Thursday, September 16, 2010

রবীন্দ্র-প্রাসঙ্গিকতা

আহমদ রফিক 
তারিখ: ০৬-০৮-২০১০

কেমন আছেন রবীন্দ্রনাথ ১৫০ বছর বয়সে এই বাংলাদেশে? কেমন চলছে পাঠকের সঙ্গে তাঁর কবিতা বা ছোটগল্পের ভাববিনিময়? বছর কয় আগে তরুণদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, তাঁর কবিতা গল্পের সমঝদার পাঠক এখনো আছে। মঞ্চে তাঁর নাটক দর্শক-শ্রোতার চিত্তগ্রাহী। তাঁর গানেরসন্ধ্যায়শ্রোতাসাধারণের উপচে পড়া ভিড়। তাঁর আঁকা ছবি দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ অনেক শিল্পভোক্তার। তবু দেখছি সমালোচনা তাঁর পিছু ছাড়ছে না, যেমন ছাড়েনি তাঁর জীবদ্দশায় এবং পরেও।
সংস্কারের সংকীর্ণতার অচলায়তন ভেঙে পড়ার ভয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বহুত্ হুজ্জত করেছিলেন রক্ষণশীল সমাজপতিদের প্রতিনিধিরা। বিপিনচন্দ্র পালের মতো ব্যক্তিরও সহ্য হয়নি নারী স্বাধিকারের পক্ষে লেখাস্ত্রীর পত্র সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সজনীকান্ত দাস সদা ব্যস্ত থাকতেন রবীন্দ্রবিরোধিতা নিয়ে। শেষোক্ত জন অবশ্য পরে প্রায়শ্চিত্ত করেন রবীন্দ্রনাথ: জীবন সাহিত্য লিখে। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন শিলাইদহে মৃণালিনী দেবীর হাতের রান্না পদ্মার টাটকা, সুস্বাদু ইলিশ-ঝোল-খাওয়া কবি-নাট্যকার ডি এল রায়। অহমবোধে অন্ধ শ্রীরায়ের রবীন্দ্র-বিরোধিতা শালীনতার সব সীমা অতিক্রম করেছিল।
এসবের পেছনে ছিল ব্যক্তিগত অপছন্দ, নান্দনিক ঈর্ষা আর সামাজিক রক্ষণশীলতার মতো বিষয়াদি। তবে বুদ্ধদেব বসু বা বিষ্ণু দের মতো কবির প্রাথমিক রবীন্দ্র-বিরোধিতা ছিল সাহিত্যের আধুনিকতার টানে। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন ভাষা শৈলীর নয়া নির্মাণে, চলতি ভাষার স্বচ্ছন্দ গতিময়তায় তেমনই শব্দের ব্যবহারেযেমন কবিতায়, ছড়ায়, কাব্যধর্মী উপন্যাস শেষের কবিতায়, কয়েকটি অসাধারণ ছোটগল্পে, তেমনি নির্ভার গদ্যের প্রবন্ধগ্রন্থে (যেমন বিশ্বপরিচয়) তাঁর জীবনস্মৃতি ছেলেবেলার ভাষাশৈলীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন ইয়েটস।
তাঁর শেষ দশকের কবিতায় বিষয়, ভাষা আঙ্গিকের বাঁকফেরা, সহজসারল্যে গভীর ভাবের প্রকাশ নিয়ে পুনশ্চ, প্রান্তিক হয়ে শেষ লেখায় অন্য রবীন্দ্রনাথ, আধুনিকতর রবীন্দ্রনাথঅনস্বীকার্য যে বলাকাপর্বে এর সূচনাঝড়ের খেয়াথেকেচঞ্চলাহয়ে চলতি ভাষার স্বচ্ছন্দ ব্যবহারে। আধুনিকতার বেশ কিছু লক্ষণ বাঁকফেরা রবীন্দ্রনাথে স্পষ্টই দেখা যায় বলে সমালোচকদের অভিমত। আর পূর্বোক্ত দুই আধুনিক কবি, যে কারণে হোক পরে রবীন্দ্রানুরাগী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। স্মর্তব্য, বিষ্ণু দের কাব্যগ্রন্থ তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ অনুরূপ কবিতা গদ্য রচনা।
তাঁর মৃত্যুর পরও রবীন্দ্র-বিরোধিতা বন্ধ হয়নি, বরং তা ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়। হঠকারী বাম রাজনীতির উগ্র আঁচে সিদ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ (১৯৪৮) এর মূলে বাম রাজনৈতিক নেতা ভবানী সেন সংস্কৃতি অঙ্গনের জনা কয় ধীমানএঁদের বিপরীতে ছিলেন ওপারের বিষ্ণু দে থেকে এদিকে অজিত গুহ। পক্ষ-বিপক্ষ দুই দলের অধিকাংশই প্রগতি লেখকগোষ্ঠীর সদস্য বা সহযাত্রী। কয়েক বছরের মধ্যেই দলের নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এঁদেরও পার্শ্ব-পরিবর্তন। ভবানী সেনের রবীন্দ্র-প্রশস্তিমূলক রচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার ভুল বিবেচনার অবসান। এদিকে মুনীর চৌধুরীকেও দেখা গেল রবীন্দ্রানুরাগী রূপে।
