Thursday, September 16, 2010

আমাদের দুঃসময়ের রবীন্দ্রনাথ


আহমাদ মাযহার 
| আগস্ট ২০০৯ ১২:১১ পূর্বাহ্ন



পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাঙালি-মুসলমান মধ্যবিত্তের কাছে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাভাষার সৃষ্টিশীল মহৎ প্রতিভা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালি মাত্রের
…….
রবীন্দ্রনাথ, সম্পাদক, আনিসুজ্জামান; প্রকাশ সাল: ২০০১; প্রকাশক: প্রথম অবসর সংস্করণ: এফ. রহমান, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ৪৬ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা ১১০০; [প্রথম সংস্করণের প্রকাশক: মোহাম্মদ ওহিদউল্লাহ, ষ্টুডেন্ট ওয়েজ, বাংলাবাজার, ঢাকা, ১৯৬৮]
……
কাছেই প্রাসঙ্গিক থাকবেন তা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু পাকিস্তানি আমলে বাস্তবে তা ছিল না। কারণ বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা সামগ্রিক অর্থে বাংলাভাষা-ভিত্তিক জাতির মধ্যেই জেগে উঠেছিল পাকিস্তান আন্দোলন তাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বাংলার মুসলমান মনে করেছিল তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক মুক্তির উপায়। কিন্তু মুসলমানিত্ব যে
—————————————————————–
ন্যাশনাল ব্যুরো অব রিকন্সট্রাকশন নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান চালু করে সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা ভাবে আর্থিক সুবিধাদি দিয়ে দেশের সৃষ্টিশীল লেখক বুদ্ধিজীবীদের দিক থেকে বিরোধিতার সম্ভাবনাকে দীর্ঘকাল ঠেকিয়ে রাখতেও সক্ষম হয়েছিল আইয়ুব খানের তৎকালীন সরকার। কিন্তু যখন বলা হল পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বার্থে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করতে হবে তখন পূর্ব-বাংলার লেখক বুদ্ধিজীবীগণ বিপন্ন বোধ করতে শুরু করলেন। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন এক সাংসদের এক প্রশ্নোত্তরে জানান যে, পাকিস্তানের বেতার টিভিতে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্রসংগীত প্রচার করা হবে না এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯ জন সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এক বিবৃতি প্রচার করেন।
—————————————————————-
একেবারে তাদের বাঙালিত্বের গোড়া ধরে এভাবে টান মারবে তা পূর্ব-বাংলার মুসলমানরা ঠিক কল্পনা করতে পারে নি। যদিও পূর্ববাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া পাকিস্তানি শাসক চক্রের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বা বুদ্ধিজীবীগণ প্রথমে তেমন একটা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন নি। কারণ সমাজের অগ্রসর মানুষ হিসাবে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য তাদের স্পর্শ করে নি তেমনভাবে শুধু তাই নয়, ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব রিকন্সট্রাকশননামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান চালু করে সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা ভাবে আর্থিক সুবিধাদি দিয়ে দেশের সৃষ্টিশীল লেখক বুদ্ধিজীবীদের দিক থেকে বিরোধিতার সম্ভাবনাকে দীর্ঘকাল ঠেকিয়ে রাখতেও সক্ষম হয়েছিল আইয়ুব খানের তৎকালীন সরকার। কিন্তু যখন বলা হল পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বার্থে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করতে হবে তখন পূর্ব-বাংলার লেখক বুদ্ধিজীবীগণ বিপন্ন বোধ করতে শুরু করলেন। তাঁরা অনুভব করলেন তাঁদের অস্তিত্বের সংকট। এই সংকটের সূচনা ঘটে ১৯৬৫ সালে যখন পাক-ভারত যুদ্ধশেষে পাকিস্তানের আইয়ুবী সরকার ভারত থেকে পুস্তক আমদনি নিষিদ্ধ করে। বাংলাভাষা সাহিত্যের বিরাট অংশ থেকে পূর্ব-বাংলার বাঙালিদের বঞ্চিত রাখবার সরকারি অভিপ্রায় এতে কাজ করেছিল। ভারতীয় সম্পদ বর্জনের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ-বর্জন নিয়ে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। এর আগে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, এরই প্রতিক্রিয়াবশত বাংলাদেশে রবীন্দ্রশতবার্ষিক সাড়ম্বরেই উদযাপিত হয়েছিল। রবীন্দ্রশতবার্ষিক উদযাপনের উত্তাপ জোরেশোরে থাকতে থাকতেই সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রকাশ করেছিল একটি বিশেষ সংখ্যা। কয়েকটি বইও সে-সময় প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রচর্চার একটা সম্মিলিত স্বরের আকাক্সক্ষা ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি-মুসলমান মধ্যবিত্ত-সমাজের মধ্যে দেখা গিয়েছিল। বলা যায় আনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রচর্চার সংকলন রবীন্দ্রনাথ [১৯৬৮, ঢাকা] তারই ফল। কিন্তু কেন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত বাঙালি-মুসলমানের মধ্যে এই ধরনের আকাক্সক্ষার জন্ম নিল সে প্রশ্নের উত্তরে যদি বলা হয় যে, সে-সময়ে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনার শিক্ষিত মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন নিজেদের বিপন্নতার প্রতীক। সেই জন্যেই তাঁর মহত্ত্বকে প্রচার করা তাঁদের পক্ষে ছিল জরুরি। করণ সাংস্কৃতিক দিক থেকে এক ধরনের অলিখিত মনোজাগতিক অবরোধও সে-সময়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বুদ্ধজীবীগণ অনুভব করছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতে প্রচার নিষিদ্ধ করা তাঁদের মনোজগতে ঘটা এই অবরুদ্ধ পরিস্থিতির চাপ অরও বাড়িয়ে দেয়।
আনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রচর্চার সংকলন রবীন্দ্রনাথ-এর পটভূমি অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্র-বিরোধিতা এর উৎসগত প্রধানতম প্রেরণা। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে তথ্য বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন এক সাংসদের এক প্রশ্নোত্তরে জানান যে, পাকিস্তানের বেতার টিভিতে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্রসংগীত প্রচার করা হবে না এবং ধরনের আরও অন্যান্য গানের প্রচারও কমিয়ে দেয়া হবে। দুই দিন পর ২৪ জুন সংক্রান্ত সংবাদ প্রচারিত হয় জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র দৈনিক পাকিস্তান-এ। সংবাদের শিরোনাম ছিলরেডিও পাকিস্তান থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারিত হবে না এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯জন সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এক বিবৃতি প্রচার করেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে,
আমরা এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক বলিয়া মনে করি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলাভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করিয়াছে, তাহার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা তীক্ষ্মতা দান করিয়াছে, তাহা রবীন্দ্রনাথের বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করিয়াছে। সরকারী নীতি নির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।
বিবৃতিতে উল্লিখিত ভাষ্য থেকে সহজেই অনুভব করা যায় যে, মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা বোধ থেকে মুক্ত হবার অভিপ্রায়ে সে-সময়ে রবীন্দ্রচর্চা একটা মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হতে শুরু করেছিল। তাই বলা যায় সামগ্রিক অর্থে এই অনুভূতিরই প্রকাশ ছিল রবীন্দ্রনাথ সংকলনটি। এবারে দেখে নেয়া যাক এতে অন্তর্ভুক্ত রচনার শিরোনামসমূহ লেখক তালিকা:
মরমী রবীন্দ্রনাথ : মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্;
রবীন্দ্র-স্মৃতি : জসীম উদ্দীন;
ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ : মুহম্মদ আবদুল হাই;
শিক্ষাসমস্যা রবীন্দ্রনাথের চিন্তা : মুহাম্মদ কুদরাত--খুদা;
রবীন্দ্র-সাহিত্যে দার্শনিক চেতনা : আবুল ফজল;
নন্দনতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ : শওকত ওসমান;
রবীন্দ্রনাথ : তাঁর শিল্পসাহিত্যতত্ত্বের ত্রিবেণী : আবদুল মান্নান সৈয়দ;
রবীন্দ্র-স্গংীত : কাজী মোতাহার হোসেন;
সৌন্দর্যবুদ্ধি রবীন্দ্র-মনীষা : আহমদ শরীফ;
রবীন্দ্রনাথের গণসচেতনতার স্বরূপ : গোলাম মুরশিদ;
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম : মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী;
রবীন্দ্রনাথ লোকসাহিত্য : মযহারুল ইসলাম;
রবীন্দ্রনাথ : আবদুল কাদির;
রবীন্দ্রসাহিত্য মূল্যায়নের সমস্যা : জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা;
বাংলা কাব্যে মূল্যবোধের বিবর্তন : রবীন্দ্রনাথ : হাসান হাফিজুর রহমান;
রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি রূপান্তর : কবীর চৌধুরী;
ইয়েট্স রবীন্দ্রনাথ : সারওয়ার মুরশিদ;
রবীন্দ্রনাথের নাটক : উপলব্ধির রূপান্তর : মুনীর চৌধুরী;
তিন নারী : বিনোদিনী, নন্দিনী কুমুদিনী : নীলিমা ইব্রাহিম;
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প : শেষ পর্যায় : আনোয়ার পাশা;
রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার স্বরূপ : সন্তোষ গুপ্ত;
রবীন্দ্রসঙ্গীত, শিল্পী শ্রোতা : সন্জীদা খাতুন;
দুই যৌবনে কৃষ্ণ শোণিত : হায়াৎ মামুদ;
নতুন করে রবীন্দ্রচর্চা : শামসুর রাহমান;
রবীন্দ্রাথের সংস্কৃতি-সাধনা : আহমদ ছফা;
রবীন্দ্রনাথ পূর্ব পাকিস্তান : রফিকুল ইসলাম;
রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছন্দ : মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান;
রবীন্দ্রকাব্যে পরবর্তী পরিবর্তন : অজিতকুমার গুহ;
মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ : রণেশ দাশগুপ্ত;
রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তা : একটি দিক : আনিসুজ্জামান।
এই সংকলনের সূচীপত্রের দিকে তাকালে সহজেই লক্ষণীয় যে, রবীন্দ্র-প্রতিভার শীর্ষকেই এখানে সন্ধান করা হয়েছে। কেবল তাঁর কবিসত্তা নয়, তাঁর ব্যক্তিতার সর্বদিকে আলো ফেলে দেখা হয়েছে। মোদ্দা কথা তাঁর অবদানের বৈচিত্র্য বিপুলতা এই সংকলনের আরদ্ধ। এই বিরাটত্বের, মহত্তের সন্ধান করতে সেই সময়ের সক্রিয় খ্যাতনামা প্রায় সকল সাহিত্যিক এখানে অংশ নিয়েছেন। লেখকতালিকার শীর্ষদেশে রয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সম্ভবত এটিই তাঁর শেষরচনা, আর সর্বকনিষ্ঠ আহমদ ছফা, এই সংকলন প্রকাশের গুরুত্ব প্রথমে যাঁরা অনুভব করেছিলেন তাঁদের একজন। আহমদ ছফা এবং কাজী সিরাজ [তাঁর কোনও লেখা অবশ্য এই সংকলনে নেই] আনিসুজ্জামানকে এই ধরনের একটি সংকলন সম্পাদনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। শুধু তাই নয় সেকালের অন্যতম অগ্রণী প্রকাশনা সংস্থাষ্টুডেন্ট ওয়েজ’-এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ওহিদুল্লাহ-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রকাশককেও! আহমদ ছফা যেমন সৃষ্টিশীলতায় তেমনই রাজনৈতিক উপলব্ধিতে ছিলেন অগ্রসর। ছিলেন সাংগঠনিক উদ্যোগে উদ্দীপিত। বাঙালি মুসলমান সমাজে এই সব অনুভবের প্রবলতা সে-সময় পর্যন্ত ছিল অভূতপূর্ব। ফলে তিনি এই ধরনের একটি সংকলনের গুরুত্ব গভীর ভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন। এও অনুভব করতে পেরেছিলেন যে এর জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিটির নাম আনিসুজ্জামান।
বলাবহুল্য আনিসুজ্জামান অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে এই চেতনার বাস্তবায়ন ঘটাতে পেরেছিলেন। প্রয়োজনীয় বিষয়াবলির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গকে অর্থাৎ লেখকদেরকে জড়ো করতে পেরেছিলেন। নারীবাদ তখনও বাংলাদেশে তো নয়ই উন্নত বিশ্বেও যথেষ্ট স্পষ্টতা পায় নি, কিন্তু এই সংকলনে নীলিমা ইব্রাহীমের লেখা এই দৃষ্টিভঙ্গির রচনা স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব-বাংলায় সম্ভবত এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত সন্তোষ গুপ্তের লেখাটিই প্রথম। বাম রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রবিচার চললেও পূর্ববাংলায় তার ঢেউ লাগে নি। রণেশ দাশগুপ্তের লেখাটিই সম্ভবত পথিকৃৎ স্থানীয়। আনিসুজ্জামান যে সে-সময়ে এইসব দিকেও তাঁর দৃষ্টি রাখতে পেরেছেন সেটাকে কৃতিত্ব দিতে হবে। তবে এই বইয়ের রবীন্দ্রবিচারের সারকথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে এখানে কেবল মুগ্ধদৃষ্টিতেই দেখা হয়েছে। এমনকী রবীন্দ্রনাথের নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে কটাক্ষ করে পরবর্তী কালে যিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন সেই আহমদ শরীফকেও এখানে প্রকাশ করতে দেখা গেছে মুগ্ধতা। ষাটের দশকেই, ১৯৬৫ সালে, যখন রাজনৈতিক মতলবে রবীন্দ্রবর্জনের প্রয়াস চলছে সে-সময়ও রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যিক কারণে মুক্তদৃষ্টিতে বিচার করে দেখার প্রয়াস চলছে। স্বসম্পাদিত কণ্ঠস্বর পত্রিকায় প্রকাশিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রবন্ধদুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ’-এর কথা উল্লেখ করা যায়। আনিসুজ্জামানের এই সংকলনে এই ধরনের কোনও বিবেচনা প্রধানত রাজনৈতিক কারণেই স্থান পায় নি।
বাঙালি মুসলমান সমাজের ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির যে উত্থান ঘটছিল এর প্রতিভূ বলেও এই সংকলন ছিল এই সমাজের সামনে পথিকৃৎ দৃষ্টান্ত। বলা চলে বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার সামগ্রিক অভিমুখও নির্ধারণ করে দিয়েছিল এই সংকলনটি। রবীন্দ্রবিচারের এই ধারাই এখনও বহাল আছে বললে অত্যুক্তি হবে না হয়তো। এমন কিছু প্রসঙ্গ এখানে আলোচিত হয়েছিল যা বাংলাদেশের সমালোচনাসাহিত্যে ছিল অদৃশ্যপূর্ব
১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে আর অবরুদ্ধ রইলেন না। এখন রবীন্দ্রবিচার মুক্তদৃষ্টিতে হওয়া কঠিন হবার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথকে আরও অনেকটা মুক্ত চোখে দেখা প্রয়োজন ভবিষ্যতেরই স্বার্থে। কিন্তু রবীন্দ্রচর্চার সেই প্রেরণা আনিসুজ্জামানের মধ্যে দেখা যায় নি বা অন্য কাউকে এই চেতনায় উজ্জীবিত হতে তেমন দেখা যায় নি। আশির দশকে আহমদ শরীফ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সমালোচনা করলেও বিচারশক্তির উজ্জ্বলতার চেয়ে তা ছিল একপেশে বিরোধপূর্ণ দৃষ্টি। অনেক সংগত প্রশ্ন থাকলেও যথার্থ মুক্তদৃষ্টির সমালোচনাও তাকে বলা যাবে না।
রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্বকে আবিষ্কার করতে গেলে তাঁর সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করা যাবে না এমন কোনও কথা নেই। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের যে যুগের সন্তান সে-যুগচেতনার অনেক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হলেও অনেক কিছু রয়ে গেছে অনতিক্রমণীয়। সেইসব অনতিক্রমণীয়তাকে শনাক্ত করা নতুন প্রজন্মের অগ্রযাত্রার স্বার্থেই রবীন্দ্রনাথের মতো মহৎ প্রতিভাকে মুক্তদৃষ্টিতে বিচার করা জরুরি। রবীন্দ্রনাথের শক্তি এবং দুর্বলতা উভয় নিয়েই গবেষণা করতে হবে আমাদের জাতীয় উৎকর্ষের স্বার্থে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং শ্রেণীগত অবস্থানের কারণে রবীন্দ্রনাথ অনেক পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। প্রতিভার বিরাটত্ব যেমন ছিল তেমনি সংকীর্ণতাও তো কম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ মহৎ মানুষ ছিলেন বলেই এই সীমাবদ্ধতাগুলোকেও খুঁজে দেখতে হবে আমাদের। লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে কাজে এগিয়েও এসেছেন। কিন্তু তা মূল সুর হয়ে ওঠে নি। যদি তা করা সম্ভব হয় তাহলে একদা সেটাই হয়ে উঠবে নতুন প্রজন্মের যাত্রাপথের দিশা। এইজন্যেই মুক্তদৃষ্টিতে রবীন্দ্রবিচার আবশ্যক। পাকিস্তান আমলে অনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ-এর মতোই সফল আর একটি মুক্তদৃষ্টির রবীন্দ্র বিবেচনার সংকলন প্রকাশ করে নিশ্চয়ই কেউ একজন রবীন্দ্রবিচারের নতুন ধারা শুরু করবেন আশা আমরা করতেই পারি।
সূত্র
. যে ১৯ জন বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তাঁরা হলেন: . আহমদ শরীফ, . নীলিমা ইব্রাহীম, . রফিকুল ইসলাম, . আনিসুজ্জামান, . শহীদুল্লা কায়সার, . ফজল শাহাবুদ্দিন, . জয়নুল আবেদিন, . কাজী মোতাহার হোসেন, . মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ১০. খান র্সাওয়ার মুরশিদ, ১১. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ১২. মালিক অবদুল মজিদ [স্বাক্ষর অস্পষ্ট বলে এই নামটি সঠিক নাও হতে পারে], ১৩. সুফিয়া কামাল, ১৪. মুহম্মদ কুদরাত খুদা, ১৫. মুনীর চৌধুরী, ১৬. হাসান হাফিজুর রহমান, ১৭. সিকান্দার আবু জাফর, ১৮. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ১৯. শামসুর রাহমান
. প্রাগুক্ত, পরিশিষ্ট
আগস্ট ২০০৯, ২২ শ্রাবণ ১৪১৬

মূল লেখাটির লিংক-

No comments:

Post a Comment