পিতা রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বজোড়া যার খ্যাতি, ভুবন জুড়ে যার সুনামের ধজ্বা। সেই রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়, পিতা রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর কে অনুসন্ধানকরব, তারই নিজের ভাষায়, অনুভুতিতে, যা বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে।এখানে তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী ও জামাতা নগেন্দ্রনাথের কিছু পত্রের উল্লেখ করব। যার প্রতিটি ছত্রে আমরা পিতা রবীন্দ্রনাথ কেই খুঁজে পাব।
৬ জুন, ১৯০৭ সালে রবিন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর বিয়ে হয় বরিশালের ব্রাম্মসমাজের নিষ্ঠাবান ভক্ত বামনচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে।
উচ্চাভিলাষী নগেন্দ্রনাথের বিলাত যাবার একান্ত বাসনা, কিন্তু পারিবারিক অবস্থা সে ইচ্ছে পূ্রনের অনুকুল ছিলনা। বিলাত যাবার ব্যয় বহনে ইচ্ছুক এমন কন্যা দায়গ্রস্থ পিতাকে দায়মুক্ত করতেও তিনি রাজি। শ্বশুরের খরচে বিলাত গমনেচ্ছু পাত্র রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না। বিয়ের নামে এই বিনিময় প্রথা তাঁর অপছন্দ ছিল। কিন্তু প্রিয়দর্শন, তেজস্বীযুবক নগেন্দ্রনাথ কে দেখে মত বদল করেন। নগেন্দ্রনাথ কে আমেরিকা পাঠাবার কড়ারে কন্যাদান করলেন।কবির ইচ্ছে অনুযায়ী নতুন জামাই নগেন্দ্রনাথ বিয়ের তিন সপ্তাহ পর ২৮ জুন, ১৯০৭ সালে আমেরিকা যাত্রা করেন। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি উর্জন করে ১৯১০ সালে দেশে ফিরে আসেন।
কবির স্বপ্ন ছিল, পুত্র জামাতা মিলে তাঁর জমিদারি পরিচালনা, পত্রিকা সম্পাদনা, ব্যাঙ্ক ও ব্যবসার তদারকি, তদুপরি
শান্তিনিকেতনে তাঁর সাধনাকে সিদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ কে নিয়ে কবির সকল আশা ভরসা অচিরেই বিলীন হয়ে গেল। শ্বশুর নির্ধারিত সকল কাজ-কর্ম থেকেনগেন্দ্রনাথ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তিনি অন্যত্র চাকরী প্রয়াসী হলেন। নগেন্দ্রনাথ কে ভারমুক্ত করতে কবি তার পৈ্তৃক দেনা শোধ করলেন, তাঁর ভাইদের পড়াশুনার ভার গ্রহন করলেন, এ ছাড়াও রবিন্দ্রনাথ কন্যা-জামাতার ভরন পোষনের জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করলেন। নগেন্দ্রনাথের কোন নির্দিষ্ট কাজকর্ম নেই, আয় নেই, কোন বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকার মানসিকতা, সব বিষয়ে গা ছাড়া ভাব, অথচ বে-হিসেবী জীবনযাত্রা ইত্যাদি নিয়ে কবির সঙ্গে মতান্তর থেকে মনান্তর শুরু হল এবং তার অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া ঘটল মীরা দেবীর উপর। যে সরল ওসুরুচিপুর্ন পরিমন্ডলে কবি-কন্যা লালিত পালিত হয়েছিলেন, জামাইএর পারিবারিক পরিবেশে মনে হয় তার কিছুটা ঘাটতি ছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে ১৯১৮ সাল নাগাদ কবি-কন্যা