এই শিরোনামে ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে একটা বই প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কামরুল হাসান। সম্প্রতি নীলক্ষেতের ফুটপাথের দোকান থেকে এই বইয়ের একটা কপি আমি কিনেছি। এই বইটি সম্ভাবত অনেকের কাছেই নাই কিন্তু বইটি পড়ে এর কিছু কিছু অংশ সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে পড়তে ইচ্ছা হল। ধারাবাহিকভাবে বইয়ের বিভিন্ন অংশ পোস্ট করব।
মুখবন্ধ
মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র দেশ ও জাতির এমন এক সংকট পরিস্থিতিতে গঠন করা হয়েছিল, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, একাত্তরের ঘাতক ও পাক হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসররা, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, সরকার ও প্রশাসনের সর্বত্র তাদের অশুভ উপস্থিতি প্রকটভাবে প্রতীয়মান। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের সমুদয় চেতনাকে সম্পুর্ণভাবে নস্যাত করে দিয়ে জাতীয় অরর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি জীবনে প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপদ নীতি ও ধ্যান ধারণা প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করা হচ্ছে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজতন্ত্রকে আনুষ্ঠানিক ভাবে খারিজ করে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক, শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় ফিরিয়ে দিয়ে, দুর্নীতি চোরাচালান ও ফড়িয়াগিরির ব্যপক প্রসার ঘটিয়ে তা মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বানিয়ে, দেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষকে দারিদ্র্য সীমার নীচে ঠেলে দিয়ে দেশে এক ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
স্বাধীনতার জন্য জীবনদান যদি সর্বোচ্চ মূল্য হয় বাঙ্গালী জাতির মত এত বেশী মূল্য অন্য কোন জাতিকে দিতে হয় নি। অথচ স্বাধীনতার ষোল বছর অতিক্রান্ত না হতেই স্বাধীনতার ইতিহাস ও চেতনা নতুন প্রজন্মের নাগরিকরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। এই বিস্মরণ অস্বাভাবিক নয় একারণে যে, স্বাধীনতার পর যে কয়টি সরকার আমরা পেয়েছি তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চায় নি। বরং চেয়েছে এই চেতনা গোটা জাতির স্মৃতি থেকে দ্রুত অবলুপ্ত হোক। যে কারণে গোলাম আজম, আব্বাস আলী খান বা মওলানা মান্নানের মতো একাত্তরের ঘাতকদের এদেশের রাজনীতিতে বা সরকারের মন্ত্রীসভায় স্থান করে নিতে দেখেও আমরা নিন্দা করি না, প্রতিরোধ গড়ে তুলি না।একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা যখন সরকার প্রশাসন, রাজনীতি কিম্বা শিল্প সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে বসে ছুরি শানাচ্ছে আরেকটি গণহত্যার জন্য, সরকার তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য। এ কথা আমরা বহুবার বলেছি, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুষ্টিমেয় লোক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে স্বধীনতার পক্ষের শক্তির উপর ইতিহাসের নৃশংতম গণহত্যা চালিয়েছিল। আমরা চিনি তারা কারা। একাত্তর বাহাত্তরের সংবাদপত্রে তাদের ততপরতার খবর প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তাদের ধরিয়েদেয়ার জন্য প্রতিদিন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য সরকারী তত্বাবধানে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খন্ডের বিশাল ইতিহাসে তাদের নাম ছাপা হয় নি। আরো বিস্মিত হই তখন—যখন এইসব ঘাতকদের দেখি পত্রিকায় সদম্ভে ঘোষণা করে –
একাত্তরে আমরা ভুল করি নি।
কিম্বা যখন বলে
......কিসের বিতর্কিত আমি?
অথচ এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ হয় না।
আমরা আগেও বহুবার বলেছি, এখনও বলছি, তালিকা প্রস্তুত করা দরকার মুক্তিযোদ্ধাদের নয়; মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত সম্ভব নয়, কারণ দেশের তখনকার সাত কোটি মানুষই ছিলেন মনে প্রাণে মুক্তিযোদ্ধা। তালিকা প্রস্তুত করা দরকার একাত্তরের গণহত্যার জন্য যারা দায়ী সেই মুষ্টিমেয় ঘাতক ও দালালদের, যাতে দেশবাসী তাদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে পারেন – তাদের পুনর্বাসন প্রয়াসকে প্রতিহত করতে পারেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের নাজী বাহিনী জার্মানী সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল সেই সব ঘাতকদের তালিকা প্রস্তুত এবং অনুসন্ধানের কাজ ৪৫ বছর অতিক্রম করার পরও অব্যাহত রয়েছে। এখনও তাদের কাঠগড়ায় দাড়াতে হচ্ছে তাদের অপরাধের জন্য। সেই সব অপরাধী এখনো তাদের দেশে ভোটাধিকার পর্যন্ত ফিরে পায় নি। অথচ আমরা তাদের মন্ত্রী সভায় স্থান দিচ্ছি, সংসদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি; পাকিস্তানের নাগরিক কুখ্যাত ঘাতক গোলাম আজমকে বাংলাদেরশর মাটিতে বসে গণ হত্যার রাজনীতি করার সুযোগ দিচ্ছি।
জাতিকে এই সংকট পরিস্থিতিতে সতর্ক করার প্রয়োজনে আমাদের এই প্রয়াস। এই গ্রন্থটিতে একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের সম্পর্কে যে সব তথ্য দেয়া হয়েছে প্রায় সবই সেই সময়ে সংবাদপত্র থেকে নেয়া। এই সব তথ্য যেহেতু যথাযথভাবে গ্রন্থকারে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ১৫ খন্ডের কোথাও ছাপা হয় নি সেহেতু এই গ্রন্থটিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ১৬তম খন্ড হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এটিও নির্দিষ্ট বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ নয়। সীমিত ক্ষমতা ও সময়ের ভেতর এটি আমাদের প্রথম প্রয়াস। ভবিষ্যতে আরো কটি খন্ডে ইতিহাসের এ বিশেষ পর্বটিকে পূর্ণাঙ্গরূপে বিবৃত করবার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গোটা দেশবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনারা আপনাদের এলাকার ঘাতক ও দালালদের তথ্য আমাদের কেন্দ্রে প্রেরণ করুন। কোন বিদ্বেষের বশবর্তী নয়, স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস যথাযথভাব লিপিবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনেই এই সব তথ্য সংরক্ষণও প্রকাশ করা দরকার।
কেন্দ্রীয় কমিটি
মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র
১০ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৭
দ্বিতীয় সংস্করণ প্রসঙ্গে গত ফেব্রুয়ারী তে বাংলা একাডেমীর বই মেলায় ‘একাত্তরের দালাল ও ঘাতকরা কে কোথায়, বের হওয়ার দশ দিনের ভেতর ৫০০০ কপি বই বিক্রি হয়ে যায়। শুধু বইমেলার ইতিহাসে নয়, বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে এটি একটি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। বইটির বিপুল চাহিদা এটাই প্রমাণ করে – এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবলুপ্ত করার যত চক্রান্তই করা হোক না কেন, জনসাধারণের ভেতর এই চেতনা আজও জাগ্রত রয়েছে।
সাধারণ মানুষ, বিশেষভাবে তরুণ সমাজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য এই অধ্যায়টি জানবার প্রয়োজনেই এই বইটি কিনেছেন এবং পড়েছেন। আমাদের চিঠি লিখে জানানো হয়েছে বইটির বিপুল চাহিদার কারণে মফস্বলের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ২৫ টাকার বই ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করেছেন।
সাধারণ পাঠকদের ভেতর বিপুলভাবে সমাদৃত হলেও কয়েকটি পত্রিকায় এই বই সম্পর্কে অপ্রাসঙ্গিক ও উদ্দেশ্যপ্রণেঅদিত কিছু মন্তব্য করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এই সব পত্রিকার অভিযোগ হচ্ছে—(১) এই বইয়ে দালালদের যে তালিকা দেয়া হয়েছে সেটি অসম্পূর্ণ, ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু দালালের নাম বাদ পড়েছে, বিশেষ করে চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত বামপন্থী নেতাদের নাম, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন (২) শেখ মুজিবুর বহমান ঘাতক ও দালালদের ক্ষমা করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন অথচ এই বই পড়লে মনে হয় দালালদের পূনর্বাসনের জন্য তিনিও কম দায়ী নন। এবং (৩) এই বইয়ে কোন লেখকের বা সম্পাদকের নাম না থাকায় এর যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
প্রথম অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ বইয়ের প্রথম সংস্করণে আমরা সবিনয়ে স্বীকার করেছি এবং বর্তমান সংস্করণ সহ ভবিষ্যতে যে কটি সংস্করণ হবে – স্বীকার করতেই হবে, দালাল ও ঘাতকদের সম্পূর্ণ তালিকা সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথম সংস্করণে আমরা বলেছিলাম এবং এখনও বলছি আমরা এই তালিকায় আরো নাম সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি এবং অবশ্যই যুক্তি প্রমান সাপেক্ষে। আমরা কাদের দালাল বা ঘাতক বলবো তার ভিত্তি এই বইয়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে। বইটি রচনার ক্ষেত্রে যে শৃঙ্খলা রক্ষা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে প্রামাণিক দলিল সমেত নতুন কোন নাম জেনে অবশ্যই তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে ৭১-এ চীনপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে ভিন্ন রচনা লেখা যেতে পারে; এ বইয়ে তার অন্তর্ভূক্তির অবকাশ নেই। কারণ গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন বা পাক বাহিনীর ভূমিকাকে সমর্থন করে কাগজে বিবৃতি দিয়েছেন কিম্বা যুদ্ধ-পরবর্তী সরকার দালালীর অভিযোগ এনেছেন – এমন কোন চীনপন্থীর নাম আমরা ৭১’ বা ৭২’ এর সংবাদপত্রে বা সরকারী গেজেটে পাই নি। পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেলে অবশ্যই সেগুলি তালিকাভুক্ত করা হবে। বর্তমান সংস্করণে এই তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে।
দ্বিতীয় অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুল্যায়ন তাঁর কাজর ভিত্তিতে করা হয়েছে। দালালদের ক্ষমা করে তিনি যে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন নি – সমাজে দালালদের বর্তমান উপস্থিতিই সেটা প্রমাণ করে। তাঁর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা কিভাবে মূল্যায়ন করেন বর্তমান সংস্করণে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র গঠিত হওয়ার পর পরই সাধারণ সভায় ৩ খন্ডে একাত্তরের দালালদের তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথম পর্যায়ে কেন্দ্রের সভাপতি কাজী নূর উজ-জামান, সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার কবির এবং কার্যনির্বাহী সদস্য ডঃ আহমদ শরীফকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে আরো কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে অন্তর্ভূক্ত করে একটি সম্পাদকমন্ডলী গঠন করা হয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নামে প্রকাশের সিদ্ধন্ত হয়। ১ম খন্ড রচনাযর দায়িত্ব দেয়া হয় সৈয়দ শফিক আহমদকে। যেহেতু এটি এমন একটি গ্রন্থ যার প্রতি সংস্করণেই নতুন নতুন তথ্য সংযুক্ত হবে এবং বহু তথ্যদাতা নাম প্রকাশে ইচ্ছুক না হওয়ায় এই গ্রন্থ রচনায় কৃতিত্ব বা দায়িত্ব কোন একক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের থকাই বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠান অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত নয় সেহেতু এর কোন প্রকাশনা সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকা উচিত্ নয়।
দ্বিতীয় সংস্করণে কয়েকটি অধ্যাযের আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে এবং নতুন অনেক তথ্য সংযৃক্ত হয়েছে। এই কাজে সাহায্য করেছেন সৈয়দ শফিক আহমদ ও আহমেদ মূসা। কলেবর বৃদ্ধির কারণে বর্তমান সংস্কারণে বইয়ের দামও কিছুটা বাড়াতে হয়েছে। আশা করি আমরা আগের মতোই পাঠকের সহযোগিতা পাবো।
কেন্দ্রীয় কমিটি
মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র
৭ই জুন ১৯৮৭
দ্বিতীয় সংস্করণ প্রসঙ্গে গত ফেব্রুয়ারী তে বাংলা একাডেমীর বই মেলায় ‘একাত্তরের দালাল ও ঘাতকরা কে কোথায়, বের হওয়ার দশ দিনের ভেতর ৫০০০ কপি বই বিক্রি হয়ে যায়। শুধু বইমেলার ইতিহাসে নয়, বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে এটি একটি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। বইটির বিপুল চাহিদা এটাই প্রমাণ করে – এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবলুপ্ত করার যত চক্রান্তই করা হোক না কেন, জনসাধারণের ভেতর এই চেতনা আজও জাগ্রত রয়েছে।
সাধারণ মানুষ, বিশেষভাবে তরুণ সমাজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য এই অধ্যায়টি জানবার প্রয়োজনেই এই বইটি কিনেছেন এবং পড়েছেন। আমাদের চিঠি লিখে জানানো হয়েছে বইটির বিপুল চাহিদার কারণে মফস্বলের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ২৫ টাকার বই ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করেছেন।
সাধারণ পাঠকদের ভেতর বিপুলভাবে সমাদৃত হলেও কয়েকটি পত্রিকায় এই বই সম্পর্কে অপ্রাসঙ্গিক ও উদ্দেশ্যপ্রণেঅদিত কিছু মন্তব্য করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এই সব পত্রিকার অভিযোগ হচ্ছে—(১) এই বইয়ে দালালদের যে তালিকা দেয়া হয়েছে সেটি অসম্পূর্ণ, ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু দালালের নাম বাদ পড়েছে, বিশেষ করে চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত বামপন্থী নেতাদের নাম, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন (২) শেখ মুজিবুর বহমান ঘাতক ও দালালদের ক্ষমা করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন অথচ এই বই পড়লে মনে হয় দালালদের পূনর্বাসনের জন্য তিনিও কম দায়ী নন। এবং (৩) এই বইয়ে কোন লেখকের বা সম্পাদকের নাম না থাকায় এর যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
প্রথম অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ বইয়ের প্রথম সংস্করণে আমরা সবিনয়ে স্বীকার করেছি এবং বর্তমান সংস্করণ সহ ভবিষ্যতে যে কটি সংস্করণ হবে – স্বীকার করতেই হবে, দালাল ও ঘাতকদের সম্পূর্ণ তালিকা সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথম সংস্করণে আমরা বলেছিলাম এবং এখনও বলছি আমরা এই তালিকায় আরো নাম সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি এবং অবশ্যই যুক্তি প্রমান সাপেক্ষে। আমরা কাদের দালাল বা ঘাতক বলবো তার ভিত্তি এই বইয়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে। বইটি রচনার ক্ষেত্রে যে শৃঙ্খলা রক্ষা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে প্রামাণিক দলিল সমেত নতুন কোন নাম জেনে অবশ্যই তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে ৭১-এ চীনপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে ভিন্ন রচনা লেখা যেতে পারে; এ বইয়ে তার অন্তর্ভূক্তির অবকাশ নেই। কারণ গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন বা পাক বাহিনীর ভূমিকাকে সমর্থন করে কাগজে বিবৃতি দিয়েছেন কিম্বা যুদ্ধ-পরবর্তী সরকার দালালীর অভিযোগ এনেছেন – এমন কোন চীনপন্থীর নাম আমরা ৭১’ বা ৭২’ এর সংবাদপত্রে বা সরকারী গেজেটে পাই নি। পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেলে অবশ্যই সেগুলি তালিকাভুক্ত করা হবে। বর্তমান সংস্করণে এই তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে।
দ্বিতীয় অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুল্যায়ন তাঁর কাজর ভিত্তিতে করা হয়েছে। দালালদের ক্ষমা করে তিনি যে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন নি – সমাজে দালালদের বর্তমান উপস্থিতিই সেটা প্রমাণ করে। তাঁর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা কিভাবে মূল্যায়ন করেন বর্তমান সংস্করণে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র গঠিত হওয়ার পর পরই সাধারণ সভায় ৩ খন্ডে একাত্তরের দালালদের তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথম পর্যায়ে কেন্দ্রের সভাপতি কাজী নূর উজ-জামান, সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার কবির এবং কার্যনির্বাহী সদস্য ডঃ আহমদ শরীফকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে আরো কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে অন্তর্ভূক্ত করে একটি সম্পাদকমন্ডলী গঠন করা হয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নামে প্রকাশের সিদ্ধন্ত হয়। ১ম খন্ড রচনাযর দায়িত্ব দেয়া হয় সৈয়দ শফিক আহমদকে। যেহেতু এটি এমন একটি গ্রন্থ যার প্রতি সংস্করণেই নতুন নতুন তথ্য সংযুক্ত হবে এবং বহু তথ্যদাতা নাম প্রকাশে ইচ্ছুক না হওয়ায় এই গ্রন্থ রচনায় কৃতিত্ব বা দায়িত্ব কোন একক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের থকাই বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠান অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত নয় সেহেতু এর কোন প্রকাশনা সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকা উচিত্ নয়।
দ্বিতীয় সংস্করণে কয়েকটি অধ্যাযের আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে এবং নতুন অনেক তথ্য সংযৃক্ত হয়েছে। এই কাজে সাহায্য করেছেন সৈয়দ শফিক আহমদ ও আহমেদ মূসা। কলেবর বৃদ্ধির কারণে বর্তমান সংস্কারণে বইয়ের দামও কিছুটা বাড়াতে হয়েছে। আশা করি আমরা আগের মতোই পাঠকের সহযোগিতা পাবো।
কেন্দ্রীয় কমিটি
মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র
৭ই জুন ১৯৮৭
ভূমিকা
গণহত্যারযজ্ঞের শিকার যে কোন জনগোষ্ঠীই তাদের ক্ষয়ক্ষতি ইতিহাসবদ্ধ করতি গিয়ে অতিরঞ্জন করে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালদের দ্বারা সংগঠিত নরমেধযজ্ঞকেও ‘মানবেতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ,’ সাম্প্রতিক কালের নিষ্ঠুরতম হত্যালীলা ইত্যাদী শব্দমালায় বর্ণনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, রক্তই যদি স্বাধীনতার মূল্য হয় তবে বাঙ্গালী জাতি সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছে।
বস্তুত এই বর্ণনায় স্বাভাবিক অতিরঞ্জন অনুপস্থিত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার তেত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘ একটি রিপোর্ট বের করে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বে ইতিহাসে যে সমস্ত গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে; তার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যায়। রিপোর্টে নিহতের সংখ্যা সর্বনিম্ন গণনায় অন্তত ১৫ লক্ষ বলে উল্লেখ করে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার লোক নিহত হয়েছেন। মানব জাতির ইতিহাসে গণহত্যাযজ্ঞের ঘটনাসমূহে দৈনিক গড় নিহতের সংখ্যায় এটি সর্বোচ্চ। এদিক থেকে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার হত্যাকান্ড নিঃসন্দেহে মানবেতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ।
নিষ্ঠুরতার দিক দিয়েও এই হত্যাযজ্ঞের কোন তুলনা নেই। অন্য কোন সূত্র না ঘেঁটে শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প প্রণীত খন্ডমালার অষ্টম খন্ডে গ্রন্থিত প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের জবানবন্দীর কয়েকটি পাঠ করলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন, কেবলমাত্র ধর্ষকামী বিকৃত মস্তিষ্ক খুনীরা ছাড়া আর কেউ ঐ ধরনের হত্যাকান্ড সংগঠিত করতে পারবে না। বাংলাদেশের নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে এই উন্মাদরা যে কসাইখানার পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে করত, তার একটি দৃষ্টান্ত এ প্রসঙ্গে দেয়া যেতে পারে। ভৈরবের কাছে নদীতীরের একটি শ্মশানে নিরপরাধ বাঙ্গালীদের হত্যা করা হত। গূলীর শব্দে চমকিত হয়ে যাতে গ্রামের লোকজন পালিয়ে না যায়, সে জন্য এসব হতভাগ্যদের জবাই করা হত। স্থানীয় একজন বৃদ্ধ কসাইকে প্রতিটি জবইয়ের জন্য শান্তি কমিটির তরফ থেকে পাঁচ টাকা করে দেয়া হত। বধ্যভূমি থেকে কোন ক্রমে পালিয়ে আসা এক ব্যক্তির সংবাদপত্রে প্রকাশিত জবানবন্দী থেকে জানা যায়, পেছনে হাত বাঁধা মৃত্যুপথযাত্রীরা যখন জবাইয়ের জন্য শূতে না চেয়ে ধস্তাধস্তি করত, তখন বৃদ্ধ কসাই তাদের অনুরোধ করত শূয়ে পড়তে, যতে তারও কষ্ট না হয় আর তাদেরও যন্ত্রণা দ্রুত চিরতরে শেষ হয়ে যায়।
হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা পড়লে আরও একটি বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যাবে যে, এই বর্বরতায় ঘাতক পাকবাহিনীর সমান নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল তাদের এদেশীয় দালাল শান্তি কমিটি, জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, আল বদর, আল শামস, মুজাহিদ, রাজাকার, ইপকাফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস) প্রভৃতি বাহিনীর সদস্যরা।
সেই খুনী দালালেরা আজ আমাদের দেশের সর্বস্তরে পুনর্বাসত হয়েছে। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা আজ সবচেয়ে সুসংগঠিত ও প্রভাবশালী। এদের এক বিরাট অংশ আজও এদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত।
পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর অজ্ঞাতনামা শহীদদের উদ্দেশ্যে স্মৃতি সৌধ স্থাপন করা হয়েছে, আর তালিকা তৈরী করে সুচিন্হিত করা হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদের। আমাদের দেশে হয়েছে ঠিক তার উল্টো। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করা এবং দালালদের সুপরিকল্পিত ভাবে পুনর্বাসিত করার প্রক্রিয়া অনুযায়ী আজও তথাকথিত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে; অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী, প্রমানিত খুনীদের মন্ত্রীসভায় সদস্যপদ দেয়া হচ্ছে। যদি শহীদদের তালিকা তৈরী করতে হয় তবে অন্ততঃ তিরিশ লক্ষ নাম তাতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল দিনগুলোতে স্বাধীনতাকামী সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, সুতরাং চিহ্নিত করতে হলে মুষ্টিমেয় দালালদেরই চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের খ্যতনামা সাহিত্যিক মুলুকরাজ আনন্দ ১৬ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে ঢাকায় বুদ্ধিজীবিদের এক সভায় বলেছিলেন, ‘আপনারা মসী ছেড়ে অসি ধরেছিলেন, এবার অসি ছেড়ে কলম ধরবেন, আপনাদের লেখায় যেন বাংলাদেশের বিপর্যয়ের ছবি আঁকা থাকে। লেখকরা সমাজের প্রতিনিধি। সমাজের হৃদস্পন্দন যেন আপনাদের লেখায় প্রকাশিত হয়। আপনাদের দেশে যে মর্মঘাতী কাহিনী অভিনীত হয়ে গেছে তা যদি প্রকাশ করতে না পারেন; জানবেন—এই দুঃখ প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই...এ’ও একটি কবিতা হবে।’
মানবেতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও আমাদের সাহিত্যিক ও গবেষকরা এই হত্যাকন্ডের সামগ্রিক রূপরেখা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আজও দেশবাসী সঠিক ভাবে জানেন না কারা কিভাবে গঠন করেছিল শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর। কোন আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন আমাদের বুদ্ধিজীবিরা। স্বাধীনতাবিরোধী খুনী দালালদের পুনর্বাসনে স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবিমৃষ্যকারীতার পাশাপাশি সমাজের প্রতি বুদ্ধিজীবি শ্রেনীর দ্বায়িত্বহীনতাও কম দায়ী নয়।
আমাদের লেখক ও গবেষকদের সেই দ্বায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা হিসাবে আমাদের এই প্রয়াস। এতে তথ্যের স্বল্পতা আছে, কারণ তথ্যের সূত্র হিসেবে গবেষণাজাত কোন গ্রন্থ খুঁজে পাওয়া যায় নি। আমরা আশা করব যোগ্য গবেষকরা এগিয়ে আসবেন, আমাদের অসম্পূর্ণতা দূর করে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়টি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করবেন।
সরকারী পৃষ্ঠপোষকাতায় পনের খন্ডে সমাপ্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের যে ইতিহাস রচনা কারা হয়েছে, পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায় মূলতঃ দালালদের ভূমিকাকে অত্যন্ত সুকৌশলে চেপে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই তা প্রনিত হয়েছে। দালালদের ভূমিকা প্রকাশের জন্য সব চেয়ে উপযোগী দলিলগুলিই এতে মুদ্রিত হয় নি; তদুপরি যে সমস্ত দলিল মুখরক্ষার জন্য ছাপা হয়েছে তাতেও বিকৃতি ঘটনো হয়েছে দালালদের পরিচয় গোপন রাখার মাধ্যমে। আমরা, কেউই আমাদের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধীতাকারী, গণহত্যার নায়ক, দালালদের সবাইকে চিনি না বা তাদের তত্কালীন ঘৃণ্য কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত নই। স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসগ্রন্থে কিভাবে দালালদের রক্ষার জন্য বিকৃতি ঘটানো হয়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত এই গ্রন্থেই দেয়া হয়েছে।
বাঙ্গালী জাতির জন্য এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলি সরকার গঠিত হয়েছে, প্রত্যেকে একাত্তরের ঘাতকদের পুনর্বাসনের জন্য কম বেশি দায়ী। শেখ মুজিবুর রহমান ঘাতক ও দালালদের বিচার না করে ক্ষমা করেছিলেন, জিয়াউর রহমান তাদের রাজনীতি করার অধিকার দিয়ে নিজের মন্ত্রীসভায়ও ঠাই দিয়েছেন এবং বর্তমানে হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ একই নীতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। জিয়াউর রহমান এবং হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা খারিজ করেছেন এই ঘাতকদের সন্তুষ্ট করার জন্য। জিয়াউর রহমান নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার কথা বলেছেন। অথচ তিনিই শাহ আজিজুর রহমান, মাওলানা আবদুল মান্নান ও আবদুল আলীমের মতো দালাল ও ঘাতকদের মন্ত্রীসভায় স্থান দিয়েছেন। একই ভাবে বর্তমান রাষ্ট্রপতিও নিজে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবী করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা বলেন অথচ তিনিও দালাল ও ঘাতকদের মন্ত্রীসভায় স্থান দিয়েছেন; বরং দালালদের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর
পূর্বর্সরীকেও অতিক্রম করেছেন। ফলে এটা খুবই স্বাভাবিক যে এই সব সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস রচিত হবে সেখানে সত্য গোপন করা হবে, ঘতকদের আড়াল করা হবে।
’৭১- এ গণহত্যাযজ্ঞের সময় দালালরা মুক্তিযোদ্ধাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের চর’, ‘ব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ইত্যাতি আখ্যায় অভিহিত করলেও এগুলো দ্বারা মূলতঃ সাধারণ নিরপরাধ স্বাধীনতামনা বাঙ্গালীদেরকেই বোঝাত। সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল বড় জোর সোয়া লক্ষ, শহীদ হয়েছেন এর ক্ষুদ্র একটি অংশমাত্র। অথচ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে দালালরা দেশের সর্বত্র ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের সমূলে উত্খাত করার কথা ঘোষণা করে বেড়িয়েছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে যখন হানাদার বাহিনীর আকস্মিক আঘাতে বিপর্যস্ত প্রাণ ভয়ে ভীত নিরীহ জনসাধারণ পালিয়ে যাচ্ছিলেন, যখন মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিতভাবে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন নি, তখনও এই ঘাতকের দল সর্বত্র ‘দুষ্কৃতকারী’ নির্মূল করে বেড়িয়েছে। সুতরাং দালারদের ‘দুষ্কৃতকারী নির্মূল’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী উত্খাত’ ইত্যাদি কথার একটি মাত্র অর্থ হচ্ছে নিরপরাধ নিরস্ত্র অসহায় মানুয়ের নির্বিচার হত্যা।
এই গ্রন্থে দালাল হিসেবে তাদেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ’৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর কার্য়কলাপকে সমর্থন করেছেন, হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছেন, নিজেরা অংশ নিয়েছেন এবং যাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ’৭২ সালে দালালীর অভিয়োগে অভিযুক্ত করেছে। ’৭১ সালে অবরুদ্ধ ঢাকার জাতীয় দৈনিকসমূহে দালালদের কার্যকলাপ গুরুত্বের সঙ্গেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। এটা ঠিক যে সংবাদপত্রে তাদের নামই স্থান পেয়েছে যাদের নাম সংবাদ হওয়ার মতো গুরুত্ব বহন করত। এমনও দেখা গেছে কারো কারো দালালীর তত্পরতা ’৭১-এর সংবাদপত্রে লিপিবদ্ধ হয় নি কিম্বা ’৭২ সালে সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও তাদের বিরুদ্ধে দালালীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয় নি, অথচ পরবর্তীকালে এই সব পাতি দালালরা জাতীয় রাজনীতি মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাদের নাম এই গ্রন্থে উল্লেখ করা সম্ভব হয় নি। যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের চরিত্র নির্ণয়ের জন্য সেটুকু যথেষ্ট বলে আমরা মনে করি।
