতন্ত্র। এই যে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে অনুসানের সম্বরে মডেলটি বিভিন্ন স্বরূপে প্রকাশিত হচ্ছে বা কাজ করছে তার ভিত্তিতে রয়েছে জ্ঞানাংশ। আমরা যদি আরো সূক্ষভাবে লক্ষ করি তাহলে দেখব বিভিন্ন যুগের বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাসের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই বিন্যাসের মধ্যে আবার কাজ করে বিভিন্ন স্বরূপের জ্ঞান-কোড। যুগ থেকে যুগে এই ‘কোড’ যেমন ভিন্ন হয়, তেমনি সাংস্কৃতিক ভিন্নতার সঙ্গেও তার ভিন্নতাও অক্ষুণí থাকে। এজন্য চরিত্রের দিক থেকে জ্ঞানাংশ বহুমুখীন। জ্ঞানাংশের মধ্যে এই বহুত্ববাদী ধর্ম থাকলেও এরা পরস্পর সহ-অবস্খান করতে পারে। পরস্পরের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে।
গ. উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যাচ্ছে জ্ঞানাংশ ধারাক্রমহীন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী চরিত্র নিয়ে ক্রিয়াশীল থাকে। সভ্যতা, আদর্শ এবং ইতিহাস নির্মাণে তা কৌশলী-যন্ত্র (ং:ৎধ:বমরপ ধঢ়ঢ়ধৎধ:ঁং) হিসাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু তাই বলে একে তিনি কোনো তত্ত্ব হিসাবে বিবেচনা করতে রাজি নন। কোনো তত্ত্ব যেভাবে কাজ করে ‘জ্ঞানাংশ’ ঠিক সেভাবে কাজ করে না। কিংবা ‘জ্ঞানাংশকে’ তিনি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে উল্লেখ করতে চান নি। কারণ বিজ্ঞানের মধ্যে ফুকো খুঁজে পেয়েছেন কার্যের সঙ্গে কারণের অহেতুক ও আরোপিত সম্পর্ক স্খাপনের প্রচেষ্টা এবং একটি বিষয় থেকে অন্যটিকে আলাদা করার জন্য শ্রেণীকরণ রীতি। এ ধরনের আরোপিত জ্ঞান, হাস্যকর শ্রেণীবিভাজন রীতি আমাদের জ্ঞানের ভিত্তি ও চিন্তাধারার সীমানাকে সংশয়াপন্ন করে তোলে বলেই তিনি বিজ্ঞান দর্শন বা বিজ্ঞানের ইতিহাস নির্মাণের যে কোনো প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখান করেন। তাই বলে ফুকো বিজ্ঞানশীলতাকে বর্জন করেননি। কারণ বিজ্ঞানশীলতা কোনোকিছুর সত্যতা-মিথ্যাত্ব প্রতিপাদন করতে সক্ষম। অন্যভাবে বলা যায় একটি জ্ঞান-অবধারণ (লঁফমসবহ:) থেকে অন্য প্রকৃতির কোনো অবধারণকে আলাদা করার জন্য এই পদ্ধতিটি খুবই বস্তুনিষ্ঠ পন্থায় কাজ করতে সক্ষম। যেমন দুটি অবধারণের একটি বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অন্যটি তা নয়, এ দুটির মধ্যে পার্থক্য ষ্পষ্ট করার জন্য জ্ঞানাংশ বা এপিস্টিম কাজ করে।
þöাইডকার্লিপাস রূপক দৃষ্টান্তের সাহায্যে ফুকোর এপিস্টিম বা জ্ঞানাংশকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। þöাইডকার্লিপাস ব্যবহার করে আমরা যেমন গোলকের ঘনত্ব নির্ধারণ করতে পারি তেমনি জ্ঞানাংশ কালের মাত্রাকে নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। জ্ঞানাংশ ব্যবহার করে আমরা কোনোকিছুর সত্যতা-মিথ্যাত্ব প্রতিপাদন করতে পারি। বিভিন্ন জ্ঞান-অবধারণের মধ্যে বিদ্যমান দ্যোতনা, ভেদ-অভেদ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তা