“বাংলা ভাষা বলে একটি বিশেষ ভাষা নেই, বাংলা বহু ভাষা।”
সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে আলাপ
…….
সলিমুল্লাহ খান (জন্ম. ১৮ আগস্ট ১৯৫৮), ছবি. নাসির আলী মামুন
……
সলিমুল্লাহ খান: আমি যখন প্রথম কবিতা লেখা শুরু করি তখনও আমি অনুবাদ করেছি কিন্তু প্রকাশের সুযোগ হয়নি। আমার প্রথম কবিতার বই এক আকাশের স্বপ্ন মৌলিক কবিতা দিয়ে ৬৪ পৃষ্ঠা হচ্ছিল না, পৃষ্ঠা পূরণের জন্য ৩/৪ টা অনুবাদ কবিতা বইতে দিয়েছিলাম।
—————————————————————-
আমি যদি গ্রিক ভাষা কিম্বা ইটালিয়ান ভাষা শিখতে পারি যেমন মধুসূদন শিখেছিলেন, তাহলে আমার উচিত ময়মনসিংহের ভাষা, বরিশালের ভাষা শেখা। কলকাতার ভাষা প্রতিষ্ঠিত ভাষা হয়ে গেছে বলে আর ময়মনসিংহের ভাষায় কোন মনযোগ দেওয়া যাবে না, প্রবণতা হিসাবে এটা হবে কবিদের জন্য ক্ষতিকর। কিছু কিছু আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এমন প্রকাশভঙ্গি আছে যা তথাকথিত শুদ্ধ ভাষায় নেই।
—————————————————————-
শামস আল মমীন: অনুবাদের জন্য সবাই বেছে নেন বহু পরিচিত, বহু পঠিত কোন লেখককে। সে ক্ষেত্রে আপনি ডরোথি জুল্লের মতো বাংলাদেশে প্রায় অপরিচিত কবিকে বেছে নিলেন কেন?
…….
আল্লাহ্র বাদশাহি । সলিমুল্লাহ খান অনূদিত বাম গণতান্ত্রিক জার্মান কবি ডরোথি জুল্লের কবিতা । প্রচ্ছদ: ওবায়দুল্লাহ আল মামুনের ছবি অবলম্বনে সেলিম আহ্মেদ । প্রকাশক: সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা । সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ । ৮০ পৃষ্ঠা । ৮৫ টাকা ।
……..
সলিমুল্লাহ খান: উত্তর খুব সোজা। আমি কবির নাম দেখে কবিতা পড়ি না। কবিতা পড়ার পর কবির নাম দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে তখন আমি কাজ করি, বইয়ের তাকে বই গোছানোই ছিল আমার কাজ। হঠাৎ দু’টা বই আমার চোখে পড়ে Revolutionary Passion এবং Of War and Love। গোটা কয়েক কবিতা পড়ে ভাল লাগলো। বই দু’টা বাসায় নিয়ে আসি। পড়ে খুবই ভাল লাগলো। ৮/১০ টা কবিতা অনুবাদও করে ফেলি। তখন মনে হলো, এঁর কবিতা যদি আরো জোগাড় করা যায় তাহলে তো একটা বই করা যায়। আমি কবির সাথে যোগাযোগ করি। দেখলাম, মানুষ হিসাবেও তিনি ভাল। এই হলো আল্লাহর বাদশাহি’র জন্মকথা।
শামস আল মমীন: ভবিষ্যতে অন্য কোন জার্মান কবির উপর কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?
সলিমুল্লাহ খান: আমি জুল্লে’র কবিতার অনুবাদ করি জার্মান ভাষার সাহিত্যের ছাত্র কিংবা জার্মান ভাষার মাস্টার হবো এই আশা করে নয়। জার্মান কবিদের নিয়ে কি কাজ করবো জানি না। আমি জার্মান ভাষা ভাল জানিও না যা এ কাজ করার জন্য পূর্বশর্ত। যদি ভাষাটা রপ্ত করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে করতেও পারি। জুল্লে’র কবিতা অনুবাদ করেছি এই জন্য যে তাঁর বিষয়বস্তু আমার ভাল লেগেছে। তাঁর সাথে (নিউইয়র্কে) আলাপ করে বুঝলাম আমার সাথে তার একটা আত্মীয়তা আছে। আমি ছোটবেলা থেকে ব্রেখটের ভক্ত। জুল্লেও ব্রেখটের কবিতা পড়ে কবিতা লিখতে অনুপ্রেরণা পান। এটা পড়ে মনে হলো, এই কবিকে আমার খালাতো বোন বলা যায়।
শামস আল মমীন: জুল্লেকে বেছে নেওয়ার আগে আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাসের সহযাত্রী কবি হিসাবে তাঁকে বাংলাদেশে প্রমোট করার কথা কখনো মনে হয়েছে?
সলিমুল্লাহ খান: না। তাঁর শ’খানেক কবিতা থেকে আমি ৬০টি অনুবাদ করেছি। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ যদি আমি তুলে ধরতে চাইতাম তাহলে তাঁর প্রবন্ধই অনুবাদ করতাম। যেমন নিকারাগুয়ায় মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে, এলসালভাদরে নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। এবং বক্তৃতাগুলো তিনি চার্চে দিয়েছেন। এগুলোতে ধর্মের প্রভার থাকলেও আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কাছাকাছি কথা আছে। কিন্তু আমি সেগুলো অনুবাদ করিনি। তাঁর কবিতার কাব্যমূল্য দেখেই আমি অনুবাদ করেছি। আমার মতে কবিতায় যদি মানুষের দরকারি কথাগুলো না বলা যায় তাহলে কবিতা লেখার দরকার কি? জুল্লে’র কবিতায় আমার প্রাণের কথাগুলি আছে। আমি যদি কবি হতে চাই, তাহলে কোন ধরনের কবি হতে চাই আমি তার নমুনা হিসাবে এটা পেশ করেছি। আপনি প্রথম প্রশ্নই করেছেন, আমি অনুবাদ বেছে নিলাম কেন। প্রত্যেক মানুষই দর্পনে নিজের মুখ দেখে। আমি জুল্লে’র ভেতরে হয়তো নিজের মুখই দেখেছি। কিন্তু সজ্ঞানে আমার কথা ডরোথির নামে চালিয়ে দেইনি। অজ্ঞানে হয়তো চলে গেছে। নাজিম হিকমতের কবিতা আমরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে পড়েছি। এঁরা দু’জনই কমুনিস্ট পার্টি করতেন। এক ধরনের সহমর্মিতা নিভৃতে কাজ করে বলতে পারেন।
শামস আল মমীন: ডরোথি জুল্লেকে অন্যান্য ইউরোপীয় কবিদের তুলনায় কোন দিক থেকে আপনার চোখে আলাদা মনে হয়েছে?
সলিমুল্লাহ খান: এটা একটা ভাল প্রশ্ন করেছেন। এলিয়ট, অডেন, ইয়েটস এঁদেরকে আমরা আধুনিক কবি বলি। ফরাসি ভাষায় বোদলেয়ার, মালার্ম, আরাগঁ। জার্মান ভাষায় রিলকে, স্টেফান। এঁদের সবার চেয়ে ভিন্ন কবি ব্রেখট। তাঁকেও আধুনিক কবি বলতে হবে। কিন্তু তিনি সব সময় কমুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। পাবলো নেরুদাও কমুনিস্ট ছিলেন। কিন্তু প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন সুররিয়ালিস্ট। আরাগঁ এবং পল এলুয়ার প্রথম জীবনে সুররিয়ালিস্ট হলেও পরে কমুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু ব্রেখট শুরু থেকেই আধুনিক এবং কমুনিস্ট। বই পড়ে যতটুকু জানি, ইউরোপের আধুনিক কবিদের মধ্যে দুটো প্রবণতা কাজ করে। যাঁরা সুররিয়ালিস্ট হিসেবে লেখা শুরু করেন তাঁদের কেউ কেউ কমুনিস্টদের প্রতি সমবেদনা সম্পন্ন আবার কেউ কেউ কমুনিস্টবিরোধী হয়ে ওঠেন।
আমি শুরু থেকেই কমুনিস্টদের প্রতি সমবেদনাসম্পন্ন। তবে আমি অ-কমুনিস্টদের কবিতা পড়েও আনন্দ পাই। যেমন রিলকে কমুনিস্ট ছিলেন না কিন্তু তাঁর কবিতা পড়ে মজা পাই। আবার নাজিম হিকমতের কবিতা পড়েও মজা পাই। কিন্তু মতাদর্শের দিক থেকে আমি নাজিম হিকমতের মতো কবিতা লিখতে পারি না। আমার কবিতা ব্রেখটের মতো। ব্রেখটের মতোই তাঁর ধারার পরবর্তী কবি ডরোথি জুল্লে। জুল্লে’র যে রাজনৈতিক বিশ্বাস সেটা আমার শ্রদ্ধেয় কিন্তু সে জন্য আমি তাঁর কবিতা অনুবাদ করি নাই। আধুনিক কবিতার দুর্বলতা, আধুনিক কবিতা জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ায় এবং যে কারণে, আমার মতে, আধুনিক কবিতা নিজেই আত্মহত্যা করেছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটাই পথ আবার ন্যাশনাল-পপুলার ট্র্যাডিশানে ফিরে যাওয়া এবং সেভাবে কবিতা নিজেকে রিনিউ করবে। জুল্লে’র কবিতায় এই ন্যাশনাল-পপুলার ট্র্যাডিশানের ভঙ্গিটা আছে, সেটা আমি ব্রেখটের মধ্যেও দেখি। কবিতা শুধু রোমান্টিকতা নয়। কবিতা প্রশ্ন করে, জিজ্ঞাসা করে। ফরহাদ মজহারের একটা গানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলি:
শামস আল মমীন: আপনার কথায়, এই কিতাবে আপনি চাণ্ডালি ভাষা ব্যবহার করেছেন। এটা কি কবিতার মেজাজকে ধরে রাখার জন্য? নাকি আগে কেউ এই ভাষা ব্যবহার করে নাই বলেই চমক সৃষ্টির জন্য নতুন মাল বাজারে দিলেন?
সলিমুল্লাহ খান: সোজা কথা, ব্রাত্য রাইসুকে অনুসরণ অর্থাৎ স্টান্ট দিলাম কি না এই তো। শামসুর রাহমানের মতো—আপনি ভদ্রলোক—ওইটুকু বলছেন না। কবিতা ভাব দিয়ে লেখা হয় না, কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে। কবির মনের ভাবনাটা কি আমরা কোনদিন জানবো না কিন্তু ভাবটা ধরা পড়ে ভাষার মধ্য দিয়ে। এটাকে আমি বলি সিগনিফায়ার। ভাষার উপর যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে কবি যতো কথাই বলুক না কেন তার শেকড় গজাবে না। এবং সচেতনভাবে আমি এই ভাষা যদি ব্যবহার করি তাতে দোষের কিছু দেখি না। আমি নিজস্ব একটা ভাষারীতি তৈরি করতে চাই। কিন্তু শুধু ভাষার জন্য ভাষা তৈরি করা যায় না। দেখতে হবে, কবিতার মেজাজকে ধরে রাখার জন্য এটার প্রয়োজন আছে কি না। আমি যেটাকে চাণ্ডালি ভাষা বলছি, আমি মনে করি, সেটা খাঁটি বাংলা ভাষা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই চাণ্ডাল বংশের এবং বাংলা ভাষাটাই একটা চাণ্ডাল ভাষা। বাংলা ভাষার প্রকৃতি বলতে কিছু নেই। আসলে বাংলা হচ্ছে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ এবং বাংলা ভাষার প্রকৃতি বলতে যদি কিছু থাকে সেটাই হচ্ছে চাণ্ডালি ভাষা। আমি কবিতা বাংলা ভাষায় লিখতে চাই।
…….
সলিমুল্লাহ খান, ছবি. খন্দকার তারেক, ওয়েস্ট চেস্টার, নিউইয়র্ক, ১৯৯৭
………
কলকাতার মধ্যবিত্ত কবিরা যে বাংলা ভাষার চালু করেছেন, বুদ্ধদেব শুরু থেকেই বলছি। এটাও একটা আঞ্চলিক ভাষা। কিন্তু রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে এটা তথাকথিত মান ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। এটাও একটা সুন্দর ভাষা। এখান থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। কিন্তু এই কারণে অন্যান্য অঞ্চলের ভাষার মধ্যে যে সাহিত্যগুণ আছে সেটাকে বাদ দিতে পারি না। এবং বাদ দেওয়ার প্রবণতা হবে আত্মহত্যামূলক। আমি যদি গ্রিক ভাষা কিম্বা ইটালিয়ান ভাষা শিখতে পারি যেমন মধুসূদন শিখেছিলেন, তাহলে আমার উচিত ময়মনসিংহের ভাষা, বরিশালের ভাষা শেখা। কলকাতার ভাষা প্রতিষ্ঠিত ভাষা হয়ে গেছে বলে আর ময়মনসিংহের ভাষায় কোন মনযোগ দেওয়া যাবে না, প্রবণতা হিসাবে এটা হবে কবিদের জন্য ক্ষতিকর। কিছু কিছু আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এমন প্রকাশভঙ্গি আছে যা তথাকথিত শুদ্ধ ভাষায় নেই। কাজেই, এগুলো আনা উচিৎ।
—————————————————————-
আমি যেটাকে চাণ্ডালি ভাষা বলছি, আমি মনে করি, সেটা খাঁটি বাংলা ভাষা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই চাণ্ডাল বংশের এবং বাংলা ভাষাটাই একটা চাণ্ডাল ভাষা। বাংলা ভাষার প্রকৃতি বলতে কিছু নেই। আসলে বাংলা হচ্ছে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ এবং বাংলা ভাষার প্রকৃতি বলতে যদি কিছু থাকে সেটাই হচ্ছে চাণ্ডালি ভাষা। আমি কবিতা বাংলা ভাষায় লিখতে চাই।
—————————————————————-
শামস আল মমীন: আমেরিকায় সাদা কালো সবাই ইংরেজি বলে; এর মধ্যেও কালোদের কথায় এবং লেখায় কিন্তু ওদের নিজস্ব ভাষাভঙ্গি আছে যা স্ট্যান্ডার্ড ইংরেজি থেকে একেবারে ভিন্ন।
সলিমুল্লাহ খান: ওটা করলে ওরা মারা যেতো। যেমন ওরা যখন লেখে ‘Lowd’ (Lord), হয়তো এটা হুবহু মুখের কথা নয়। কিন্তু কালোদের যে সমস্যা, তাদের যে ঐতিহাসিক সংকট এটা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে। আপনি ঠিকই বলেছেন ইংরেজি তো একটা ভাষা নয়, বহু ভাষা। আমি শুধু মেসেজটাই দিতে চেয়েছিলাম, বাংলা ভাষা বলে একটি বিশেষ ভাষা নেই, বাংলা বহু ভাষা।
শামস আল মমীন: আপনার এই চাণ্ডালি ভাষার বদনাম করেছে অনেকেই। তারা ঠিক এটাকে গ্রহণ করতে পারছে না। তাদেরকে আপনি কি বলবেন?
সলিমুল্লাহ খান: বদনাম যারা করে তাদের নাম বলাই ভালো। আপনি ভদ্রলোক তাই নাম বলতে চান না। আমার নাম বলতে আপত্তি নাই। যেমন হুমায়ুন আজাদ। বাংলা ভাষার একজন কবি এবং পণ্ডিত। উনি ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা ভালই জানেন কিন্তু সাহিত্যের মূল ন্যারেটিভে তিনি এই ভাষা ব্যবহার করবেন না। কিম্বা সাহিত্য সমালোচনা এই ভাষায় করবেন না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তাঁকে বলতে শুনেছি, বাংলা ভাষার একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিৎ। আমি মনে করি তাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভাষার চিরকালীন কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই। যেমন ষোড়শ শতাব্দীতে যা স্ট্যান্ডার্ড ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে তা আর স্ট্যান্ডার্ড থাকে না। এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর স্ট্যান্ডার্ড কিন্তু আজ আর স্ট্যান্ডার্ড নেই। এবং এই প্রক্রিয়াতে থেমে থাকা বলে কোন ব্যাপার নেই। এটা নিরন্তর চলছে। সৃষ্টিশীল লেখকরা কিন্তু ভাষা পরিবর্তনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, এবং আমি সেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছি মাত্র। আমি চাণ্ডালি ভাষা লিখে যদি ব্যর্থ হই আমি একজন নগণ্য কবি ব্যর্থ হলাম। কিন্তু যদি সফল হই কিম্বা অন্য কেউ এই পথ অনুসরন করে তাহলে বাংলা ভাষার গতি পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা আছে।
শামস আল মমীন: আধুনিক কবিতায় ‘মুই’, ‘মোর’, ‘অরা’ এসব শব্দের ব্যবহার ঘটা করে নিষিদ্ধ ঘোষণা দেওয়ার পরেও আপনি এসবের পুনর্ব্যবহার করলেন কেন?