এরপর স্নায়ুকাঁপানো সেই স্লোগান: ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক আবার রবীন্দ্রনাথের ওপর হামলা, বলা চলে এবার শিরশ্ছেদ। দীর্ঘকাল পার হয়ে গেলেও এরা অবশ্য ওই অবস্থানেই, যদিও প্রাথমিক উগ্রতা আর নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনাপর্বে এদের অনুসারীদের হাতে নতুন করে রবীন্দ্র-বিরোধিতার হাওয়া ওঠেসমর্থকদের অধিকাংশই তরুণ, নতুন বাংলাদেশ গড়ার নতুন প্রত্যয় নিয়ে উদ্দীপ্ত।
সাপ্তাহিক বিচিত্রায় উসকে দেওয়া ওই বিতর্কের মূল কথা ছিল: নতুন বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ কি প্রাসঙ্গিক? হলোই বা তাঁর কবিতা-গান আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের উদ্দীপক সঙ্গী। বাংলাদেশের নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রয়োজনীয়? প্রায় একই ধরনের প্রশ্ন, অবশ্য সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ যুক্ত করে একদা নকশালপন্থী রণবীর সমাদ্দার (কলকাতা) তুলেছিলেন অনেকটা নেতিবাচক ভঙ্গিতে। ব্যক্তিগত আলোচনায় তাঁর লেখায়।
বিচিত্রার আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের পক্ষে লেখেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, আসহাবুর রহমান প্রমুখ। ভিন্নমত হাসান হাফিজুর রহমানের: ‘নতুন সমাজের সমর্থক উপাদান রবীন্দ্রনাথে পাওয়া যাবে না। বর্তমান মানবযাত্রার গন্তব্যসীমা অবধি রবীন্দ্র-নায়কত্ব অক্ষুণ্ন থাকার কথা নয়।একই সময়ে উগ্র বাম ধারার সমর্থক তরুণের বক্তব্য: ‘আমাদের শ্রেণীসংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ মিত্রশক্তি নন।অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ শ্রেণীসংগ্রামী নন, যদিও বলশেভিক রাশিয়ার অবিশ্বাস্য সমাজ পরিবর্তন শিক্ষাবিপ্লবের গভীর সমর্থক।
বিষয়ে কারোরই বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে ওই বিতর্কের দীর্ঘ সময় (প্রায় চার দশক) পরেও বাংলাদেশে শ্রেণীসংগ্রাম দূরের কথা, জাতীয় বুর্জোয়ার সংগ্রামই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। আমাদের নিম্নবর্গীয় সমাজের দুস্থ সদস্যদের একাংশে দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা চলছে এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্র ঋণদান ব্যবস্থার মাধ্যমে, যা এখন বিশ্বে বহুল প্রশংসিত। কিন্তু ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে তেমন একটা হালে পানি পাচ্ছে না, যেমনটা পেয়েছিল কালিগ্রাম পরগনার গ্রামে গ্রামে রবীন্দ্রনাথের ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ সমবায় সংগঠনের মাধ্যমে। একই সঙ্গে গ্রামে ছোট ছোট কুটিরশিল্প স্থাপনের ওপরও জোর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং তা গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণের সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে।
ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ, সমবায় কুটিরশিল্পগ্রামীণ দারিদ্র্য দূর করার ক্ষেত্রে বিষয় তিনটির গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথ প্রায় শতবর্ষ আগে যেভাবে বুঝেছিলেন, আশ্চর্য যে এতকাল পর আমাদের সেভাবেই বুঝতে হচ্ছে। প্রসঙ্গত বলি, এই সেদিন বেসরকারি দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি টিভি অনুষ্ঠানে শোনা গেলজাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব করণীয়সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনার পূর্বোক্ত তিনটি সূত্রেরই বিশদ আলোচনা। অবাক হয়েছি এবং রবীন্দ্রবিরোধী তরুণের প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি এই মর্মে যে আমাদের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এতকাল আগের রবীন্দ্রভাবনা এখনো অর্থবহ প্রাসঙ্গিক। অবশ্য ওই আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের নামও উচ্চারিত হয়নি, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ অর্থনৈতিক ভাবনার সঙ্গে বক্তাদের পরিচয় না থাকার কারণে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজে, বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষকশ্রেণীতে রবীন্দ্রনাথের কর্মাদর্শ কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতাই আমরা স্মরণ করতে পারি। শিলাইদহ-পতিসরে গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেন যে মুসলমান কৃষকশ্রেণী স্বেচ্ছায় তাঁর প্রস্তাবিত কাজকর্মে অংশ নিতে এগিয়ে আসছে তুলনামূলকভাবে অধিক আগ্রহে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘যারা মুসলমান তাদের মধ্যে বেশ কাজ অগ্রসর হচ্ছে, হিন্দুপল্লীতে বাধার অন্ত নেই। এই সমস্ত প্রত্যক্ষ করে হিন্দুসমাজ সম্বন্ধেআইডিয়ালাইজকরে কোনো শ্রুতিমধুর মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিতে আর আমার ইচ্ছাই হয় না। জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শিলাইদহ থেকে মুসলমান-প্রধান বালিগ্রাম পরগনায় (সদর পতিসরে) স্থানান্তরিত করেছিলেন। এবং তাঁর স্বপ্ন সেখানে অনেক পরিমাণে সফলও হয়েছিল।
তাই রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা বাংলাদেশের মুসলমান জনমানসে পৌঁছাতে পারবে না কেবল ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে, এমন ধারণার পেছনে যুক্তি নেই বরং এটাই সত্য যে জনকল্যাণ জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত যেকোনো পরিকল্পনা সাধারণ মানুষ আগ্রহের সঙ্গেই গ্রহণ করে থাকে এবং সে ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনার সুবাদে গ্রামীণ জনমানসের সঙ্গে রবীন্দ্রভাবনার সেতুবন্ধনও ঘটতে পারে।

দুই
এবার রাজনীতির স্বদেশি বৈশ্বিক প্রসঙ্গ। আমাদের বর্তমান রাজনীতি পরাশক্তির বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত। এর ফল যে শুভ হয়নি, তা সবাই মানেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, বিশ্বপরিসরে তাঁর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা, বিশ্বশান্তির পক্ষে বলিষ্ঠ ঘোষণা (স্মর্তব্য রঁলা-বার্বুস প্রেরিতক্লার্তঘোষণাপত্রে তাঁর স্বাক্ষর), ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ বাসভূমিতে ন্যায়সংগত পুনর্বাসনের পক্ষে সমর্থন জ্ঞাপন, এশিয়া-আফ্রিকায় পাশ্চাত্যশক্তির অন্যায় আগ্রাসনের বিরোধিতা, আত্ম-উন্নয়নে এশীয় দেশগুলোর ঐক্য ইত্যাদি বহু আন্তর্জাতিক বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ছিল বলিষ্ঠ, সদর্থক ভূমিকা। সেসব বিষয় কালেরও সমস্যা বিধায় রবীন্দ্রভূমিকা আমাদের জন্য পথনির্দেশকও বটে।