ও জামাতার মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে গেল। বিলম্বে হলেও নগেন্দ্রনাথের একটা জীবিকার ব্যবস্থা হল, কিন্তু এদিকে কন্যা-জামাতার জীবন বীনার ছেঁড়া তারে জ়োড়া লাগার কোন লক্ষন দেখা গেল না। কন্যার প্রতি মমত্ববোধ, আর জামাইএর প্রতি কর্তব্যবোধে কবির দিক থেকে কোনো ঘাটতি না থাকলেও উভয়ের মানসিকতায় যে যোজন পরিমান ফারাক সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতিবিধান কবির সাধ্যাতীত। ফলে মীরা দেবী স্বামীর ঘর করতে কলকাতা যেতেই অনিচ্ছুক। নগেন্দ্রনাথের ইচ্ছে, কবি তাঁকে জোর করে স্বামীর কাছে পাঠান। সেখানেই কবির আপত্তি। তিনি লিখেছেন......... “ মীরার সঙ্গে তোমার লেশমাত্র বিচ্ছেদ হয়, এ আমার কিছুতেই ইচ্ছাসম্মত নয়। এর দায়িত্ব ও আমার পক্ষে কঠিন। তবু আমাকে পরম দুঃখে এটা স্বীকার করতে হচ্ছে। এবার মাদ্রাজে যখন দেখলুম মীরা তোমাকে ভয় করে, তোমার হাত থেকে প্রকাশ্য অপমানের সংকচে একান্ত সংকুচিত হয়, তখন স্পষ্ট দেখতে পেলুম তোমাদের দুজনের প্রকৃতির মুল সুরে মিল নেই। ( চিঠি, ৮ ভাদ্র, ১৩২৬ )।সুতরাং মীরা দেবী পুত্র-কন্যা নিয়ে রয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে, কখনো বা পিতার সাথে জ়োড়াসাঁকোয়, আর নগেন্দ্রনাথ কলকাতায়। নগেন্দ্রনাথ বার বার চেষ্টা করেছেন স্ত্রী কে নিজের কাছে আনতে, কিন্তু মীরা দেবী রাজি হন নি। কারন কবিই তাঁর জামাইএর স্বভাব-চরিত্র বিশ্লেষন করে বলেছেন......... “ তোমার অধৈয অসহিষ্ণুতা, তোমার আত্মসম্বরনে অসাধ্যতা, তোমার দুর্দান্ত ক্রোধ, এবং আঘাত করিবার হিংস্র ইচ্ছা, সাংসারিক দিক থেকে আমাকে অনেক সময়ে কঠীণ পীড়া
দিয়েছে।( চিঠি,১১ অগ্রহায়ন,১৩২৬ )। এমন পরিবেশে কন্যা স্বামী গৃহে যেতে না চাইলে কবি তাকে জোর করে পাঠাবেন না। অন্য একটি চিঠিতেও কবি লিখেছেন......... “ মীরা যে প্রশান্ত গাম্ভির্যের সঙ্গে নিঃশব্দে আপন দুঃখবহন করে, তাতে ওর মুখের দিকে তাকালে আমার চোখে জল আসে। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে কোনও জীবনযাত্রা বহন করতে যদি প্রস্তত হতে হয়, তবে সে চিন্তা আমার জন্য দুর্বিষহ। এখন সে শুধু আমার কন্যা নয়, সে যে আমার আশ্রয়ে আছে, আমি যদি তাকে বলি তার এখানে থাকা হবেনা, তাহলে তাকে চলে যেতেই হবে----জানি, সে কখনো আভাসেও অসম্মতি জানাবেনা। কিন্তু কোনমতেই আমার দ্বারা এমন নির্মম কাজ হবেনা। মীরা যখনি ইচ্ছে করবে, যখনি সে আমাকে বলবে আমি যাব, তখনি আমি তাকে যেতেবলব”।(চিঠি, ২০ ফাল্গুন,১৩২৬)
ব্যথাহত রবীন্দ্রনাথ এক পত্রে নগেন্দ্রনাথ কে লিখেছেন,......... “ তোমাদের দুইজনেরই ভাগ্য তোমাদের নিজেদের হাতে। আমি জোর করে তার গতি পরিব্ররতন করতে পারিনে, এ সকল দুর্ঘটনার মুল অন্তরের মধ্যে। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটেছে সে তো বাইরের জিনিস নয়। বাইরে থেকে জোর করে, শাসন করে, ভয় দেখিয়ে জোড়া দেবার যে চেষ্টা সে আমার দ্বারা কিছুতেই হতে পারেনা। কারন, তার মতো নীচতা ও নিষ্ঠূরতা আর কিছুই নেই।
