Thursday, September 16, 2010

রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথের মানস বিবর্তনের স্বরূপ


সৈয়দ তোশারফ আলী



ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে দৃঢ়মূল করতে মুসলিম সমাজের ওপর দিয়ে যেমন একটা ঝড় বয়ে যায় তেমনি হিন্দু সমাজের ওপর দিয়েও নানাভাবে প্লাবন বয়ে গেছে। খ্রিস্টান পাদরিদের নিন্দা, ব্রাহ্মদের সংস্কার এবং হিন্দু কলেজের বিরোধিতা- এই ত্রিমুখী আক্রমণে হিন্দুসমাজ বিপন্ন বোধ করতে থাকে। এসবের মধ্যে হিন্দু কলেজের আক্রমণটা ছিল মারাত্মক। এই বৃহত্তর হিন্দু সমাজ আক্রমণকারীদের ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ হিসেবে গণ্য করে। এই পর্বে রাজনারায়ণ বসুর ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ববিষয়ক প্রস্তাব’, শশধর তর্কচূড়ামণির হিন্দু ধর্মের চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্বজনবাৎসল্য হিন্দু রক্ষণশীলতাকে শক্তি যুগিয়েছিল। পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রতিভার আলোকরশ্মিতে তা আরো ঔজ্জ্বল্য লাভ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মনীষী ভূদেব মুখোপাধ্যায় ধর্মাদর্শে ও সাধনায় ব্রাহ্মণ হলেও ভারতীয় সভ্যতায় ইসলামের অবদানকে গভীর আনন্দে স্বীকার করেছিলেন। তিনি অন্যতম হিন্দু লেখক, যার সাহিত্যের প্রধান চরিত্র ছিল মুসলিম। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। ভারতের ইতিহাসকে ঔপনিবেশিক শাসকরা সম্প্রীতির পথে অগ্রসর হতে দেয়নি। তবে যারা দু’টি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার চেষ্টা করেছিলেন তাদের ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য।

উনিশ শতকের নবজাগরণ ত্রি-ধারায় বিভক্ত ছিলো বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। প্রথম ধারার সূচনা করেন রামমোহন রায় তার ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধারাটির সূত্রপাত ঘটান হিন্দু কলেজের কিছুসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক। হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও এই ধারার নেতৃত্ব দেন। আর তৃতীয় ধারাকে বলা যায় নব্য হিন্দুত্বের ধারা; বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ এই ধারায় নেতৃত্ব দেন। তিনটি ধারাতেই অনেক বড় মাপের কর্মী-পুরুষ তৈরি হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রমানসের স্বরূপ বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে রামমোহন রায়কে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। কারণ, রামমোহন রায়ের সুযোগ্য উত্তরসাধক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলায় রেনেসাঁর সূচনা করেন রামমোহন এবং সমাপ্তি টানেন রবীন্দ্রনাথ।

রামমোহন রায় (১৭৭২/৭৪-১৮৩৩) ভারতীয় সমাজে আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটানোর কাজে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। ধর্মীয় পরিভাষায় যাকে অবতার কিংবা পরমপুরুষ বলা হয় তিনি তা ছিলেন না। তবে তিনি যে একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আধুনিকতার ঊষালগ্নে চলমান পথিকদলের তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষ। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল যুগের কল্যাণ বাণী। উপরন্ত তিনিই শুনতে সক্ষম হয়েছিলেন কালের ধ্বনি। তাঁকে কেন্দ্র করে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের কাছাকাছি সময়ে কলকাতায় একটি সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল।।বাংলার আধুনিক ইতিহাসে যাঁদের কীর্তি অসামান্য।

জ্ঞানের অন্বেষণকেই তিনি মুক্তির পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাই তিনি সম্ভাব্য সকল উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর পিতা রামকান্ত রায় মাত্র নয় বছর বয়সে তাঁকে পাটনা পাঠিয়েছিলেন আরবি-ফারসি শিখতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ভারত শাসন করলেও ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের কোর্ট-কাচারি ও সরকারি দপ্তরের ভাষা ছিল ফারসি। তাই ধর্মীয় প্রয়োজনে নয়, বৈষয়িক প্রয়োজনেই যে রামমোহনকে আরবি-ফারসি ভাষা শিখতে পাটনা পাঠানো হয়েছিল এমন ধারণাই সঠিক এবং স্বাভাবিক। তবে মুসলমানদের সঙ্গে আগে থাকতেই তাঁদের পরিবারের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তাঁর ঠাকুরদা ব্রজবিনোদ রায় নবাব আলিবর্দি খার অধীনে চাকরি করতেন। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম পূর্ব-ভারতে এলে ব্রজবিনোদ তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিলেন। আর দিল্লীর বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তদুপরি তাঁর ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব ও বিষয়বুদ্ধি দেখে তাঁকে তিনি তার দৌত্যকর্মে নিযুক্ত করেছিলেন।