সলিমুল্লাহ খান: সমস্যা না থাকলে কোন সমাধান আসে না। বাংলা কবিতায় আমি একটা সমস্যা অনুভব করেছি। কবিতায় ‘মুই’, ‘মোর’ লেখা যাবে না, অর্থাৎ যারা এই নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন, আমি মনে করি তারা কাজটা খুব তড়িঘড়ি করে করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন ‘মুই’ ব্যবহার করা অনাধুনিক আর ‘আমি’ ব্যবহার করাটা আধুনিক। আমি এটা অস্বীকার করি না। কিন্তু দেখা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে ‘মুই’ ব্যবহার না করলে ভাষা তার ব্যঞ্জনা হারিয়ে ফেলে। বাংলা ভাষার প্রকাশ ক্ষমতাকে যদি আমরা বাড়াতে চাই তাহলে তার সমস্ত সম্ভাবনাকে তলিয়ে দেখতে হবে। আমার ধারণা ‘মুই’ বা ‘মোর’ ব্যবহারের সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশেষিত হয়ে যায় নি। যেমন এক কবিতায় আমি লিখেছি:
নতুন শহরে এসে টের পাই
বন্ধু নাই মোর বন্ধু নাই ।
এখানে “বন্ধু নাই আমার বন্ধু নাই” বললে ঐ বোধ আসে না যা ‘মোর’ বললে আসে। গদ্যে কিন্তু আমি নিজেই ‘আমি’ লিখছি, পদ্যে আবার ‘মুই’ লিখছি। যারা বলে দিয়েছেন ‘মুই’ ‘মোর’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। আমি মনে করি, তারা প্রিম্যাচিউর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
শামস আল মমীন: The artist should not fear being considered absurd as long as the artistic efforts are sincere. ই. ই. কামিংসের এই উক্তি আপনার মনে আছে কি?
সলিমুল্লাহ খান: না । এই উক্তি আমার জানা ছিলো না। তবে কামিংসের সাথে আমি একমত হতে পারি। যদিও লোলে ‘সিনসিয়ার’ এবং ‘অ্যাবসার্ড’-এর অর্থ নিয়ে দ্বিমত হবেন, তর্ক করবেন।
শামস আল মমীন: সমালোচক মুসতাফা সাঈদ আপনার অনুবাদে অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছেন (যথা: ‘তোর গল্প করতে পারি না ঈসা… হেন বিশপ নেই তোর পাছা মারে না।’ পৃ. ১৫) তাঁর মতে এটা ঠিক কবির উক্তি নয়, এখানে আপনার অতিরঞ্জন আছে।
সলিমুল্লাহ খান: পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলা দরকার, বইয়ের ৬০টা কবিতার মধ্যে ৪০টা আমি ইংরেজি থেকে করেছি, বাকিগুলার মূল জার্মান আমি পড়েছি। তবে এই কবিতাটা আমি অনুবাদ করেছি ইংরেজি থেকে। লাইনগুলো এরকম, Every Bishop sleeps with you. আমি আঞ্চলিক শব্দে এর অনুবাদ করেছি। এর চেয়ে বেটার এক্সপ্রেশন থাকতেও পারে। কিন্তু আমি যা করেছি সেটাকে আমি অশ্লীল বলব না।
শামস আল মমীন: আমার ধারণা, কবিতায় অশ্লীল বলে কিছু নেই। শিল্পসম্মত প্রয়োগই হচ্ছে মূল কথা। মুসতাফা সাঈদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি বর্তমান বিশ্বের আধুনিক কবিতা যদি নিয়মিত পড়ার সুযোগ পেতেন তাহলে হয়তো এই অভিযোগ করতেন না। মার্কিন এক বিখ্যাত কবি Etheridge Knight-এর একটি বিখ্যাত কবিতার কিছু অংশ মুসতাফা সাঈদ ও পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম।
শামস আল মমীন: ভূমিকায় আপনি বলছেন, আপনার ভাবনার উপর ওলন্দাজ স্পিনোজার মতো একরোখা দার্শনিক ফরহাদ মজহারের প্রভাব আছে। ফরহাদ মজহারকে মুসতাফা সায়ীদ বলেছেন “একজন উদ্বাস্তুচিত্ত মানুষ আর তার এবাদতনামা বাংলা কাব্যের ইতিহাসে এক অট্টহাসি।” আপনার গুরুনিন্দাকে আপনি কিভাবে গ্রহণ করেন।
সলিমুল্লাহ খান: ফরহাদ মজহারের সাথে আমি ১০১টা বিষয়ে একমত নই। কিন্তু গুরু বলে কাকে?—যে আলো দেয়। ফরহাদ যখন আমেরিকা থেকে ফেরত গেলেন তখন আপনার মতো (আমার বুকসেলফ দেখিয়ে) এরকম দুই সেলফ নতুন বই নিয়ে যান। ফরহাদের যে বিশাল পড়াশোনা সেদিন পর্যন্ত সেরকম পড়াশুনা করা আর কোন লোকের সাথে আমার দেখা হয় নাই। ফরহাদের কবিতা যখন পড়লাম, গান যখন শুনলাম তখন আমার মনে হলো, ঢাকায় আমার পরিচিত কবি-সাহিত্যিক সবার চেয়ে এই উদ্বাস্তুচিত্ত লোকটিই উজ্জ্বল। তাঁর এবাদতনামা যদি অট্টহাসি হয় তাহলে আমাদের সাহিত্যে এখন অট্টহাসিরই দরকার। ফরহাদের কবিতা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং এই মতে আমি পৌঁছেছি আজ থেকে ২৩ বছর আগে এবং ফরহাদ আমাকে হতাশ করেন নি।
আমি আগেই বলেছি বের্টল্ট ব্রেখট আমার প্রিয় কবি। বাংলা ভাষা যদি জার্মান ভাষার মতো হতো তাহলে ফরহাদ আজকে পৃথিবীতে বিখ্যাত হতো। ফরহাদ বাংলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি এতে কোন সন্দেহ নাই। বর্তমান ৫ জন সেরা কবির মধ্যে ফরহাদ একজন এবং ফরহাদ আমার শক্র হলেও এটা বলতে হবে। অথবা আমি কবিতা বুঝি না এটাও হতে পারে।
শামস আল মমীন: কেউ কেউ আপনার এই চাণ্ডালি ভাষা ব্যবহারের সুনাম করেছে প্রচুর। এদের বেশির ভাগই তরুণ কবি, সমালোচক। অথচ বয়স্ক লেখকরাই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার বেশি—কারণটা কি?
সলিমুল্লাহ খান: সেটা সঠিক করে বলা মুশকিল। যেসব তরুণদের পছন্দ হয়েছে তাদের অনেকের সাথে আমার পরিচয় চিঠিপত্রে। যেমন ব্রাত্য রাইসু। তাঁর কবিতার মধ্যেও এই প্রয়াসটা আছে। আমাদের মধ্যে আলাপ করে কিন্তু এটা হয়নি। তাতে বুঝতে পারছি সময়ের যখন একটা চাহিদা দেখা দেয় তখন বিভিন্ন দিক থেকে তার প্রতিধ্বনি হতে থাকে। এবং দেখলাম আমার মত করে অনেকেই চিন্তা করছে। আমি বলব না তারা আমার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অথবা আমিও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হইনি। একটা কমন তৃতীয় ঘটনা দ্বারা আমরা প্রভাবিত হয়েছি।
এটাকেই আমি বলি সমকালীন বাংলা কবিতা বা ভাষার সংকট। আধুনিক বাংলা বলে যে ভাষাটা চালু রয়েছে, হুমায়ুন আজাদ যে ভাষায় লেখেন আর কি। তিনি বুদ্ধদের বসুর শিষ্য। হুমায়ুন আজাদ প্রতিভাবান মানুষ। কিন্তু প্রতিভাবান মানুষের হাতে ভাষাটা যখন দুর্বল থাকে তখন আমি বুঝতে পারি এ ভাষার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এটাই বাংলা ভাষার লিমিট। যেমন আবদুল মান্নান সৈয়দ নিঃশেষিত হয়ে গেলেন। শুদ্ধতম কবি যখন তিনি লিখেছিলেন তখন সুধীন দত্তকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত সুধীন দত্তের যে মেধা সেটা মান্নানের নেই। সুধীন দত্তীয় বাংলা গদ্য আবদুল মান্নানের হাতে প্রাণহীন হয়ে গেছে। যেমন আকাশে ওড়ার সময় পাখিকে সুন্দর লাগে। সেই পাখি মাটিতে পড়ে যখন ধড়ফড় করে তখন প্রাণের মধ্যে শুধু বেদনাই জাগে। আমি যদি সুধীন দত্তকে আকাশে ওড়া কবুতর মনে করি তাহলে মান্নান সেই মাটিতে পড়া ধড়ফড় করা কবুতর।
বাংলা ভাষার সংকট থেকেই আমি এই চাণ্ডালি ভাষার দিকে গিয়েছি এবং দেখি আমি একা নই। ব্রাত্য রাইসু এবং আরো অনেক তরুণ এটাকে পছন্দ করছে। এতে প্রাণে এই আশা জাগে যে আমি ভুল পথে নেই। আর বুড়ারা বুঝতে পারছেন না কারণ তাদের সত্য বোঝার অক্ষমতা এবং স্বার্থপরতা। যেমন ধরুন, শামসুর রাহমান ৬০/৭০ টা বই লিখেছেন। তাঁর পক্ষে নতুনদের অভিনন্দন জানানো সম্ভব শুধু মুখে, কাজে নয়।
শামস আল মমীন: আল্লাহর বাদশাহি প্রকাশের আগেই ঢাকায় লেখকদের মধ্যে আপনার চাণ্ডালি ভাষার কথা নিয়ে চাপা গুঞ্জন চলছিল। সলিমুল্লাহ খান নিউইয়ার্কে গিয়ে বাংলা ভুলে গেছেন। বাংলা ভাষায় যে পরিবর্তন এসেছে উনি তার খোঁজ-খবর রাখেন না। তাঁদেরকে কি কিছু বলার আছে আপনার?
সলিমুল্লাহ খান: তাঁদেরকে কিছু বলার নেই, তবে তাদের জন্য একটা গল্প আছে। মধুসূদন দত্ত নামে বাংলা ভাষার একজন কবি ছিলেন, কেউ কেউ বলেন। আমি তাঁকে দেখিনি, কিন্তু বিশ্বাস করি তিনি ছিলেন। মেঘনাদ বধ কাব্য লেখার আগে তিনি কিছু নাটক-কবিতা লিখেছেন। তখন যদি কেউ বলতেন পয়ার কি মধুসূদন ভুলে গেছেন কিম্বা অমিত্রাক্ষর লেখার আগে বাংলা ভাষায় যে পুঁথি লেখা হতো সেটা তিনি জানেন না কিম্বা ভুলে গেছেন—মধুসূদন যে জবাব দিতেন আমি সেই জবাবই দিবো। আমি নিজেকে মধুসূদনের সাথে আপাতত তুলনা করছি না। মধুসূদন বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর চালু করেছেন এবং আমরা তা গ্রহণও করেছি। আমি যে কাজটা করেছি তা না জানার জন্য যতটা নয় তার চেয়ে বেশি অসন্তুষ্টির জন্য। স্বীকার করি, গত ১৫ বছরে সবার লেখা আমার পড়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু এর আগে তো বাংলা ভাষায় কিছু লেখা হয়েছে। এবং সেগুলো কিছু আমি পড়েছি।
শামস আল মমীন: আপনার ভূমিকায় লিখেছেন “পশ্চিম থাইক্যা আসা পচা মালের ভিড়ে আমরা বিস্তর তাজা প্রাণ হারাইয়া ফালাইছি। অহন ফ্রয়েড-লাকাঁ পড়ে দেখি সব শেষ হয় নাই। লেজে প্রাণ আছে।” প্রাণটা কার লেজে দেখলেন একটু খোলোসা কইরা কন দেখি।
সলিমুল্লাহ খান: লালন ফকির আমাদের দেশে এখন খুব আলোচিত। দুই বাংলার যতগুলো কবিতার এন্থোলজি আছে এগুলোতে অনেকের কবিতা থাকলেও লালনের কবিতা কোথাও স্থান পায়নি। লালনকে কোথাও কবি বলে স্বীকার করা হয় না, কিন্তু তাঁর গানকে স্বীকার করছে। তাঁর গান তো কবিতাও বটে, কিন্তু আমরা তা স্বীকার করতে পারছি না, তার মানে লেজের প্রাণটা স্বীকার করছি না। লেজে প্রাণ বলতে আমি বোঝাচ্ছি—লালনের কবিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিম্বা ইংরেজ শাসনের উপর নির্ভর করেনি, কিন্তু সেগুলো টিকে আছে। কি করে তিনি টিকে থাকলেন? প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর আখড়ায় আসে। এই মানুষগুলো যার টানে আসে এটাকেই আমি বলছি লেজে প্রাণ। কারণ ঐ লোকগুলো খেতে আসে না, ওর মধ্যে একটা এসথেটিক আছে। এবং ওটাকেই আমি বলব আসল সাহিত্য। আমাদের সমাজে আমরা যারা কবিতা লিখছি তারা কৃত্রিম একটা জগতে বাস করি। এটাকে আমি বলছি পশ্চিম থেকে আসা পচা মাল।
শামস আল মমীন: মুসতাফা সাহেব আরো বলছেন, আপনি টের পাইলেন কিন্তু লাকাঁ পড়ার আগে টের পাইলেন না কেন?
সলিমুল্লাহ খান: লাকাঁ একজন ফরাসি লেখকের নাম। লাকাঁর জায়গায় যদি লিখতাম শেক্সপিয়র তাহলে মোস্তফা সাব কি এই প্রশ্ন করতেন? ঘটনাটা হচ্ছে গত দু’শ বছর আমরা শুধু ইংরেজের গোলাম ছিলাম না। পুরা ইউরোপের গোলাম ছিলাম। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপ যা অবদান রেখেছে এগুলো বাদ দিয়ে আমরা ইউরোপের বিরুদ্ধে এমনকি নিজেদের মধ্যেও টিকতে পারব না। লাকাঁ একটা নাম মাত্র। আমি এখানে দুটো কাজ করেছি। প্রথমটা, লাকাঁর প্রতি আমার ভক্তি প্রকাশ। দুই, শুধু পশ্চিমের দর্পনেই আমি টের পেলাম নিজেকে।
শামস আল মমীন: মুসতাফা সাহেবের শেষ কথা, আপনার লেখার উদ্দেশ্যই যেন প্রতিপক্ষের ভ্রান্ত প্রয়াসকে আঘাত করা। চোখে আঙুল দিয়ে নয়, শুধু যেন কান ধরে ভুলটি দেখিয়ে দেওয়া এরকম একটা কিছু। আপনি যা লিখছেন সেগুলো কি প্রাণের তাগিদেই লিখছেন, নাকি সাঈদের কথাই সত্য।
সলিমুল্লাহ খান: আমার মনে হয় দু’টাই সত্য। এখানে প্রতিপক্ষটা কে? প্রতিপক্ষ হচ্ছে যে ধারণাকে আমি ভুল মনে করি। কোন ব্যক্তিকে আমি প্রতিপক্ষ মনে করি না। যদি ঘটনাচক্রে কোন ব্যক্তি ঐ ভুল মতকে ধারণ করে আমি তাকেও আক্রমণ করতে পিছপা হই না। উদাহরণ দেই, প্রফেসর রাজ্জাক আমার খুব প্রিয় মানুষ, কিন্তু তাঁর মতের একটা ভুল যখন আমি পেলাম আমি তাঁর সমালোচনা করতে পিছপা হইনি। কিন্তু আমি রাজ্জাকবিরোধী নই।
শামস আল মমীন: আপনি তো অনেকদিন থেকেই কবিতা লিখছেন। আপনার প্রথম বই এক আকাশের স্বপ্ন-র ভাষা এবং দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আজকের ভাষা এবং দৃষ্টিভঙ্গি আপনার কাছে কতটা ভিন্ন মনে হয়?
সলিমুল্লাহ খান: বেশ ভিন্ন মনে হয়। কখনো কখনো অনুতাপ করি কিছু কবিতার দুর্বল এক্সপ্রেশনের জন্য। ঐ বই সম্পর্কে আমার বিশেষ কোন দাবি নাই। তবে ৩/৪ টা ভালো কবিতা আছে বলে আমি মনে করি। আমার মৌলিক কাব্যবিশ্বাস বদলায় নি। তবে ভাষা বলদেছে। এটাকে আমি উন্নতির লক্ষণ বলেই মনে করি।
শামস আল মমীন: অক্টোবর ’৯৯-এ ভোরের কাগজে কবি নুরুল হুদা সত্তরের কবিতাকে রাজনীতির কবিতা উচ্চকণ্ঠের কবিতা বলে মত প্রকাশ করেন এবং ২৯ অক্টোবর সংখ্যায় সত্তরের ১২ জন কবি এর প্রতিবাদ জানান। আপনি ঐ সময়ের কবি হিসাবে কিভাবে এর মূল্যায়ন করেন?
সলিমুল্লাহ খান: আমি মনে করি নুরুল হুদার বক্তব্য সত্য। সত্তর দশকে যাঁরা কবি হিসাবে পরিচিত যেমন মোহন রায়হান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ—এঁরা উচ্চকণ্ঠের কবি। আমি নিজেও কিছু উচ্চকণ্ঠের কবিতা লিখেছি, কিন্তু আমি উচ্চকণ্ঠের কবি নই। আমি ওঁদের চেয়ে ছোট, কিন্তু ভিন্ন ধরনের কবি। যদি মোহন-রুদ্রকে আমরা কবি হিসাবে স্বীকার করি তবে স্বীকার করতেই হয় ওরা উচ্চকণ্ঠের কবি। কিন্তু শিহাব সরকার, আবিদ আজাদ কিম্বা আবু করিম উচ্চকণ্ঠের কবি ছিলেন না। এ ক্ষেত্রে নুরুল হুদার বক্তব্য যেমন সত্য আবার সেই ১২ জন কবির প্রতিবাদও সত্য। তবে আমার ধারণা সত্তরের কবিতা দুর্বল। রুদ্র একজন ভালো কবি (ও আমার বন্ধু ছিল), ওর কিছু ভালো কবিতা আছে। সব বাদ দিয়েও আমি মোহন ও রুদ্রকে ভালো কবি বলে মনে করি। যদিও মোহন এখন ভালো কবিতা লিখতে পারছে না।
শামস আল মমীন: প্রথম আলো’র এক টেবিল বৈঠকে কবি সরকার আমিন তরুণ কবিদের কৃতিত্বকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করছেন, প্রবীণ কবিদের নাকচ করার স্পর্ধা, তরুণদের হাতে কবিতা ছন্দের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে, সম্পাদকীয় ভাষা থেকে কবিতা সরে এসেছে। তাঁর এই ব্যাখ্যা কবিতার জন্য কতটা সঠিক?
সলিমুল্লাহ খান: তরুণ কবিরা প্রবীণ কবিদের চিরকালই নাকচ করে। আমিন ভাবছন্দ বলতে কি বোঝাচ্ছেন ব্যাখ্যা না করলে তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রচলিত ছন্দকে নাকচ করা যায় না, এগুলো এবজর্ভ করতে হয়। কোন প্রতিভাবান কবি যদি নতুন কিছু করে আমি তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত আছি।
শামস আল মমীন: একই বৈঠকে টোকন ঠাকুর বলছেন, কবিদের মধ্যে পার্থক্য এতই বেশি যে, কবিতা কোন পথে যাচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না। চঞ্চল আশরাফ বলছেন, কবিতা নিয়ে গত এক দশকে কথা যতো হয়েছে সে তুলনায় ফসল কম। উত্তরাধুনিকতার নামে কোন বিনির্মাণ হচ্ছে না বরং পুনর্নির্মাণ হচ্ছে। নতুনদের এই ভাবনাকে আপনি কি ভাবে দেখেন?
সলিমুল্লাহ খান: কবিতার গতি পরিবর্তন হচ্ছে এটা সঠিক। কিন্তু কোন দিকে হচ্ছে? এখনো আমার চোখে কোন কবি পড়েনি যিনি তিরিশের কবিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। যাঁরা নিজেদের উত্তরাধুনিক বলে দাবি করছেন এদের মধ্যে একজন কবিকেও দেখি না যিনি জীবনানন্দের চেয়ে ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখছেন। বিষ্ণু, সুধীন, অমিয় বুদ্ধদের কবিতায় একটু একটু রাজনৈতিক কথা বললেও এরা মূলত প্রতিক্রিয়াশীল কবি। আমি আক্ষরিক অর্থেই বলছি। এরা একটা বিশেষ সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় এরা এক ধরনের নিরাপত্তা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু নজরুল পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। সত্তরের কবিরা চেষ্টা করেছেন। উত্তরাধুনিক কবিদের প্রধান সংকট হচ্ছে এরা শিক্ষিত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এরা টের পেয়েছেন শিক্ষিত হওয়ার দরকার আছে। এরা অনেকেই ইংরেজি বই পড়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু পড়ে বোঝেন না। ইংরেজি বুঝতে হলে বিদ্যার দরকার। অনুবাদের সময় অনুবাদক সচেষ্ট থাকেন যাতে অনুবাদ ভুল না হয়। কিন্তু ভুল অনুবাদ হলে কবিতা বেটার হয়। আমাদের কবিতা বেশির ভাগই ভুল অনুবাদ হয় এবং সে কারণেই এগুলো মৌলিক। যেমন নুরুল হুদা বলেন, বাংলা কবিতার ইতিহাস হচ্ছে অনুবাদের ইতিহাস। হুদার মুখে শুনেছি, রফিক আজাদ ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে পোয়েট্রি পত্রিকা থেকে কবিতা পড়ে সাথে সাথে একটা বাংলা কবিতা লিখতেন। শহীদ কাদরীও এ কাজ বিস্তর করেছেন। এই দুই কবির কবিতা যদি কেউ অনুসন্ধান করেন তাহলে বুঝতে পারবেন তাঁদের অর্ধেক কবিতা ইংরেজি কবিতা থেকে নেওয়া। কিন্তু আমরা এটাকে বলি ইন্সপায়ারড অনুবাদ, আক্ষরিক অনুবাদ নয়। কিন্তু প্রকৃত উত্তরাধুনিক কবি যেমন ফরহাদ মজহার ও সুব্রত গোমেজ এরা বুঝতে পেরেছেন আমাদের আবার ময়মনসিংহ গীতিকা পড়তে হবে এবং ট্রেডিশনাল উৎসগুলোতে ফিরে যাওয়া, এগুলোকে পুনর্বিবেচনা করা এবং পুণর্নির্মাণ করা। আমি ফরহাদ এবং সুব্রতের মধ্যে এই প্রতিভা দেখি।
শামস আল মমীন: বছর দুয়েক আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে উত্তরাধুনিক কবিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, এটা থিওরিতে যেমন প্রাকটিক্যালি এর তেমন ভিন্নরূপ আমার চোখে পড়ে না। আপনার মতামত কি?
সলিমুল্লাহ খান: ফরহাদ মজহারের এবাদতনামা আমার কাছে পোস্টমডার্ন কবিতার একটা উজ্জ্বল উদাহরণ। আমি মনে করি, তিরিশের আধুনিক কবিতার ধারাটি এখন প্রাণহীন হয়ে গেছে। আমাদের সবচে ভালো আধুনিক কবি সিকদার আমিনুল হক। ছন্দে তাঁর অপূর্ব দক্ষতা কিন্তু তাঁর মধ্যে নতুন কোন চিন্তা নাই। তিনি আত্মরতিপরায়ণ হয়ে উঠেছেন। মদ্যপান করা, নারীর বক্ষ উম্মোচন এগুলো তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। সেজন্যই বলছি, কবিতার এই ধারাটি মরে গেছে। ফরহাদ সেলফ কনশাসলি পোস্টমডান কবি। তাঁর এবাদতনামায় আধুনিক কবিতাকে পুরোপুরি রপ্ত করার পর তাকে প্রত্যাখ্যান এবং ট্র্যাডিশনাল কবিতা থেকে আহরণের চেষ্টা আছে। ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলোতে যে নতুন কবিদের কবিতা পড়েছি তার উপর ভিত্তি করেই আমার এ মন্তব্য। এর মধ্যে যারা বই প্রকাশ করেছেন কিন্তু যাদের লেখা আমি পড়িনি তারা আমার মন্তব্যের মধ্যে পড়েন না।
শামস আল মমীন: পাঠক কবিতা থেকে সরে যাচ্ছে। কারণ বর্তমান বাংলা কবিতা তারা বোঝে না। কবি ফরিদ কবিরের ধারণা ছন্দ বুঝলে তারা কবিতার ভেতরে পৌঁছাতে পারবে। এই ধারণাকে মনে রেখে তিনি ভোরের কাগজে ছন্দ এবং তার পর্ব ভেঙে পাঠককে বোঝানোর চেষ্টায় দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। প্রশ্ন, পাঠকের ছন্দ বোঝার দরকার আছে কি?
সলিমুল্লাহ খান: ছন্দজ্ঞান থাকা ভালো, কিন্তু ছন্দে পণ্ডিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
শামস আল মমীন: কবিতার ভাষা দশকে দশকে বদলায়, মানুষের মুখের ভাষা এতো তাড়াতাড়ি বদলায় না। অর্থাৎ কবিতা এগুচ্ছে পাঠককে পেছনে ফেলে। এটাকে কি ভাবে ব্যালান্স করা যায়?
সলিমুল্লাহ খান: আধুনিক কবিদের একটা সংকট আছে। ইনডিভিজুয়ালের ভাষা যতো দ্রুত বদলায় সাধারণের ভাষা ততো দ্রুত বদলায় না। দু’জন ব্যক্তি যখন তাদের নিজ ভাষা তুলে ধরেন তখন মানুষ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কোনটা সঠিক। ভাষায় যে দ্বিত্ব আছে এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তার বহু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ভাষা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কিন্তু প্রত্যেক কবিই চায় তার নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে। অনেকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা ভাষা কল্পনা করা যায় না। এটা ভুয়া কথা। ভাষা বদলায় কবিও বদলায়। এটা ঠিক। কিন্তু এই দুইয়ের মাত্রা একটু আলাদা। একজন রবীন্দ্রনাথ আসা যাওয়ায় বাংলা ভাষার কিছু যায় আসে না। বাংলা ভাষা তার চেয়ে বড়।
শামস আল মমীন: শামসুর রহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ ছাড়া তিনজন কবির নাম বলেন যাঁদের লেখা টিকে যাবে।
সলিমুল্লাহ খান: ফরহাদ মজহার। আবুল হাসান এবং নির্মলেন্দু গুণের কিছু কবিতা টিকে যাবে, যদিও গুণ অনেক বাজে কবিতা লিখেছেন। যদি অনুমতি দেন, সিকদার আমিনুল হকের নামও উল্লেখ করতে চাই, যদিও তাঁর কবিতার দর্শন আমার পছন্দ নয়। যাদের আমি বুর্জোয়া কবি মনে করি সিকদার হচ্ছেন তাদের রাজা। কেউ যদি আমাকে বলে, কবি হওয়া বলতে কি বোঝায়? আমি বলবো, সিকদারের জীবন ফলো করো। চেষ্টা করে তিনি ভালো কবি হয়েছেন। কেউ কেউ আমাকে বলে তুমি তো ভালো ছাত্র, তোমাকে দিয়ে কবিতা হবে না। কথাটা আমি প্রায় বিশ্বাস করতে বসেছিলাম। আমাকে উদ্ধার করেছেন সিকদার। তার কাছ থেকে দুটো জিনিস আমি শিখেছি। ১. কবিতায় কি লিখতে নেই; ২. জন্মগত প্রতিভা বলে কিছু নেই।
শামস আল মমীন: আহমদ ছফা কবি হিসাবে কেমন?
সলিমুল্লাহ খান: মানুষের নানা রকম ফ্যান্টাসি থাকে। কবিতা লেখা ছিল তাঁর এক ধরনের ফ্যান্টাসি। আমি তাঁকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি, আপনি পাগলামি করেন কেন? তিনি বলেন, পাগলামি না করলে টিকতে পারতাম না। যেহেতু পাগলামি করে তিনি সব জায়গায় পাত্তা পেয়েছেন তাঁর ধারণা কবিতাতেও তিনি পাত্তা পাবেন। কবিতার জগৎ খুব নিষ্ঠুর। তাঁর প্রথম বই জল্লাদ সময়-এ বেশ কয়েকটা ভালো কবিতা আছে, কিন্তু কবিতার যে ভাষা, প্রকরণ, আধুনিকতা ওটা তিনি কোনদিন ধরতে পারেন নি।
শামস আল মমীন: আপনার লেখা এবং বক্তৃতায় দেখা যায় আপনি সব সময় ইন্টেলেকচুয়ালি টারবুলেন্স সৃষ্টি করেন যেটা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। যেমন “অমর্ত্য সেনের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি’র ভাষা প্রসঙ্গে: কি আনন্দ সন্তান ধারণে?” বক্তৃতায় লালন ফকিরকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কিম্বা উপরে তুলে ধরেছেন (বক্তৃতা, বস্টন, ), বা রাজ্জাক সাহেবের উপর যে প্রবন্ধ লিখেছেন… ইত্যাদি।
সলিমুল্লাহ খান: ল্যাংস্টন হিউজেস-এর কবিতা থেকে উদ্বৃতি দিয়ে বলি: A women does the best she can. এর সাথে যোগ দিয়ে আমি বলি So does a man.
—————————————————————-
রবীন্দ্রনাথে ঈশ্বরের যে ধারণা আমরা পাই তার চেয়ে লালনের ধারণাটি দার্শনিক অর্থে অনেক বেশি গভীর। আমার বক্তব্য ছিল এই, এবং এখনো আমি এই বক্তব্যে অটল। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনার কোনো সুযোগই নাই। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরা যেমন এডওয়ার্ড সি. ডিমোক, জুনিয়র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আধুনিক বাঙলার শ্রেষ্ঠ বাউল উপাধি দিয়েছিলেন। এই উপাধি হাস্যকর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরের পায়ের কাছে বসারও যুগ্যি নন।
—————————————————————-
আমার কাজ হচ্ছে কমিউনিকেট করা। শামসুর রাহমান বলতে পারেন আপনি স্টান্ট দিয়ে কথা বলেন কেন? আমার কথা হচ্ছে, আমি সত্য বলছি কি না। লালন ফকিরকে নিয়ে কেউ যদি কখনও চিন্তা না করে তার পক্ষে আমার কথা বোঝা সম্ভব নয়। বস্টনে বক্তৃতার সময় আপনিও উপস্থিত ছিলেন। ঐ সময় ফরিদা পারভিনের গাওয়া লালন ফকিরের ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা/বেদে নাই যা রূপরেখা’ গানটি বাজিয়ে শোনাই এবং সেই গানের ব্যাখ্যা করি। রবীন্দ্রনাথে ঈশ্বরের যে ধারণা আমরা পাই তার চেয়ে লালনের ধারণাটি দার্শনিক অর্থে অনেক বেশি গভীর। আমার বক্তব্য ছিল এই, এবং এখনো আমি এই বক্তব্যে অটল। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনার কোনো সুযোগই নাই। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরা যেমন এডওয়ার্ড সি. ডিমোক, জুনিয়র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আধুনিক বাঙলার শ্রেষ্ঠ বাউল উপাধি দিয়েছিলেন। এই উপাধি হাস্যকর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরের পায়ের কাছে বসারও যুগ্যিও নন। আমার উদ্দেশ্য ইন্টেলেকচুয়াল সৃষ্টি করা নয়, বরং মানুষকে চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা। মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন পাছায় লাথি মেরে জাগিয়ে তুলতে হয়। আমার লেখাগুলো পাছায় লাথি মারার মতই হয়। আমি জানি, অমর্ত্য সেন আমার লেখার জবাব দেবেন না, কেউ যদি আমাকে বলেন, অমর্ত্য সেন সম্পর্কে তোমার মন্তব্য ঠিক নয় আমি তার জবাব দিতে রাজী আছি। কিন্তু এই প্রশ্নে কখনই একমত হবো না যে তাঁর সম্পর্কে লেখা যাবে না, যেহেতু তিনি অর্থনীতিবিদ, ভাষাবিদ নন।
শামস আল মমীন: আলবেনীয় কবি ইসমাইল কাদারে বর্তমানে ফ্রান্সে ১৯৫০ সনে মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউটে সাহিত্য পড়তে যান। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মস্কোয় আমি খুব দ্রুত অনুভব করলাম সাহিত্য সম্পর্কে আমার অধ্যাপকদের চেয়ে আমি অধিক অবগত।” ছাত্রজীবনে আপনার এরকম অভিজ্ঞতা কখনো হয়েছে।
সলিমুল্লাহ খান: তা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এক ইংরেজ লেখকের বই পড়াচ্ছেন। আমি বুঝতে পারছি তিনি বইটির মর্মকথা বুঝতে পারেন নি। আরেক শিক্ষক A text book of Jurisprudence (4th edition) বইটি অনুবাদ করে “ব্যবহার শাস্ত্রের বিজ্ঞান” শিরোনামে নিজের নামে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ করেন। আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র। সভ্যতা নামে এক পত্রিকায় বইটির রিভিউ লিখলাম। অর্থাৎ জালিয়াতিটা ধরিয়ে দিলাম। পত্রিকাটি যখন মাস্টারদের হাতে আসে তাঁরা তো মহা ক্ষ্যাপা। এই কারণে আমাকে অনার্সে ফাস্ট ক্লাস দেওয়া হয় নি। আরো আপত্তিকর ঘটনা হলো, বইটির ভূমিকা তিনি এমনভাবে লিখেছেন যে পড়ে মনে হবে এটা তাঁর বহু বছরের গবেষণার ফল। তাঁর শালা দুলাভাই তাকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন, তিনি তাও উল্লেখ করেন।
শামস আল মমীন: সৈয়দ জামালউদ্দিন আফগানি সম্পর্কে আপনি বলেছেন, “জামাল লেখাপড়া যতটা জানতেন ততটা লিখে যাননি এটাই আমাদের পোড়া কপাল।” আপনার বেলাতেও কি আমরা একই রকম দুঃখ করবো?
সলিমুল্লাহ খান: হজরত মোহাম্মদ, গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিস, লালন ফকির এঁরা কেউ নিজে কিছুই লিখে যান নি। তাঁদের কথা লিখেছেন অন্যরা। আমরা লেখার যুগের মানুষ। বলার মধ্যে আমার সব ইন্দ্রিয় যেভাবে ইনবলভড হয় লেখার সময় তা হয় না। প্রথমে আমি চিন্তা করি কথার মাধ্যমে তারপর মাথায় ঘুরতে থাকে সেটা কিছুদিন এবং একদিন লিখেও ফেলি। কিন্তু কেন জানি লেখা আমার জন্য কঠিন ব্যাপার।
শামস আল মমীন: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্বন্ধে কিছু বলবেন ?
সলিমুল্লাহ খান: আমি সার্বক্ষণিক লেখক হতে চাই। আমি বুঝতে পেরেছি লেখা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু লেখার উপর ঈমান আনতে পারছি না। কারণ লিখে ভাত জোগাড় করা মুশকিল। নিউইয়র্কে আসার আগেও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। জীবিকার প্রয়োজনে হয়তো মাস্টারিতে আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে। আমি না চাইলেও হয়তো কেউ আমাকে টেনে নিয়ে ছাত্রদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিবে। আর আমি অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যাব। ঘরে ফিরে আবার অনুতাপ করবো।
শামস আল মমীন: আমাদের প্রধান কবিদের কবিতা নিয়ে কিছু লিখবেন কি?
সলিমুল্লাহ খান: আমি মনে করি, আমরা যা চিন্তা ভাবনা করি তার সর্বোচ্চ ব্যবহার হওয়া উচিৎ। দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে আমাদের মৌলিক চিন্তা ভাবনাগুলো নিয়ে কিছু লিখতে চাই এবং সাহিত্যও আমার ভাবনার একটা অংশ। The Unconsciousness from Freud to Lacan এই শিরোনামে ফ্রয়েড আনকনশাস বলতে কি বুঝতেন ফ্রয়েডের অনুসারীরা কি বুঝেছেন এবং লাকাঁ কি করে সেই ধারণার পরিবর্তন করেছেন এই নিয়ে কয়েকটা প্রবন্ধ লিখতে চাই। আমি মনে করি দর্শনে বিশ্বব্যাপী আমাদের অবদান রাখার সময় এসেছে। কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ আমার বোধ হয় আর লেখা হবে না। কারণ আমার চিন্তার দিগন্ত সরে যাচ্ছে।
নিউইয়র্ক, এপ্রিল ২০০০
kabitanadia@hotmail.com
ওয়েব লিংক
শামস আল মমীন: আর্টস
সলিমুল্লাহ খান: আর্টস । ফেসবুক
সলিমুল্লাহ খান (জন্ম. ১৮ আগস্ট ১৯৫৮), ছবি. নাসির আলী মামুন
……
- [জ্ঞান অর্জনের জন্য যাঁরা জাগতিক প্রাপ্তিকে তুচ্ছ ভেবে একরোখা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, বর্তমান সময়ে, সলিমুল্লাহ খান তাঁদের মধ্যে (তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ফলাফলের মতই) প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার দাবি রাখেন নিঃসন্দেহে। তিনি আমেরিকাতে ছিলেন প্রায় চৌদ্দ বছর। এবং ইচ্ছা করলেই তিনি এখানে অনেকের মতো স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারতেন এবং প্রাচুর্যও কোনও না কোন ভাবে তাঁর কাছে ধরনা দিতো একথা নিশ্চিত বলতে পারি। কিন্তু, তিনি তা করেননি আর এখানেই অন্যদের থেকে তিনি আলাদা হয়ে যান। আর কিছু না হোক নিউইয়র্কে থাকাকালীন বই পড়ে তিনি তাঁর পড়াশুনা করার অতল পিপাসার কিছুটা হলেও মিটিয়েছেন বলেই আমার ধারণা। নিউইয়র্কে বাসা বদল করতে করতে শেষদিকে তিনি আমার প্রতিবেশী হয়ে ওঠেন। তিনি যেদিন পিএইচডি ডিগ্রীপ্রাপ্ত হন (এপ্রিল, ২০০০) সেদিনই আমাকে জানালেন আর মাত্র চারদিন পরই সুইডেন হয়ে দেশে ফিরছেন। তাঁর একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার ইচ্ছা মনে মনে ছিল কিন্তু এমন তাড়াহুড়া করতে হবে তা কখনো ভাবিনি। বলা দরকার, এই সাক্ষাৎকার যখন নেওয়া হয় তখন তিনি, এক আকাশের স্বপ্ন (কবিতা), আল্লাহর বাদশাহি (অনুবাদ কবিতা) এবং বাংলাদেশ: জাতীয় অবস্থার চালচিত্র—শুধুমাত্র এই তিনটি বইয়ের জনক ছিলেন। এবং আমাদের আলোচনাও, সঙ্গত কারণেই, এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবং সেই থেকে সাক্ষাৎকারটি বাক্সবন্দি হয়ে আছে। আমি নিজে কখনো কোথাও ছাপানোর চেষ্টা করিনি। কারণ এটা এতদিন আমার কাছে আমাদের বন্ধুত্বের স্মৃতি হিসাবেই বিবেচ্য ছিল। কবিবন্ধু ব্রাত্য রাইসু এর আগে আমাকে দিয়ে কবি শহীদ কাদরীর একটা দীর্ঘ ইন্টারভিউ করিয়ে নিয়েছিলেন এবং প্রথম আলো পত্রিকায় ছেপেছিলেন। এবারও ব্রাত্য রাইসুর উৎসাহ এবং ইচ্ছায় পাঠকের সাথে বর্তমান সাক্ষাৎকারটির যোগাযোগ ঘটছে এ জন্য তাঁর সম্পাদনার উৎসুক মনকে অভিনন্দন জানাই। শামস আল মমীন। নিউইয়র্ক, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৯।]
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: শামস আল মমীন
শামস আল মমীন: বহু বছর অপেক্ষার পর সম্প্রতি আপনার অনূদিত তৃতীয় বই আল্লাহর বাদশাহি বের হয়েছে। এদ্দিন পর বই প্রকাশের জন্য অনুবাদ বেছে নিলেন কেন?সলিমুল্লাহ খান: আমি যখন প্রথম কবিতা লেখা শুরু করি তখনও আমি অনুবাদ করেছি কিন্তু প্রকাশের সুযোগ হয়নি। আমার প্রথম কবিতার বই এক আকাশের স্বপ্ন মৌলিক কবিতা দিয়ে ৬৪ পৃষ্ঠা হচ্ছিল না, পৃষ্ঠা পূরণের জন্য ৩/৪ টা অনুবাদ কবিতা বইতে দিয়েছিলাম।
—————————————————————-
আমি যদি গ্রিক ভাষা কিম্বা ইটালিয়ান ভাষা শিখতে পারি যেমন মধুসূদন শিখেছিলেন, তাহলে আমার উচিত ময়মনসিংহের ভাষা, বরিশালের ভাষা শেখা। কলকাতার ভাষা প্রতিষ্ঠিত ভাষা হয়ে গেছে বলে আর ময়মনসিংহের ভাষায় কোন মনযোগ দেওয়া যাবে না, প্রবণতা হিসাবে এটা হবে কবিদের জন্য ক্ষতিকর। কিছু কিছু আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এমন প্রকাশভঙ্গি আছে যা তথাকথিত শুদ্ধ ভাষায় নেই।
—————————————————————-
শামস আল মমীন: অনুবাদের জন্য সবাই বেছে নেন বহু পরিচিত, বহু পঠিত কোন লেখককে। সে ক্ষেত্রে আপনি ডরোথি জুল্লের মতো বাংলাদেশে প্রায় অপরিচিত কবিকে বেছে নিলেন কেন?
…….
আল্লাহ্র বাদশাহি । সলিমুল্লাহ খান অনূদিত বাম গণতান্ত্রিক জার্মান কবি ডরোথি জুল্লের কবিতা । প্রচ্ছদ: ওবায়দুল্লাহ আল মামুনের ছবি অবলম্বনে সেলিম আহ্মেদ । প্রকাশক: সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা । সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ । ৮০ পৃষ্ঠা । ৮৫ টাকা ।
……..
সলিমুল্লাহ খান: উত্তর খুব সোজা। আমি কবির নাম দেখে কবিতা পড়ি না। কবিতা পড়ার পর কবির নাম দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে তখন আমি কাজ করি, বইয়ের তাকে বই গোছানোই ছিল আমার কাজ। হঠাৎ দু’টা বই আমার চোখে পড়ে Revolutionary Passion এবং Of War and Love। গোটা কয়েক কবিতা পড়ে ভাল লাগলো। বই দু’টা বাসায় নিয়ে আসি। পড়ে খুবই ভাল লাগলো। ৮/১০ টা কবিতা অনুবাদও করে ফেলি। তখন মনে হলো, এঁর কবিতা যদি আরো জোগাড় করা যায় তাহলে তো একটা বই করা যায়। আমি কবির সাথে যোগাযোগ করি। দেখলাম, মানুষ হিসাবেও তিনি ভাল। এই হলো আল্লাহর বাদশাহি’র জন্মকথা।
শামস আল মমীন: ভবিষ্যতে অন্য কোন জার্মান কবির উপর কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?