কাজ করে। ধরা যাক একটি অবধারণ বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, আবার কোনকটি তা নয়। অথচ এ দুটি ভিন্ন প্রকৃতির বাক্যকে আলাদা চরিত্রে বোঝার জন্য জ্ঞানাংশ কাজ করে থাকে। টমাস কুনের প্যারাডাইমের আঙ্গিকে ফুঁকোর জ্ঞানাংশকে বোঝা যেতে পারে। তবে স্বরূপগতভাবে টমাস কুনের প্যারাডাইমের সঙ্গে ফুঁকোর জ্ঞানাংশ-প্রকল্পের পার্থক্যও স্পষ্ট। কুন প্যারাডাইমকে ব্যবহার করেছেন বৈজ্ঞানিক বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর অনুশীলনের কৌশল হিসাবে। ফুকো তাঁর এই কৌশলকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসূত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বয়ানের বিস্তৃতি পরিসর বা ‘রিফবৎ ৎধহমব ড়ভ ফরংপড়ঁৎংব’ হিসাবে দেখেছেন। এ দিক থেকে কুনের প্যারাডাইম শিফটের সঙ্গে ফুকোর ‘জ্ঞানাংশে’র স্পষ্টত পার্থক্য বিদ্যমান।
(বাকি অংশ পরবর্তী সংখ্যায় পড়ুন)


চিন্তা ও জ্ঞানাংশ
প্রশ্ন হল জ্ঞানাংশ (বঢ়রং:বসব) কীভাবে চিন্তাকে গঠন করে? ফুকো এ বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য ‘ঔষধের ধারণা’ দৃষ্টান্তের সাহায্য নিয়েছেন। কোনোপ্রকার চিন্তাভাবনা না করেই যে কোনো ব্যক্তি অনায়াসে মন্তব্য করতে পারেন “অসুখে ঔষধের যথেষ্ট উপকারিতা রয়েছে, মূল্য রয়েছে এবং স্বাস্খ্যের জন্য তা খুবই জরুরি।” এরকম ভাবার কারণ কী? কারণ সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান, যেমন : হাসপাতাল, চিকিৎসালয়, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী সংস্খা, গণমাধ্যম ইত্যাদিন্ধ সব আমাদেরকে এভাবেই শিখতে সাহায্য করেছে। কিন্তু আমরা এটাও প্রশ্ন করতে পারি, “সত্যিকার ঔষধ কোনটি যাতে বাস্তবিকই অসুখ সারে?” উত্তরে হয়তো অনেকেই বলতে পারেন : সত্যিকার অর্থে অসুখ সারে সেরকম ঔষধ হল ‘প্রতিষেধক’ (ধহ:রনরড়:রপ)। আবার এই প্রতিষেধকের ধারণাটি বোঝা যাবে অন্য একটি ঔষধের সঙ্গে তুলনা করেন্ধ যা প্রতিষেধক নয়। আসলে প্রত্যেকটি বিষয়ের জ্ঞান পাবার জন্য প্রয়োজন ‘বস্তুর মধ্যকার শৃঙ্খলা’ (ড়ৎফবৎ ড়ভ :যরহমং) সম্পর্কে জানা। ‘বস্তুর মধ্যকার শৃঙ্খলা’ একদিকে কতগুলো বৈজ্ঞানিক নিয়মের ধারণা ও যুক্তি-পদ্ধতির মধ্যকার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে দেহের চর্চা যা ডাক্তার এবং সেবিকাদের নিয়ে গঠিত রোগ-নিরাময় প্রণালির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সুতরাং স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, বস্তু-ধারণা (রফবধ ড়ভ ধ :যরহমং) বলতে ফুকো বুঝেছেন জনগণ, ধারণা, বস্তুগত উপাদান এবং মনোভঙ্গি তথা দৃষ্টিভঙ্গিকে। আবার বস্তুকে তিনি দু’টি দিক থেকে বিভাজিত করেছেন ‘হয় ঔষধ’ (যা একাধারে মূল্যবান তথা বৈজ্ঞানিক) নতুবা ‘গণ-প্রতিকার’ (যা খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হয় কিংবা মূল্যবান হিসাবেও ধরা হয়) হিসাবে। জ্ঞানাংশ সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা দেবার জন্য ফুকো অভিন্নতা (ংধসবহবংং), পরিবেশন (ৎবঢ়ৎবংবহ:ধ:রড়হ) এবং ভিন্নতা (ফরভভবৎবহপব) সম্পর্কিত কয়েকটি ধারণার একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। এই তিনটি ধারণার সঙ্গে তিনি তিনটি কাল-পর্বের দার্শনিক কৌশলের সান পান। সংক্ষেপে এ বিষয়সমূহ দেখা যাক :