আমরা জানি, রবীন্দ্রচেতনার সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ দিক সর্বজনীন মানবিক বোধযেকোনো প্রকার অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে যা প্রতিবাদী ভূমিকা নিতে সক্ষম। এই সদর্থক মানবতাবাদ ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীনির্বিশেষে অত্যাচারিত যেকোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়িয়েছেচীন, স্পেন, আফ্রিকান দেশ তার প্রমাণ। এই চেতনাই রবীন্দ্রনাথকে সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্দীপনা জুগিয়েছে, যেমন জুগিয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা সর্বপ্রকার মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে। অন্যদিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের অগণতান্ত্রিক আচরণের সমালোচনা সম্ভব করে তুলেছে।
মানবিক চেতনাঋদ্ধ বা সত্যনিষ্ঠ আচরণের জন্য দেশে-বিদেশে আত্মপরায়ণ লেখক-বুদ্ধিজীবীর সমালোচনার শিকার রবীন্দ্রনাথ। একটি বিদেশি উদাহরণ। লন্ডনে প্রকাশিত (১৯৯৫) রবীন্দ্রবিষয়ক একটি ঢাউস বইতে অ্যান্ড্রু রবিনসনের অভিযোগ, রবীন্দ্রনাথ অযৌক্তিকভাবে পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ইংরেজ বেনিয়াবৃত্তির সমালোচনা করেছেন। তাঁর রুশপ্রীতি চীনপ্রীতিরাজনৈতিক বিভ্রান্তিছাড়া কিছু নয়। বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি নেই। সম্পর্কে বিশদ আলোচনার স্থানাভাব।
বর্তমান বিশ্বে পরাশক্তির অধীনে মতাদর্শগত বিকিকিনির ব্যাপকতায় সত্যনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কমে আসছে। সুবিধাবাদ আপসবাদের বাড়বাড়ন্ত। আদর্শবাদী তাই নন্দিত নন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিন্দিত বা সমালোচিত পরাশক্তির দরবারি কলমে। যেমন একদা নিন্দিত রবীন্দ্রনাথ, রাসেল, রঁলা, তেমনি সার্ত্র, চমস্কি বা এডোয়ার্ড সাঈদ।

তিন
বর্তমান বাংলার নাগরিক সমাজে যে বিনষ্ট মূল্যবোধের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাধান্য, সেখানে ভোগবাদী সমাজের লোভ অর্থাত্ ক্ষমতার লোভ, বিত্তের লোভের প্রাধান্য, পরিণামে ব্যাপক দুর্নীতি। এসব দূষিত করছে সংস্কৃতি-অঙ্গনকেও। এমনকি এর প্রসার তৃণমূল স্তরে। অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় সমাজ পরিবর্তন। সে জন্য দরকার একটি রেনেসাঁসের, যা আমরা পাইনি। কিন্তু বায়ান্ন থেকে চুয়ান্ন, ঊনসত্তর থেকে একাত্তরের অল্প সময়ে তেমন সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে শেষ হয়ে গেছে। বায়ান্ন থেকে চুয়ান্নতে পৌঁছে একুশ দফার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের সম্ভাবনা পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের হামলায় শেষ হয়ে গেছে।
ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় স্বাধীন ভূখণ্ড চেয়েছি। সেই বাঙালিয়ানার জোয়ারে ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটেছে ভাষা-সংস্কৃতি ঘিরে। তখন ব্যক্তিজীবনে, সমাজজীবনে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সঙ্গীযেমন কবিতায়, গানে, সংস্কৃতিচর্চায় তেমনি বাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান এমনকি সন্তানের নামকরণের মতো ছোটখাটো বিষয়েও রবীন্দ্রনাথ ছাড়া চলেনি।
রবীন্দ্রনাথ যে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশ (যেমনটা সবাই বক্তৃতায় বলে থাকেন) তার প্রমাণ মেলে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনাচরণে। ছোট একটি ঘটনা। যে সাপ্তাহিক বিচিত্রার হাত ধরে পূর্বোক্ত রবীন্দ্র-বিরোধিতার আয়োজন, সেই বিচিত্রা সম্পাদকের চোখে গুরুতর অস্ত্রোপচারের ঘটনা নিয়ে পত্রিকার প্রচ্ছদ-কাহিনির স্লোগান ছিল, বোধহয় অসচেতনভাবে রবীন্দ্রসংগীতের পঙিক্ত ধার করে: ‘অন্ধজনে দেহ আলো।কী চমত্কার প্যারাডক্স! এমন সব ছোটখাটো ঘটনাও প্রমাণ করে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে রবীন্দ্রনাথের অনিবার্য উপস্থিতি।