গ্রন্থে স্বাধীনতাবিরোধী মূল সংগঠনগুলির উত্পত্তি ও কার্যকলাপের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নেতৃবৃন্দের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরা সহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের নামের তালিকা এবং বর্তমান অবস্থান যথা সম্ভব পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে। মূল আলোচনায় নাম নেই বলেই কোন দালালের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকাকে লঘু করে দেখা ঠিক হবে না। পরিশিষ্টে নামের তালিকা দেয়া হয়েছে সংগঠন, দল বা গোষ্ঠী ভিত্তিতে। যারা এই সব সংগঠন বা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নন (যেমন শর্ষিণার পীর) এবং বর্তমানে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে বা দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কীর্তিকলাপ মূলগ্রন্থে রয়েছে। আমরা এ গ্রন্থ রচনায় ’৭১ এ ’৭২-এর সংবাদপত্র, সরকারী সার্কুলার ও গেজেটকে গুরুত্ব দিয়েছি, এবং এসব সূত্র থেকে প্রাপ্ত জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত দালাল ও ঘতকদের নাম ও কার্যকলাপ যতদূর সম্ভব উল্লেখ করেছি। যে সব ক্ষেত্রে সূত্রের উল্লেখ করা হয় নি; সে সবও উপরোক্ত উত্স থেকে প্রাপ্ত। এরপরও যদি এমন কারো নাম বাদ পড়েছে বলে জানতে পারি, যাদের বিরুদ্ধে দালালীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, অবশ্যই এই গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে তাদের নাম উল্লেখ করা হবে।
পুনর্বাসনের সাধারণ পটভূমি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রিতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সর্বত্র মানবেতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের সূচনা করে। নিরপরাধ নিরস্ত্র জনগনের উপর বর্বর বাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের সাথে যোগ দেয় বিহারীদের একটি বড় অংশ এবং এদেশে জন্মগ্রহণকারী কিছু বিশ্বাসঘাতক দালাল।
এই হত্যাকান্ডের খবর যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, তার জন্য পাক সরকার সর্বাত্মক প্রচেস্টা চালায়। সে সময় এখানে অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের সামরিক প্রহরাধীনে বিমান বন্দরে এনে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। যাবার আগে তাঁদের কাছ থেকে প্রায় সমস্ত নোট ও ফিল্ম ছিনিয়ে নেয়া হয়। এরপর থেকে বহির্বিশ্বে সংবাদ প্রেরণ এবং বিদেশী সাংবাদিকদের এদেশে আসার উপর কড়া সেন্সরশীপ আরোপসহ বিশ্ববাসীর কাছে গোপন করার জন্য সমস্ত প্রচেষ্টা চালানো হয়।
কিন্তু হত্যাযজ্ঞে এতই ব্যাপক ও ভয়াবহ ছিল যে তা চেপে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। যে সমস্ত বিদেশী সাংবাদিক আত্মগোপন করে বা অন্য কোন উপায়ে দেশের ভেতরে থেকে যেতে পেরেছিলেন তাঁরা এই হত্যাযজ্ঞের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন লিখতে থাকেন। এছাড়া সাংবাদিকসহ অন্যান্য য়ে সমস্ত আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দলকে খুনি চক্র ‘প্রদেশের অবস্থা স্বাভাবিক’ বলে দেখাবার জন্য নিয়ে এসেছিল, তাঁরাও হত্যাযজ্ঞের ভয়াভহতা চাক্ষুষ দেখে এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এ সমস্ত প্রতিবেদনের দু একটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করলেই বোঝা যাবে এই হত্যাযজ্ঞ কত ভয়াবহ ছিল। নিউজ উইক পত্রিকায় ২০ জুন সাংবাদিক ক্লিফটন লিখেছিলেন, ‘আমার কোন সন্দেহ নাই য়ে, পূর্ব পাকিস্তানের শত শত জায়গায় মাই লাই ও লিডিসের ঘটনা ঘটেছে- এবং আরো ঘটবে বলেই আমার ধারণা। দ্বিতীয় মাহাযুদ্ধে পদকপ্রাপ্ত জনৈক অফিসার গ্যালাঘার আমাকে বলেছেন, -‘আমি ফ্রান্সে যুদ্ধের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা– নরম্যান্ডির হনন কেন্দ্র দেখেছি- কিন্তু এগুলোর কাছে সে কিছুই নয়। কান্না চেপে আত্মসম্বরণ করতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।’(১)
আই, পি, এম কারগিলের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যাংক প্রতিনিধিদলের অন্যতাম সদস্য হেনডিক ভ্যানডার হেজিডেন হত্যাকান্ডের স্বরূপ প্রকাশের জন্য কুষ্টিয়া শহরের বর্ণনা দিয়ে তাঁর আনুষ্ঠানিক রিপোর্টে লেখেন, ‘শহরটিকে দেখাচ্ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত জার্মান শহরগুলোর মত। শহরের ৯০ ভাগ বাড়ি, দোকান, ব্যাংক পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আমরা যখন ঘুরছিলাম সবাই তখন পালাচ্ছিল। অবস্থাটা ছিল পারমাণবিক হামলার পরদিনের সকালের মত।’(২)
এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের বিবরণ জানতে পেরে সারা বিশ্বের সচেতন মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন। বিশ্বের বিভিন্ন নেতা গণহত্যার নিন্দা করে বক্তব্য রাখেন। এই প্রতিবাদের প্রকৃতি অনুধাবন করা যাবে জাতিসংঘের তত্কালীন মহাসচিব উথান্টের বক্তব্য থেকে। তিনি এই হত্যাকান্ডকে ‘ইতিহাসের অন্যতম করুণ ঘটনা এবং মানব ইতিহাসের অতি কলংকজনক অধ্যায়’ বলে আখ্যায়িত করেন।(৩)
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ইতিহাসের জঘন্যতাম হত্যাযজ্ঞে ক্ষরিত এক সমুদ্র রক্তে স্নাত হয়ে জন্ম হল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। মুক্তির আনন্দে উদ্বেল হল জনতা।
কিন্তু এই আনন্দ ম্লান হয়ে যায় বিজয় লাভের মুহূর্ত থেকেই। ১৬ ডিসেম্বর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যেই সারাদেশে অনুন্য পাঁচ হাজার বধ্যভূমি ও গণকবর আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তী দু’মাস ধরে চলতে থাকে গণকবর আবিষ্কারের এই ধারা। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে দেশের প্রত্যেক ইউনিয়নে গড়ে অন্ততঃ একটি গণকবর আবিষ্কৃত হয়।
সারাদেশে আবষ্কৃত বধ্যভূমিতে অসংখ্য বিকৃত লাশের সংবাদ পেয়ে সমস্ত বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। সমগ্র মানবতার বিরূদ্ধে এই অপরাধের প্রতিবাদ জানিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে থাকে শোকবার্তা। জাতিসংঘে গণহত্যার নিন্দা করে প্রস্তাব গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কায়রোতে আফ্রো-এশীয় গণসংস্থার সম্মেলনে বাংলাদেশে সুপরিকল্পিতভাবে নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত করার জন্য নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। মাদার তেরেসার নেতৃত্বাধীন ‘ক্রিসটাস’ সংস্থা থেকে বাংলাদেশের গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের নিন্দা করে নির্যাতিতাদের সহায়তার জন্য মাদার তেরেসাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে আসেন। বিভিন্ন বধ্যভূমিতে অকল্পনীয় নির্যাতনের চিন্হসহ অজস্র বিকৃত মৃতদেহ এবং হাড়-কঙ্কালের স্তুপ চাক্ষুষ দেখে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে যান। আন্তর্জাতিক রেডক্রস, প্রতিনিধিদল এসেছিলেন মূলতঃ যুদ্ধবন্দী এবং তাদের দেশীয় দোসরদের বিচারের বিষয়ে প্রভাবান্বিত করার জন্য। কিন্তু দেশজুড়ে অসংখ্য বধ্যভূমিতে হত্যাকান্ডের ভয়াবহতা দেখে তাঁরা নিজেরাই এদের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন।
বিশ্ব শান্তি পরিষদ প্রতিনিধি দলের নেত্রী মাদাম ইসাবেলা ব্লুম ২০/১/৭২ তারিখে সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে বাঙ্গালী হত্যাযজ্ঞের যে লোমহর্ষক নৃশংসতার স্বাক্ষর আমি দেখেছি তাতে আমি শোকাভিভূত ও সন্ত্রস্ত হয়ে গেছি। এই হত্যাকান্ড নাত্সী গ্যাস চেম্বারের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও অনেক বিভত্স।’ তিনি দেশে ফিরে গিয়ে পরিষদের সভাপতির কাছ এই গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবী জানাবেন বলে জানান। (আজাদ, ২২/১/৭২)
বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত দলটির অপর একজন সদস্য বলেন, ‘আমি যা দেখে এসছি তা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। আমাকে আজীবন এই স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে।’
স্বাধীনতাযুদ্ধের সকমর্থক মার্কিন সিনেটের ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য এ্যাডলাই স্টিভেনসন কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বধ্যভূমিগুলো দেখে এসে ৩০ জানুয়ারী বলেন, ‘বাংলাদেশে পাকবাহিনীর নৃশংসতা ছিল ভয়াবহ এবং মানবজাতির ইতিহাস তার কোন নজীর নেই। এই বর্বরতা মানুষের কল্পনাকেও ছড়িয়ে গেছে।’ (আজাদ, ৩১/১/৭২)
মার্কিন সিনেটের অপর সদস্য এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, ‘মানুষের মস্তিষ্কে এ’ধরনের বর্বরতার চিন্তা আসতে পারে এ’কথা ভাবতেও কষ্ট হয়।’ (আজাদ, ১৭/২/৭২)
ফরাসী সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো বলেন, ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাত্সীদের নৃশংসতার নিদর্শন আমি দেখেছি, কিন্তু এখানকার নিশংসতা তার চেয়ে অনেক বেশী।’ (আজাদ, ১৩/৩/৭২)
সারা দেশে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যথাযথ বিচারের মাধ্যমে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য দাবী ওঠে।
এই জঘন্য হত্যাকান্ডের খবর বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য এবং এর সাথে জড়িত পাক-সামরিক অফিসার ও তাদের এদেশীয় দালালদের বিচার করার জন্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাত্সীদের বিচারের উদ্দেশ্যে বার্টান্ড রাসেল, জ্যাঁ পল সার্ত, আঁদ্রে মালরো প্রমুখ বিশ্বখ্যাত ব্যাক্তিত্বের সমন্বয়ে যে ধরনের আন্তর্জাতিক কমিশন গঠিত হয়েছিল, সে ধরনের কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রকাশ্য বিচারের দাবী করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকেও আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য দাবী জানানো হয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য সদস্য এই হত্যাযজ্ঞকে নজীরবিহীন বর্বরতা বলে উল্লেখ করে এর বিচারের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা জেনেভা কনভেনশনের সুবিধা পাওয়ার অধিকার হারিয়েছে বলেও তারা মত প্রকাশ করেন।
কিন্তু এর ভেতর চলছিল ভিন্ন আর এক খেলা। স্বাধীনতাবিরোধী কুখ্যাত খুনী দালালদের জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ১৬ ডিসেম্বর থেকেই প্রচেষ্টা চালানো শুরু করে। ১৬ ডিসেম্বর থেকে কুখ্যাত খুনী এবং দালালদের জন্য একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায় জেলখানা। কুখ্যাত দালালদের কাছ থেকে সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ১১ হাজার লিখিত আবেদনপত্র পড়েছিল, তাদেরকে জেলখানায় সরিয়ে নেয়া জন্য। এদের বিচারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার কালক্ষেপণ নীতি গ্রহণ করেন।
১ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে মন্ত্রী পরিষদের এক বৈঠকে গণহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনের সেদ্ধান্ত নেয়া হয়। হাইকোর্টের কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত কোন বিচারপতি বা সমপর্যায়ের কোন মনোনীত ব্যক্তির নেতৃত্বে কমিশন পাকবাহিনী ও দালালদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের মৌখিক ও লিখিত সাক্ষত্কার গ্রহণ করে ব্যাপক রিপোর্ট পেশ করবেন বলে ঘোষণা করা হয়।
----------------------------------------------------------------------
(১) ‘বাংলাদেশের গণহত্যা দৈনিক বাংলা’, ১৬ জানুয়ারী ’৭২।
(২) প্রাগুক্ত।
(৩) প্রাগুক্ত।
‘দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে—’
শেখ মুজিবের প্রতিজ্ঞা
১০ জানুয়ারী পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে আসন শেখ মুজিবুর রহমান। ওই দিন রমনা রেসকোর্স ময়দানে ক্রন্দনরত অবস্থায় শেখ মুজিব বলেন, ‘বিশ্বকে মানবেতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক দল এই বর্বরতার তদন্ত করুক এই আমার কামনা।’ (দৈনিক বাংলা, ১১/১/৭২)
এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন সভায়, সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা কালে কিংবা দেশী-বিদেশী অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে সাক্ষাত্কারে গণহত্যার নিন্দা করে বাংলার মাটিতে দালালদের অবশ্যই বিচার করা হবে বলে বক্তব্য রাখেন।
১০ জানুয়ারীর জনসভাতেই তিনি বলেন, ‘যারা দাকলালী করেছে, আমার শত শত দেশবাসীকে হত্যা করেছে , মা বোনকে বেইজ্জতি করেছে, তাদের কি করে ক্ষমা করা যায়? তাদের কোন অবস্থাতেই ক্ষমা করা হবে না, বিচার করে তাদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে।’ এ জন্য দায়িত্ব সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়ার আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখিয়ে দিতে চাই শান্তিপ্রিয় বাঙালীরা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে জানে, তেমনি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।’ (প্রাগুক্ত)
১২ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করার পর শেখ মুজিব গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া যাবে না বলে দৃঢ়মত প্রকাশ করে বলেন, ‘লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কাহিনী আমারা শুনেছি, তবু বাংলার মানুষ এত নীচে নামবে না, বরং যা মানবিক তাই করবে, তবে অপরাধীদের আইনানুযায়ী অবশ্যই বিচার হবে।’ (দৈনিক বাংলা, ১৩/১/৭২)
১৪ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ অফিসে তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতিশোধ গ্রহণের পথ পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘দালালদেরকে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে।’ (পূর্বদেশ, ১৫/১/৭২)
৬ ফেব্রুয়ারী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দশ লক্ষ লোকের বৃহত্তম জন সমাবেশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘যারা গণহত্যা চালিয়েছে তারা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, এদর ক্ষমা করলে ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে না।’ (দৈনিক বাংলা, ৭/২/৭২)
ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারী জনসভায় তিনি বলেন, ‘বাংলার মাটিতেই খুনীদের বিচার হবে।’(দৈনিক বাংলা ২৩/২/৭২)
৩০ মার্চ চট্টগ্রামের জনসভায় গণহত্যাকারীদের ‘নমরুদ’ বলে আখ্যায়িত করে তিনি প্রশ্ন করেন দালালদের ক্ষমা করা হবে কি না, সমবেত জনতা হাত তুলে বলে ‘না,’ ‘না।’ (পূর্বদেশ, ৩১/৩/৭২)
৩১ মার্চ খুলনার জনসভায় শেখ মুজিব বলেন, ‘বর্বর হানাদার বাহিনীর সাথে স্থানীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, জামাত প্রভৃতি যোগ দেয়। তারা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যদি কেউ দালালদের জন্য সুপারিশ করতে আসে তবে তাকেই দালাল সাব্যস্ত করা হবে, দালালদের কখনোই ক্ষমা করে দেয়া হবে না।’ (পূর্বদেশ, ১/৪/৭২)
২৬ এপ্রিল তিনি দিল্লী স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘যারা গণহত্যা করেছে তাদের এর পরিণতি থেকে রেহাই দেয়া যায় না। এরা আমার ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করেছে। এদের ক্ষমা করলে ভবিষ্যত্ বংশধরগণ এবং বিশ্ব সমাজ আমাদের ক্ষমা করবেন না।’ (দৈনিক বাংলা, ৩০/৪/৭২)
৬ মে আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (এবিসি) সাথে এক টেলিভিশন সাক্ষাত্কারে শেখ মুজিব যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি অবশ্যই তাদের বিচার করব, এ ব্যাপারে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। যেখানে তারা ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করেছে সেখানে কোন দেশ কি তাদের ছেড়ে দিতে পারে? এই সাক্ষত্কারেই দালালদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দালালদের কেসগুলো একটি তদন্ত কমিশন কর্তৃক বিবেচিত হবে। আমরা তদন্ত করছি এবং নির্দোষ লোকদের ছেড়ে দিচ্ছি, অবশ্য যারা অপরাধ সংগঠনের জন্য দায়ী নিশ্চিতভাবেই তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।’ (আজাদ, ১৫/৫/৭২)
‘বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশ ১৯৭২’ : ঘাতকদের রক্ষাকবচ
শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারের অন্যান্য সদস্যদের এ ধরনে বক্তৃতা বিবৃতির পাশাপাশি চলতে থাকে দালালদের সুরক্ষার আয়োজন। বিভিন্ন মহল থেকে দালালদের বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত আদালোতের দাবীকে উপেক্ষা করে ২৪ জানুয়ারী জারী করা হয় ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’।দালালদের বিচারের জন্য এই আদেশ অনুযায়ী আসামীর ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করার অধিকার থাকলেও ফরিয়াদীকে ট্রাইব্যুনালের বিচার্য অপরাধের জন্য অন্য কোন আদালতের বিচার প্রার্থনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
গণহত্যাকারী ও দালাল নেতাদের সুকৌশলে রক্ষার জন্যই প্রণীত হয়েছিল এই আইন। কারণ আইনের ৭ম ধারায় বলা হয়েছিল, থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি যদি কোন অপরাধকে অপরাধ না বলেন তবে অন্য কারো কথা বিশ্বাস করা হবে না, অন্য কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার হবে না ট্রাইব্যুনালে। অন্য কোন আদালতেও মামলা দায়ের করা যাবে না। দালালদের আত্মীয়-স্বজনের ওসিকে তুষ্ট করার মত আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল, স্বজন হারানো নির্যাতিত দরিদ্র জনসাধারণের তা ছিল না।
২৮ মার্চ দালাল আইনে বিচারের জন্য সারাদেশের সমস্ত জেলায় মোট ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যেসব অপরাধের বিচার করা হবে তা অন্য কোন আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়। এপ্রিল মাস থেকে দালাল আইনের বিচার কাজ শুরু হয়।
দালাল আইন কুখ্যাত খুনী দালালদের জন্য রক্ষাকবচ হিসাবে দেখা দেয়। যে শান্তি কমিটির মূল কাজ ছিল নিরপরাধ বাঙ্গালীদের হত্যা তালিকা প্রস্তুত করা এবং তাদের হত্যার জন্য পাকসেনাকে সহায়তা করা, তার সদস্যরা সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদন্ড পেয়ে নিস্তার পেয়ে যায়। শান্তি কমিটির নিজস্ব ঘোষণা অনুযায়ীই এর মূল কাজ ছিল তাদের ভাষায় ‘দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় চরদের তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাদেরকে নির্মূল করা’, সুতরাং যে কোন দালালের সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার জন্য তার শান্তি কমিটির সদস্য প্রমাণিত হওয়াই ছিল যথেষ্ট।
৩০ নভেম্বর ১৯৭৩ তারিখে তথাকথিত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে ৩১ অক্টোবর ১৯৭৩ পর্যন্ত দালাল-অধ্যাদেশে অভিযুক্ত মোট ৩৭ হাজার ৪ শত ৭১ জনের মধ্যে ২ হজার ৮ শত ৪৮ জনের মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল ৭ শত ৫২ জন, বাকী ২ হাজার জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। এর মধ্যে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় মাত্র একজন রাজাকারকে। সুতরাং সহজেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি গণহত্যাযজ্ঞের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে দালালরা কোন মানুষকে হত্যা করে নি, নির্যাতিত লক্ষ কোটি মানুষের জবানবন্দী কি সবই মনগড়া গল্প ছিল? নারকীয় বধ্যভূমিগুলিতে প্রাপ্ত বহুবিধ নৃশংস নির্যাতনের চিত্রসহ বিকৃত লাশগুলির সবই কি ছিল শুধু পাক সেনার শিকার?
দালাল আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনালের বিচারও ছিল প্রহসন মাত্র। একটি দৃষ্টান্ত এ প্রসংঙ্গে দেয়া যেতে পারে। সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের অপহরণকারী আল বদরটির বিরুদ্ধে হত্যার উদ্দেশ্যে শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণের অভিযোগ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল, কিন্তু তবু তাকে মাত্র ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। গণহত্যার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর ইত্যাদি দলে যোগদানকারী ব্যক্তিদের এইভাবে লঘু শাস্তি দিয়ে কিছু দিনের জন্য কারাগারে রেখে বিক্ষুব্ধ জনতা এবং তাদের হাতে নির্যাতিতদের রোষানল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
দালাল রক্ষার এই ষড়যন্ত্র কুখ্যাত দালালদের তথাকথিত বিচার হওয়ার পূর্বে জনসাধারণের কাছে ধরা পড়ে নি। তবে সচেতন বুদ্ধিজীবী শেণী প্রথম থেকেই এই চক্রান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। এরপর যখন দেখা গেল সরাসরি গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী দালালরা নামমাত্র শাস্তি পেয়ে নিষ্কৃতি পাচ্ছে তখন এ ব্যাপারে সচেতনতা আরো বৃদ্ধি পায়।
২৩ জুলাই ১৯৭২ তারিখে দৈনিক বাংলায় এ বিষয়ে ‘দালাল আইন সংশোধনের প্রয়োজন’ শীর্ষক একটি রিপোর্টে লেখা হয় — ‘দেশ স্বাধীন হবার পর দালাল বলে যাদের আটক করা হয়েছে তদের শতকরা ৭৫ জনেরই মুক্তি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এই বিপুল সংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
‘পুলিশের সংখ্যা এমনিতেই অপ্রতুল। তদুপরি কোলাবরেটরস অ্যাক্ট-এ অভিযোগ তদন্তের ভার দেয়া হয়েছে শুধু থানার ওসিকে। কিন্তু ওসির পক্ষে একা অসংখ্য মামলার তদন্ত করা এক প্রকার অসম্ভব।......
‘এ ছাড়া দালাল আইন সম্পর্কেও কিছু বক্তব্য রয়েছে আইন বিশেষজ্ঞদের। তাঁরা বলেছেন, দালাল আইন করা হয়েছে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার জন্য। কাজেই সে অপরাধ প্রমাণের জন্য অনুসরণ করতে হয় একশ বছরের পুরনো ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট’। এই অ্যাক্ট হয়েছে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার জন্য। কাজেই বিশেষ পরিস্থিতির অপরাধের প্রমাণের জন্য প্রণীত এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুসরণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে নানা জটিলতা। ফলে অপরাধ প্রমাণ করা হয়ে উঠেছে অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য।......
‘একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে পরিষ্কার ভাবে। ধরা যাক একজন রাজাকার অপহরণ করেছে কোন এক ব্যক্তিকে, তার পর থেকে সে ব্যক্তির আর সন্ধান মেলেনি। এই অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে এই সিদ্ধান্ত করা যায় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু যদি সেই রাজাকারটির বিরুদ্ধে মামলা চলে দালাল আইনে, তবে তার বিরুদ্ধে আনা যাবে না হত্যার অভিযোগ। অভিযোগ আনা হবে হত্যার জন্যা অপহরণ করা হয়েছে। কারণ এভিডেন্স অ্যাক্টে হত্যার চাক্ষুষ সাক্ষ্য প্রমাণ না এনে খুনের অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং এক্ষেত্রে যদিও লোকটি খুন হয়েছেন তবুও আইনের মার-প্যাচে আসামীকে খুনী প্রমাণ করা যাবে না।’
বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হয় এ বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য। ৪ আগস্ট ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভা সাব কমিটির এক বৈঠকে অপরাধীধের সর্বোচ্চ শাস্তি দানের বিধান রাখার জন্য দালাল আইন সংশোধনের বিষয় নিয়ে আরোচনা করা হয়। তবে বৈঠকে কোন সদ্ধান্ত নেয়া হয় নি।
এইভাবে কালক্ষেপণের খেলা চলতে থাকে। ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলই তত্কালীন আইন মন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর গণহত্যাকারীদের সহায়তাকারীদের বিচারের জন্য রাষ্ট্রকে ক্ষমতা দেবার উদ্দেশ্যে আনীত সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেন। বিলটিতে বাংলাদেশ সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে গণহত্যাকারীদের দোসরদের বিচার করার জন্য রাষ্ট্রকে নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেবার কথা বলা হয়।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা : শেখ মুজিবের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর একটি আকস্মিক সরকারী ঘোষণায় দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত এবং বিচারাধীন সকল আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ইতিপূর্বেকার সমস্ত প্রতিশ্রুতি, জনসভায় ক্রন্দন, মানব সমাজ ও ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকার ভীতি প্রকাশ করে দেয়া বক্তব্য প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি বিস্মৃত হয়ে শেখ মুজিবর রহমান ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ নির্দেশ দেন যেন এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত দালালকে ছেড়ে দেয়া হয়, যাতে তারা দেশের তৃতীয় বিজয় দিবস পালনের উত্সবে শরীক হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এই দালালদের দেশ গড়ার কাজে সামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এবং শান্তি ও কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার চক্রান্তকারী দালালসহ মূল স্বাধীনতা বিরোধীরা জেল থেকে বেরিয়ে আসে।
এভাবেই মানবেতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড পরিচালনাকারী উম্মাদদের আবার স্বজন হারানো জনতার মাঝে ছেড়ে দেয়া হয়। এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও সরকারী গেজেটে আত্মগোপনকারী দালালদের নাম ঠিকানাসহ আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ এবং অন্যথায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুঁশিয়ারী জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারী করা সমন প্রকাশিত হতে থাকে, কারণ ইতিমধ্যেই তা মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল।
একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের কেন ক্ষমা করা হল এ নিয়ে আওয়ামী লীগ মহল ও বিরোধী মহলের ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। আওয়ামী লীগের আবেগাক্রান্তরা মনে করেন দালালদের ক্ষমা করাটা ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর মহনুভবতা’, দালালদের পুনর্বাসনের জন্য তাঁকে কোন ভাবেই দায়ী করা যাবে না। অপেক্ষাকৃত যুক্তিবাদীদের বক্তব্য—পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালীদের উদ্ধার করার জন্য নাকি দালালদের ক্ষমা করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। বিরোধী পক্ষ অবশ্য এ যুক্তি খন্ডন করে বলেছেন, আটকে পড়া বাঙ্গালীদের মুক্তির জন্য ৯৬ হাজার যুদ্ধবন্দী পাক বাহিনী যথেষ্ট ছিল। বিরোধী পক্ষের কেউ এভাবেও মুল্যায়ন করেছেন—‘........আওয়ামী লীগের মধ্যে সামগ্রিকভাবে যদি সাম্প্রদায়িক, ভারত ও সোভিয়েত বিরোধী ও মার্কিনপন্তী শক্তি সমূহের বৃদ্ধি না হতো তাহলে এই ক্ষমা প্রদর্শন আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা সম্ভব হতো না। এই পরিবর্তন যদি না ঘটতো তাহলে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭২ সালের প্রথমে যাদেরকে বাংলাদেশের ‘জাতশত্রু’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিলো, সেই জাতশত্রুদেরকে দেশগড়ার কাজে আহ্বান জানানো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা কিছুতেই সম্ভব হতো না।’ (বদরউদ্দিন উমর : যুদ্ধোত্তর বালাদেশ, পৃ:১১৯। প্রথম প্রকাশ : ঢাকা, মার্চ ১৯৭৫)
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবর রহমান দারলালদের ক্ষমা করার ক্ষেত্রে মহনুভবতা দেখাতে পেরেছেন শ্রেণীস্বার্থ অভিন্ন বলে। ’৭১ এর এই নৃশংস ঘাতকদের সঙ্গে এক যুগ পরেও আওয়ামী লীগের সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের অবনতি যে ঘটেনি গত কয়েক বছরে তাদের কার্যকলাপই সেটা পমাণ করেছে। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার নামে আওয়ামী লীগ জামাতে ইসলামের মতো ঘাতকদের দলকে শুধু রাজনৈতক মর্যাদাই প্রদান করে নি, জামাতের নতুন করে শক্তিবৃদ্ধির পথও প্রশস্ত করেছে।
সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে শহীদ পরিবারবর্গ
’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের মাতা, পিতা, স্ত্রী, ও পুত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে কিভাবে দেখেন ঢাকার একটি সাপ্তাহিকে পরবর্তীকালে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা রুমির মা লেখিকা জাহানারা ইমাম বলেছেন, ‘গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যায় যাদের ভূমিকা সস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পর পরই তাঁদের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সাধারণ ক্ষমার জন্য তা হয় নি। তত্কালীন সরকারের সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক একটি ভুল। সেদিন ক্ষমা ঘোষণা না করা হলে ঘাতকরা নিজেদের সমাজে পুনর্বাসিত করার সুযোগ পেত না।.......
‘প্রখ্যাত সাংবাদিক শহীদ শহীদুল্লাা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার বলেন, বর্তমানে রাজাকার, আল বদরদের যে দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে তা শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমারই ফল। ওই ক্ষমা ছিল বিচার-বুদ্ধি হীন। সেদিন সরকার যদি ঘাতকদের বিচার করে সাজা দিত, তাহলে আজ এ অবস্থা হত না।
‘পান্না কায়সার বলেন, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোন নেতা যুদ্ধে আপনজন হারান নি। ফলে স্বজন হারানোর ব্যথা তাদের জানা ছিল না। ঘাতকদের তারা সহজেই ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলেন। তাই আজ খালেকের মত ঘাতকরা বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং নতুন হত্যার ইন্ধন যোগাচ্ছে। আমার মেয়ে যখন ঘাতক খালেকের বই পড়ে নানা প্রশ্ন করে, আমি উত্তর দিতে পারি না।...
‘দেশ স্বাধীন হবার একদিন আগে, ১৫ ডিসেম্বর আলবদর, রাজাকাররা এক পরিবারের তিন সহোদর ভাইকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর, যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের দিনে রায়ের বাজার বধ্যবূমিতে তিন ভাইয়ের লাশ পাওয়া যায়। এই তিন ভাই হচ্ছেন শহীদ বদিউজ্জামান বদি, শহীদ শাহজাহান ও শহীদ করিমুজ্জামান ওরফে মল্লুক জাহান।
‘তিন শহীদ ভাইয়ের পিতা-মাতা অনেক আগেই মারা গেছেন। এখন শুধু শহীদ বদি’র বিধবা স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে বেঁচে আছে। অপর দু’ভাই অবিবাহিত ছিলেন। বর্তমানে শহীদ বদি পরিবাদেরর সার্বিক দেখা শোনা করেন তাদের ফুপাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হুদা। তিনি ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের অধীনে যুদ্ধ করেছেন।
‘শহীদ বদি পরিবাবেরর মুখপাত্র হয়ে মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হুদা আওয়ামী লীগ সরকারের সাধারণ ক্ষমা সম্পর্কে বলেন, রাষ্ট্র প্রধান যে কাউকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু যারা লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী লোককে হত্যা করেছিল তাদের ক্ষমা করে দেয়া অমার্জনীয় অপরাধ ছিল। ছিল একটি চরম ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, শুধু ক্ষমা নয়, ঐসরকার শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাও প্রদর্শন করেনি।
‘সাধারণ ক্ষমার কারণে ৭১-এর ঘাতকরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে—এ কথা উল্লেখ করে শামসুল হুদা বলেন, এই দেশ যদি সত্যি স্বাধীন হেয়ে থাকে, তাহলে এই স্বাধীন দেশে ঘাতকদের রাজনীতি করার অধিকার বন্ধ করে দিতে হবে।
‘দশম শ্রেণীর ছাত্র শহীদ বদির পুত্র তুরানুজ্জামানের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধ, আল বদরদের হত্যাকান্ড সবই একটি ধোঁয়াটে ব্যাপার। কিছুটা বিভ্রান্তও সে। তবে ১৬ বছরের তুরান এ কথা বলেন যে, আমার পিতার হত্যাকারীদের বিচার না হওয়ায় আমি স্তব্ধ।
‘ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার ও প্রগতিশীল আন্দোলণের অন্যতম সৈনিক শহীদ ডাঃ মর্তুজার স্ত্রী মিসেস মর্তুজা বলেন, যাদের প্রাণ গেছে , তাদের আত্মীয়- স্বজনরাই বুঝতে পেরেছেন, শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমার মর্মান্তিক মর্ম।
‘স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রারম্ভে হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাতে নিহত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙারোর একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানের অমর সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা মাহমুদ বলেন, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা কোন ভাবেই উচিত হয় নি। সেদিন সাধারণ ক্ষমা না করা হলে, অন্তত: আমার স্বামীকে হত্যা করে কোথায় দাফন করা হয়েছিল তা জানতে পারতাম। কিন্তু সাধারণ ক্ষমার ফলে আমার স্বামীর বধ্য ভূমির ঠিকানা পাই নি।
‘তিনি বলেন, ঘাতকদের অনেকেকে আমরা চিনি। সেদিন যদি তাদের ফাঁসি দেয়া হতো তাহলেও কিছুটা শান্তি পেতাম । অন্তত: বুঝতাম যে, হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। তবে আখনও তাদের শাস্তি দেয়া যায়। আমি আশা করবো সরকার এটা বিচনা করবেন। মিসেস সারা মাহমুদ ঘাতকদের বর্তমান তত্পরতা সম্পর্কে বলেন, ’৭১ সালে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মিলে যারা একের প এক হত্যাকান্ড চালিয়েছে, তারাই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একইভাবেব কাজ করছে। আর এটা ঐ সাধারণ ক্ষমারই ফল।
‘শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জণ হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস মনোয়োরা চৌধুরী বলেন, ঘাতকদের সাধারণ ক্ষমা করা হবে তা আমরা ভাবরতই পারিনি। কিন্তু সরকার সাধারণ ক্ষমা করে দিলেন। আমরা ভেবেছিলাম শেখ মুজিবুর বহমান ঢাকায় এসে ঘাতকদের বিচার করবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। শেখ মুজিব তো ব্যক্তিগতভাবেও আমদের চিনতেন। সে চেনা-জানাটুকুও কাজে লাগালো না।
‘স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতে নিহত জ্যোতির্ময় গুহ ঠকুরতার বিধবা স্তী বাসন্তী গুহ ঠকারতা সাধারণ ক্ষমা সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন যে, ১শ’ ৯৫ জন যুদ্ধ অপরাধী পাক সামরিক অফিসারদের কোন বিচার হলো না? শেখ মুজিব তো বহুবার বললেন, যুদ্ধ অপরাধী পাক সামরিক অফিসারদের বিচার করবেন। কিন্তু পারলেন না। আবার তিনি এ দেশীয় ঘাতকদেরও ক্ষমা করে দিলেন। আর এই ক্ষমাটাই সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। সেদিন যদি ক্ষমা না করে অন্তত: দু’একজন ঘাতকেরও যদি সাজা হতো তাহলে অনেক শহীদ পরিবারই শান্তি পেতেন। তাছাড়া ঘাতকরাও আজ আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারতো না।
‘শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হকের স্ত্রী বেগম সুরাইয়া খানম বলেন, ঘাতকদের আমরা তো ক্ষমা করিনি। ক্ষমা করেছে সরকার। আমরা ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু তা পাইনি। এতে বছর পরে বিচার চাইবোই বা কার কাছে?’
‘শহীদ অধ্যাপক মোহাম্মদ সাদেকের স্ত্রী শামসুন্নাহার হতাশায়, ভয়ে কাতর। তিনি গভীর উদ্বেগ নিয়ে মেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমা সম্পর্কে বলেন, যাদের ক্ষমা করা হয়েছে তাদেরকে আমরা ঘৃণার চোখে দেখি। সেই ক্ষমার জোরে আজ সেই সব দালাল রাজাকাররা এখন আমাদের বাড়ি থেকে উত্খাতের চেষ্টা করছে।
‘তিনি বলেন, সাধারণ ক্ষমা একটা গুরুতর অপরাধ ছিল। সে সব ঘাতককে আমরা সবাই চিনি এবং জানি। তারা আমাদের চারপাশেই আছে। কিন্তু আমাদের করার কিছুই নাই।
‘এদেশের সংবাদপত্র জগতের উজ্জল ব্যক্তিত্ব এবং দৈনিক ইত্তেফাকের ‘মঞ্চ নেপথ্য’ কলামের লেখক সিরাজউদ্দিন হোসেনের জ্যৈষ্ঠ পুত্র শাহীন রেজা বলেন, শুধু সাধারণ ক্ষমা নয়, এর আগে বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছিল। হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সুকৌশলে রেহাই দেয়া হয়। অথচ যাদের বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডের কোন প্রমাণ ছিলনা তাদেরকে জেলে ঢোকানো হয়। এছাড়াও যারা হত্যার মূল পরিকল্পনা করেছিল তারাও অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় সকল দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এরকম প্রহসনমূলক বিচারর পর আবার আসলো সাধারণ ক্ষমা।
‘শাহীন রেজা বলেন, এ ধরনের হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এর সাথে একমাত্র তুলনা হয় জার্মান একনায়ক হিটলারের ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের হত্যাকান্ডের। অথচ তত্কালীন সরকার জঘন্য হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিলেন। এটা অত্যন্ত গর্তিত কাজ হয়েছিল। আর এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তত্কালীন সরকারের অদুরদর্শিতাই প্রমাণিত হয়েছিল।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছিল বলেই আজ তারা সমাজ ও রাজরীতিতে পুনর্ববাসিত হয়েছে।
‘ইউনিট কমান্ডার শহীদ শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহের বাকির বৃদ্ধ পিতা শেখ মোহাম্মদ আবদুল বারী বলেন, শহীদদের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতে আওয়ামী লীগ সরকার ’৭১-এর ঘতকদের ক্ষমা করে দিল। এই ক্ষমা ছিল এক অদ্ভুত খেয়ালীপনা। পৃথিবীতে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। খুনীদের ক্ষমা করে দিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে তা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত সাধারণ বিষয় যে, যারা হত্যা করে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি। আর এই না হওয়াটা অমার্জনীয় অপরাধ হয়েছে।’(বিচিত্রা:স্বাধীনতা দিবস ’৮৭ বিশেষ সংখ্যা, পৃ: ২৮-৩৩)
মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়ার অবদান: ঘাতক ও দালালদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হবার পর রুশ-ভারত বিদ্বেষী, শার্কিনপন্থী আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় আসেন। এ’সময় বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বদলিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার এবং দালালীর কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলে। তবে এই সরকার ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় তা কার্যকরী করে যেতে পারে নি। ১৯৭৫ এর ৭ই নভেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে মোশতাক সরকারের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারী মাসে নতুন সামরিক সরকার একটি বিশষ অধ্যাদেশ জারী করে দালাল আইন তুলে নেয়।
১৯৭৬ সালের জুন মাসে জিয়াউর রহমান যখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, তখন জারি হয় ‘রাজনৈতিক দলবিধি’ নামে এক অভিনব অধ্যাদেশ। এতে বলা হয় কোন দল যদি রাজনীতি করতে চায় তাহলে সরকারের দেয়া কতিপয় শর্তপূরণ সাপেক্ষে তারা রাজনীতি করতে পারবে। এই শর্ত পূরণ করে রাজনীতির বৈধ লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য দালালরা বিশেষভাবে তত্পর হয়। জামাতে ইসলামীর ঘাতকরা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ এবং অন্যান্য দালালরা মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম সহ কয়েক ডজন পার্টিতে সংগঠিত হয়। বাংলাদেশে মৃতপ্রায় মৌলবাদী রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ ছিল সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়া। ফলে ’৭১ এ বাঙ্গালী হত্যায় নেত্যত্ব দেয়ার কারণে যে সমস্ত দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেগুলি পুনরুত্থিত হওয়ার সুযোগ পায়। যাদের রক্তে স্বাধীন হয়েছিল এই দেশ, তাদের খুনীরা এ দেশে রাজনীতি করার হারানো অধিকার ফিরে পায়। ইতিপূর্বে ’৭৬ সালের প্রথম দিকে একটি বিশেষ মহল থেকে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা এবং পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন গঠনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। এই দাবীর সপক্ষে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ গোলাম তওয়াব এবং গোপনে সংগঠিত জামাতে ইসলামী এক গণজমায়ে ও বিক্ষোভের আযোজন করে।*
আওয়ামী লীগ সরকার দালালদের পুনর্বাসরন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও স্বাধীনতাবিরোধী খুনীদের সরকারী উচ্চপদেআসন দেয় নি। জিয়াউর রহমান এসে শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার, আল বদরদের নিয়ে দল গঠন করেন। একজন মুখ্য দালাল শাহ আজিজুর রহহমানকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। নিরপরাধ বাঙ্গালীদের বেয়নেট চার্জ করে এবং লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত আবদুল আলিমের মত খুনীসহ বহু দালালকে মন্ত্রীসভায় নেয়া হয়।
দালাল পুনর্বাসনের এই ধারা আজও চলছে। আজও মন্ত্রীসভায় স্থান পাচ্ছে অসহায় বাঙ্গালীদের হত্যাকারী খুনী দালালরা।
বিশ্বের ইতিহাসে গণহত্যা পরিচালনাকারী দালালদের এভাবে ‘ক্ষমা’ করে দিয়ে জনসমাজে বিচরণের জন্য ছেড়ে দেওয়ার অপর কোন নজীর রয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। আমাদের জানা নেই কোন দেশ স্বাধীনতার এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার আগে স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। বিশ্ব জুরী পরিষদ আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধপরাধীদের বিচার করার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। নাত্সী যুদ্ধপরাধীর কঙ্কাল পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে সত্যিসত্যিই তা কথিত যুদ্ধাপরাধীর কঙ্কাল কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য। বেঁচে থাকলে তাদের নিশ্চয়ই বিচার হত। গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য তাদের এই আগ্রহ ও সতর্কতা কোন বিদ্বেষ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবসমাজের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপরাধর সুবিচার এবং এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধের জন্যই এই ব্যবস্থা।
-------------------------------------------------------------------
*বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান, ডঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৩ বর্ষ সংখ্যা, ৩০ নভেম্বর ’৮৪, পৃঃ—২৩।
পুনর্বাসিত শান্তি কমিটির সদস্যবৃন্দ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পাক সামরিক বাহিনী এদেশে বিশ্বের নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ এতটা ভয়াবহভাবে চালাতে পারত না, যদি না তারা এদেশীয় কতিপয় দালাল ও বিশ্বাসঘাতককে দোসর হিসেবে পেতো। এই বেঈমানরা আগে থেকেই এদেশে ছিল।
পাকবহিনী তাদের এই গণহত্যাযজ্ঞে সক্রিয় সহায়তার জন্য স্বাভাবিকভাবেই এদেশীয় জনবিচ্ছিন্ন, উগ্রপন্থী ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলিকে দোসর করে নেয়। ২৫ মার্চের কালরাতের আগেই এসমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পাক সামরিক জান্তার সাথে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করে। ২৫ মার্চের পর রাজধানী ঢাকায় স্বাধীনতাকামী জনগণের প্রকাশ্য আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গেলে এই দালালরা প্রকাশ্যে মাঠে নেমে পড়ে।
৪ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে, সামরিক বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সমাধা হবার পর, ‘খ’ অঞ্চলের আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ লেঃ জেঃ টিক্কা খানের সাথে পি ডি পি প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে ১২ জন বিশিষ্ট দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী নেতা সাক্ষাৎ করেন। এ প্রতিনিধি দলে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আজম, মৌলভী ফরিদ আহমদ, খাজা খায়েরুদ্দিন, এ কিউ, এম, শফিকুল ইসলাম, মাওলানা নুরুজ্জামান প্র্রমুখ। প্রতিনিধিদল টিক্কা খানকে ‘অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসনকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস এবং জনগণের মন থেকে ভিত্তিহীন ভয় দূর করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়।
(পূর্বদেশ, ৫/৪/৭১)
শান্তি কমিটি গঠন
টিক্কা খান এই প্রতিনিধিদলের সহযোগিতার প্রস্তাবকে ধন্যবাদ জানিয়ে ‘দুষ্কৃতকারী ও সমাজবিরোধীদের আশ্রয় না দেওয়া এবং সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কাছে এদের সম্পর্কে সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য’ উপদেশ দেন। সাক্ষাত্কারে টিক্কা খান তাদেরকে ‘শুধু বক্তৃতা বিবৃতির শধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের অখন্ডতা রক্ষায় ফলপ্রসূ কাজ করতে নির্দেশ দেন।’ বৈঠক শেষে নেতৃবৃন্দ রেডিওতে ভাষণ দিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তার প্রতিজ্ঞা করেন। (প্রাগুক্ত)
এই সময়ে শান্তি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে একটি অসুবিধা উপস্থিত হয়। টিক্কা খান চেয়েছিলেন প্রদেশের পরস্পরবিরোধী উগ্র ডানপন্থী দলগুলো একই প্লাটফর্মে থেকে সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞে সহায়তা করবে। কিন্তু সর্বাধিক সংগঠিত এবং চরমপন্থী জামাতে ইসলামী দলের সাথে অন্যান্য মুখ্য দল মুসলিম লীগ (কাইন্সিল, কাইউমপন্থী ও কনভেনশন—সকল গ্রুপ), পিডিপি, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলের নেতৃত্বের কোন্দল দেখা দেয়। বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষিত ও অতি উচ্চাভিলাষী মৌলভী ফরিদ আহমদ ও নুরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন একটি দল জামাতের নেতৃত্বে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে ৬ এপ্রিল তারিখেই গোলাম আজম পুনরায় একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন।
এই প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী। পরস্পরবিরোধী দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টির জন্য একজন মুরুব্বী স্থানীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল, হামিদুল হক চৌধুরী সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন।
হামিদুল হক চৌধুরীর মধ্যস্থতায় সাময়িকভাবে দালালদের অন্তর্কলহের অবসান হয় এবং সম্মিলিতভাবে নাগরিক শন্তি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ৯ এপ্রিল টিক্কা খান ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি, এ, সিদ্দকীর কাছে প্রাদেশিক গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পরই ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট ঢাকা নাগরিক শন্তি কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। সংবাদপত্রে শান্তি কমিটি গঠনের খবর প্রকাশিত হয় ’৭১-এর ১০ এপ্র্রিলের পরিবর্তে ১১ এপ্রিল। খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে গঠিত ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে শহরের শন্তি কমিটিগুলো কাজ করবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়, কমিটিকে আরও সদস্য কো-অপ্ট করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। কমিটি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৪ এপ্রিল বায়তুল মোকাররম থেকে চকবাজার মসজিদ পর্যন্ত একটি মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
শান্তি কমিটি গঠিত হবার পর পরই এতে নেতৃত্বের কোন্দল উপস্থিত হয়, যার ফলে পরদিন ১০ এপ্রিল তারিখেই বিরোধী অংশটি মৌলভী ফরিদ আহমদকে সভাপতি করে নয় সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে মূল শান্তি কমিটি থেকে বেরিয়ে যায়। পাক্তন প্রদেশিক পি পি পি প্রধান নুরুজ্জামানকে এই স্টিয়ারিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। নুরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিটির ১০ এপ্রিল সভায় যারা কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তারা হচ্ছেন কোরবান আলী বার এট-ল, ওয়াজিউল্লাহ, আজিজুর রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, কাজী ফিরোজ সদ্দিকী, এ, কে, নুরুল করিম এবং নব নির্বচিত এম, পি, এ মাহমুদ আলী সরকার।
স্টয়ারিং কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই কমিটি পূর্ব পাকিস্তান শন্তি ও কল্যাণ কাউন্সিল গঠন করে প্রতিটি জেলায় এর শাখা প্রতিষ্ঠা করবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার শান্তি রক্ষা, জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, ভারতীয় বেতরের মিথ্যা প্রচারণার স্বরুপ উন্মোচন করা, এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কার্যকরীভাবে মোকাবিলা করতে জনগণকে পস্তুত করতে এই কাউন্সিল কাজ করবে।’ (পূর্বদেশ, ১১/৪/৭১)
শান্তি কমিটির তৎপরতা
মূল শান্তি কমিটির উদ্যোগে ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৩ এপ্রিল জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে একটি মিছিলের আয়োজন করা হয়। এই মিছিল পুরনো ঢাকার প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে চকবাজার মসজিদের সামনে দিয়ে অগ্রসর হয়ে নিউ মার্কেটের মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন শান্তি কমিটির আহব্বায়ক খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আজম, শফিকুল ইসলাম, পীর মোহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া), সৈয়দ আজজুল হক (নান্না মিয়া), মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, এ, টি, সাদী প্রমুখ।
শহরের বিভিন্ন অংশ থেকে বিহারী ও দালালরা ব্যান্ড পার্টি, পাকিস্তানের পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদি হাতে নিয়ে বায়তুল মোকাররমে এসে জড়ো হয়। একটি মিছিলের সামনে একজন ঘোড়ার পিঠে করে পাকস্তানের পতাকা বয়ে নিয়ে আসে। তুমুল বর্ষণের মধ্যে মিছিলকারীরা মিছিলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা রকম শ্লোগান দেয়। ‘ভরতের দালালী চলবে না, ওয়াতানকে গাদ্দারোসে হুশিঁয়ার, আমরিকি সমরাজোসে হুশিয়ার, সংগ্রাম না শান্তি—শান্তি, শান্তি, পাকিস্তানের উত্স কি—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, পাকিস্তানী ফৌজ জিন্দাবাদ, কায়দে আজম— জিন্দাবাদ, ইন্দিরা গান্ধী—মুর্দাবাদ, ইয়াহিয়া খান—জিন্দাবাদ, টিক্কা খান—জিন্দাবাদ, আল্লাহতা’লা মেহেরবান— ধংস কর হিন্দুস্তান,’ ইত্যাদি ছিল মিছিলের শ্লোগান।
মিছিলে বাংলা, উর্দ্দু ও ইংরেজীতে লেখা অসংখ্য ফেস্টুনও ছিল। “পাক চীন—জিন্দাবাদ, দুস্কৃতিকারীরা দুর হও, মুসলীম জাহান, এক হও, ভারতকে—খতম কর, ভারতকে ধংস কর, পাকিস্তানকে রক্ষা কর’ ইত্যাদি ছিল ফেস্টুনের ভাষা। মিছিলকারীরা ব্যানার, ফেস্টুন ছাড়াও বহন করে ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান, আল্লামা ইকবাল, লিয়াকত আলী খান, ফাতেমা জিন্নাহ, সর্দার আবদুর রব নিশতার, মির্জা গালিব, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমুখের ছবি।
মিছি শেষে খাজা খয়েরুদ্দিনের বক্তৃতার পর মোনাজাত পরিচালনা করেন গোলাম আজম। তিনি ‘পাকিস্তানের সংহতি ও অশেষ ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত পাকিস্তানের বুনিয়াদ যেন অটুট থাকে’ তার জন্য দোয়া করেন। এছাড়া ‘ভারতের ঘৃণ্য হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তান যেন উপযুক্ত জবাব দিতে পারে’ সে জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করেন। মোনাজাতের পর সমাবেশের সমাপ্তি ঘটে। (পূর্বদেশ, ১৪/৪/৭১)
সমাবেশ সমাপ্ত হবার পর মিছিলকারীরা আজিমপুর কলোনী, শান্তিনগর, শাঁখারী বাজার প্রভৃতি স্থানে বাঙ্গালীদের ঘরবাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বেশ কিছু বাঙ্গালীকে ধাওয়া করে হত্যা করে রাস্তার পাশে লাশ ফেলে রাখা হয়।
১৩ এপ্রিলে সমাবেশ এবং তার পরের ভাংচুরের মাধ্যমে শান্তি কমিটি কাজ শুরু করে। পরদিন ১৪ এপ্রিল নাগরিক শান্তি কমিটির বৈঠক বসে। বৈঠকে কমিটির নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি’ নাম রাখা হয়। এর ফলে কমিটি ‘সারা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে পারবে বলে’ সভার প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
প্রস্তাবে বলা হয়, প্রয়োজন অনুসারে কমিটি যে কোন সময় সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবে। জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে ইউনিট গঠন করে ‘মিশনের কাজ’ সাফল্য মন্ডিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
কোন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং তা কার্যকরী করার জন্য কমিটি ২১ সদস্যের একটি ওয়াকিং কমিটি গঠন করে। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা ছিলেন—১. খাজা খয়েরুদ্দিন, আহব্বায়ক, ২. এ, কিউ, এম শফিকুল ইসলাম, ৩. গোলাম আজম, ৪. মাহমুদ আলী, ৫. আবদুল জব্বার খদ্দর, ৬. মওলানা সিদ্দিক আহমদ, ৭. আবুল কাশেম, ৮. ইসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), ৯. মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, ১০. আবদুল মতিন, ১১. ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন, ১২. অধ্যাপক গোলাম সরওয়ার, ১৩. এ, এস, এম, সোলায়মান, ১৪. পীর মোহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া), ১৫. এ, কে, রফিকুল হোসেন, ১৬. নুরুল আমিন, ১৭. আতাউল হক খান, ১৮. তোহা বিন হাবিব, ১৯. মেজর আফসারুদ্দিন, ২০. দেওয়ান ওয়ারেসাত আলী, ২১. হাকিম ইরতিজায়ুর রহমান আখুনজাদা।
বর্তমানে যেখানে জামাতের কেন্দ্রীয় অফিস, সেখানকার একটি বাড়ী ৫, এলিফেন্ট লেন, মগবাজারে কমিটির কেন্দ্রীয় অফিস স্থাপন করা হয়।
কমিটি গঠনের পর ১৬ এপ্রিল সন্ধায় নুরুল আমিনের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা গভর্ণর হাউসে হত্যাযজ্ঞের সর্বোচ্চ নেতা জেনারেল টিক্কা খানের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। আলোচনাকালে কমিটির সদস্যরা টিক্কা খানকে জানান, ‘জনসাধারণ ভারতের ঘৃণ্য শয়তানী পুরোপুরি অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা রক্ষায় তারা সেনাবাহিনীকে মদদ জুগিয়ে যেতে অটল রয়েছেন।’ প্রত্যূত্তরে ‘জনগণের প্রকৃত সমস্যাবলী সম্পর্কে তদন্ত করে অবিলম্বে সেগুলোর সুরাহা করা হবে’ বলে টিক্কা খান নিশ্চয়তা দেন। (পূর্বদেশ, ১৭/৪/৭১)
শান্তি কমিটির কর্মকান্ড এভাবেই শুরু হয়। তারপর, স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে এই কমিটি ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সুবিস্তৃত হয়ে ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে। বস্তুত: পাক সামরিক জান্তার চেয়ে এই তাথাকথিত শান্তি কমিটি গণহত্যায় আরও বেশী অবদান রেখেছে। পাকসেনা যে জনপদে গেছে, সেখানেই বেপরোয়াভাবে ধংসযজ্ঞ চালিয়েছে, কিন্তু শান্তি কমিটি খুন করেছে সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রস্তুতের মাধ্যমে অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে। শান্তি কমিটির সদস্যরা নিজের হাতে খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও ধংসাত্মক কাজ করা ছাড়াও এসব কাজের জন্য গড়ে তুলেছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী। শান্তি কমিটি পরিচালিত গণহত্যা আরও বেশী ক্ষতিকর ছিল এই কারণে যে, পাক সেনারা তাদের ধংসাত্মক তত্পরতা চালাতে পেরেছে তাদের অবস্থানস্থলের কাছাকাছি পর্যন্ত, কিন্তু শান্তি কমিটি সুবিস্তৃত ছিল জালের মতন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সর্বত্র। এছাড়া পাক সেনা হত্যা করত কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী, ত্রাস সৃষ্টি করা এবং জিঘাংসা ও লাম্পট্য চরিতার্থ করার জন্য, কিন্তু কমিটির ক্ষেত্রে এর সাথে যুক্ত হয়েছিল নিহতদের সম্পত্তি দখল, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, সামরিক জান্তার বাহবা অর্জন, বিকৃত ধর্মীয় উন্মাদনা ইত্যাদি কারণ। এর ফলাফল তুলনামূলক ভাবে দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য।
শান্তি কমিটির মূল উদ্দেশ্য কি ছিল তার পরিচয় পাওয়া যাবে এই নব্য নাত্সী বাহিনীর মূল হোতা বর্তমানে জামাতে ইসলামীর আমীর গোলাম আজমের প্রকাশ্য জনসভায় প্রদত্ত ভাষণের উদ্ধৃতি থেকে। ১৯৭১ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের ‘আজাদী দিবস’ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি আয়োজিত সভায় তিনি ‘পাকিস্তানের দুশমনদের মহল্লায় মহল্লায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলোপ করার জন্য’ দেশ প্রেমিক নাগরিকদের শান্তি কমিটির সাথে সহযোগিতা করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মাসের পর মাস কিভাবে অগণন মানুষকে তাদের জীবন, জীবিকা, সম্ভ্রম আর স্বস্তি বিসর্জন দিয়ে শান্তি কমিটির ‘মিশনের’ শিকার হতে হয়েছে, কিভাবে শান্তি কমিটির সদস্যরা স্বহস্তে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যাসাহ অন্যান্য অপরাধ ঘটিয়েছে, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যাবে বাংলাদেশে গণহত্যার যে কোন বর্ণনায় কিংবা সারা বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের জবানীতে। এখানে শুধু ’৭২ এর সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাদেরই সম্পাদিত দুটি দলিল উপস্থাপন করা হবে নমুনা হিসেবে, যদিও শান্তি কমিটির অপরাধমূলক তত্পরতার স্বরূপ উদঘাটনের ক্ষেত্রে এগুযলো নিতান্তই অপ্রুতুল।
কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি ৬-৫-৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় নিম্ন লিখিত সিদ্ধান্ত সমূহ গ্রহণ করে:
১.সভাপতি ও সহ-সভাপতির অনুপস্থিতিতে জনৈক চৌধুরীকে সর্বসম্মতিক্রমে আজকের সভাপতি করা হয়।
২. জনৈক চৌধুরীর পদত্যাগপত্র পরবর্তী সভায় পেশ করার জন্য রেখে দেয়া হল।
৩. ক) তথাকথিত মুক্তিবাহিনী এবং তাদের তহবিল সংগ্রহ, সদস্যভুক্তি ইত্যাদি গোপন কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ ও তথ্যাদি এবং ইতিমধ্যেই অর্ন্তভূক্ত সদস্যদের বিবরণ যথাশীগ্র কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটিকে জানানো হোক। যারা মুক্তিবাহিনীর জন্য চাঁদা আদায় করছে এবং যারা প্রদান করেছে তাদের একটি তালিকা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কাছে পেশ করা হোক।
খ) লাইসেন্স ছাড়া সমস্ত বন্দুক রাইফেল ও অন্যান্য সাজসরঞ্জামের খোঁজ জানানো হোক।
গ) ইউনিয়ন শান্তি কমিটি সমূহকে পুনরায় অনুরোধ করা হলো মালি, মেথর, পেশাদার ‘ধোপী’, জেলে এবং নাপিত ছাড়া সকল হিন্দুকে উত্খাত করা হোক। এধরনের ‘কেস’ সমূহের একটি তালিকা প্যর্ণ বিবরণসহ পেশ করা হোক।
ঘ) পাকিস্তানে আশংকামক্ত হয়ে ও আত্মবিশ্বসের সাথে সকর বৌদ্ধ যাতে বাস করতে পারে সেজন্য তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক। বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলে বসবাসকারী বৌদ্ধদের একটি করে তালিকা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন শান্তি কমিটি কর্তৃক পেশ করা হোক।
৪. অধুনা লুপ্তঘোষিত আওয়ামী লীগের যেসব সদস্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তাদের নিম্নলিখিত কারণে একটি প্রথামত সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া হোকঃ
ক) অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ পাকস্তানের বিভক্তির জন্য এবং কার্যতঃ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য কাজ করে।
খ) উক্ত রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের মুসলমানরদন মধ্যে জাতসত্তাগত বা প্রদেশগত সংঘর্ষে উত্সাহিত করে এবং পাকিস্তানের সর্বাত্মক ক্ষতি করার জন্য আঞ্চলিকতাকে উত্সাহিত করে।
৫. সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নসমূহে সামরিক লোকদের ও প্রাক্তন সামরিক ব্যাক্তিদের তালিকা পেশ করা হোক।
৬. সরকারী ও আধাসরকরী প্রতিষ্ঠানের অফিসারবৃন্দ ও কারখানার শ্রমিদের স্ব স্ব কাজে যোগদানের জন্য উত্সাহিত করা হোক।
৭. ১৬ নং ইউনিয়ন কাউন্সিলের মোহাম্মদপুর ও ইছাপুরে বা তার আশেপাশে লুন্ঠন ও সমাজবিরোধী তত্পরতা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য নিম্নলিখিত ভদ্রলোকদের নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি করা হোক। এই কমিটি ৯-৫-১৯৭১ তারিখে বা তার পূর্বে রিপোর্ট পেশ করবেন।a
[a‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ মোহাম্মদ আবু জাফর; সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১০ বর্ষ ১ সংখ্যা, ২২ মে ’৮১ পৃ: ৩০-৩৩।]
লাকসামের ইউনিয়নে ইউনিয়নে যে সমস্ত নিরপরাধ হিন্দু নারী-পুরুষ-শিশু শান্তি কমিটির তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই রাজাকার, মুজাহিদ, আলবদর বা আলশামস বাহিনীর সদস্যদের হাতে নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছেন।স্বাধীনতার পর হয়তো কোন গণকবরে আবিষ্কৃত তাঁদের বেওয়ারিশ বিকৃত লাশ আবারও মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে; এ মাটি সাথে চিরতরে মিশে গেছেন তাঁরা।
কিন্তু ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে সংবাদপত্রে মুদ্রিত শান্তি কমিটির ওই নামগুলোর আয়াসসাধ্য পাঠোদ্ধারের পর খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে এদের প্রায় সকলেই আজও লাকসামে প্রতাপের সাথে বিরাজমান।
শান্তি কমিটির নেতারা তাদের বক্তৃতায় দুষ্কৃতকারী ও ভারতের দালালদের নির্মূল করা বলতে কি বোঝাত তার একটি অপর্যাপ্ত দৃষ্টান্ত হতে পারে এই দলিলটি। এই শান্তি কমিটির একটি সভার খবর বের হয় ’৭১ এর ২৬ অক্টোবরের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে। এতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি লাকসামে শান্তি কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানানো হয়। শান্তি কমিটির সভাপতি তাঁর ভাষণে দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় চরদের প্রতিরোধ করার জন্য সকলের প্রতি আহব্বান জানান। দশ হাজারেরও অধিক লোক সভায় যে কোন মূল্যে পাকিস্তানের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পুনরায় শপথ গ্রহণ করে।’
অপর দলিলটি হচ্ছে ঢাকার মোহাম্মদপুরে শান্তি কমিটির শাখা সংগঠন ‘পাকিস্তার অখন্ডতা ও সংহতি সংরক্ষণ এ্যাকশন কমিটির ৯-৮-১৯৭১ তারিখ অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তসমূহ। ইংরেজীতে গৃহীত এই সিদ্ধান্তসমূহোর বঙ্গানুবাদ হচ্ছেঃ
গোপনে বিলি ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খাঁটি পাকিস্তানী মুসলিম নাগরিকদের এক সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহঃ
১.উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং বিদ্যালয়ের বাধ্যতামূলক বিষয় করা হোক। বাংলা সাইনবোর্ড, নম্বর প্লেট ও নাম অপসারণ এবং সংস্কৃত ধরনের বাংলা অক্ষরের পরিবর্তে রোমান হরফ ব্যবহার করতে হবে।
২. যে কাফের কবি নজরুল ইসলামের ছেলেদের হিন্দু/বাংলা নাম রয়েছে তার রচনাসহ বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির হিন্দু প্রভাবিত অংশসমূহ বর্জন করতে হবে।
৩. পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও টেলিভেশনের অনুষ্ঠানের শতকরা ৫০ ভাগ ব্যয় করতে হবে উর্দু অনুষ্ঠানের জন্য।
৪. আমাদের পবিত্র ভূমিতে পাকিস্তান বিরোধীদের আসতে দেওয়া হবে না (যেমন, ইহুদীবাদী দুশ্চরিত্র ইসলামের শত্রু এডওয়ার্ড কেনেডী)।
৫. বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির কারণে বাঙালী সরকারী কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের উপর ২৪ ঘন্টা নজর রাখতে হবে, (পরে তাদের সামরিক আদালতে বিচার করে হত্যা করতে হবে)।
৬. জাতির স্বার্থে উচ্চপদ থেকে বাঙ্গালী অফিসারদের দু’বছরের জন্য অপসারণ করতে হবে।
৭. রাজাকার বাহিনীর বেতন এবং শান্তি কমিটির ব্যয় নির্বাহের জন্য হিন্দু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
৮. কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে ইউ, এস, এস, আর, ইউ-কে এবং অন্যান্য শত্রু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
৯. বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য বাস্তুহারাদের সাহায্য দ্রব্য এবং উর্দুভাষী খাঁটি পাকিস্তানীদের মধ্যে বিতরণের জন্য সাহায্য তহবিল ব্যবহার করতে হবে।
১০. বীর পাকিস্তানী ও আমাদের সত্যিকারের বন্ধুরাষ্ট্র চীনের সৈনিকদের নামে শহরগুলোর নামকরণ করতে হবে।*
[*সংস্কৃতি ধংসের এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৫ জুন ১৯৭১ ঢাকা শহরের ২৪০টি রাস্তার নতুন নামকরণ করা হয়। এই নামগুলির কয়েকটি ছিল— শাঁখারি বাজার রোডঃ টিক্কা খান রোড; মাদারটেকঃ মাজারটেক; ইন্দিরা রোডঃ আনারকলি রোড; এলিফেন্ট রোডঃ আল আরাবিয়া রোড; বেইলি রোডঃ বু’আলী রোড; রায়ের বাজারঃ সুলতান গঞ্জ। বুদ্ধিজীবী হত্যার বধ্যভূমির কাছে বছিলা গ্রামের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ওয়াসিলা’।]
১১. বর্তমানে জাতীয় পুনর্গঠনের সময় তিন মাসের জন্য বিদেশী সাংবাদিক এ অনভিপ্রেত ব্যক্তিদের বহিষ্কার করতে হবে।b
[b প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৩]
গণহত্যাকারী পাক সেনাবাহিনীর সাথে শান্তি কমিটির যোগাযোগ কত উচ্চপর্যায় পর্যন্ত সুবিস্তৃত ছিল তার একটি দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে দেয়া যেতে পারে। ২৫ জুন ১৯৭১ তারিখে ‘আজাদ’ পত্রিকায় হেড লাইনে মোটা হরফে লেখা সংবাদটি ছিল নিম্নরূপ—‘অদ্য পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল সফরকালে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খানকে বিভিন্ন কল্যাণকর কাজ এবং বেসামরিক জনতা ও সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যেকার সৌহার্দ্যের কথা জানারো হয়। জেনারেল হমিদ অদ্য সকালে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার ও জি ও সি সহ যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙা, এবং ফরিদপুর সফর করিয়া পূর্বাহ্নে ঢাক প্রত্যাবর্তন করেন। জেনারেল হমিদকে জানানো হয়, এই অঞ্চলের দেশদরদী জনগৰণ দেশ হইতে রাষ্ট্রদ্রোহীদের উচ্ছেদে কর্তৃপক্ষকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করিতেছে। এই সমস্ত রাষ্ট্রদ্রোহীর মধ্যে কিছুসংখ্যক লোক আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তি প্রিয় লোকালয়ে আত্মগোপন করিলে স্থানীয় জনসাধারণ তাহাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া শাস্থি প্রদান করে। ইহাদের শাস্তি প্রদানের জন্য দেশে বহু রাজাকারবাহিনী গঠিত হইয়াছে।’
যে ১৪০ জন ব্যক্তির সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল তাঁদের প্রায় সবাই ছিল জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পি ডি পি, নেজামে ইসলাম এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতৃবৃন্দ। এই ১৪০ জনের মধ্যে চার থেকে পাঁচ জন বিদেশে রাজনীতি করছেন, দশ বার জনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, এবং বাদবাকী সবাই আজ বাংলাদেশের রাজনীতি বা অন্য ক্ষেত্রে উচ্চপদে আসীন। এদের প্রত্যেকের পরিচয় স্বল্প পরিসর এই গ্রন্থে প্রদান করা সম্ভব নয়। তবে নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের যুদ্ধকালীন কার্যকলাপের বিবরণ আমরা দেবো যা থেকে শান্তি কমিটির দালালী, নৃশংসতা ও ঘাতক চরিত্র উন্মোচন করা যাবে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির মূল কাজ ছিল স্বাধীনতামনা বাঙ্গালীদের হত্যা তালিকা প্রস্তুত ও তাদের হত্যা করার কাজে পাক সেনাবাহিনীকে সহায়তা প্রদান এবং রাজাকার, আলবদর, আলশমস প্রভৃতি বাহিনীকে নিয়োজিত করা। একাত্তরে এদের বক্তৃতা বিবৃতির আক্ষরিক অর্থ ছাড়াও তার অন্তর্নিহিত তাত্পর্য বুঝতে পারলেই এদের প্রকৃত অপরাধ অনুধাবন করা যাবে। আগা মাহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, আবদুল হমিদ খান, টিক্কা খান বা আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী নিজের হাতে বাঙ্গালী হত্যা না করলেও তারা গণহত্যার অপরাধে অপরাধী। একই অপরাধে অপরাধী শান্তি কমিটির প্রত্যেকটি সদস্য। কারণ এই কমিটির পরিকল্পনা ও নির্দেশেই রাজাকার, আল বদর, আল শামস ইত্যাদির তত্পরতা পরিচালিত হত।
আজকের জামাতে ইসলামী , মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশ, খেলাফত আন্দোলন, আই, ডি, এল, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলের নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই একাত্তরের মূখ্য দালাল। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, বি, এন, পির বিভিন্ন অংশ এবং ডান পন্থী অন্যান্য দলেও ঘটেছে কুখ্যাত দালালদের সমাবেশ।
শান্তি কমিটির ক্রমবিকাশ
এ পর্যায়ে মূল প্রসঙ্গ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি সংগঠনের ক্রমবিকাশের আলোচনায় ফিরে আসা যেতে পারে। ১৯ এপ্রিল কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি ঢাকা শহরের বিভিন্ন ইউনিট ও মহল্লায় শান্তি কমিটি গঠন এবং সেগুলোর আহব্বায়ক মনোনয়নের কথা ঘোষণা রে। কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে ইউনিট ও আঞ্চলিক কমিটির তত্পরতা সম্পর্কিত রিপোর্ট ঢাকার মগবাজার এলাকাস্তিত কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির অফিসে পৌঁছে দিতে বলা হয়। কেন্দ্রীয় অফিস ২৪ ঘন্টা খোলা রেখে অফিস সেক্রেটারী এডভোকেট নুরুল হক মজুমদারকে (মুসলিম লীগ নেতা) সর্বক্ষণ অফিসে মোতায়েন করা হয়।
বিভিন্ন স্থানে ইউনিট শান্তি কমিটি গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি বিভিন্ন জেলায় ও মহকুমায় নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
‘জনগণের অসুবিধাদি সম্পর্কে তথ্যাদি গ্রহণ এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষে ও আর্মি সেক্টরের সাহায্যে তার প্রতিকার করার জন্য’ কমিটির সদস্যদের মধ্যে থেকে বেশ কিছু সংখ্যক লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগ করা হয়, এবং ‘তাঁরা ইতিমধ্যেই তাদের কর্তব্য সম্পাদন করতে শুরু করেছেন’ বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। লিয়াজোঁ অফিসারেদের প্রতিদিন তাদের কর্মতত্পরতার রিপোর্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। (এই লিয়াজোঁ অফিসারদের তালিকা পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে)। লিয়াজোঁ অফিসগুলো ছিল ঢাকা শহরে শান্তি কমিটির কার্যকলাপের মূল ঘাঁটি। লিয়াজোঁ অফিসারদের তাদের নিজ নিজ এলাকার রাজাকারদের উপর কর্তৃত্ব ছিল।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতামনা বাঙ্গালীদের চিহ্নিত করে ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনীর কাছে তাদের নামের তালিকা পৌঁছে দেয়া ছিল লিয়াজোঁ অফিসগুলির মূল কাজ। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় কোন মুক্তিযোদ্ধা থাকা সম্ভব ছিল না। বস্তুত: ‘আর্মি সেক্টরের সাহায্যে প্রতিকার করার’ একটি মাত্র অর্থ হতে পারে, আর তা হচ্ছে প্রাণ ভয়ে লুকিয়ে থাকা অসহায় বাঙ্গালীদের হত্যা করার জন্য পাকবাহিনীকে ডেকে আনা। এপ্রিলের সেই ভয়াবহ দিনগুলিতে ঢাকা শহরে যারা ছিলেন, তারা সবাই জানেন, এই সমস্ত লিয়াজোঁ অফিসে প্রতিদিন সামরিক জীপে করে পাকিস্তানী সেনা এসেছে, লিয়াজোঁ অফিসাররা তাদেরকে সাথে করে নিয়ে গোছে অসহায় বাঙ্গালীদের বাড়িতে বাড়িতে। তারপর পাকবাহিনী যে নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ চালিয়েছে— সে সময় ঢাকায় আটকে পড়া বাঙ্গালীদের অজানা নয়।
রাতদিন ২৪ ঘন্টা খোলা রেখে সে সময় লিয়াজোঁ অফিসগুলি বন্দী বাঙ্গালীদের নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। একটি দৃষ্টান্ত এপ্রসঙ্গে দেয়া যেতে পারে। তেজগাঁ থানার লিয়াজোঁ অফিসার মাহবুবুর রহমান গুরহা স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে আত্মগোপন করেন। দালাল আইনের প্রহসনমূলক বিচারে তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাকেঁ কারাদন্ড দেয়া হয়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর তিনি নাখাল পাড়ায় তাঁর বাড়িতে চলে আসেন। এখন তিনি পৌরসভার স্থানীয় ওয়ার্ড চেয়ারম্যান এবং জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা।
১৬ ডিসেম্বর বিকেল বেলায় নাখাল পাড়ায় অবস্থিত এই তথাকথিত লিয়াজোঁ অফিসে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রবেশ করেন। সেখানে চাপ চাপ রক্তের মধ্যে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকতে দেখাযায় মৃতদেহ।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের প্রধান জল্লাদ আলবদর বাহিনীর আশরাফজ্জামান খান এই লিয়াজোঁ অফিস থেকে কয়েকশত গজ দূরে ৩৫০ নাখাল পাড়ায় বাস করত। এই লিয়াজোঁ অপিসে তাঁরও যাতায়াত ছিল। রাজধানীর প্রত্যেকটি লিয়াজোঁ অফিস সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য।
২২ এপ্রিল কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির এক আবেদনে ‘সমস্ত দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানীর প্রতি রাষ্ট্রদ্রোহীদের সব রকম ধংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিহত করায় এবং সশস্ত্র বাহিনীকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সহায়তা করার’ জন্য আহ্বান জানানো হয়। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির পক্ষে আহ্বায়ক খাজা খয়ের উদ্দিন কর্তৃক ইস্যুকৃত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রদ্রোহীরা সম্পূর্ণভাবে হতাশ হয়ে এখন পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছে এবং তারা যোগাযোগ ব্যবস্থা ধংস এবং শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হয়রানি করছে। আবেদনে আরও বলা হয়, ‘সশস্ত্রবাহিনী জনগণেরই অন্তর্গত এবং নাগরিকদের জীবন ও ধনসম্পত্তি রক্ষাই তাদের উদ্দেশ্য।’
২৫ এপ্রিল কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির মিশন সফল করার উদ্দেশ্যে জেলা ও মহকুমা সদরে শান্তি কমিটি গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধিদের পাঠানো হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে যদি কোন জেলঅ বা মহকুমায় দেশপ্রেমিক লোকদের উদ্যোগে শান্তি কমিটি গঠিত হয়ে থাকে তবে সেসব কমিটির নাম অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কামটি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদিত ইউনিট সম্পর্কে রিপোর্ট দেবেন।
‘শহরে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি স্কোয়াড যাতায়াত করছেন।’
মাথায় সাদা বা লাল পট্টি বাঁধা শান্তি কমিটির এই শান্তি স্কোয়াডের সদস্যরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে বাঙ্গালী হত্যা সহ তাদের বড়িতে লুটতরাজ এবং অগ্নি সংযোগ করে। বাঙ্গালী, বিশেষতঃ তরুণ ও যুবকদের দেখামাত্র পিটিয়ে, বেয়নেট চার্জ করে বা গুলি করে হত্যা করে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাঙ্গালীদের বাড়িঘরে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সে সময় পর্যন্ত ঢাকা শহরে আটকে পড়া বাঙ্গালী মাত্রই এই স্কোয়াডের অত্যাচার সম্পর্কে জ্ঞাত আছেন। এপ্রিল মাসের শেষ থেকে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ জেলা ও মহকৃমা পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে সারা বাংলাদেশে সাংগঠিনিক সফর করেন। ইতিমধ্যে অধিকাংশ এলাকায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়ে গিয়েছিল; যে সমস্ত এলাকায় হয় নি, সে সব এলাকায় মোটামুটিভাবে মে মাসের মাঝামাঝির দিকে শান্তি কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়ে যায়।
বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে রয়েছে সরাসরি নির্বিচার গণহত্যার অভিযোগ। এই হত্যাকারীদের প্রায় সকলেই আজ পুনর্বাসিত, কেউ কেউ মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যও হয়েছেন। আমারা এই গ্রন্থে জেলা পর্যায়ের তিনটি নমনা দেব। [জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে দালাল ও ঘাতকদের তত্পরতা এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে মুদ্রিত হবে।]
জিয়াউর রহমানের আমলে রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন আবদুল আলীম। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন জয়পুরহাট শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। নিরপরাধ বাঙ্গালীদের সম্পর্কে সে সময় তাঁর কি মনোভাব ছিল তা বুঝবার জন্য এখানে ১৮ জানুয়ারী ১৯৭২ সালের দৈনিক বাংলায় একটি বক্স আইটেম—‘হানাদার বাহিনীর বর্বরতা মধ্যযুগীয় নরঘাতকদেরও হার মানিয়েছে’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হল—
‘জয়পুরহাট শান্তি কমিটির নেতা জয়পুরহাট ইউনিয়র কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগের আবদুল আলীমকে একদিন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর সংখ্যালঘুদের দেশে ফেরার নিশ্চয়ই আর কোন বাধা নেই। উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, ওদের ক্ষমা নেই। ওরা দেশে ফিলেই ওদের সামারিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে। শুনে স্তম্ভিত হতে হয়েছে। একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি যদি এরকাম ধারণা পোষণ করে তবে সংখ্যালঘূদের সম্পর্কে অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত দালালদের কি রকম মনোভার ছিল তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। বস্তুতঃ ইয়াহিয়া খানের লোক দেখানো ক্ষমা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে যে সব মুষ্টিমেয় সংখ্যালঘু ফিরে এসেছিল তাদের আর পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখতে হয় নি।’
আবদুল আলীম সেই সময় নিজের হাতে বাঙ্গালীদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিলেন। এছাড়া বেয়নেট চার্জ করে বহু বাঙ্গালীকে মারার অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য আয়েনউদ্দিন ছিলেন রাজশাহী জেলা শান্তি কমিটি প্রধান। ১৯৭১ সালের ৩১ মে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাত্কারে তিনি ‘পাক সেনাবাহিনীর বিশেষ তত্পরাতর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তারা অসীম ধৈর্য্যের সাথে শত্রুর মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। রাজশাহী জেলার সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসছে। প্রতি মহকুমা, থানা ও ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
ইয়াহিয়া খানের ‘দেশপ্রেমিক নাগরিকদের ফিরে আসা’ সংক্রান্ত প্রতারণামূলক সিদ্ধন্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, প্রেসিডন্টের এই বীরোচিত আহবানকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। একটি মুসলিম রাষ্ট্রের একজন নির্ভীক রাষ্ট্রপ্রধানের এই আহবান বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে।’
৪ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামের খবরে বলা হয়, ‘রাজাকার বাহিনীর প্রথম গ্রুপের ট্রেনিং সমাপ্তি উপলক্ষে আজ স্থানীয় জিন্নাহ ইসলামিক ইনস্টিটিউটে এক সমাপনী উত্সব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরান স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করা হয়। অনুষ্ঠানে শান্তি কমিটির সভাপতি জনাব আয়েনউদ্দিন রাজাকারবাহিনীকে যথাযথ কর্তব্য পালনে সক্রিয় থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি রাজাকারদের বিশ্বস্ততার সাথে পাকিস্তানের আদর্শ, সংহতি ও অখন্ডত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সামরিক অফিসারবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
২৮ আগস্ট রাজশাহী কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আয়েনউদ্দিন। এই সভায় ‘শহীদ’ রাজাকারদের শোক সন্তপ্ত পরিবারবর্গকে খাস জমি অথবা দুষকৃতকারীদের পরিত্যক্ত জমি থেকে ১০ বিঘা করে জমি দেবার প্রস্থাব করা হয়। এছাড়া সাময়িক আর্থিক সংকট উতরানোর জন্য কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি কর্তৃক রাজাকারদের শোক সন্তপ্ত পরিবারকে পাঁচশ টাকা ও এক বস্তা করে চাউল দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।’
No comments:
Post a Comment