এক. জ্ঞানচর্চার উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হল ‘দুটি বস্তু বা ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য দেখে’ ঐ বস্তু বা ঘটনা প্রসঙ্গে একটি সিদ্ধান্তে আসা। এজন্য ফুকো রেনেসাঁস পর্বকে উল্লেখ করেছেন ‘সাদৃশ্যতার যুগ’ (ধমব ড়ভ ৎবংবসনষধহপং) হিসাবে। এ সময়ে চিন্তা পরিচালিত হতো সাদৃশ্যতা দিয়ে। মানব চিন্তায় চার রকমের সাদৃশ্য কাজ করে :
ক. কনভেনিয়েনসিয়া : নিকটবর্তী বৈশিষ্ট্য দেখে বস্তুর মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হলো এ ধরনের সাদৃশ্যানুমানের কাজ। যেমন দেহের সঙ্গে মনের সংযোগ এই সাদৃশ্যনুমান থেকে করা হয়। কিন্তু এ ধরনের সাদৃশ্যনুমান কতোটা যৌক্তিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে। ইতোমধ্যে আমরা ডেকার্তের দ্বৈতবাদী দর্শনের সাহায্যে জেনেছি ‘দেহ’ এবং ‘মন’ পৃথক ও স্বতন্ত্র। দেহের আছে বিস্তৃতি, মনের আছে চেতনা। আচরণ মনোবিজ্ঞানও দেহ ও মনের এই বৈপরীত্যকে স্বীকার করে নেয়। এরকম বিপরীত দুই সত্তার মধ্যে সাদৃশ্য অনুমান টানা কতোটা যুক্তিসঙ্গত তা বিবেচ্য বিষয়।
খ. অ্যাকমুলেসিও : দুটি দূরবর্তী বস্তুর মধ্যও আমরা সাদৃশ্যনুমান করে থাকি। যেমন অনেক সময় সুন্দর মুখাবয়ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলি ‘চাঁদ বদন’। এখানে মুখের সৌন্দর্যকে চাঁদের সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করে মুখাবয়বকে বোঝানো হচ্ছে মাত্র।
গ. অ্যানালজি : দুটি বস্তু বা ঘটনা কতোটা নিকট সম্পর্কে আবদ্ধ তার আঙ্গিকে আমরা সাদৃশ্যনুমান করে থাকি। এ ধরনের সাদৃশ্যের মাধ্যমে আমরা বস্তুসমূহের মধ্যে শৃঙ্খলা স্খাপন করে বস্তুর জ্ঞান পাই। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ন্ধ এখানে পাখির নীড় চোখের এনালজি হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
ঘ. এনþেöইভড : একটি বস্তু বা বাস্তবতার সঙ্গে অন্য একটি বস্তু বা বাস্তবতার সংযোগ দেখানোর ক্ষেত্রে আমরা এ ধরনের সাদৃশ্যনুমান ব্যবহার করি। যেমন গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে যে আবর্তন হয় তার সঙ্গে মানব ভাগ্যকে মেলানোর জ্ঞান মূলত এই সাদৃশ্যানুমান রীতিতে হয়ে থাকে।
দুই. সপ্তদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের তিন-চতুর্থাংশ সময়কালকে বলা হয় ধ্রুপদী যুগ। এ যুগে জ্ঞান বিন্যাসের জন্য আর সাদৃশ্য পদ্ধতিকে অনুসরণ করা হয়নি। এ সময়ে সাদৃশ্যনুমান রীতিতে জ্ঞান আহরণের প্রয়াসটি পাল্টে যায়। সাদৃশ্যের পরিবর্তে এখানে অনুসৃত হয় ‘পরিবেশন পদ্ধতি’ (সব:যড়ফ ড়ভ ৎবঢ়ৎবংবহ:ধ:রড়হ)।