আল্লাহর বাদশাহি থেকে কিছু অনুবাদ কবিতা
নাদেজদা মান্দেলস্তামের লেখা পড়ে কবির নাম গোয়েন্দা বিভাগের খাতায় বহুদিন টিকটিকিও পিছু বন্ধুর অভাব নাই একজন তিন তিনবার তুলে রেখে দিল তাক নিশান লোকটার ফোন আরজন একটু খোঁজ-খবর নিতে পাঠাল বউকে উনি নিজে শহরের বাইরে গেছেন তিন নম্বর বনে গেল পুলিশের চর আর খুব দরকার একটা বাসার গাড়ি এলো অকে তুলে নিতে সেদিন ঘটনাচক্রে ঘনিষ্ঠ তিন পড়শি পড়েছে ঘুমিয়ে বর্জন, গাদ্দারি, পরিত্যাগ এবং নিদ্রা দোস্তালির পুরানা অধ্যায় ঈসা রুহুল্লার প্রাণ–মনে রেখ–গিয়েছিল এ রকমই দোস্তের ধান্দায় তোর গল্প করতে পারি না তোর গল্প করতে পারি না ঈসা হাস্যকর শোনায় তোকে পাওয়া ভার তোর নামে তোলা বিশাল হর্ম্যরে গীর্জায় পাড়ার কনে শুড়িখানায় অরা ভাবে মাথাপাগলা তুই দেখতে মন্দ নস্ বলে মোর চালাক বন্ধুরা অরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না বাসি দরকার তোর অন্য পথ দেখা গন্তব্য একই থাক বলে মোর সরল বন্ধুরা দরকার তোর তোলা ধৈর্যের মোর হতাশার কথা শুনলে শক্ররা খুশিতে করতো যাজকী হৈ-হল্লা তোর গল্প বলতে পারি না ঈসা তোকে দিয়ে চলে না পেট, পুরান মাল হবে না তোকে দিয়ে, তুই একলা তুই এটাও তুই সেটাও, তুই নিলামে হেন বিশপ নেই তোর পাছা মারে না মোর হেই বেটার দশা সারারাত গলা চেঁচিয়ে মাইকের লগে পাল্লা দেয় পর্যটনকেন্দ্রের নলডুগি গর্দভ মিউঝাক বাজনা ছাপিয়ে গলা ফাটায় বেটা চালাতে যায় পরিসংখ্যার যুগে মাতৃভাষায় মান্ধাতার আমলের কথা বিপদের ফোন পেয়ে কেবল মটকায় কর্ড, জড়ায় আঙুলে তোর গল্প বলতে পারি না ঈসা চালাকদের চেয়ে সরল বন্ধুদেরই বিশ্বাস বেশি চড়া দাম দিতে হয় ওদেরই সবসই অদের সান্ত্বনায় আমার লাভ কী দেশে দেশে ঘুরি আল্লাহর গুণ গাই দেশে দেশে ঘুরি আল্লাহর গুণ গাই তবে শুরু করি রাক্ষসের গুণ দিয়ে সচরাচর সমবেত সুধীদের কাছে আর্জি রাখি অর খেদমত আর করবেন না আপনেগোর মেহনত আর আপনেগোর বালবাচ্চা আপনেগোর দুদিনের জান আর অর পায়ে করবেন না কোরবানি জীবন্ত আহার হবার ভয়হীন জীবনের কথা বলি নরম গলায় স্মৃতির ভাষায় ছুঁই হাত দিয়ে পুরানা কালের কথা বড় বড় সোভিয়েত ইউনিয়নের মেয়েদের ডাকি আপা না খাওয়া মানুষের পেটে খানা পড়লে বলি শান্তি ভিনদেশী রাক্ষসের কথা বলি না কেন তার গাই না সাফাই দাওয়াতটাই বড় কথা আল্লাহর গুণ গাই আমাকে যখন ৫৭২ বার জিগান হলো হিংসা সম্পর্কে আমার মতামত কী প্রুশিয়ার রাজা নামে পরিচিত গোবেচারা এক শহরের মাসুম এক জেনারেল ইলেকট্টিক কারখানায় পামাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র অভিহিত নিরাপত্তার কিছু নিরীহ হাতিয়ার অকেজো করতে আমার শান্তিবাদী বন্ধুরা যখন একটা হিংসাত্মক অস্ত্র–পুরানা হাতুড়ি– চালায় তখন তারা হিংসার আশ্রয় নিল এই দায়িত্বজ্ঞানবর্জিত আচরণ জায়েজ করার মতলবে অরা ঈসা আলাইহেস সালামের আট শ বছর আগের এক লোকের বক্তব্য তুলে ধরে মনে হয় লোকটার মুরিদ অরা লোকটার মাথায় ছিট তলোয়ার পিটিয়ে লাঙলের ফলা বানাবে সে বড় এক প্রাণের তরফে আর ছোট ছোট প্রাণ ফাঁকিবাজ কুঁড়ে, হতচ্ছাড়াদের স্বার্থে অনেক বড়র আর সাংঘাতিক ছোটর– ওদের ভাষায় লিল্লাহ ওদের ভাষায় গরিবের–এই হিংসাত্মক জোট মাঝখানে নিরপেক্ষ আমাদের নিরাপত্তার সত্যিকার হুমকি বিশেষ সীমান্তের অইপারে সীমান্তের অইপারে বুঝতেই পারছেন, বুঝলেন না বাস করে এক রাক্ষস খুব বাজে একদম অগণতান্ত্রিক গরীব প্রজাসাধারণের সহায়-সম্পত্তি কর-খাজনা খেয়ে জীবন-জীবিকা বেলা-অবেলা গিলে প্রাণ মন গবেষণা নাশ করে বেটা দিন দিন মোটা হচ্ছে ভুললে চলবে না মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বাধা না থাকায় বেটা বেপরোয়া বড় হচ্ছে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক আমাদের রাক্ষসের চেয়ে বেটার কোমর এক ইঞ্চি ফোলা ওজন প্রাণসমেত আধপোয়া কম–তাতে কী সীমান্তের নাকের ডগায় আমাদের দিশি রাক্ষসের এই শুকোবার ঝোঁক ঠেকাতে নিখুঁত ব্যবস্থা চাই এ বিনা উপায় নাই এর পেশি ফুলিয়ে অর গলা গলা করার বিকল্প নাই আমাগোর আল্লাহর বাদশাহি বা মহা ঐকমত্য নতুন শহরে এসে টের পাই বন্ধু নাই মোর বন্ধু নাই মোর বন্ধু নাই গিয়া গলা ধরে কাঁদবার সোডার বোতলও শুনি আজ চুপ হাতিয়ার পরদুঃখে দুঃখী মানে ক্যান্সার বিমার শুধু এইটুক মতের মিলনে প্রাণ রাখা দায় এই নিয়ে বড় জোর মরা ভালো যায় মোর বন্ধু নাই জড়াজড়ি ভয়ে কাঁপবার সব খাত ছাড়িয়ে আজ শান্তি-শৃঙ্খলার বরাদ্দ একাশি সালেই বাড়ছে বাজেট পুলিশের তিন ভাগের আরও এক ভাগ শুধু ভয়ে পাশের বাড়ির রুটিয়লার বউয়ের লগে মোর রোজ মতে মিলে লড়ে যাওয়া দায় এই নিয়ে যেমন চলছে চলা ভাল যায় সবচেয়ে বড় কথা মোর বন্ধু নাই এক স্বরে চাই বলবার কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে পিটোচ্ছে, কেউ দেখে পিটুনি খাবার পড়ি এই ভদ্রমহিলাদের কথা এর ভি চাইবার যারা তারা কি গায়েব দূরে দেখবার মতের মহামিলনের দিন আজও বহুদূর তলোয়ার এখনো হলো না লাঙলের ফলা না হয়নি ট্যাংক এখনো ট্রাক্টর কাজ নেই নিরাপত্তা খাতের টাকায় আন্ধাদের নিজ চোখে না দেখাই রায় বহুদিন আগের ওয়াদা আল্লাহর বাদশাহি, মতের মহামিল এদেশে আমাদের দিলে নতুন শহরে এসে মোর বন্ধু নাই ভরসা পাই ঈমান রাখার [সলিমুল্লাহ খানের সৌজন্যে পুনর্মুদ্রিত। বি. স.]সলিমুল্লাহ খান: আমি জুল্লে’র কবিতার অনুবাদ করি জার্মান ভাষার সাহিত্যের ছাত্র কিংবা জার্মান ভাষার মাস্টার হবো এই আশা করে নয়। জার্মান কবিদের নিয়ে কি কাজ করবো জানি না। আমি জার্মান ভাষা ভাল জানিও না যা এ কাজ করার জন্য পূর্বশর্ত। যদি ভাষাটা রপ্ত করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে করতেও পারি। জুল্লে’র কবিতা অনুবাদ করেছি এই জন্য যে তাঁর বিষয়বস্তু আমার ভাল লেগেছে। তাঁর সাথে (নিউইয়র্কে) আলাপ করে বুঝলাম আমার সাথে তার একটা আত্মীয়তা আছে। আমি ছোটবেলা থেকে ব্রেখটের ভক্ত। জুল্লেও ব্রেখটের কবিতা পড়ে কবিতা লিখতে অনুপ্রেরণা পান। এটা পড়ে মনে হলো, এই কবিকে আমার খালাতো বোন বলা যায়।
শামস আল মমীন: জুল্লেকে বেছে নেওয়ার আগে আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাসের সহযাত্রী কবি হিসাবে তাঁকে বাংলাদেশে প্রমোট করার কথা কখনো মনে হয়েছে?
সলিমুল্লাহ খান: না। তাঁর শ’খানেক কবিতা থেকে আমি ৬০টি অনুবাদ করেছি। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ যদি আমি তুলে ধরতে চাইতাম তাহলে তাঁর প্রবন্ধই অনুবাদ করতাম। যেমন নিকারাগুয়ায় মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে, এলসালভাদরে নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। এবং বক্তৃতাগুলো তিনি চার্চে দিয়েছেন। এগুলোতে ধর্মের প্রভার থাকলেও আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কাছাকাছি কথা আছে। কিন্তু আমি সেগুলো অনুবাদ করিনি। তাঁর কবিতার কাব্যমূল্য দেখেই আমি অনুবাদ করেছি। আমার মতে কবিতায় যদি মানুষের দরকারি কথাগুলো না বলা যায় তাহলে কবিতা লেখার দরকার কি? জুল্লে’র কবিতায় আমার প্রাণের কথাগুলি আছে। আমি যদি কবি হতে চাই, তাহলে কোন ধরনের কবি হতে চাই আমি তার নমুনা হিসাবে এটা পেশ করেছি। আপনি প্রথম প্রশ্নই করেছেন, আমি অনুবাদ বেছে নিলাম কেন। প্রত্যেক মানুষই দর্পনে নিজের মুখ দেখে। আমি জুল্লে’র ভেতরে হয়তো নিজের মুখই দেখেছি। কিন্তু সজ্ঞানে আমার কথা ডরোথির নামে চালিয়ে দেইনি। অজ্ঞানে হয়তো চলে গেছে। নাজিম হিকমতের কবিতা আমরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে পড়েছি। এঁরা দু’জনই কমুনিস্ট পার্টি করতেন। এক ধরনের সহমর্মিতা নিভৃতে কাজ করে বলতে পারেন।
শামস আল মমীন: ডরোথি জুল্লেকে অন্যান্য ইউরোপীয় কবিদের তুলনায় কোন দিক থেকে আপনার চোখে আলাদা মনে হয়েছে?
সলিমুল্লাহ খান: এটা একটা ভাল প্রশ্ন করেছেন। এলিয়ট, অডেন, ইয়েটস এঁদেরকে আমরা আধুনিক কবি বলি। ফরাসি ভাষায় বোদলেয়ার, মালার্ম, আরাগঁ। জার্মান ভাষায় রিলকে, স্টেফান। এঁদের সবার চেয়ে ভিন্ন কবি ব্রেখট। তাঁকেও আধুনিক কবি বলতে হবে। কিন্তু তিনি সব সময় কমুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। পাবলো নেরুদাও কমুনিস্ট ছিলেন। কিন্তু প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন সুররিয়ালিস্ট। আরাগঁ এবং পল এলুয়ার প্রথম জীবনে সুররিয়ালিস্ট হলেও পরে কমুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু ব্রেখট শুরু থেকেই আধুনিক এবং কমুনিস্ট। বই পড়ে যতটুকু জানি, ইউরোপের আধুনিক কবিদের মধ্যে দুটো প্রবণতা কাজ করে। যাঁরা সুররিয়ালিস্ট হিসেবে লেখা শুরু করেন তাঁদের কেউ কেউ কমুনিস্টদের প্রতি সমবেদনা সম্পন্ন আবার কেউ কেউ কমুনিস্টবিরোধী হয়ে ওঠেন।
আমি শুরু থেকেই কমুনিস্টদের প্রতি সমবেদনাসম্পন্ন। তবে আমি অ-কমুনিস্টদের কবিতা পড়েও আনন্দ পাই। যেমন রিলকে কমুনিস্ট ছিলেন না কিন্তু তাঁর কবিতা পড়ে মজা পাই। আবার নাজিম হিকমতের কবিতা পড়েও মজা পাই। কিন্তু মতাদর্শের দিক থেকে আমি নাজিম হিকমতের মতো কবিতা লিখতে পারি না। আমার কবিতা ব্রেখটের মতো। ব্রেখটের মতোই তাঁর ধারার পরবর্তী কবি ডরোথি জুল্লে। জুল্লে’র যে রাজনৈতিক বিশ্বাস সেটা আমার শ্রদ্ধেয় কিন্তু সে জন্য আমি তাঁর কবিতা অনুবাদ করি নাই। আধুনিক কবিতার দুর্বলতা, আধুনিক কবিতা জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ায় এবং যে কারণে, আমার মতে, আধুনিক কবিতা নিজেই আত্মহত্যা করেছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটাই পথ আবার ন্যাশনাল-পপুলার ট্র্যাডিশানে ফিরে যাওয়া এবং সেভাবে কবিতা নিজেকে রিনিউ করবে। জুল্লে’র কবিতায় এই ন্যাশনাল-পপুলার ট্র্যাডিশানের ভঙ্গিটা আছে, সেটা আমি ব্রেখটের মধ্যেও দেখি। কবিতা শুধু রোমান্টিকতা নয়। কবিতা প্রশ্ন করে, জিজ্ঞাসা করে। ফরহাদ মজহারের একটা গানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলি:
যে জীবন স্বপ্নের সে জীবন নয়জুল্লে’র কবিতায় আমি স্বপ্ন এবং অন্বেষণের একটা মিল পাই। জুল্লে এখানেই অন্যদের থেকে ভিন্ন।
যে জীবন প্রশ্নের
অন্বেষণের
সে জীবন আজ আমি চাই।
শামস আল মমীন: আপনার কথায়, এই কিতাবে আপনি চাণ্ডালি ভাষা ব্যবহার করেছেন। এটা কি কবিতার মেজাজকে ধরে রাখার জন্য? নাকি আগে কেউ এই ভাষা ব্যবহার করে নাই বলেই চমক সৃষ্টির জন্য নতুন মাল বাজারে দিলেন?
সলিমুল্লাহ খান: সোজা কথা, ব্রাত্য রাইসুকে অনুসরণ অর্থাৎ স্টান্ট দিলাম কি না এই তো। শামসুর রাহমানের মতো—আপনি ভদ্রলোক—ওইটুকু বলছেন না। কবিতা ভাব দিয়ে লেখা হয় না, কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে। কবির মনের ভাবনাটা কি আমরা কোনদিন জানবো না কিন্তু ভাবটা ধরা পড়ে ভাষার মধ্য দিয়ে। এটাকে আমি বলি সিগনিফায়ার। ভাষার উপর যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে কবি যতো কথাই বলুক না কেন তার শেকড় গজাবে না। এবং সচেতনভাবে আমি এই ভাষা যদি ব্যবহার করি তাতে দোষের কিছু দেখি না। আমি নিজস্ব একটা ভাষারীতি তৈরি করতে চাই। কিন্তু শুধু ভাষার জন্য ভাষা তৈরি করা যায় না। দেখতে হবে, কবিতার মেজাজকে ধরে রাখার জন্য এটার প্রয়োজন আছে কি না। আমি যেটাকে চাণ্ডালি ভাষা বলছি, আমি মনে করি, সেটা খাঁটি বাংলা ভাষা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই চাণ্ডাল বংশের এবং বাংলা ভাষাটাই একটা চাণ্ডাল ভাষা। বাংলা ভাষার প্রকৃতি বলতে কিছু নেই। আসলে বাংলা হচ্ছে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ এবং বাংলা ভাষার প্রকৃতি বলতে যদি কিছু থাকে সেটাই হচ্ছে চাণ্ডালি ভাষা। আমি কবিতা বাংলা ভাষায় লিখতে চাই।
…….
সলিমুল্লাহ খান, ছবি. খন্দকার তারেক, ওয়েস্ট চেস্টার, নিউইয়র্ক, ১৯৯৭
………
কলকাতার মধ্যবিত্ত কবিরা যে বাংলা ভাষার চালু করেছেন, বুদ্ধদেব শুরু থেকেই বলছি। এটাও একটা আঞ্চলিক ভাষা। কিন্তু রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে এটা তথাকথিত মান ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। এটাও একটা সুন্দর ভাষা। এখান থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। কিন্তু এই কারণে অন্যান্য অঞ্চলের ভাষার মধ্যে যে সাহিত্যগুণ আছে সেটাকে বাদ দিতে পারি না। এবং বাদ দেওয়ার প্রবণতা হবে আত্মহত্যামূলক। আমি যদি গ্রিক ভাষা কিম্বা ইটালিয়ান ভাষা শিখতে পারি যেমন মধুসূদন শিখেছিলেন, তাহলে আমার উচিত ময়মনসিংহের ভাষা, বরিশালের ভাষা শেখা। কলকাতার ভাষা প্রতিষ্ঠিত ভাষা হয়ে গেছে বলে আর ময়মনসিংহের ভাষায় কোন মনযোগ দেওয়া যাবে না, প্রবণতা হিসাবে এটা হবে কবিদের জন্য ক্ষতিকর। কিছু কিছু আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এমন প্রকাশভঙ্গি আছে যা তথাকথিত শুদ্ধ ভাষায় নেই। কাজেই, এগুলো আনা উচিৎ।
—————————————————————-
আমি যেটাকে চাণ্ডালি ভাষা বলছি, আমি মনে করি, সেটা খাঁটি বাংলা ভাষা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই চাণ্ডাল বংশের এবং বাংলা ভাষাটাই একটা চাণ্ডাল ভাষা। বাংলা ভাষার প্রকৃতি বলতে কিছু নেই। আসলে বাংলা হচ্ছে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ এবং বাংলা ভাষার প্রকৃতি বলতে যদি কিছু থাকে সেটাই হচ্ছে চাণ্ডালি ভাষা। আমি কবিতা বাংলা ভাষায় লিখতে চাই।
—————————————————————-
শামস আল মমীন: আমেরিকায় সাদা কালো সবাই ইংরেজি বলে; এর মধ্যেও কালোদের কথায় এবং লেখায় কিন্তু ওদের নিজস্ব ভাষাভঙ্গি আছে যা স্ট্যান্ডার্ড ইংরেজি থেকে একেবারে ভিন্ন।
সলিমুল্লাহ খান: ওটা করলে ওরা মারা যেতো। যেমন ওরা যখন লেখে ‘Lowd’ (Lord), হয়তো এটা হুবহু মুখের কথা নয়। কিন্তু কালোদের যে সমস্যা, তাদের যে ঐতিহাসিক সংকট এটা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে। আপনি ঠিকই বলেছেন ইংরেজি তো একটা ভাষা নয়, বহু ভাষা। আমি শুধু মেসেজটাই দিতে চেয়েছিলাম, বাংলা ভাষা বলে একটি বিশেষ ভাষা নেই, বাংলা বহু ভাষা।
শামস আল মমীন: আপনার এই চাণ্ডালি ভাষার বদনাম করেছে অনেকেই। তারা ঠিক এটাকে গ্রহণ করতে পারছে না। তাদেরকে আপনি কি বলবেন?