রামমোহন আরবি ভাষায় এরিস্টটলের তর্কশাস্ত্র, ইউক্লিডের জ্যামিতির সূত্র, গ্রীক দর্শন ও বিজ্ঞানের সঙ্গে পবিত্র কোরআন, হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী, ফারসিতে সুফিদের মরমি সাহিত্য, মোতাজেলা দর্শন ইত্যাদি পড়েছিলেন বলে জানা যায়। তাছাড়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করার সময় বিচার ও রাজস্ব বিভাগের মুসলিম কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও তিনি ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম আইন-বিজ্ঞানের ওপর পরিচ্ছন্ন ধারণা লাভ করেছিলেন। এ কারণে হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে লালিত হলেও তার সবকিছুকে অন্ধভাবে মেনে নেয়া এই সত্য সন্ধানীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। জ্ঞানের আলো তাঁর চিন্তার কুয়াশা দূর করে দিয়েছিল। তাই তিনি বাঙালির পরম প্রিয় প্রতিমা পূজা ও বহু ঈশ্বরে প্রত্যয় পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে বেদ ও উপনিষদের মধ্যে তিনি একেশ্বরবাদের সমর্থন খুঁজে পান। ফলে সাধারণের মধ্যে উপনিষদের শিক্ষাকে তুলে ধরার জন্য তিনি উপনিষদের অনুবাদ করেন। আধুনিক মন-মানসিকতা নিয়ে তিনি তাঁর বিশ্বাসের সমর্থন খোঁজার জন্য বেদ-উপনিষদ, বাইবেল, কোরআন অধ্যয়ন করেন । তাঁর দৃষ্টি ছিল সামনের দিকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ব্রহ্মবাদী ঋষির উত্তরসাধক। অন্যদিকে ফারসিতে লেখা তার ‘তুহফাত-উল-মুয়াহেদ্দিন’-কে মুসলিম ভাবুকদের কেউ কেউ একটি দার্শনিক সনদ তথা উনিশ শতকের ঐশী পরমতত্ত্বের ইশতেহার বলতে দ্বিধা করেননি। ধর্মের আলোকোজ্জ্বল দিক যেমন যুগে যুগে মানুষকে পরম নিয়ন্তার বিধান মানতে অনুপ্রাণিত করেছে ঠিক তেমনি এর মানববিদ্বেষী রূপ দেখেও মানুষ কম ধর্মবিরোধী হয়নি। রামমোহন রায় ভারতের একেশ্বরবাদীদের অন্ধকার থেকে আলোয় আনতে চেয়েছিলেন, হিংসা-বিদ্বেষের বদলে প্রেম ও প্রীতির বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয়, তিনি তা পারেননি। তাঁর আহ্বানে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ তেমন সাড়া দেয়নি। কারণ, সংস্কার দুর্মর এবং সত্য কঠিন। কঠিনকে সবাই ভালবাসতে পারে না। যে পারে সে মহান। রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) কঠিনকে ভালবেসেছিলেন বলেই রামমোহনের সত্যিকার প্রতিভূ, সার্থক উত্তরসাধক হতে পেরেছেন।

রামমোহনের চিত্ত ছিল হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান তথা সকল ধর্মীয় চিন্তাস্রোতের সঙ্গমস্থল। সবার পরশে পবিত্র করা সেই তীর্থ-নীরে ভারতীয় উপমহাদেশের যারা স্নান হয়ে শক্তি ও সৌন্দর্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, তারা যে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।। একথা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়।

আল-বেরুনী বেদকে বলেছেন অজ্ঞাতের জ্ঞান। সেই বেদ অধ্যয়ন করে রামমোহন বলেছেন: “বেদের ধর্মতত্ত্ববিষয়ক অধ্যায়গুলোর সর্বত্র একসুরে একথাই বলা হয়েছে যে, মানুষ তার আপন স্বভাব ও অভ্যাস অনুযায়ী শ্রদ্ধার ও উপাসনার পাত্রগুলোকে সর্বদা মূর্তরূপ দিতে চায় এবং এইভাবে সে আরাধ্য বস্তুসমূহের ওপর এমন কতগুলো গুণারোপ করে, যা উক্ত বস্তু সম্পর্কে পোষিত ধারণার দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট বিবেচিত হবার দাবি রাখে। এই প্রক্রিয়াই মানুষকে স্থূল বা সূক্ষ্মাকারে পৌত্তলিক উপাসনার দিকে আকর্ষণ করে। এই জন্যই এই প্রমাণিক গ্রন্থগুলো (চতুর্বেদ) মানুষকে কোন কাল্পনিক দেবতা সৃষ্টির প্রবণতার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপদেশ দিয়েছে এবং মানুষকে আপন পারিপার্শ্বিকের অন্তর্গত বস্তুরাজিকে সমগ্রভাবে বা এককভাবে অনুশীলন করার অনুরোধ জানিয়েছে।” তিনি আরও বলেছেন, “এই বস্তুজগত মানবমনে আশ্চর্য ঐক্য, বিন্যাস, জ্ঞান ও শৃঙ্খলার ধারণাই মুদ্রিত করে দেয় না, বেদসমূহ সাধু ও নিরাসক্ত ব্যক্তির মনে এমন এক সর্বশ্রেষ্ঠ পরমেশ্বরের ধারণা জাগিয়ে তোলে যিনি বিশ্বব্রহ্মান্ডের ব্যবস্থাপক এবং শাসনকর্তা।।যিনি বিশ্বের সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ঠ হয়ে আছেন।” তিনি এটাও লক্ষ্য করেছেন যে, বেদগ্রন্থে বিভিন্ন গ্রহ, প্রাকৃতিক বস্তু, বিমূর্ত মনোগত চিন্তার কাল্পনিক রূপাবলি ও দেবরূপে পূজিত বীর পুরুষগণকে আশ্রয় করে গড়ে-ওঠা বাহ্য ক্রিয়াকলাপ ও অনুষ্ঠানাদির বিবরণেরও কোন অভাব নেই। এসবের ব্যবস্থা অবশ্য তাদের জন্য, যাদের বোধশক্তি ক্ষীণ। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর সন্দেহ নেই যে, সুখ এবং কল্যাণ লাভের অনন্য উপায়স্বরূপ বেদ আধ্যাত্মিক ঈশ্বরানুরাগ, জীবহিতৈষণা ও প্রবৃত্তি দমনের উপদেশ দিয়েছে।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, রামমোহনের ঈশ্বর বিশ্বের সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ঠ হয়ে আছেন। তাই সঙ্গত কারণেই বলা যায়, তার অনুভবে সর্বেশ্বরবাদের ছায়া পড়েছে। এই ভাবনার সঙ্গে ইসলামের তাওহিদ বা একেশ্বরবাদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এখানে সে দার্শনিক আলোচনায় আমি যাব না।

বেদ প্রসঙ্গে একথা উল্লেখ করা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বেদের চারটি বিভাগ রয়েছে- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা অর্থে মন্ত্র সংগ্রহকে বোঝানো হয়েছে। বেদের মন্ত্রসমূহ আবার চার ভাগে বিভক্ত ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব। প্রথমে পাঠ করার নিয়ম, বৈদিক মন্ত্র বা সংহিতা। তারপর ব্রাহ্মণ অংশের যাগযজ্ঞাদির বিবরণ ও ব্যাখ্যা। এরপর আরণ্যক অংশের যজ্ঞ সম্পর্কে রূপক কল্পনা ও প্রতীক উপাসনার আদেশ। সর্বশেষ পঠিত হয় উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্ব। দাবি করা হয়, এই উপনিষদেই বৈদিক চিন্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটেছে। উপনিষদ শব্দটির অর্থ গুরুর সমীপে উপবিষ্ট হয়ে শিষ্যের শাস্ত্রজ্ঞান লাভ।। যে জ্ঞান ব্রহ্ম সমীপে নিয়ে যায়। বেদান্ত দর্শনের সার কথা হচ্ছে- ব্রহ্ম। উপনিষদে ব্রহ্মকে আনন্দরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই ব্রহ্মতত্ত্বকে শিক্ষা দেয়ার জন্য কলকাতার অদূরে বোলপুরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তাঁর কবিতা ও গানে বার বার অসীম আনন্দের জয়গান করেছেন।

গৌতম বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রবীন্দ্রনাথ কিন্তু দুঃখ থেকে নির্বাণ লাভের জন্য তার প্রদর্শিত পথে পা বাড়াননি। নৈবেদ্য কাব্যের ‘মুক্তি’ কবিতায় তিনি ‘‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।। / অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়/লভিব মুক্তির স্বাদ!।”।। এই স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। তবে বন্ধনের মাঝে মহানন্দ উপভোগ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তার ঈশ্বরকে বিস্মৃত হননি। একই কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘ইন্দ্রিয়ের দ্বার/রুদ্ধ করি’ যোগাসন, সে নহে আমার।/ ‘যা কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে/তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’ ব্যক্তি জীবনে মৃত্যুশোকজর্জর এই মানুষটি আরও লিখেছেন, “জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ/ধন্য হোক, ধন্য হোক মানবজীবন” অথবা “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে” বা “বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা”- এই আনন্দ সম্পর্কিত ধারণা তিনি উপনিষদেই পেয়ে থাকবেন।

‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি’।। কথাটি রবীন্দ্রনাথের কবিতার নিছক একটি পঙক্তি নয়, এটাই ছিল তার জীবনের মহামন্ত্র। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জেনেছিলেন সত্যের যা-কিছু উপহার ‘মধুরসে ক্ষয় নাই তার’। তাঁর আরও মনে হয়েছে, সত্যের উপহার এতই মহার্ঘ যে তার কাছে সব ক্ষতি মিথ্যা, তুচ্ছ। অনন্ত সত্য আনন্দরূপেই তাঁর কাছে প্রতিভাত হয়েছে। দুর্যোগের আড়ালে তিনি দেখেছেন জ্যোর্তিময় নিত্যানন্দকে। সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে তাই তিনি ‘আরোগ্য’ কাব্যের ‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ কবিতায় উচ্চারণ করেছেন: সত্যের আনন্দরূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মূরতি/ এই জেনে এ ধূলায় রাখিনু প্রণতি।

রামমোহন যেমন সত্য সন্ধানী ছিলেন তেমনি ছিলেন মানব কল্যাণে সোচ্চার। ধর্মীয় সত্যকে তিনি সন্ধান করেছেন কোরআনে, পুরানে, বাইবেলে এবং মহাপুরুষদের জীবন ও বাণীর মধ্যে। লব্ধ সত্য প্রচার করতে গিয়ে তাঁকে তর্ক করতে হয়েছে প্রতিপক্ষ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন প্রমুখের সঙ্গে। খ্রিস্টান পাদরিদের বিশেষ করে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের সঙ্গেও তাঁকে বিতর্কে নামতে হয়েছিল। বিতর্ক করতে হয়েছিল মুসলমান মৌলভিদের সঙ্গে। এমনকি নিজ পরিবারের সঙ্গেও।

যুক্তিবাদী রামমোহন হিন্দু ধর্মের প্রতিমা পূজা ও বহুদেবতার ওপর শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মের উচ্চতর দার্শনিক সিদ্ধান্তের ওপর তাঁর আস্থা ছিল অটুট। তবে কাশীতে বেদান্ত পাঠ এবং তাঁর গুরু হরিহরানন্দনাথ তীর্থস্বামীর উপদেশ তাঁকে তান্ত্রিক সাধনার প্রতি কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল বলে জানা যায়।

রামমোহনের মতো দূরদর্শী ভাবুক ভারতবর্ষে খুব কম জন্মগ্রহণ করেছেন। দু’শো বছর আগে তিনি যা বলে গেছেন আজও তার প্রাসঙ্গিকতা নিঃশেষ হয়নি। আরবি-ফরাসি ভাষায় কোরআন পড়ে, সুফিদের মরমি সাহিত্য পড়ে কিশোর বয়সে তাঁর বোধের জমিনে একেশ্বরবাদের যে বীজ-অঙ্কুরিত হয়েছিল, সময়ের ধারায় তাকেই আমরা ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনে ফলবান বৃক্ষে পরিণত হতে দেখি। ষোল বছর বয়সে এই তরুণ উত্তর ভারত এবং তিব্বত ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করতে। তিনি সংস্কৃত শিখে প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন বারানসীতে। পাশ্চাত্যের উদারপন্থী চিন্তানায়কদের দ্বারাও তিনি যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।

ফারসি ভাষায় লেখা তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘তুহফাত-উল-মুয়াহেদ্দিন’, যেখানে তিনি বলেছিলেন: আমি পৃথিবীর দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করেছি। ভ্রমণ করেছি সমতল ভূমিতে, ভ্রমণ করেছি পর্বতময় প্রান্তরে। সর্বত্রই আমি দেখতে পেয়েছি মানুষ মাত্রেরই বিশ্বাস, একজন স্রষ্টা এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একে পরিচালনা করছেন। স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে একক কোন পারলৌকিক সত্তায় প্রত্যয়ী হওয়ার ব্যাপারটা যখন মানুষ মাত্রেরই সহজাত বৈশিষ্ট্য তখন তাকে বিশ্বাসের সঙ্কীর্ণ গণ্ডীতে বেঁধে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সঞ্চারিত করতে যাওয়ায় ধর্মে-ধর্মে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। অন্ধ বিশ্বাসের বদলে তিনি আত্মপোলব্ধির ওপর জোর দেন এবং বলেন, মানুষের রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য ও সংবেদনশীল শক্তি। তার উচিত কাজ হচ্ছে স্ব-গোত্রের ভ্রাতৃপ্রতিমদের দৃষ্টান্ত অনুকরণ না করে লব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে ঈশ্বরের মূল্যবান দান।। বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভাল-মন্দ বিচার করে দেখা। ধর্ম থেকে নীতি-নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতাকে পৃথক করে দেখার কোন সুযোগ নেই বলেই তার প্রতীতী জন্মেছিল। বেদ এবং উপনিষদ থেকে তিনি এই জ্ঞান লাভ করেন যে, নৈতিক গুণাবলি ঈশ্বরেরই বিভূতি। উপনিষদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘কোন পাপী মানুষের পক্ষেই আত্মা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়।’ তিনি বাইবেল অধ্যয়ন করে ঈশ্বর প্রেম এবং ভ্রাতৃপ্রেম সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন।। যা তাঁর মানস নির্মাণে বিরাট ভূমিকা রাখে।

রামমোহনের প্রতিভা হচ্ছে সমন্বয়ের প্রতিভা। হিন্দুধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের সর্বোত্তম শিক্ষাকে সমন্বিত করে তিনি ব্রাহ্ম সমাজ গড়ে তোলেন। একজন ধর্ম সংস্কারক হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বের সেরা ধর্মগুলোর মধ্যকার ব্যবধান ও তিক্ততা দূর করতে। ঈশ্বরকে পাবার পথ একটিতে সীমাবদ্ধ হতে পারে না।। এই ছিল তাঁর ধারণা। তাঁর মত মুক্তচিন্তার মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে খুব কম জন্ম নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ভারত পথিক’ বলে প্রণাম জানিয়েছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক (১৮৯০-১৯০০) এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক (১৯০০-১৯১০) ছিল সনাতন ধর্মের পুনরুজ্জীবন কাল। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম থেকে ব্রাহ্মণ হন। যদিও তিনি সে অবস্থানে অটল থাকেননি। তাই আবার তিনি ব্রাহ্মণ থেকে ব্রাহ্ম হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে আদি ব্রাহ্ম থেকে সাধারণ ব্রাহ্ম হতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়ে পৌত্তলিকতা ত্যাগ করেছিলেন বটে, কিন্তু হিন্দুত্ব ত্যাগ করেছিলেন এমন কথা তিনি নিজে কখনও বলেননি। অন্য কেউ বলেছেন বলেও শোনা যায়নি। তার পুত্র রবীন্দ্রনাথ তার নিজের ধর্মীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন : আমি হিন্দু সমাজে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ভুক্ত। আমার ধর্ম বিশ্বজনীনতা, আর সেটাই হিন্দুধর্ম।

বৈষ্ণব সাধনায় প্রেমময় ভগবানকে ভক্তিযোগে খোঁজা হয়, রবীন্দ্রনাথও অনেকটা সেভাবেই ঈশ্বরকে সন্ধান করেছেন। এ সন্ধানের ছাপ পড়েছে তার সৃজনশীলতায়। গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য এবং গীতালী।। এই কাব্যত্রয়ী রবীন্দ্রনাথের বৈষ্ণব ধারারই কাব্য। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় ‘সোনার তরী’ কাব্যের বৈষ্ণবকবিতার কিছু পঙক্তি: সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণবকবি,/ কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমছবি,/ কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান/ বিরহ তাপিত। হেরি কাহার নয়ান।