তিন. অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে অদ্যাবধি সময়কালকে ফুকো আধুনিক কাল হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, এ সময়ে সাদৃশ্যরীতি বা পরিবেশন পদ্ধতি কোনোটিই কাজ করেনি। বরং এ দুটির পরিবর্তে ‘বস্তুর শৃঙ্খলা’ (ড়ৎফবৎ ড়ভ :যরহমং) পদ্ধতি অনুসৃত হতে থাকে। এ পর্বে জ্ঞানাংশ ম্যাথেসিস, ট্যাক্সোনমিয়া ইত্যাদি ধারা কার্যকর ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান উভয়ই এ রীতিতে জ্ঞান আহরণকে উৎসাহিত করে থাকে। এ পর্যায়ে জ্ঞানাংশের মূল চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় জ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে অসংগতিপূর্ণ গল্প ফাঁদা।
ফুকো চারশ’ বছরের ইউরোপীয় জ্ঞানচর্চার ধারাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ বিগত চারশ’ বছর ধরে জ্ঞানচর্চায় ‘খণ্ডতা’ যেন তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে একেকটি কাল-পর্বে একেকটি খণ্ডতা বা জ্ঞানাংশ কাজ করে। একেক কাল-পর্ব থেকে অন্য কাল-পর্ব-সমূহের মাত্রা, ধরন এবং পদ্ধতি উভয় দিক থেকে আলদা। একটির সঙ্গে অন্যটিকে মেলানো ঠিক নয়। বিভিন্ন কাল পর্বের এই স্বতন্ত্র ধারাকে আমেরিকান দার্শনিক টমাস কুন বলেছেন ‘প্যারাডাইম শিফ্ট’ হিসাবে। ‘প্যারাডাইম শিফ্ট’-এর মূল বক্তব্য হল : কম কিংবা বেশি যাহাই হোক না কেন, বৈজ্ঞানিক যুক্তি বিকশিত হয় রৈখিক প্রগতিতে (ষরহবধৎ ঢ়ৎড়মৎবংং)। কুন আরো বলেন, বৈজ্ঞানিক অতিক্রমণ (ংপরবহ:রভরপ ংযরভ:) হলো অনেকটা ‘বিল্ডিং ব্লক’-এর মতো। কিন্তু ফুকো কুনের মতো এই স্বাতন্ত্র্যকে কোনো প্রকার পদ্ধতিগত উত্তোলন হিসাবে দাবি করেননি। ফুকোর ব্যাখ্যা টমাস কুনের ব্যাখ্যা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ কুনের ব্যাখ্যা মেনে নিলে রেনেসাঁস থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত প্রত্যেকটি অতিক্রমণকে ধরতে হবে রৈখিক (ষরহবধৎ) এবং প্রগতি (ঢ়ৎড়মৎবংংরাব) হিসাবে। কিন্তু ফুঁকো এই উত্তরণকে রৈখিক কিংবা প্রগতিমুখী বলতে রাজি নন।
১০
ফুকোর জ্ঞানতত্ত্ব ও ব্যাখ্যান
ফুকো তাঁর তত্ত্ব-চিন্তার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন, পরিবর্তনশীল জগতের অভিজ্ঞান এবং মানবিক সংকটের টানাপোড়েনকে গঠন ও বিঘটনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর করেছেন। এই ধারাবাহিকতার কারণে লক্ষ করা যায় তাঁর পূর্ববর্তী রচনাসমূহের অভিব্যক্তি, প্রয়াস ও প্রক্ষেপণ পরবর্তী রচনায় অনুপস্খিত। অনেক ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অবস্খানকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছেন। এজন্য বলা যায় ফুকোর ভাবনা স্খির, নির্ধারিত বা কাঠামোবাদী ধারা দ্বারা অনুসৃত হয় নি। ফুকোর ভাবনার পরিপূর্ণতা আমরা লক্ষ করি অৎপযধবড়ষড়মু ড়ভ কহড়ষিবফমব (১৯৬৯) গ্রন্থে। এখানে তিনি দেখান চিন্তার ধারাপ্রবাহ কীভাবে বিষয় ও বিষয়ীর সঙ্গে এক ও অভিন্ন হয়ে যায়। এরকম এক ও অভিন্ন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে লেখক বা তাত্ত্বিক যখন কোনো বিষয় নিয়ে ভাবেন, সেই ভাবনা তার নিজস্ব আঙ্গিক ও চেতনার প্রকৃতি থেকেই হয়। এই আঙ্গিক-ভাবনা প্রকাশিত হওয়ার অর্থই হল লেখক-সত্তারই প্রকাশ। লেখকের অভিজ্ঞতা, ভাবনা, অর্জিত জ্ঞান-অভিজ্ঞান কোনো কিছুই তা থেকে বাদ পড়ে না। সুতরাং কোনো রচনায়ই শেষ পর্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক (রহ:বৎঢ়বৎংড়হধষ) হয়ে উঠতে পারে না। নৈর্ব্যক্তিক অবস্খান থেকে কোনো লেখকের পক্ষেই কোনো কিছু দাঁড় করানো সম্ভব নয়। বাস্তবতাটি যেভাবে থাকে লেখকের বর্ণনার মধ্য দিয়ে তা কিছুটা বস্তুনিষ্ঠতা হারায়। আবার লেখকের ব্যাখ্যাটি অন্য-বয়ানের মধ্য দিয়ে হারিয়ে যায় তার মূল অভিব্যক্তিটি। অর্থাৎ লেখক যেভাবে ‘মূল-পাঠ’ (মবহবৎরপ :বী:) নির্মাণ করেন তা আবার হারিয়ে যায় ’ব্যাখ্যানের’ (রহ:বৎঢ়ৎব:ধ:রড়হ) মধ্য দিয়ে। মূল-পাঠ থেকে একটা কিছু হারিয়ে গিয়ে ব্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে নতুন-পাঠ তৈরি হয়। সেই নতুন পাঠটিকে তাই বলে তাৎপর্যহীন বলা যাবে না। কারণ কোনোকিছুই স্খির বা অপরিবর্তনীয় নয়। সকলকিছূই বদলায় : সময়, বাস্তবতা, জ্ঞান-অভিজ্ঞান, নির্মাণ, অবিনির্মাণ সবকিছুই এই পাল্টানোর ধারা থেকে আলাদা নয়। সুতরাং পাল্টানোর ধারায় ত্রিমাত্রিকতা রয়েছে : মূল-বাস্তবতা (মবহবৎরপ ংর:ঁধ:রড়হ), লেখকের ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে পরিবেশিত পাঠ (ৎবঢ়ৎবংবহ:ধ:রাব :বী:) এবং ব্যাখ্যান (রহ:বৎঢ়ৎব:ধ:রড়হ)। ফুকোর কাছে ‘ব্যাখ্যান’ হল তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যাখ্যানের পক্ষ নেন। এ প্রসঙ্গের রেশ ধরে ফুকো বলেন, “সকল-কিছুই ইতোমধ্যে ব্যাখ্যাত” (বাবৎু:যরহম রং ধষৎবধফু রহ:বৎঢ়ৎব:ধ:রড়হ)। ফুকোর এই বক্তব্যের মধ্যে কী আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘আমি’ কবিতার প্রতিধ্বনি পাই? “আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ/চুনি উঠে রাঙা হয়ে/”। এখানে কবি যেন মূল-পাঠেরই ব্যাখ্যান দাঁড় করাচ্ছেন চেতনার নান্দনিকতায়। “আমি চোখ মেললুম আকাশে জ্বলে উঠলো আলো পুবে-পশ্চিমে”ন্ধ এ যেন আলোকিত পৃথিবী নতুন আঙ্গিকে নতুন নির্মাণে কবির কাছে ধরা পড়েছে। নান্দনিক চেতনার অভিমিশ্রণে কবি আসলে সবুজ চুনিকে রাঙা, আলোকিত পৃথিবীকে কবির অন্তর্নিহিত ভাবোচ্ছ্বাসের মাধুরী মিশিয়ে আরো আলোকিত করে দেখতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই মাধুরী মেশানো আলোকিত পৃথিবী আদি-পাঠেরই ‘ব্যাখ্যান’ বৈ কিছু নয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে ফুকোর ‘ব্যাখ্যান’ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন চলে আসে : ফুকো যে ব্যাখ্যানকে অপরিহার্য করে তুলেছেন তা কি চিন্তা ও সামাজিক বাস্তবতায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে না? কারণ যখন ব্যাখ্যানের সাহায্যে আদি-পাঠকে উপস্খাপন করা হয় তখন সেখান থেকে