তাই ব্যক্তিবিশেষ যদি রবীন্দ্রনাথের কবিতা অপছন্দ করে না- পড়েন, ক্ষতি কী? বরং পাল্টা প্রশ্ন করা যায়: কয়টা অতি-আধুনিক কবিতা বা তরুণের লেখা কবিতা প্রতিদিন পড়ি? অনেকেই পড়েন না। কারণটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক। পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজের আদলে গড়া আমাদের অনাচারী সমাজে ঐতিহ্যবাহী সুস্থ মূল্যবোধসম্পন্ন সংস্কৃতির চর্চা সংকুচিত হয়ে আসছে। আসছে মূলত ব্যান্ড-বাদ্যের কোলাহলে আর হিন্দি সিরিয়ালের উদ্ভটাচারের কারণে।
আগেও বলেছি, অবস্থার মুক্তি ঘটাতে পারে একটি সামাজিক রেনেসাঁস, যা সময়সাপেক্ষ বিষয়। সে সম্ভাবনা তৈরি করার জন্য তাত্ক্ষণিক প্রয়োজন সংস্কৃতি অঙ্গনে একজনবাঁশিওয়ালা, যে অনায়াস-বিশ্বাসে বলতে পারবেআমি মানুষ, আর মানবিক সত্যই বড় সত্য। আমি ব্রাত্য আমি পংক্তিহারা, তাই পৌঁছাতে পারি সাধারণ মানুষের দরজায়।যে পারবেভেদচিহ্নের-তিলক-পরা সঙ্কীর্ণতার ঔদ্ধত্যথেকে মুক্তি দিতে, যার ডাকেঅন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে ঘোমটা-খসা নারী।
মনে পড়ছে, চুয়ান্নতে একুশ দফার বিজয় উদ্যাপনে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে লায়লা সামাদ নারী স্বাধিকারের আহ্বান জানান উচ্চকণ্ঠে এমনই উচ্চারণে: ‘ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এস নারী।ঘটনাটি কাকতালীয় মনে হলেও তখন সামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা সামনে রেখেই ছিল ওই আহ্বান। পরিবেশ ছিল অনুকূল; রবীন্দ্রনাথ তাঁর নানা কথায় তখন সে সম্ভাবনার পক্ষে আমাদের সঙ্গী এবং একই ভাবে এখনো। তবে রাজনৈতিক টানাপোড়েনে সেসব সম্ভাবনা বাস্তবে ধরা দেয়নি।
বঙ্গীয় রেনেসাঁসের সর্বোত্তম উত্তরপুরুষ রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রতিভা সংস্কৃতির নানা শাখা ফলপ্রসূ করে তুলেছিল, যার অনেক কিছুই কালান্তরে পৌঁছে আমাদের যাত্রাপথে, আমাদের ভাবনায় সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। এভাবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য এখনো হতে পারেন প্রাসঙ্গিক। তার মানে এই নয় যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গল্প সবার কাছে ভালো লাগবে। আসলে তাঁর কবিতা বা গল্প বা নাটকের মূল্যায়ন সাহিত্যবিচারের মানদণ্ডে তেমন বিচারে উত্কর্ষের সীমা স্পর্শ করে, কখনো সীমা অতিক্রম করে, তেমন কবিতা বা গল্পের সংখ্যা নেহাত কম নয়। নাটক সম্বন্ধেও একই কথা খাটে। সব দিক বিচারে মনে হয় একুশ শতকের বাংলায় রবীন্দ্রনাথের অবস্থান ভিত্তিহীন নয়।
ভাষা সম্বন্ধে একটু কিছু বলে শেষ করি। রবীন্দ্রনাথ যে ভাষায় লিখতেন, তাঁর মৃত্যুর প্রায় সত্তর বছর পর আমরা কি একই ভাষায় লিখব? ভাষা বহতা নদী। বাঁক ফিরে ফিরে সময়ের ধারায় তার ভিন্ন থেকে ভিন্নতর রূপ। সেখানে মূল স্রোতের উত্স ঠিকই সচল থাকে নবরূপায়ণের সহায়তায়। শেক্সপিয়ারের ইংরেজি ভাষা আধুনিক শৈলীর সাহিত্যভাষা থেকে অনেক পৃথক। তা সত্ত্বেও সাহিত্যরসিক ঠিকই আধুনিক মন নিয়েও শেক্সপিয়ার পড়েন। তাঁর অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক কাব্যনাট্য কালের সাহিত্যিক মননে নতুন করে ভাবনার রসদ জোগায়। এখানেই কালজয়ী রচনার মহত্ত্ব। রবীন্দ্রনাথও তথৈবচ।

No comments:

Post a Comment