রবীন্দ্রনাথের এই জিজ্ঞাসা এবং কৌতূহল দেখে বোঝা যায় বৈষ্ণব কবিদের প্রতি তিনি কতটা মুগ্ধ ছিলেন। শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান ।।এ কথা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি বৈষ্ণব কবিতার প্রেম-প্রীতির মধ্যে চিরকালের যুবক-যুবতীদের অবগাহন করার মতো সুর-ছন্দ এবং মাধুর্য খুঁজে পেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের বাবা যেমন ছিলেন ঈশ্বরপ্রেমিক তেমনি ছিলেন হাফিজের অনুরাগী ও ভক্ত। হাফিজের এই লাইনটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল।।‘হরগিজম্ মোহরে তু আজ লওহে দিল্ ও জাঁ-ন রওদ’।। তোমার ছাপ আমার চিত্তফলক থেকে কিছুতেই মুছবে না। বাবার মুখে হাফিজের কবিতার আবৃত্তি ও অনুবাদ শোনার ভেতর দিয়ে পারস্যের হৃদয় যে রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল, একথা তিনি হাফিজের সমাধি পরিদর্শনকালে বলতে ভোলেননি। কবি হাফিজ ছাড়াও ইরানের সুফিদের প্রভাবও পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর। লালন ফকির, সিরাজ সাঁইয়ের মতো বাউল ধারার ‘গ্রামের কবি’দের প্রভাব পড়ার কথাতো তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। তবে পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে সংযোগ ও সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর তাঁর সৃষ্টিধারা নতুন পথে মোড় নেয়। ‘বলাকা’ কাব্যে আমরা তারই স্বাক্ষর দেখতে পাই।

বৈষ্ণব ধারার প্রেমের কবিতার প্রতি তাঁর যেমন গভীর অনুরাগ ছিল, ঠিক তেমনি পশ্চিমের মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণার প্রতিও তাঁর মুগ্ধতা কম ছিল না। মানবমন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ভারতীয় পুরাণের কিছু চিরন্তন চরিত্রকে নতুন রূপ দেয়া। মহাভারতের একাধিক চরিত্রকে আধুনিক কালের মুখপাত্র করে তোলা। প্রাচীন কাহিনী ও চরিত্র রবির আলোয় লাভ করেছে নতুন লাবণ্য ও তাৎপর্য। অর্জুন, চিত্রাঙ্গদা, কর্ণ, গান্ধারী, দেবযানী, দুর্যোধন- প্রত্যেকটি চরিত্র মহাভারতের অপভ্রংশ হয়ে না থেকে স্বাধীন ও স্বকীয় সত্তায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ এদের মনোলোকের এমন ছবি এঁকেছেন যা প্রাচীন কবিদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন ছিল। রবীন্দ্র প্রতিভার পরশ পেয়ে এরা আধুনিক মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছেন। এদের সংলাপ শুনলে স্পন্দিত হয় আধুনিক নর-নারীর মন। দুর্যোধনের জয়োল্লাস, গান্ধারীর পতিভর্ৎসনা, দেবযানীর প্রণয় সৌরভ।।অতীতের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে উনিশ শতকী মানবিকতার সঙ্গে এসে স্বচ্ছন্দে মিশে গেছে।

জোড়াসাঁকোতে থাকতে রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা যে রকম ছিল শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর তা কিন্তু ধীরে ধীরে বদলে গিয়েছিল। বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ছাত্রদের কাছে বক্তব্য তুলে ধরতে গিয়ে তার ধর্মীয় ভাবনায় পরিবর্তন এসেছিল। গৌতম বুদ্ধ, যীশু খ্রিস্ট, গুরু নানক প্রমুখ ধর্মগুরুর সম্মানে তিনি কবিতা ও গান রচনা ও পরিবেশন করেছেন। তাঁদের জীবন ও দর্শন সম্পর্কে আলোচনাও করেছেন। হযরত মোহাম্মদ (সা:)-এর জন্মদিনে শান্তি নিকেতনের মন্দিরের অনুষ্ঠানে ‘কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো’ গানটি গাওয়া হতো।। এই তথ্যের উল্লেখ দেখি অমিতাভ চৌধুরীর লেখায়। ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নয়া দিল্লীর জামে মসজিদ থেকে হযরত মোহাম্মদ (সা:)-এর জন্মদিন উপলক্ষে একটি প্রকাশনায় প্রেরিত শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি ‘যিনি বিশ্বের মহত্তমদের অন্যতম সেই পবিত্র পয়গম্বর’-এর উদ্দেশে তার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বলেছিলেন : ‘মানুষের ইতিহাসে এক নতুন, সম্ভাবনাময় জীবনীশক্তির সঞ্চার করেছিলেন পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ, এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ।’ এ থেকে বোঝা যায় ধর্মীয় চিন্তায় তিনি কতটা উদার ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ উদারতা তিনি পেয়েছিলেন পূর্বসূরী রামমোহনের কাছ থেকেই।

ইসলামের মূল তত্ত্ব, একেশ্বরবাদ, যুক্তিবাদ, সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক সাম্য রামমোহনকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে উচ্চারিত সত্যসমূহকে তিনি তাঁর জ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে যাচাই করে দেখেন। তর্ক-বিতর্ক করেন। নিজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিছক যুক্তি দিয়ে ধর্মের মর্ম উপলব্ধি করা কঠিন। কারণ, ধর্মের সঙ্গে যুক্তির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির সম্পর্ক অনেক নিবিড়। নিছক যুক্তিলব্ধ সত্য জীবন্ত বিশ্বাসের সেই অনির্বাণ শিখা জ্বালাতে পারে না, ব্যক্তিগত উপলব্ধিজাত সত্য যা জ্বালাতে পারে। এ কারণেই শুধু বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে মানুষকে খুব কমই প্রভাবিত করা সম্ভব হয়েছে। ধর্মীয় আবেগ ব্যক্তির এমনকি সমাজের চেহারা পর্যন্ত বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে, যা যুক্তিধর্মী আদর্শবাদ পারেনি। ইউরোপের সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে যুক্তিবাদ প্রাণবন্ত শক্তি হিসেবে কাজ করেনি। করলে গণতন্ত্রের ভেতরে অসহিষ্ণুতা, ঘাত-প্রতিঘাত, দুর্বল ও দরিদ্রদের লাগামহীন শোষণের সুযোগ সৃষ্টি হতো না। পক্ষান্তরে ঐশীবাণীভিত্তিক আদর্শ উদ্গত হয় অন্তরের গভীর প্রদেশ থেকে। এ জন্য দেখা যায় একজন সাধারণ মানুষও জীবনের আধ্যাত্মিক ভিত্তির ওপর দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে এবং সেই বিশ্বাস রক্ষার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান পার্থিব জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকে। এ সম্পর্কে কবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ছিল অনেক গভীর ও ধর্মীয় সত্যের কাছাকাছি। এ প্রসঙ্গে চিত্রা কাব্যের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার অসাধারণ এ পঙক্তিগুলো স্মরণীয়: “শুধু এইটুকু জানি, তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে/চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে/ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে/অন্তর প্রদীপখানি। শুধু জানি, যে শুনেছে কানে/ তাহার আহ্বানগীত, ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে/সংকট-আবর্ত মাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন, /নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি; মৃত্যুর গর্জন/শুনেছে সে সঙ্গীতের মতো।”

রামমোহন যুক্তির আলোকে যে একেশ্বরবাদকে উপস্থাপন করেছিলেন তা নবী-রাসুলদের আধ্যাত্মিক বাণীর মতো জীবন্ত বিশ্বাসের অনির্বাণ শিখা জ্বালাতে পারেনি। হয়তো এ কারণে ব্রাহ্ম সমাজ কাঙিক্ষত বিকাশ লাভ করেনি। পাশ্চাত্যের মতো যুক্তিবাদ যদি প্রাচ্যেও প্রভাব বিস্তার করতো তাহলে রামমোহন নিঃসন্দেহে অনেক বেশি গুরুত্ব পেতেন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের মতি-গতি সেদিকে নয়। দেশের মানুষকে অশিক্ষা ও অভাবের মধ্যে রেখে সে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হবার সাধনা করে যাচ্ছে। অন্যের অনুকরণ করতে গিয়ে এই সত্য ভুলে যাচ্ছে যে, প্রাকৃতিক ভূগোলে মাটি ও আবহাওয়া গুণে ফসলে যেমন পার্থক্য দেখা যায়, তেমনি মনের ভূগোলে বিশ্বাসের বৈচিত্র্যও কম প্রকটিত নয়!

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি হলেও অন্যান্য ধর্মের মানুষও একেবারে কম নয়। তবে ভারতে আগত ইহুদি, খ্রিস্টান এবং পারসিকদের হিন্দু সম্প্রদায় সাদরে গ্রহণ করলেও এবং মার্ক্সীয় মতে তাদের সকলের ‘হিন্দুত্বপ্রাপ্তি’ ঘটলেও মুসলিম বিজেতা এবং তাদের সঙ্গে আগত সহযোগীদের কিন্তু সেভাবে সাদরে বরণ করা হয়নি এবং তাদের হিন্দুত্ব প্রাপ্তিও ঘটেনি। মধ্য এশিয়ার তুর্কি বিজেতারা যে সংস্কৃতি বয়ে এনেছিলেন তার মধ্যে ছিল পারসিক এবং বাইজেন্টাইনি উত্তরাধিকার। বিজেতাদের চরিত্রগুণে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ঐ সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও রূপান্তর ঘটেছিল। আরবরা সিন্ধুদেশ জয় করলেও হিন্দুদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি এবং তারাও হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত হননি। উত্তর ভারতে তুর্কি বিজেতারা যে ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন তা ইসলামের মূল কাঠামোকে ঠিক রেখেই ‘ভারতীয় রূপ’ কিংবা জনপ্রিয় রূপ ধারণ করেছিল। এর ফলে ভারতীয় সভ্যতায় কিছু নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সমস্যা প্রতিফলিত হয় জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বে। মুসলিম বিজেতা এবং তাদের অনুগামীদের ‘হিন্দুত্বপ্রাপ্তি’ ঘটলে ভারত বিভক্তির কোন প্রয়োজন হতো না এবং ধর্মীয় সমস্যারও সহজ সমাধান মিলে যেতো। কিন্তু ইসলামের মধ্যে এমন সব উপাদান শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল যা রামমোহনের মতো প্রবল একেশ্বরবাদীকেও ‘তুহফাত-উল-মুয়াহেদ্দিন’ লিখে অভিযোগ তুলতে বাধ্য করেছিল। বিধর্মী, বিশেষ করে পৌত্তলিকদের সম্পর্কে কোরআনের নির্দেশ মুসলিম মানসে প্রভাব ফেলেছিল বলেই ভারতবর্ষের হিন্দু মানসে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। এ ব্যাপারে উদার রামমোহন রায়ও অনুযোগ তুলেছিলেন। প্রতিমা পুজারী বিধর্মীদের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি রামমোহনের কাছে মানবিক মনে হয়নি। বস্তুত সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে কোরআনের বাণী বা হযরতের শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এরকম ভুল হওয়া বিচিত্র নয়।

রামমোহনের মতো রবীন্দ্রনাথেরও সমন্বয়ধর্মী চিন্তা ও ঐক্যমুখিন ভাবনা চমৎকার অভিব্যক্তি লাভ করেছে গীতাঞ্জলির ‘ভারত তীর্থ’ কবিতায়। এই কবিতায় কবি ভারতকে এমন এক পুণ্যতীর্থ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যেখানে নানা জাতির মানুষ এসে মিলিত হয়েছে। ‘কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা/দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।’ ভারতবর্ষে আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, চীন, শক-হুন, পাঠান এবং মোগলের এক দেহে লীন হওয়ার কথা কবি উল্লেখ করে বলছেন: রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে/ ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত যারা এসেছিল সবে/ তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে, কেহ নহে নহে দূর/ আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তার বিচিত্র সুর।

কবির স্মৃতিপটে সুদূর অতীত ভেসে উঠেছে। তিনি শুনতে পাচ্ছেন: হেথা একদিন বিরামবিহীন মহা-ওঙ্কার ধ্বনি/ হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে উঠেছিল রণরণি।/ তপস্যাবলে একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া/ বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া।

এখানে কবি ভারতের ঔদার্যের কথা, হৃদয়ের বিরাটত্বের কথা এবং ঐক্য সাধনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সকলকে আবার একতাবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন। এই উদার ও উদাত্ত আহ্বান রবীন্দ্র মানসের সেই দিকটিকে উন্মোচিত করে যে দিকটি রামমোহনের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে চমৎকারভাবে মিলে যায়। প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা অক্ষুণœ রেখে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার সাধনা যথেষ্ট যুক্তিসম্মত। তবে একের অনলে বহুরে আহুতি দেয়ার কথা বলায় হয়তো সবাই তাঁর আহবানে স্বচ্ছন্দে সাড়া দেয়নি। বিদেশি শাসকদের বিভেদ নীতি, সংখ্যালঘু মুসলিম মনে ভীতি সর্বোপরি লাভ ও লোভের টানা-পোড়েন সংহতি বিনাশী ভূমিকা রেখেছিল।

রামমোহন ভাবুক ছিলেন, সংস্কারক ছিলেন।। শিল্পী ছিলেন না। কিন্তু তার উত্তরসাধক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কবি ও শিল্পী। তাই নানা উৎস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে শিল্পরূপ দেয়ার সময় তাঁর ওপর শিল্পীর ব্যক্তিজীবন ও রুচির প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাঁর মানস নির্মাণে আনন্দ ও বেদনার ভূমিকা কম নয়। বৌঠান কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা এবং মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে পরিণয় তাঁর জীবনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল; সৃজনে এনেছিল বৈচিত্র্য। বস্তুত প্রেম-প্রীতি, বিরহ-মিলন, মান- অভিমান, শোক-দুঃখ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত তার প্রতিভাকে মহতী পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। পারিবারিক পুরনো জমিদারি তদারকির নির্দেশ পালন তাঁর কাছে ‘প্রায় নির্বাসনে’ পাঠানোর সিদ্ধান্ত বলে মনে হলেও পদ্মা নদীর ‘তটে ও বক্ষে’ তিনি পেয়ে যান তার মনের মতো ‘আসন ও নীড়’। প্রকৃতির নিবিড় সংসর্গ এবং সাধারণ মানুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তাঁর সৃজনী প্রতিভার চতুর্মুখী দ্বার খুলে দেয়।। নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কবিতায় ভরে ওঠে তার সৃষ্টি সম্ভার। একেই বলে শাপে বর!

রবীন্দ্র মানস নির্মাণে গ্রামবাংলার ভূমিকা নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথ নদীমাতৃক পূর্ববাংলায় বসবাস না করলে গল্পগুচ্ছের অনেক গল্পের চরিত্র এবং স্বাদ হয়তো অন্যরকম হতো, ‘সোনার তরী’ বা ‘চৈতালির’ অনেক কবিতাই হয়তো ভিন্ন স্বাদের কবিতা হয়ে উঠতো। পদ্মাতীরে কিংবা পদ্মাবক্ষে না কাটালে ‘ছিন্নপত্রে’র স্বরূপ হয়তো ভিন্ন রকম হওয়ারই সম্ভাবনা ছিল বেশি। সর্বোপরি তাঁর দেশভাবনা কতটা পরিচ্ছন্ন ও জনমুখী হতো।। সে বিষয়ে রয়েছে সংশয়ের অবকাশ। তবে পূর্ববঙ্গ বাস তাঁর ‘মনকে মুক্তি দিয়েছিল’ গবেষক গোলাম মুরশিদের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি পশ্চিমবঙ্গের সত্যেন্দ্রনাথ রায়। তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে জন্মান্তর বা পালাবদলের ব্যাপারটি একবার ঘটেনি, ঘটেছে একাধিকবার। তার কার্যকারণও এক নয়, বরং একাধিক। বণিক সভ্যতার হিংস্রতা, ধনতন্ত্রীদের লোভের নগ্নরূপ, বিশ্বযুদ্ধের উৎকণ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ এবং স্বদেশী আন্দোলন, সাধনা এবং বঙ্গদর্শন সম্পাদনা, ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, হিন্দু-ব্রাহ্ম মতান্তর, বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে বিতর্ক, পল্লীবাস, ইউরোপ প্রবাস প্রভৃতি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের মানস বিবর্তনের সঙ্গে। রবীন্দ্র মানস বিকাশে ইতিহাস, সমাজ পরিবেশও যথেষ্ট অবদান রেখেছে। রবীন্দ্রনাথও তার সমাজ-পরিবেশ ও ইতিহাসের উপাদানকে সার্থকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন। তাই ইতিহাসের সন্তান হয়ে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। মার্ক্সসের মতো বস্তুবাদী চিন্তাবিদও স্বীকার করেছেন : “ওঃ রং সধহ, ৎবধষ, ষরারহম সধহ যিড় সধশবং, ড়হিং ধহফ ভরমযঃং; রঃ রং হড়ঃ যরংঃড়ৎু যিরপয ঁংবং সধহ ঃড় ৎবধষরংব রঃংবষভ; ভড়ৎ যরংঃড়ৎু রং হড়ঃযরহম বষংব নঁঃ ঃযব ধপঃরারঃু ড়ভ সধহ ঢ়ঁৎংঁরহম যরং বহফং.” (ঞযব ঐড়ষু ঋধসরষু)

রবীন্দ্রনাথ কেন, মূলত কোন মানুষই স্বয়ম্ভূ নয়। মানুষকে ইতিহাসের পরম্পরায় মানুষ হয়ে উঠতে হয়। সবাই হতে পারেন না। তবে কেউ কেউ হন। যেমন রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে উপনিষদ, কালিদাস, পদ্মাবাস এবং পল্লীবাস সবই অত্যন্ত গভীরভাবে সত্য। সেইসঙ্গে এটাও সত্য যে, পূর্ববঙ্গ বাসের অব্যবহিত পরই সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের ভাষায় ‘রবীন্দ্রনাথের জীবনে সব থেকে রক্ষণশীল, সব থেকে পশ্চাদমুখী, সব থেকে বন্ধনের কাল’ দেখা দিয়েছিল। তবে গ্রামবাংলার সুখ-দুঃখ, মানুষের দারিদ্র্য, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা সম্পর্কে তিনি যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন সেটা তাঁর খুব কাজে লেগেছিল। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর চিন্তা-ভাবনার যে বৃত্ত গড়ে উঠেছিল নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর সেই বৃত্তের পরিধি আরও বহুগুণ সম্প্রসারিত হয়েছিল। বাংলা কিংবা ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের নর-নারীকে সামনে রেখে তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন। এই ভাবনার ফসল হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় জাতীয়তাবাদ ও ব্যক্তিত্বের ওপর লেখা তাঁর দু’টি সারগর্ভ প্রবন্ধ। বাংলার কবি ও ভাবুক এই সময়ে বিশ্বের অন্যতম কবি ও ভাবুক হিসেবে সমাদৃত হন এবং প্রাচীন ভারতের বর্ণাশ্রমী তপোবন থেকে আধুনিক ভারতের ‘মহামানবের সাগর তীরে’ এসে দাঁড়ান। তাঁর সৃজন সামর্থ্যরে উৎকর্ষ বিচার করতে গিয়ে মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় ‘পূরবী’কে তার কাব্যের, ‘রক্ত করবী’কে তার নাটকের, ‘যোগাযোগ’কে তার উপন্যাসের এবং ‘মানুষের ধর্ম’কে প্রবন্ধের চূড়া বলেছেন। রবীন্দ্রমানসের বিকাশ বোঝার ক্ষেত্রে তার এ অভিমত নিঃসন্দেহে মূল্যবান।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ইউরোপীয় ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদের সমর্থক ও অনুসারী। তাঁর সাধনা যতটা ব্যক্তিমুখী ছিল, ততোটা সমাজমুখী ছিল না। নিজের মনের মুকুরে তিনি বিশ্বকে প্রতিবিম্বিত দেখেছেন। বিশ্ববোধে সাড়া দিতে গিয়ে জাতীয়বোধ, দেশাত্মবোধ এমনকি বাঙালিত্ব বর্জন করতে হয় তাকে। এ জন্য কবি মোহিতলাল মজুমদার, নীরদ চন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ তার সমালোচনা করেন। ব্রাহ্মধর্মের উপনিষদীয় ভাববাদ ও আদর্শবাদ মহিতলালের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র চেয়েছিলেন একটি বিশেষ জাতির বিশেষ অবস্থায় যথাসাধ্য কল্যাণ। দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে মানবাত্মার স্বরূপ সন্ধানে তাঁর আগ্রহ কিংবা আস্থা কোনটাই ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন: সকল ধর্মের উপরে স্বদেশ-প্রীতি, ইহা বিস্মৃত হইওনা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছিলেন। যেমন: স্বজাতির সিংহাসন উচ্চকরি গড়ো/ সেই সঙ্গে মনে রেখো সত্য আরো বড়ো। স্বদেশের চাহ যদি তারো ঊর্ধ্বে ওঠো,/ করো না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো।

জগতের উদার ও মহৎ ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ নিজের করে নিতে কখনও কার্পণ্য করেননি। তিনি বলেছেন : জগতে যত মহৎ আছে/ হইব নত সবার কাছে/ হৃদয় যেন প্রসাদ যাচে/ তাদের দ্বারে দ্বারে।

মানুষের মধ্যে লোকপ্রিয় হবার বাসনা থাকা খুবই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও হয়তো ছিল। কিন্তু সত্যের বদলে জনপ্রিয়তাকে তিনি শ্রেয় জ্ঞান করেননি। মুক্তবুদ্ধির ভাবুক হিসেবে তিনি শশধর তর্কচূড়ামণি প্রমুখের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে পাপের ফল হিসেবে দেখতে সম্মত হননি। রাশিয়ার চিঠিতে ‘প্রিয় হবার’ বদলে ‘সত্য হবার’ কথা বলেছেন। এত কিছু বলার পরও ‘ঐকতান’ কবিতায় অকপটে স্বীকার করেছেন: এই স্বর সাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক, রয়ে গেছে ফাঁক।। সে ফাঁক পূরণ করার প্রয়াস তাঁর জীবদ্দশাতেই শুরু হয়।

No comments:

Post a Comment