কিছু শর্ত হারিয়ে যায়, আবার কিছু বিষয় অতি-শায়িত হয়ে উপস্খাপিত হয়। এভাবে মূল-পাঠকে বিকৃত করার সুযোগ থাকে। সমকালীন পুঁজিবাদী বাস্তবতায় এ বিষয়টি যথেষ্ট বিচারের দাবি রাখে। ‘ইরাক ও সাদ্দাম’ ইস্যুতে পুঁজিবাদী প্রতিভূ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা জর্জ বুশের অবস্খানটি মূল্যায়ন করা যাক : গোটা বিশ্বের নামকরা সব মিডিয়ার বদৌলতে বুশ ইরাক ইস্যুকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। এই প্রচেষ্টায় আমরা লক্ষ করি ফুকোর ‘ব্যাখ্যানের’ দুটি নেতিবাচক উপাদানই উপস্খিত রয়েছে : ইরাকিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে এসব মিডিয়াতে প্রথমত হেয় ও হীন করে উপস্খাপন করা হয়েছে, আবার বুশ এবং আমেরিকান দৃষ্টিকোণ থেকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ তথা ‘মারাত্মক মারণাস্ত্র’ থাকবার বিষয়টিকে প্রমাণ-ব্যতিরেকে অতি-শায়িত করে উপস্খাপন করা হয়েছে। একটি রাষ্ট্রের গণতন্ত্র পনুরুদ্ধার, সন্ত্রাস ও সহিংসতা রোধকল্পে ইরাকি জনগোষ্ঠীকে পুনরুদ্ধার করার জন্য তারা বক্তৃতা করছেন। মার্কিন ও তার অনুগত যৌথ-বাহিনীর হত্যাকাণ্ড এবং ইরাকি সম্পদ-লুণ্ঠন করার মতো জঘন্য বিষয়সমূহও আড়াল করে সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে পরিবেশন করা হচ্ছে। এ-কাজে মার্কিনী প্রচার মাধ্যমসমূহও ‘প্রোপাগাণ্ডায়’ ভূমিকা রাখছে। সুতরাং ‘ ব্যাখ্যানের’ মূল অভিপ্রায় কিন্তু ক্ষমতার দিক থেকে যারা প্রান্তিক তাদের জন্য কাজ করছে না, বরং ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিবর্গের পক্ষেই কাজ করছে। বস্তুত ব্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাকৃত ও প্রবণাতাজাত বাস্তবতান্ধ সেও পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণেরই আরেকটি কৌশল। আমাদের তৃতীয় বিশ্বের রাষ্টসমূহও এ কর্মে কম যায় না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কানসাট, ফুলবাড়ী এমনকি বিভিন্ন সময়কালের গণ-আন্দোলনের সময় সরকারী ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ এই ব্যাখ্যানের আওতায় চলে আসে : এক. আন্দোলনকারী জনগোষ্ঠীর ক্ষোভের ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষয়ক্ষতির বিশাল হিসাব লক্ষ করা যায় এসব মিডিয়াতেন্ধ এটা হল ব্যাখ্যানের আতিশায়িত অবস্খা, দুই. আন্দোলন প্রতিরোধ করতে গিয়ে সরকারের পেটোয়াবাহিনী যে হত্যা-যজ্ঞ চালায়, লাঠিপেটা করে, ঘটনার অনুপুঙ্খতা সহ অনেক অনেক তথ্যই মিডিয়া পাশ কেটে যায়ন্ধ এটা হল ব্যাখ্যানের ন্যূনতার দিক। তাহলে ‘ব্যাখ্যানে’ দুটি দিক রয়েছে : একটি হল ঘটনার অতিশায়ন, অন্যটি ন্যূনতা অন্যভাবে ঘটনার মধ্য থেকে হারিয়ে যাওয়া বিষয় আশয়। সুতরাং ব্যাখ্যানে আলো এবং অকার দুটোই রয়েছে।
ফুকো যখন বলেন, “সবকিছু ইতোমধ্যে ব্যাখ্যাত হয়ে গিয়েছে”ন্ধ তাতে ইতিহাসের শর্তাদির সংকটাপন্ন অবস্খাটি চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু সবকিছু ব্যাখ্যা হয়ে গিয়েছে এখানে এসে স্খাণুর মতো নিশ্চল হয়ে থাকার জো নেই। কারণ ইতিহাসের একটি সর্পিল ধারা-পথ রয়েছে, এ গতিধারায় নানানমুখী গ্রহণ-বর্জন, পরিবর্তন ও পরিশোধন অব্যাহত রয়েছে। আবার ইতিহাসের মূল-চালিকা শক্তি যে মানুষ এবং তার উৎপাদন সম্পর্ক তাও সুনির্দিষ্টকালের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দ্বারা পথ চলে না। সময়, বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা নতুন নতুন কালের জন্য নতুন নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। সুতরাং সবকিছু ব্যাখ্যা হয়ে গিয়েছে এ-কথা বললে নতুন কোনো অর্জনকে উৎসাহিত করা হবে না, বরং থামিয়ে দেওয়া হবে। বরং পুরোনো ব্যাখ্যাসমূহের গ্রহণ ও বর্জন, কিংবা অতি-শায়িত ও ন্যূনতা শর্তাদিও শনাক্তকরণের মধ্য দিয়ে মানবিক পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণের প্রসঙ্গটিকেও ধর্তব্যে আনতে হবে। সুতরাং ফুঁকোর দার্শনিক চিন্তায় অনুশীলন বা তৎপরতার বিষয়টি অবহেলিত রয়ে গেছে। ফুকোর দার্শনিক চিন্তায় বস্তুনিষ্ঠতাও সেভাবে স্খান পায় নি। ফুকো মনে করছেন ব্যক্তি (বিষয়ী) কোনো বিষয় (তথ্য) নির্মাণে স্বাধীন। কিন্তু বিষয়ী কী তার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বিষয় নির্মাণ করেন, নাকি বিষয় যেভাবে থাকে ঠিক সেভাবেই তার কাছে প্রতিপাদিত হয়? এরকম প্রশ্ন দিয়ে ফুকোর চিন্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। কারণ ফুকো মনে করেন ব্যক্তি যখন কোনো নির্মাণ করেন সেখানে তিনি স্বাধীনন্ধ এ স্বাধীনতা আবার নৈরাজ্য নয় তো? কারণ নির্মাণের ক্ষেত্রে কর্তা যদি বস্তুনিষ্ঠ না হয়ে স্বাধীন হন তাহলে সেখানের ব্যক্তির ‘হেঁয়ালি মনের খেলা’ জায়গা করে নেবে। তাতে করে বিষয়ের চারপাশ, তার বাস্তবতা, প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত এসব কিছু বাদ পড়ে যাবে। শুধু জ্ঞান-নির্মাণ হোক, আর ভাস্কর্য নির্মাণই হোক অন্তত এ ক্ষেত্রে ফুকো বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় দিতে পারেন নি।
১১
উপসংহার
ফুকোর দর্শনভাবনা, সমাজতত্ত্ব এবং চিন্তার ইতিহাসে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। জ্ঞানের সঙ্গে ক্ষমতা, সমাজ এবং ইতিহাসের এক অনবদ্য সম্পর্ক স্খাপন করেছেন। প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসতত্ত্ব, দার্শনিক জ্ঞান এবং সমাজকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ করি তাঁর বিভিন্ন রচনায়। এসব দেখার পেছনে তিনি যে আইকনটি রেখেছেন তা জ্ঞানতত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব নিরঙ্কুশভাবে সমালোচনার উর্ধে নয়। ফুকো তার গোটা দর্শনে যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এমনকি ইউরোপীয় রেনেসাঁস বা আলোকসম্পাত যে যুক্তিবাদের পক্ষে জোরালো অবস্খান নেয় ফুকো তার বিরুদ্ধে অবস্খান নিয়েছেন। কিন্তু সমালোচনা-তাত্ত্বিক ইয়ুর্গন হাবারমাস এ ধরনের যুক্তিবাদ-বিরোধিতাকে প্রত্যাখান করেন। যুক্তিহীনতা চিন্তাভাবনাকে নৈরাজ্যবাদের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং কঠোরভাবে যুক্তির প্রত্যাখানকে মেনে নেওয়া যায় না। হাবারমাস চযরষড়ংড়ঢ়যরপধষ উরংপড়ঁৎংব ড়ভ গড়ফবৎহর:ু গ্রন্থের দুটি অধ্যায়ে ফুকোর চিন্তা ভাবনায় বিদ্যামান ভ্রান্তিসমূহ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত ঞযড়সধং ইরবনৎরপযবৎ, টহরাবৎংর:ু ড়ভ ঋষড়ৎরফধ, এধরহবংারষষব প্রমুখের লিখিত ঐধনবৎসধং, ঋড়ঁপধঁষ: ধহফ ঘরব:ুংপযব: অ উড়ঁনষব গরংঁহফবৎং:ধহফরহম প্রবে ফুকো সম্পর্কে হাবারমাসের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা করেন। তারা বলেন, ফুকো জ্ঞানতাত্ত্বিক নির্মাণের ক্ষেত্রে মানব জ্ঞান, মানবপ্রকৃতি, আলোকসম্পাত ইত্যাদি সব বিষয় নিয়ে যা বলেছেন তার মধ্যে পপারের বিজ্ঞানের দর্শন, এবং কুনের দার্শনিক ভাবনান্ধ এসবকিছুর যুৎসই প্রভাব পাওয়ার কোনো কারণ নেই। অথচ হাবারমাস ফুকোর জ্ঞানতত্ত্ব প্রত্যাখানে এসব দর্শনের প্রভাব রয়েছে বলে দাবি করেন। হাবারমাস আরেকটি বিষয় লক্ষ করেছেন : প্রত্ন-পদ্ধতির সাহায্যে ফুকো জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের যে সংশোধিত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তা মূলত ‘ছদ্ম-বিজ্ঞানের’ (ঢ়ংবঁফড়-ংপরবহপব) মানবতাবাদী কূটাভাস (যঁসধহরং:রপ ঢ়ধৎধফড়ী)। এ ধারার জ্ঞান-পদ্ধতির উপর ভর করে ফুকো ক্ষমতাতত্ত্বের জন্য যে নতুন বিজ্ঞান দাঁড় করিয়েছেন তা অতি-বিজ্ঞানও বটে। হাবারমাসের এই বক্তব্যের প্রতধ্বনি লক্ষ করি নোয়াম চমেস্কির এক টিভি সাক্ষাৎকারে। চমেস্কিও দাবি করেন আঠারো শতকের যুক্তিবাদে যে স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার ধারণা সম্পৃক্ত রয়েছে ফুকো সেই যুক্তিবাদকে প্রত্যাখান করে মানব-জ্ঞানের ইতিহাসকে প্রত্যাখান করেছেন। সতের এবং আঠারো শতকে জ্ঞানাংশ যেভাবে কাজ করেছে সে সম্পর্কে ফুকো মনে করেন : তাতে দমন, পীড়ন এবং বহিষ্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এরকম দাবিতে দুটি শতাব্দীর অর্জনসমূহকে অস্বীকার করা কতোটুকু যথার্থ জ্ঞান-তথ্য সরবরাহ করে? এরকম প্রশ্নসাপেক্ষে চমস্কি মনে করেন, কালের এপিস্টিম বা জ্ঞানাংশ যে চরিত্রে ফুকোর কাছে প্রতিপাদিত হয়েছে তাতে দমন-পীড়নই মুখ্য। বাস্তবে তা সঠিক নয়। এর বিপরীতে ব্যক্তির সৃজনশীলতা, সৃজনকর্মে ব্যক্তির সামর্থ, স্বত:প্রণোদিত উদ্ভাবন-প্রবণতা এবং বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের আগ্রহ ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় ফুকো দর্শন ও জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে যে অনুসান চালিয়ছেন তাকে পরিপূর্ণভাবে বাদ করে দেবার কোনো জো নেই। কারণ মানব-মনের গভীরে যে ক্ষমতালিïসা কাজ করে তার প্রকাশ নানানমাত্রায় ঘটতে পারে, এই প্রকাশরীতিটি ফুকোর জ্ঞানতত্ত্ব এবং দর্শনে উন্মোচিত হয়েছে। এখানেই তার কৃতিত্ব।

No comments:

Post a Comment