সলিমুল্লাহ খান: বদনাম যারা করে তাদের নাম বলাই ভালো। আপনি ভদ্রলোক তাই নাম বলতে চান না। আমার নাম বলতে আপত্তি নাই। যেমন হুমায়ুন আজাদ। বাংলা ভাষার একজন কবি এবং পণ্ডিত। উনি ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা ভালই জানেন কিন্তু সাহিত্যের মূল ন্যারেটিভে তিনি এই ভাষা ব্যবহার করবেন না। কিম্বা সাহিত্য সমালোচনা এই ভাষায় করবেন না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তাঁকে বলতে শুনেছি, বাংলা ভাষার একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিৎ। আমি মনে করি তাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভাষার চিরকালীন কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই। যেমন ষোড়শ শতাব্দীতে যা স্ট্যান্ডার্ড ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে তা আর স্ট্যান্ডার্ড থাকে না। এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর স্ট্যান্ডার্ড কিন্তু আজ আর স্ট্যান্ডার্ড নেই। এবং এই প্রক্রিয়াতে থেমে থাকা বলে কোন ব্যাপার নেই। এটা নিরন্তর চলছে। সৃষ্টিশীল লেখকরা কিন্তু ভাষা পরিবর্তনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, এবং আমি সেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছি মাত্র। আমি চাণ্ডালি ভাষা লিখে যদি ব্যর্থ হই আমি একজন নগণ্য কবি ব্যর্থ হলাম। কিন্তু যদি সফল হই কিম্বা অন্য কেউ এই পথ অনুসরন করে তাহলে বাংলা ভাষার গতি পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা আছে।
শামস আল মমীন: আধুনিক কবিতায় ‘মুই’, ‘মোর’, ‘অরা’ এসব শব্দের ব্যবহার ঘটা করে নিষিদ্ধ ঘোষণা দেওয়ার পরেও আপনি এসবের পুনর্ব্যবহার করলেন কেন?
সলিমুল্লাহ খান: সমস্যা না থাকলে কোন সমাধান আসে না। বাংলা কবিতায় আমি একটা সমস্যা অনুভব করেছি। কবিতায় ‘মুই’, ‘মোর’ লেখা যাবে না, অর্থাৎ যারা এই নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন, আমি মনে করি তারা কাজটা খুব তড়িঘড়ি করে করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন ‘মুই’ ব্যবহার করা অনাধুনিক আর ‘আমি’ ব্যবহার করাটা আধুনিক। আমি এটা অস্বীকার করি না। কিন্তু দেখা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে ‘মুই’ ব্যবহার না করলে ভাষা তার ব্যঞ্জনা হারিয়ে ফেলে। বাংলা ভাষার প্রকাশ ক্ষমতাকে যদি আমরা বাড়াতে চাই তাহলে তার সমস্ত সম্ভাবনাকে তলিয়ে দেখতে হবে। আমার ধারণা ‘মুই’ বা ‘মোর’ ব্যবহারের সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশেষিত হয়ে যায় নি। যেমন এক কবিতায় আমি লিখেছি:
নতুন শহরে এসে টের পাই
বন্ধু নাই মোর বন্ধু নাই ।
এখানে “বন্ধু নাই আমার বন্ধু নাই” বললে ঐ বোধ আসে না যা ‘মোর’ বললে আসে। গদ্যে কিন্তু আমি নিজেই ‘আমি’ লিখছি, পদ্যে আবার ‘মুই’ লিখছি। যারা বলে দিয়েছেন ‘মুই’ ‘মোর’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। আমি মনে করি, তারা প্রিম্যাচিউর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
শামস আল মমীন: The artist should not fear being considered absurd as long as the artistic efforts are sincere. ই. ই. কামিংসের এই উক্তি আপনার মনে আছে কি?
সলিমুল্লাহ খান: না । এই উক্তি আমার জানা ছিলো না। তবে কামিংসের সাথে আমি একমত হতে পারি। যদিও লোলে ‘সিনসিয়ার’ এবং ‘অ্যাবসার্ড’-এর অর্থ নিয়ে দ্বিমত হবেন, তর্ক করবেন।
শামস আল মমীন: সমালোচক মুসতাফা সাঈদ আপনার অনুবাদে অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছেন (যথা: ‘তোর গল্প করতে পারি না ঈসা… হেন বিশপ নেই তোর পাছা মারে না।’ পৃ. ১৫) তাঁর মতে এটা ঠিক কবির উক্তি নয়, এখানে আপনার অতিরঞ্জন আছে।
সলিমুল্লাহ খান: পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলা দরকার, বইয়ের ৬০টা কবিতার মধ্যে ৪০টা আমি ইংরেজি থেকে করেছি, বাকিগুলার মূল জার্মান আমি পড়েছি। তবে এই কবিতাটা আমি অনুবাদ করেছি ইংরেজি থেকে। লাইনগুলো এরকম, Every Bishop sleeps with you. আমি আঞ্চলিক শব্দে এর অনুবাদ করেছি। এর চেয়ে বেটার এক্সপ্রেশন থাকতেও পারে। কিন্তু আমি যা করেছি সেটাকে আমি অশ্লীল বলব না।
শামস আল মমীন: আমার ধারণা, কবিতায় অশ্লীল বলে কিছু নেই। শিল্পসম্মত প্রয়োগই হচ্ছে মূল কথা। মুসতাফা সাঈদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি বর্তমান বিশ্বের আধুনিক কবিতা যদি নিয়মিত পড়ার সুযোগ পেতেন তাহলে হয়তো এই অভিযোগ করতেন না। মার্কিন এক বিখ্যাত কবি Etheridge Knight-এর একটি বিখ্যাত কবিতার কিছু অংশ মুসতাফা সাঈদ ও পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম।
fuck marx and mao fuck fidel……সলিমুল্লাহ খান: মুসতাফা সাহেব এখানে রক্ষণশীল একটা অবস্থান নিয়েছেন। আমাকে অবলম্বন করে উনি সমাজে তাঁর নিজস্ব মত প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। প্রতিদিন আমরা মুড়ি-মুড়কির মতো অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করি, কিন্তু লেখার সময় আমাদের হাত সংকুচিত হয়ে আসে। আমি মনে করি না এই কবিতায় কোন অশ্লীলতা প্রকাশ পেয়েছে। এখানে প্রকাশ পেয়েছে এক ধরনের সামাজিক নিন্দা ও ধিক্কার।
fuck joseph fuck mary fuck god jesus …
fuck the whole muthafucking thing
all i want now is my woman back
so my soul can sing.
শামস আল মমীন: ভূমিকায় আপনি বলছেন, আপনার ভাবনার উপর ওলন্দাজ স্পিনোজার মতো একরোখা দার্শনিক ফরহাদ মজহারের প্রভাব আছে। ফরহাদ মজহারকে মুসতাফা সায়ীদ বলেছেন “একজন উদ্বাস্তুচিত্ত মানুষ আর তার এবাদতনামা বাংলা কাব্যের ইতিহাসে এক অট্টহাসি।” আপনার গুরুনিন্দাকে আপনি কিভাবে গ্রহণ করেন।
সলিমুল্লাহ খান: ফরহাদ মজহারের সাথে আমি ১০১টা বিষয়ে একমত নই। কিন্তু গুরু বলে কাকে?—যে আলো দেয়। ফরহাদ যখন আমেরিকা থেকে ফেরত গেলেন তখন আপনার মতো (আমার বুকসেলফ দেখিয়ে) এরকম দুই সেলফ নতুন বই নিয়ে যান। ফরহাদের যে বিশাল পড়াশোনা সেদিন পর্যন্ত সেরকম পড়াশুনা করা আর কোন লোকের সাথে আমার দেখা হয় নাই। ফরহাদের কবিতা যখন পড়লাম, গান যখন শুনলাম তখন আমার মনে হলো, ঢাকায় আমার পরিচিত কবি-সাহিত্যিক সবার চেয়ে এই উদ্বাস্তুচিত্ত লোকটিই উজ্জ্বল। তাঁর এবাদতনামা যদি অট্টহাসি হয় তাহলে আমাদের সাহিত্যে এখন অট্টহাসিরই দরকার। ফরহাদের কবিতা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং এই মতে আমি পৌঁছেছি আজ থেকে ২৩ বছর আগে এবং ফরহাদ আমাকে হতাশ করেন নি।
আমি আগেই বলেছি বের্টল্ট ব্রেখট আমার প্রিয় কবি। বাংলা ভাষা যদি জার্মান ভাষার মতো হতো তাহলে ফরহাদ আজকে পৃথিবীতে বিখ্যাত হতো। ফরহাদ বাংলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি এতে কোন সন্দেহ নাই। বর্তমান ৫ জন সেরা কবির মধ্যে ফরহাদ একজন এবং ফরহাদ আমার শক্র হলেও এটা বলতে হবে। অথবা আমি কবিতা বুঝি না এটাও হতে পারে।
শামস আল মমীন: কেউ কেউ আপনার এই চাণ্ডালি ভাষা ব্যবহারের সুনাম করেছে প্রচুর। এদের বেশির ভাগই তরুণ কবি, সমালোচক। অথচ বয়স্ক লেখকরাই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার বেশি—কারণটা কি?
সলিমুল্লাহ খান: সেটা সঠিক করে বলা মুশকিল। যেসব তরুণদের পছন্দ হয়েছে তাদের অনেকের সাথে আমার পরিচয় চিঠিপত্রে। যেমন ব্রাত্য রাইসু। তাঁর কবিতার মধ্যেও এই প্রয়াসটা আছে। আমাদের মধ্যে আলাপ করে কিন্তু এটা হয়নি। তাতে বুঝতে পারছি সময়ের যখন একটা চাহিদা দেখা দেয় তখন বিভিন্ন দিক থেকে তার প্রতিধ্বনি হতে থাকে। এবং দেখলাম আমার মত করে অনেকেই চিন্তা করছে। আমি বলব না তারা আমার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অথবা আমিও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হইনি। একটা কমন তৃতীয় ঘটনা দ্বারা আমরা প্রভাবিত হয়েছি।
এটাকেই আমি বলি সমকালীন বাংলা কবিতা বা ভাষার সংকট। আধুনিক বাংলা বলে যে ভাষাটা চালু রয়েছে, হুমায়ুন আজাদ যে ভাষায় লেখেন আর কি। তিনি বুদ্ধদের বসুর শিষ্য। হুমায়ুন আজাদ প্রতিভাবান মানুষ। কিন্তু প্রতিভাবান মানুষের হাতে ভাষাটা যখন দুর্বল থাকে তখন আমি বুঝতে পারি এ ভাষার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এটাই বাংলা ভাষার লিমিট। যেমন আবদুল মান্নান সৈয়দ নিঃশেষিত হয়ে গেলেন। শুদ্ধতম কবি যখন তিনি লিখেছিলেন তখন সুধীন দত্তকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত সুধীন দত্তের যে মেধা সেটা মান্নানের নেই। সুধীন দত্তীয় বাংলা গদ্য আবদুল মান্নানের হাতে প্রাণহীন হয়ে গেছে। যেমন আকাশে ওড়ার সময় পাখিকে সুন্দর লাগে। সেই পাখি মাটিতে পড়ে যখন ধড়ফড় করে তখন প্রাণের মধ্যে শুধু বেদনাই জাগে। আমি যদি সুধীন দত্তকে আকাশে ওড়া কবুতর মনে করি তাহলে মান্নান সেই মাটিতে পড়া ধড়ফড় করা কবুতর।
বাংলা ভাষার সংকট থেকেই আমি এই চাণ্ডালি ভাষার দিকে গিয়েছি এবং দেখি আমি একা নই। ব্রাত্য রাইসু এবং আরো অনেক তরুণ এটাকে পছন্দ করছে। এতে প্রাণে এই আশা জাগে যে আমি ভুল পথে নেই। আর বুড়ারা বুঝতে পারছেন না কারণ তাদের সত্য বোঝার অক্ষমতা এবং স্বার্থপরতা। যেমন ধরুন, শামসুর রাহমান ৬০/৭০ টা বই লিখেছেন। তাঁর পক্ষে নতুনদের অভিনন্দন জানানো সম্ভব শুধু মুখে, কাজে নয়।
শামস আল মমীন: আল্লাহর বাদশাহি প্রকাশের আগেই ঢাকায় লেখকদের মধ্যে আপনার চাণ্ডালি ভাষার কথা নিয়ে চাপা গুঞ্জন চলছিল। সলিমুল্লাহ খান নিউইয়ার্কে গিয়ে বাংলা ভুলে গেছেন। বাংলা ভাষায় যে পরিবর্তন এসেছে উনি তার খোঁজ-খবর রাখেন না। তাঁদেরকে কি কিছু বলার আছে আপনার?
সলিমুল্লাহ খান: তাঁদেরকে কিছু বলার নেই, তবে তাদের জন্য একটা গল্প আছে। মধুসূদন দত্ত নামে বাংলা ভাষার একজন কবি ছিলেন, কেউ কেউ বলেন। আমি তাঁকে দেখিনি, কিন্তু বিশ্বাস করি তিনি ছিলেন। মেঘনাদ বধ কাব্য লেখার আগে তিনি কিছু নাটক-কবিতা লিখেছেন। তখন যদি কেউ বলতেন পয়ার কি মধুসূদন ভুলে গেছেন কিম্বা অমিত্রাক্ষর লেখার আগে বাংলা ভাষায় যে পুঁথি লেখা হতো সেটা তিনি জানেন না কিম্বা ভুলে গেছেন—মধুসূদন যে জবাব দিতেন আমি সেই জবাবই দিবো। আমি নিজেকে মধুসূদনের সাথে আপাতত তুলনা করছি না। মধুসূদন বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর চালু করেছেন এবং আমরা তা গ্রহণও করেছি। আমি যে কাজটা করেছি তা না জানার জন্য যতটা নয় তার চেয়ে বেশি অসন্তুষ্টির জন্য। স্বীকার করি, গত ১৫ বছরে সবার লেখা আমার পড়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু এর আগে তো বাংলা ভাষায় কিছু লেখা হয়েছে। এবং সেগুলো কিছু আমি পড়েছি।
শামস আল মমীন: আপনার ভূমিকায় লিখেছেন “পশ্চিম থাইক্যা আসা পচা মালের ভিড়ে আমরা বিস্তর তাজা প্রাণ হারাইয়া ফালাইছি। অহন ফ্রয়েড-লাকাঁ পড়ে দেখি সব শেষ হয় নাই। লেজে প্রাণ আছে।” প্রাণটা কার লেজে দেখলেন একটু খোলোসা কইরা কন দেখি।
সলিমুল্লাহ খান: লালন ফকির আমাদের দেশে এখন খুব আলোচিত। দুই বাংলার যতগুলো কবিতার এন্থোলজি আছে এগুলোতে অনেকের কবিতা থাকলেও লালনের কবিতা কোথাও স্থান পায়নি। লালনকে কোথাও কবি বলে স্বীকার করা হয় না, কিন্তু তাঁর গানকে স্বীকার করছে। তাঁর গান তো কবিতাও বটে, কিন্তু আমরা তা স্বীকার করতে পারছি না, তার মানে লেজের প্রাণটা স্বীকার করছি না। লেজে প্রাণ বলতে আমি বোঝাচ্ছি—লালনের কবিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিম্বা ইংরেজ শাসনের উপর নির্ভর করেনি, কিন্তু সেগুলো টিকে আছে। কি করে তিনি টিকে থাকলেন? প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর আখড়ায় আসে। এই মানুষগুলো যার টানে আসে এটাকেই আমি বলছি লেজে প্রাণ। কারণ ঐ লোকগুলো খেতে আসে না, ওর মধ্যে একটা এসথেটিক আছে। এবং ওটাকেই আমি বলব আসল সাহিত্য। আমাদের সমাজে আমরা যারা কবিতা লিখছি তারা কৃত্রিম একটা জগতে বাস করি। এটাকে আমি বলছি পশ্চিম থেকে আসা পচা মাল।
শামস আল মমীন: মুসতাফা সাহেব আরো বলছেন, আপনি টের পাইলেন কিন্তু লাকাঁ পড়ার আগে টের পাইলেন না কেন?
সলিমুল্লাহ খান: লাকাঁ একজন ফরাসি লেখকের নাম। লাকাঁর জায়গায় যদি লিখতাম শেক্সপিয়র তাহলে মোস্তফা সাব কি এই প্রশ্ন করতেন? ঘটনাটা হচ্ছে গত দু’শ বছর আমরা শুধু ইংরেজের গোলাম ছিলাম না। পুরা ইউরোপের গোলাম ছিলাম। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপ যা অবদান রেখেছে এগুলো বাদ দিয়ে আমরা ইউরোপের বিরুদ্ধে এমনকি নিজেদের মধ্যেও টিকতে পারব না। লাকাঁ একটা নাম মাত্র। আমি এখানে দুটো কাজ করেছি। প্রথমটা, লাকাঁর প্রতি আমার ভক্তি প্রকাশ। দুই, শুধু পশ্চিমের দর্পনেই আমি টের পেলাম নিজেকে।
শামস আল মমীন: মুসতাফা সাহেবের শেষ কথা, আপনার লেখার উদ্দেশ্যই যেন প্রতিপক্ষের ভ্রান্ত প্রয়াসকে আঘাত করা। চোখে আঙুল দিয়ে নয়, শুধু যেন কান ধরে ভুলটি দেখিয়ে দেওয়া এরকম একটা কিছু। আপনি যা লিখছেন সেগুলো কি প্রাণের তাগিদেই লিখছেন, নাকি সাঈদের কথাই সত্য।
সলিমুল্লাহ খান: আমার মনে হয় দু’টাই সত্য। এখানে প্রতিপক্ষটা কে? প্রতিপক্ষ হচ্ছে যে ধারণাকে আমি ভুল মনে করি। কোন ব্যক্তিকে আমি প্রতিপক্ষ মনে করি না। যদি ঘটনাচক্রে কোন ব্যক্তি ঐ ভুল মতকে ধারণ করে আমি তাকেও আক্রমণ করতে পিছপা হই না। উদাহরণ দেই, প্রফেসর রাজ্জাক আমার খুব প্রিয় মানুষ, কিন্তু তাঁর মতের একটা ভুল যখন আমি পেলাম আমি তাঁর সমালোচনা করতে পিছপা হইনি। কিন্তু আমি রাজ্জাকবিরোধী নই।
শামস আল মমীন: আপনি তো অনেকদিন থেকেই কবিতা লিখছেন। আপনার প্রথম বই এক আকাশের স্বপ্ন-র ভাষা এবং দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আজকের ভাষা এবং দৃষ্টিভঙ্গি আপনার কাছে কতটা ভিন্ন মনে হয়?
সলিমুল্লাহ খান: বেশ ভিন্ন মনে হয়। কখনো কখনো অনুতাপ করি কিছু কবিতার দুর্বল এক্সপ্রেশনের জন্য। ঐ বই সম্পর্কে আমার বিশেষ কোন দাবি নাই। তবে ৩/৪ টা ভালো কবিতা আছে বলে আমি মনে করি। আমার মৌলিক কাব্যবিশ্বাস বদলায় নি। তবে ভাষা বলদেছে। এটাকে আমি উন্নতির লক্ষণ বলেই মনে করি।
শামস আল মমীন: অক্টোবর ’৯৯-এ ভোরের কাগজে কবি নুরুল হুদা সত্তরের কবিতাকে রাজনীতির কবিতা উচ্চকণ্ঠের কবিতা বলে মত প্রকাশ করেন এবং ২৯ অক্টোবর সংখ্যায় সত্তরের ১২ জন কবি এর প্রতিবাদ জানান। আপনি ঐ সময়ের কবি হিসাবে কিভাবে এর মূল্যায়ন করেন?
সলিমুল্লাহ খান: আমি মনে করি নুরুল হুদার বক্তব্য সত্য। সত্তর দশকে যাঁরা কবি হিসাবে পরিচিত যেমন মোহন রায়হান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ—এঁরা উচ্চকণ্ঠের কবি। আমি নিজেও কিছু উচ্চকণ্ঠের কবিতা লিখেছি, কিন্তু আমি উচ্চকণ্ঠের কবি নই। আমি ওঁদের চেয়ে ছোট, কিন্তু ভিন্ন ধরনের কবি। যদি মোহন-রুদ্রকে আমরা কবি হিসাবে স্বীকার করি তবে স্বীকার করতেই হয় ওরা উচ্চকণ্ঠের কবি। কিন্তু শিহাব সরকার, আবিদ আজাদ কিম্বা আবু করিম উচ্চকণ্ঠের কবি ছিলেন না। এ ক্ষেত্রে নুরুল হুদার বক্তব্য যেমন সত্য আবার সেই ১২ জন কবির প্রতিবাদও সত্য। তবে আমার ধারণা সত্তরের কবিতা দুর্বল। রুদ্র একজন ভালো কবি (ও আমার বন্ধু ছিল), ওর কিছু ভালো কবিতা আছে। সব বাদ দিয়েও আমি মোহন ও রুদ্রকে ভালো কবি বলে মনে করি। যদিও মোহন এখন ভালো কবিতা লিখতে পারছে না।
শামস আল মমীন: প্রথম আলো’র এক টেবিল বৈঠকে কবি সরকার আমিন তরুণ কবিদের কৃতিত্বকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করছেন, প্রবীণ কবিদের নাকচ করার স্পর্ধা, তরুণদের হাতে কবিতা ছন্দের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে, সম্পাদকীয় ভাষা থেকে কবিতা সরে এসেছে। তাঁর এই ব্যাখ্যা কবিতার জন্য কতটা সঠিক?
সলিমুল্লাহ খান: তরুণ কবিরা প্রবীণ কবিদের চিরকালই নাকচ করে। আমিন ভাবছন্দ বলতে কি বোঝাচ্ছেন ব্যাখ্যা না করলে তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রচলিত ছন্দকে নাকচ করা যায় না, এগুলো এবজর্ভ করতে হয়। কোন প্রতিভাবান কবি যদি নতুন কিছু করে আমি তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত আছি।
শামস আল মমীন: একই বৈঠকে টোকন ঠাকুর বলছেন, কবিদের মধ্যে পার্থক্য এতই বেশি যে, কবিতা কোন পথে যাচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না। চঞ্চল আশরাফ বলছেন, কবিতা নিয়ে গত এক দশকে কথা যতো হয়েছে সে তুলনায় ফসল কম। উত্তরাধুনিকতার নামে কোন বিনির্মাণ হচ্ছে না বরং পুনর্নির্মাণ হচ্ছে। নতুনদের এই ভাবনাকে আপনি কি ভাবে দেখেন?
সলিমুল্লাহ খান: কবিতার গতি পরিবর্তন হচ্ছে এটা সঠিক। কিন্তু কোন দিকে হচ্ছে? এখনো আমার চোখে কোন কবি পড়েনি যিনি তিরিশের কবিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। যাঁরা নিজেদের উত্তরাধুনিক বলে দাবি করছেন এদের মধ্যে একজন কবিকেও দেখি না যিনি জীবনানন্দের চেয়ে ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখছেন। বিষ্ণু, সুধীন, অমিয় বুদ্ধদের কবিতায় একটু একটু রাজনৈতিক কথা বললেও এরা মূলত প্রতিক্রিয়াশীল কবি। আমি আক্ষরিক অর্থেই বলছি। এরা একটা বিশেষ সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় এরা এক ধরনের নিরাপত্তা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু নজরুল পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। সত্তরের কবিরা চেষ্টা করেছেন। উত্তরাধুনিক কবিদের প্রধান সংকট হচ্ছে এরা শিক্ষিত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এরা টের পেয়েছেন শিক্ষিত হওয়ার দরকার আছে। এরা অনেকেই ইংরেজি বই পড়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু পড়ে বোঝেন না। ইংরেজি বুঝতে হলে বিদ্যার দরকার। অনুবাদের সময় অনুবাদক সচেষ্ট থাকেন যাতে অনুবাদ ভুল না হয়। কিন্তু ভুল অনুবাদ হলে কবিতা বেটার হয়। আমাদের কবিতা বেশির ভাগই ভুল অনুবাদ হয় এবং সে কারণেই এগুলো মৌলিক। যেমন নুরুল হুদা বলেন, বাংলা কবিতার ইতিহাস হচ্ছে অনুবাদের ইতিহাস। হুদার মুখে শুনেছি, রফিক আজাদ ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে পোয়েট্রি পত্রিকা থেকে কবিতা পড়ে সাথে সাথে একটা বাংলা কবিতা লিখতেন। শহীদ কাদরীও এ কাজ বিস্তর করেছেন। এই দুই কবির কবিতা যদি কেউ অনুসন্ধান করেন তাহলে বুঝতে পারবেন তাঁদের অর্ধেক কবিতা ইংরেজি কবিতা থেকে নেওয়া। কিন্তু আমরা এটাকে বলি ইন্সপায়ারড অনুবাদ, আক্ষরিক অনুবাদ নয়। কিন্তু প্রকৃত উত্তরাধুনিক কবি যেমন ফরহাদ মজহার ও সুব্রত গোমেজ এরা বুঝতে পেরেছেন আমাদের আবার ময়মনসিংহ গীতিকা পড়তে হবে এবং ট্রেডিশনাল উৎসগুলোতে ফিরে যাওয়া, এগুলোকে পুনর্বিবেচনা করা এবং পুণর্নির্মাণ করা। আমি ফরহাদ এবং সুব্রতের মধ্যে এই প্রতিভা দেখি।
শামস আল মমীন: বছর দুয়েক আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে উত্তরাধুনিক কবিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, এটা থিওরিতে যেমন প্রাকটিক্যালি এর তেমন ভিন্নরূপ আমার চোখে পড়ে না। আপনার মতামত কি?
সলিমুল্লাহ খান: ফরহাদ মজহারের এবাদতনামা আমার কাছে পোস্টমডার্ন কবিতার একটা উজ্জ্বল উদাহরণ। আমি মনে করি, তিরিশের আধুনিক কবিতার ধারাটি এখন প্রাণহীন হয়ে গেছে। আমাদের সবচে ভালো আধুনিক কবি সিকদার আমিনুল হক। ছন্দে তাঁর অপূর্ব দক্ষতা কিন্তু তাঁর মধ্যে নতুন কোন চিন্তা নাই। তিনি আত্মরতিপরায়ণ হয়ে উঠেছেন। মদ্যপান করা, নারীর বক্ষ উম্মোচন এগুলো তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। সেজন্যই বলছি, কবিতার এই ধারাটি মরে গেছে। ফরহাদ সেলফ কনশাসলি পোস্টমডান কবি। তাঁর এবাদতনামায় আধুনিক কবিতাকে পুরোপুরি রপ্ত করার পর তাকে প্রত্যাখ্যান এবং ট্র্যাডিশনাল কবিতা থেকে আহরণের চেষ্টা আছে। ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলোতে যে নতুন কবিদের কবিতা পড়েছি তার উপর ভিত্তি করেই আমার এ মন্তব্য। এর মধ্যে যারা বই প্রকাশ করেছেন কিন্তু যাদের লেখা আমি পড়িনি তারা আমার মন্তব্যের মধ্যে পড়েন না।
শামস আল মমীন: পাঠক কবিতা থেকে সরে যাচ্ছে। কারণ বর্তমান বাংলা কবিতা তারা বোঝে না। কবি ফরিদ কবিরের ধারণা ছন্দ বুঝলে তারা কবিতার ভেতরে পৌঁছাতে পারবে। এই ধারণাকে মনে রেখে তিনি ভোরের কাগজে ছন্দ এবং তার পর্ব ভেঙে পাঠককে বোঝানোর চেষ্টায় দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। প্রশ্ন, পাঠকের ছন্দ বোঝার দরকার আছে কি?
সলিমুল্লাহ খান: ছন্দজ্ঞান থাকা ভালো, কিন্তু ছন্দে পণ্ডিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
শামস আল মমীন: কবিতার ভাষা দশকে দশকে বদলায়, মানুষের মুখের ভাষা এতো তাড়াতাড়ি বদলায় না। অর্থাৎ কবিতা এগুচ্ছে পাঠককে পেছনে ফেলে। এটাকে কি ভাবে ব্যালান্স করা যায়?
সলিমুল্লাহ খান: আধুনিক কবিদের একটা সংকট আছে। ইনডিভিজুয়ালের ভাষা যতো দ্রুত বদলায় সাধারণের ভাষা ততো দ্রুত বদলায় না। দু’জন ব্যক্তি যখন তাদের নিজ ভাষা তুলে ধরেন তখন মানুষ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কোনটা সঠিক। ভাষায় যে দ্বিত্ব আছে এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তার বহু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ভাষা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কিন্তু প্রত্যেক কবিই চায় তার নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে। অনেকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা ভাষা কল্পনা করা যায় না। এটা ভুয়া কথা। ভাষা বদলায় কবিও বদলায়। এটা ঠিক। কিন্তু এই দুইয়ের মাত্রা একটু আলাদা। একজন রবীন্দ্রনাথ আসা যাওয়ায় বাংলা ভাষার কিছু যায় আসে না। বাংলা ভাষা তার চেয়ে বড়।
শামস আল মমীন: শামসুর রহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ ছাড়া তিনজন কবির নাম বলেন যাঁদের লেখা টিকে যাবে।
সলিমুল্লাহ খান: ফরহাদ মজহার। আবুল হাসান এবং নির্মলেন্দু গুণের কিছু কবিতা টিকে যাবে, যদিও গুণ অনেক বাজে কবিতা লিখেছেন। যদি অনুমতি দেন, সিকদার আমিনুল হকের নামও উল্লেখ করতে চাই, যদিও তাঁর কবিতার দর্শন আমার পছন্দ নয়। যাদের আমি বুর্জোয়া কবি মনে করি সিকদার হচ্ছেন তাদের রাজা। কেউ যদি আমাকে বলে, কবি হওয়া বলতে কি বোঝায়? আমি বলবো, সিকদারের জীবন ফলো করো। চেষ্টা করে তিনি ভালো কবি হয়েছেন। কেউ কেউ আমাকে বলে তুমি তো ভালো ছাত্র, তোমাকে দিয়ে কবিতা হবে না। কথাটা আমি প্রায় বিশ্বাস করতে বসেছিলাম। আমাকে উদ্ধার করেছেন সিকদার। তার কাছ থেকে দুটো জিনিস আমি শিখেছি। ১. কবিতায় কি লিখতে নেই; ২. জন্মগত প্রতিভা বলে কিছু নেই।
শামস আল মমীন: আহমদ ছফা কবি হিসাবে কেমন?
সলিমুল্লাহ খান: মানুষের নানা রকম ফ্যান্টাসি থাকে। কবিতা লেখা ছিল তাঁর এক ধরনের ফ্যান্টাসি। আমি তাঁকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি, আপনি পাগলামি করেন কেন? তিনি বলেন, পাগলামি না করলে টিকতে পারতাম না। যেহেতু পাগলামি করে তিনি সব জায়গায় পাত্তা পেয়েছেন তাঁর ধারণা কবিতাতেও তিনি পাত্তা পাবেন। কবিতার জগৎ খুব নিষ্ঠুর। তাঁর প্রথম বই জল্লাদ সময়-এ বেশ কয়েকটা ভালো কবিতা আছে, কিন্তু কবিতার যে ভাষা, প্রকরণ, আধুনিকতা ওটা তিনি কোনদিন ধরতে পারেন নি।
শামস আল মমীন: আপনার লেখা এবং বক্তৃতায় দেখা যায় আপনি সব সময় ইন্টেলেকচুয়ালি টারবুলেন্স সৃষ্টি করেন যেটা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। যেমন “অমর্ত্য সেনের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি’র ভাষা প্রসঙ্গে: কি আনন্দ সন্তান ধারণে?” বক্তৃতায় লালন ফকিরকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কিম্বা উপরে তুলে ধরেছেন (বক্তৃতা, বস্টন, ), বা রাজ্জাক সাহেবের উপর যে প্রবন্ধ লিখেছেন… ইত্যাদি।
সলিমুল্লাহ খান: ল্যাংস্টন হিউজেস-এর কবিতা থেকে উদ্বৃতি দিয়ে বলি: A women does the best she can. এর সাথে যোগ দিয়ে আমি বলি So does a man.
—————————————————————-
রবীন্দ্রনাথে ঈশ্বরের যে ধারণা আমরা পাই তার চেয়ে লালনের ধারণাটি দার্শনিক অর্থে অনেক বেশি গভীর। আমার বক্তব্য ছিল এই, এবং এখনো আমি এই বক্তব্যে অটল। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনার কোনো সুযোগই নাই। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরা যেমন এডওয়ার্ড সি. ডিমোক, জুনিয়র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আধুনিক বাঙলার শ্রেষ্ঠ বাউল উপাধি দিয়েছিলেন। এই উপাধি হাস্যকর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরের পায়ের কাছে বসারও যুগ্যি নন।
—————————————————————-
আমার কাজ হচ্ছে কমিউনিকেট করা। শামসুর রাহমান বলতে পারেন আপনি স্টান্ট দিয়ে কথা বলেন কেন? আমার কথা হচ্ছে, আমি সত্য বলছি কি না। লালন ফকিরকে নিয়ে কেউ যদি কখনও চিন্তা না করে তার পক্ষে আমার কথা বোঝা সম্ভব নয়। বস্টনে বক্তৃতার সময় আপনিও উপস্থিত ছিলেন। ঐ সময় ফরিদা পারভিনের গাওয়া লালন ফকিরের ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা/বেদে নাই যা রূপরেখা’ গানটি বাজিয়ে শোনাই এবং সেই গানের ব্যাখ্যা করি। রবীন্দ্রনাথে ঈশ্বরের যে ধারণা আমরা পাই তার চেয়ে লালনের ধারণাটি দার্শনিক অর্থে অনেক বেশি গভীর। আমার বক্তব্য ছিল এই, এবং এখনো আমি এই বক্তব্যে অটল। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনার কোনো সুযোগই নাই। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরা যেমন এডওয়ার্ড সি. ডিমোক, জুনিয়র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আধুনিক বাঙলার শ্রেষ্ঠ বাউল উপাধি দিয়েছিলেন। এই উপাধি হাস্যকর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরের পায়ের কাছে বসারও যুগ্যিও নন। আমার উদ্দেশ্য ইন্টেলেকচুয়াল সৃষ্টি করা নয়, বরং মানুষকে চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা। মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন পাছায় লাথি মেরে জাগিয়ে তুলতে হয়। আমার লেখাগুলো পাছায় লাথি মারার মতই হয়। আমি জানি, অমর্ত্য সেন আমার লেখার জবাব দেবেন না, কেউ যদি আমাকে বলেন, অমর্ত্য সেন সম্পর্কে তোমার মন্তব্য ঠিক নয় আমি তার জবাব দিতে রাজী আছি। কিন্তু এই প্রশ্নে কখনই একমত হবো না যে তাঁর সম্পর্কে লেখা যাবে না, যেহেতু তিনি অর্থনীতিবিদ, ভাষাবিদ নন।
শামস আল মমীন: আলবেনীয় কবি ইসমাইল কাদারে বর্তমানে ফ্রান্সে ১৯৫০ সনে মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউটে সাহিত্য পড়তে যান। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মস্কোয় আমি খুব দ্রুত অনুভব করলাম সাহিত্য সম্পর্কে আমার অধ্যাপকদের চেয়ে আমি অধিক অবগত।” ছাত্রজীবনে আপনার এরকম অভিজ্ঞতা কখনো হয়েছে।
সলিমুল্লাহ খান: তা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এক ইংরেজ লেখকের বই পড়াচ্ছেন। আমি বুঝতে পারছি তিনি বইটির মর্মকথা বুঝতে পারেন নি। আরেক শিক্ষক A text book of Jurisprudence (4th edition) বইটি অনুবাদ করে “ব্যবহার শাস্ত্রের বিজ্ঞান” শিরোনামে নিজের নামে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ করেন। আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র। সভ্যতা নামে এক পত্রিকায় বইটির রিভিউ লিখলাম। অর্থাৎ জালিয়াতিটা ধরিয়ে দিলাম। পত্রিকাটি যখন মাস্টারদের হাতে আসে তাঁরা তো মহা ক্ষ্যাপা। এই কারণে আমাকে অনার্সে ফাস্ট ক্লাস দেওয়া হয় নি। আরো আপত্তিকর ঘটনা হলো, বইটির ভূমিকা তিনি এমনভাবে লিখেছেন যে পড়ে মনে হবে এটা তাঁর বহু বছরের গবেষণার ফল। তাঁর শালা দুলাভাই তাকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন, তিনি তাও উল্লেখ করেন।
শামস আল মমীন: সৈয়দ জামালউদ্দিন আফগানি সম্পর্কে আপনি বলেছেন, “জামাল লেখাপড়া যতটা জানতেন ততটা লিখে যাননি এটাই আমাদের পোড়া কপাল।” আপনার বেলাতেও কি আমরা একই রকম দুঃখ করবো?
সলিমুল্লাহ খান: হজরত মোহাম্মদ, গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিস, লালন ফকির এঁরা কেউ নিজে কিছুই লিখে যান নি। তাঁদের কথা লিখেছেন অন্যরা। আমরা লেখার যুগের মানুষ। বলার মধ্যে আমার সব ইন্দ্রিয় যেভাবে ইনবলভড হয় লেখার সময় তা হয় না। প্রথমে আমি চিন্তা করি কথার মাধ্যমে তারপর মাথায় ঘুরতে থাকে সেটা কিছুদিন এবং একদিন লিখেও ফেলি। কিন্তু কেন জানি লেখা আমার জন্য কঠিন ব্যাপার।
শামস আল মমীন: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্বন্ধে কিছু বলবেন ?
সলিমুল্লাহ খান: আমি সার্বক্ষণিক লেখক হতে চাই। আমি বুঝতে পেরেছি লেখা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু লেখার উপর ঈমান আনতে পারছি না। কারণ লিখে ভাত জোগাড় করা মুশকিল। নিউইয়র্কে আসার আগেও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। জীবিকার প্রয়োজনে হয়তো মাস্টারিতে আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে। আমি না চাইলেও হয়তো কেউ আমাকে টেনে নিয়ে ছাত্রদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিবে। আর আমি অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যাব। ঘরে ফিরে আবার অনুতাপ করবো।
শামস আল মমীন: আমাদের প্রধান কবিদের কবিতা নিয়ে কিছু লিখবেন কি?
সলিমুল্লাহ খান: আমি মনে করি, আমরা যা চিন্তা ভাবনা করি তার সর্বোচ্চ ব্যবহার হওয়া উচিৎ। দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে আমাদের মৌলিক চিন্তা ভাবনাগুলো নিয়ে কিছু লিখতে চাই এবং সাহিত্যও আমার ভাবনার একটা অংশ। The Unconsciousness from Freud to Lacan এই শিরোনামে ফ্রয়েড আনকনশাস বলতে কি বুঝতেন ফ্রয়েডের অনুসারীরা কি বুঝেছেন এবং লাকাঁ কি করে সেই ধারণার পরিবর্তন করেছেন এই নিয়ে কয়েকটা প্রবন্ধ লিখতে চাই। আমি মনে করি দর্শনে বিশ্বব্যাপী আমাদের অবদান রাখার সময় এসেছে। কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ আমার বোধ হয় আর লেখা হবে না। কারণ আমার চিন্তার দিগন্ত সরে যাচ্ছে।
নিউইয়র্ক, এপ্রিল ২০০০
kabitanadia@hotmail.com
ওয়েব লিংক
শামস আল মমীন: আর্টস
সলিমুল্লাহ খান: আর্টস । ফেসবুক
একজন আরজে বা বেতার সাংবাদিক যদি চাণ্ডালি অথবা অপ্রমিত ভাষায় কথা বলেন, সেটি গ্রহণযোগ্য মনে করেন কি না?
—————————————————————-
মি. খান বলছেন যে, ’ভাষার চিরকালীন কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই। যেমন ষোড়শ শতাব্দীতে যা স্ট্যান্ডার্ড ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে তা আর স্ট্যান্ডার্ড থাকে না। এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর স্ট্যান্ডার্ড কিন্তু আজ আর স্ট্যান্ডার্ড নেই। এবং এই প্রক্রিয়াতে থেমে থাকা বলে কোন ব্যাপার নেই। এটা নিরন্তর চলছে।’
তাঁর এই কথার সূত্র ধরেই আমি এফএম রেডিওর একজন কর্মী হিসেবে তাঁর কাছে জানতে চাইব–হাল আমলে এফএম রেডিওর ভাষা নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। আপনি যেমন চাণ্ডালি ভাষার পক্ষে বলছেন, তেমনি এফএম রেডিও’র (এবিসি রেডিও বাদে) রেডিও জকি (আরজে) বা কথাবন্ধুরা নাগরিক বাংলা, ঘরোয়া ইংরেজি আর মুখ বাঁকা করা উচ্চারণ মিলিয়ে যে ভাষায় কথা বলেন, তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে সমালোচনা বিস্তর। এক্ষেত্রে আরজেগণের আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তিটা এরকম যে, তাদের যারা উদ্দীষ্ট জনগোষ্ঠী বা টার্গেট পিপল অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী তারা এই ভাষায়ই কথা বলেন। এটি নাকি অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগবান্ধব।
তবে ভাষাবিদ এবং যারা প্রমিত বাংলার পক্ষে কথা বলেন, তারা মনে করেন এভাবে বিকৃত উচ্চারণ আর ভুলভাল শব্দে এফএম রেডিও যে ভাষা চালু করেছে, তাতে করে আলটিমেটলি নিজভাষার প্রতি অবজ্ঞাই প্রদর্শিত হচ্ছে। কিন্তু যদি মি. খানের কথা মেনে নিই, তাহলে তো আরজেদের এই ভাষায় কথা বলায় কোনো দোষ দেখি না। আবার টেলিভিশন নাটকে ‘ভাই বেরাদার’খ্যাত মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বা আনিসুল হক যে ভাষা ব্যবহার করেন, তাতেও কোনো অসুবিধা নাই।
উপসংহারে মি. খানের কাছে এক লাইনে একটা প্রশ্ন রাখি–আপনি যখন চাণ্ডালি ভাষায় কবিতা কিংবা গদ্য লেখেন অথবা গল্প উপন্যাস, সেখানে প্রমিত বাংলার পক্ষের কেউ বিতর্ক করলেও কিছু যায় আসে না। কারণ সাহিত্যকে কোনো ভাষার সীমানায় না আটকানোই শ্রেয়। কিন্তু একজন আরজে বা বেতার সাংবাদিক যদি চাণ্ডালি অথবা অপ্রমিত ভাষায় কথা বলেন, সেটি গ্রহণযোগ্য মনে করেন কি না?
- Amin Al Rasheed
- স্বাক্ষর শতাব্দ
এফএম রেডিও আরজেগণ সাধারণের ভাষাকে ব্যবহার করছেন নাকি নিজেদের তৈরি করা ভাষা সাধারণকে গেলানোর চেষ্টা করছেন ভেবে দেখা দরকার। আমি মি. খানের সাথে একমত হয়েও রেডিও আরজেদের প্রয়োগকৃত ভাষার বিরোধিতা করতে পারি।
- তৌহিদ টিপু
বাংলা চণ্ডাল ভাষা, তাই সেটার প্রকৃতি বলতে কিছু নেই। এটা একেবারেই ভুল কথা।…
———————————–
লেখাটির প্রতি আমার মূলত দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিল এর শিরোনাম দেখে। এখানে বাংলা বহু ভাষা বলতে যেটা বোঝানো হচ্ছে, সেটা আসলে বাংলা ভাষাই, শুধু সেটার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ। এটা প্রত্যেকটি ভাষার ক্ষেত্রেই সত্যি। ইংরেজি, আরবি সব ভাষারই অনেক অনেক আঞ্চলিক সংস্করণ রয়েছে, তাই বলে সেটা ভিন্ন কোন ভাষা হয় যাচ্ছে না।
অন্য আরেকটি ব্যাপার যেটার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে, সেটা হচ্ছে বাংলা চণ্ডাল ভাষা, তাই সেটার প্রকৃতি বলতে কিছু নেই। এটা একেবারেই ভুল কথা। আমরা অনেকেই হয়তো Pidgin ভাষার কথা শুনেছি। এটা সব ভাষার জগাখিচুড়ি একটা রূপ, কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ভাষা সবসময়েই কিছু নিয়ম মেনে চলে। সেটা আমাদের মনের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায়। তাই ভাষা, সেটা যতো প্রাগৈতিহাসিক হোক না কেন, সেটার একটা প্রকৃতি আছে, ব্যাকরণ আছে। আর এসব কারণেই চমস্কি ইউনিভার্সাল গ্রামারের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন।
কোন ভাষা শুদ্ধ বা প্রমিত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে গুটি কয়েক লোকের রাজনীতি। সব ভাষার ক্ষেত্রেই এটা হয়েছে। তবে এখনকার ভাষাবিদরা সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। আর এই কারণেই আঞ্চলিক ভাষাগুলোও যেন তথাকথিত শুদ্ধ ভাষার সমান মর্যাদা পায় সে ব্যাপারে তারা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে সাক্ষাৎকারটা বেশ প্রাঞ্জল, এবং এজন্য লেখককে ধন্যবাদ।
- শেখ তুহিন
- মোজাফফর হোসেন
কবিতা সম্পর্কে কিংবা অনুবাদ সম্পর্কে তাঁর ভাবনা নতুন না হলেও, নানা দিক থেকে দেখার কারণে তা পরিপূর্ণ যা আমাদের অন্য লেখকদের মধ্যে বিরল।
———————————————-
বহুদিন পর একটি অসাধারণ সাক্ষাৎকার পড়ার গভীর আনন্দ পেলাম। সলিমুল্লাহ খান আমাদের চিন্তা-ভাবনার জগতটিকে নতুনভাবে বিন্যাস করার জন্য শুরু থেকেই আমাদেরকে উদ্ধুদ্ধ করে আসছেন। কবিতা সম্পর্কে কিংবা অনুবাদ সম্পর্কে তাঁর ভাবনা নতুন না হলেও, নানা দিক থেকে দেখার কারণে তা পরিপূর্ণ যা আমাদের অন্য লেখকদের মধ্যে বিরল। মন্তব্যের ক্ষেত্রে তাঁর সততাও আমাকে মুগ্ধ করেছে। শামস আল মমীন এবং সলিমুল্লাহ খান, আপনারা দুজনই আমার কৃতজ্ঞতা নেবেন।
- রাজু আলাউদ্দিন
তাঁর অনেক লেখা পড়েছি, ওগুলোর মধ্যে অন্যরকম মুগ্ধতা আছে, এরকম নয়।
—————————————————————-
ড. সলিমুল্লাহ খানের লেখা পেলেই পড়ি। তাঁর লেখা ভেতর থেকে নাড়া দেয়। ড. খানের সাক্ষাৎকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ বোধকরি এই প্রথম হল। অসম্ভব রকম সুন্দর। তাঁর অনেক লেখা পড়েছি, ওগুলোর মধ্যে অন্যরকম মুগ্ধতা আছে, এরকম নয়। তাঁর অন্য লেখা পড়তে আমার যেরকম কষ্ট করতে হয়েছে, এ সাক্ষাৎকার পড়তে আমার একটুও কষ্ট হয়নি। পরবর্তীতে আমরা তাঁর কাছ থেকে এ ভাষায় লেখা দেখব আশা করি। একটা মন্তব্য আমার খুব ভাল লেগেছে–”নিউইয়র্কে আসার আগেও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। জীবিকার প্রয়োজনে হয়তো মাস্টারিতে আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে। আমি না চাইলেও হয়তো কেউ আমাকে টেনে নিয়ে ছাত্রদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিবে। আর আমি অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যাব। ঘরে ফিরে আবার অনুতাপ করবো।”
অনুতাপ করেন কি?
- নূরুল আনোয়ার
এত সস্তা কথা সলিমুল্লাহ খান মাত্র দশ বছর আগেও বলতেন! আজ এক দশক পরে এ বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন জানতে ইচ্ছা করতাছে।
- মারজু