তুমি এ সম্নধে আদালতে নালিশ করতে চাও, মীরা যদি সেই আঘাতও সহ্য করতে সম্মত থাকে, তাহলে আমি কি
করতে পারি? তুমি এ সম্মন্ধে তাকেই বরঞ্চ ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখো। যদি ভয় পেয়ে সে হার মানে তাহলে তাই হোক।
চিঠি, ২৫মাঘ,১৩২৬) মীরা দেবী স্বামীর ঘরে না থেকে বাবার কাছে থাকলে লোকনিন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করে নগেন্দ্রনাথ কবি কে লিখলে
তিনি জবাবে লিখেছেন............ “ মীরা যদি তোমার কাছ থেকে দূরে থাকলে তোমার সম্মন্ধে লোকনিন্দার আশঙ্কা
আছে বলে তুমি কল্পনা করছ। মীরা নিজের সম্মন্ধে লোকনিন্দা কে গ্রাহ্য করেনা তোমাকে লিখেছে শুনে খুশী হলুম।
জীবনে সব মানুষের ভাগ্যে সুখ থাকেনা--- তা নাই বা থাকল----কিন্তু স্বাধীনতা যদি না থাকে তবে তার চেয়ে দুর্গতি
কিছু হতে পারেনা। মীরা এখানে আপন মনে একটি কোনে থাকে—বেশী কিছুই চায়না,-- একটু খানি শান্তি এখানে পায়,
আর যানে আমি ওকে কত স্নেহ করি। লোকনিন্দার ভয়ে মীরার এই অধিকার টুকুকে নষ্ট হতে দেখলে আমার আর দুঃখের
অন্ত থাকবেনা।(চিঠি,মাঘ-ফাল্গুন,১৩২৯)বিদেশ থেকে কবি মীরা দেবী কে লিখেছিলেন,...... “ তোর দুঃখ আমার হৃদয় ভরে আছে, আমি একদিন ও ভুলতেপারিনে। এ দুঃখ দূর করি এমন শক্তি আমার নেই,--- তোদের নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে সুখী হব ঈশ্বর আমাকে সেঅবকাশ দেবেন না......... সুখের আশা রাখিসনে মীরু, দুঃখ কে ভয় করিসনে---তুই যে কোনো শাসনের ভয়ে, পীড়নেরদায়ে নিজের সত্ত্যকে বিকোতে চাসনে এতে আমি সুখী। (চিঠি,১৯২১) কিছুদিন পর নগেন্দ্রনাথ কে এক চিঠিতে লিখলেন............ “ এই দুঃখ রয়ে গেল যে, তোমাদের দুজনের কাউকেই আমি সুখী করতে পারিনি,-- তার শাস্তি নিয়ত অন্তরের মধ্যে ভোগ করছি, অতএব আমাকে ক্ষমা কোর। (চিঠি,২১ আশ্বিন১৩২৯)। তার কয়েক মাস পর আর একটি চিঠিতে......... “ তোমাকে শান্তি ও সান্তনা দেবার কোন ক্ষমতা আমার হাতে যদি থাকত তাহলে আমি চেষ্টার ত্রুটি করতুম না। (৬ফাল্গুন,১৩২৯)
আর গভীর দুঃখ ও মর্মবেদনায় কবি পুত্র রথিন্দ্রনাথ কে এক চিঠিতে লিখেছেন............”” মীরা যখন নাবার ঘরে
ঢুকেছিলো তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফনা ধরে উঠেছিল, আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনি তাকে
কাটত, তাহলে ও পরিত্রান পেত।“” বিশাল বিচিত্রমুখী রবিন্দ্র সাহিত্যের কোন চ্চরিত্রের মুখে এমন নিষ্ঠূর নিষ্করুন সংলাপক্তি শোনা যায়নি। কি গভীর মনস্তাপে রবিন্দ্রনাথের মতো স্নেহশীল পিতা ও সংবেদনশীল কবির কলমে এমন নির্মম, নির্দয় উক্তি বেরোতে পারে তা অনুভব করা যায়, বোঝান যায় না।
সুত্রঃ রবিন্দ্রনাথ, নগেন্দ্রনাথ, ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
দীনেশ্চন্দ্র সিংহ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী