বিশ্বায়ন সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেস
বিশ্বায়ন সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেস
গত ২৪ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে সান দিয়েগোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যানডেভিল অডিটোরিয়ামে 'গ্লোবালাইজেশন: এ নিউ ডিল ফর এ নিউ এজ' বিষয়ে প্রখ্যাত মেক্সিকান লেখক কার্লোস ফুয়েন্তেস একটি বক্তৃতা দিয়েছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও লেখক রাজু আলাউদ্দিন সেই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন। কার্লোস ফুয়েন্তেসকে তিনি তার সম্পাদিত 'মেহিকান মনীষা' বইটি উপহার দিয়েছেন। ফুয়েন্তেস এক বর্ণ বুঝতে পারবেন না, তারপরও তার সংগ্রহে একটি বাংলা বই রাজু আলাউদ্দিনএর সৌজন্যে থেকে গেল এটা বাঙালি হিসেবে আমার কাছে একটা আনন্দ ও গর্বের বিষয়।
রাজু আলাউদ্দিন এর 'বিশ্বায়ন সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেস' শীর্ষক লেখাটি বস্তুত একটা ভ্রমণ কাহিনী। তবে রচনাশৈলীর গুণে তা নিছক ভ্রমণলগ হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমকালীন সাহিত্য, ফুয়েন্তেসের সক্রিয় জীবন, রাজনীতি, ভ্রমণ বর্ণনা, সান দিয়েগো ইউনিভার্সিটির বর্ণনা প্রভৃতি বিষয়ে রাজু আলাউদ্দিনের সরস ও বিস্তারিত বর্ণনা একটি নিবন্ধ পাঠের অনুভূতি এনে দেয়। লেখাটি পাঠ করতে করতে মনে হল এর কিছু অংশ বারবার পড়ার মত। অংশটুকু নিচে পুন:প্রকাশ করলাম। রাজু আলাউদ্দিন এর লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সমকাল এর ২৭ জুন ২০০৮ সংখ্যার কালের খেয়াতে।
..................................................................
বিশ্বায়ন সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেস
রাজু আলাউদ্দিন
ফুয়েন্তেসের মতে, ‘বিশ্বায়ন’ ধারণাটি সাম্প্রতিককালের। ২০ শতকের সর্বশেষ ধারণা হিসেবে এর জন্ম হলেও এর বিস্তৃতি আজকের একুশ শতকে। বিশ্বায়ন আসলে কী? ফুয়েন্তেসের মতে, এটি ক্ষমতারই এক কাঠামো (Power System)। অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য এ বিশ্বায়ন নামক দানবীয় ধারণাটি হয়ে উঠতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ, যদি তাকে অনুন্নত দেশের অর্থনীতি বিকাশের অনুকূলে গ্রহণ না করা হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছেন, মুক্তবাজার এবং প্রতিযোগিতাপ্রবণ করপোরেশনগুলো ছোট এবং মাঝারি আয়তনের শিল্প-কারখানাগুলোকে গিলে খেয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান এবং বেতন সংকট তৈরি করবে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নে এক বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আখেরে তা কেবল ধনী এবং গরিবের মধ্যে দূরত্বকে ক্রমেই প্রসারিত করবে। আর একথা তো আমরা সবাই জানি যে, বিশ্বায়নের ধারণাটি এসেছে উন্নত দেশগুলোর মাথা থেকে। তারা মানবজাতির মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ না করে যখন বিশ্বায়নের পক্ষে ওকালতি করে তখন সেটা করে নিতান্তই তাদের অর্থনৈতিক বিকাশকে এক দানবীয় রূপ দেওয়ার জন্যই। এর পেছনে আদৌ কোনো সদিচ্ছা আছে কি-না তা নিয়ে গভীর সন্দেহ পোষণ করা যেতে পারে, যদি আমরা ফুয়েন্তেসের দেওয়া এ তথ্যগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি : উন্নয়নশীল দেশগুলোর মৌলিক শিক্ষা-চাহিদা পূরণের জন্য ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারই যথেষ্ট, অন্যদিকে কেবল আমেরিকাতেই সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় প্রসাধন সামগ্রীর পেছনে। এটা কী করে মেনে নেওয়া সম্ভব?
আজকের পৃথিবীতে, গরিব দেশগুলোর খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং পানি সমস্যা সমাধানের জন্য তের বিলিয়ন মার্কিন ডলারই যথেষ্ট। অন্যদিকে কেবল ইউরোপে সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় আইসক্রিমের পেছনে। এও কি গ্রহণযোগ্য? ইউনেস্কোর সাবেক মহাপরিচালক ফেদেরিকো মাইয়র এবং বিশ্বব্যাংকের (সাবেক) পরিচালক জেমস উলফেনসনের পক্ষে ‘এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব, যে পৃথিবী অস্ত্রের পেছনে বছরে আনুমানিক ৮০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে পারে সে কি-না প্রতিটি শিশুকে স্কুলে শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার জোগাড় করতে পারে না।’ বিশ্বব্যাপী সামরিক খাতে ব্যয়ের মাত্র এক শতাংশ অর্থ দিয়ে পৃথিবীর প্রত্যেক শিশুকে ব্লাকবোর্ডের সামনে দাঁড় করানো সম্ভব।
তবে এও সত্য যে, উন্নত দেশগুলোর অপকর্মের খতিয়ান এবং পরিসংখ্যান হাজির করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বিশ্বায়নকে ইতিবাচক করতে হলে আমাদের করণীয় আছে অনেক কিছু। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তীয় অঞ্চলের দেশগুলোর যদি স্থানীয় সরকার, পাবলিক সেক্টর, প্রশাসন ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে বিশ্বায়ন কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে না। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রবণতাকে ইতিবাচক প্রবণতায় রূপান্তরিত করা সম্ভব।
বিল ক্লিনটনের বক্তৃতা থেকে একটি উদ্ধৃতি ফুয়েন্তেস জানিয়েছেন, ১৯৯৩ সালে ক্লিনটন যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন তখন বিশ্বব্যাপী ওয়েবসাইটের সংখ্যা ছিল মাত্র পঞ্চাশটি। আর আট বছর পর তিনি যখন ক্ষমতা ত্যাগ করেন ততদিনে ওয়েবসাইটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন এবং তা ক্রমেই বাড়ছে দ্রুতগতিতে। অতএব প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার কি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবে? সরকার যদি এগুলোকে গণমুখী কর্মকাণ্ডে পরিচালিত করতে পারে তাহলে সম্ভব। মোটামুটি এই-ই ছিল বিশ্বায়ন সম্পর্কে ফুয়েন্তেসের বক্তৃতার সারসংক্ষেপ। বক্তৃতা শেষে শুরু হলো প্রশ্ন-উত্তরের পালা। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে উৎসাহী সাত-আটজন সাধারণ কিছু প্রশ্নবাণে আক্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন ফুয়েন্তেসকে। বিপুল পাণ্ডিত্য আর প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিয়ে সেসব প্রশ্ন তিনি মোকাবেলা করেছেন সাবলীলতার সঙ্গে।
গত ২৪ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে সান দিয়েগোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যানডেভিল অডিটোরিয়ামে 'গ্লোবালাইজেশন: এ নিউ ডিল ফর এ নিউ এজ' বিষয়ে প্রখ্যাত মেক্সিকান লেখক কার্লোস ফুয়েন্তেস একটি বক্তৃতা দিয়েছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও লেখক রাজু আলাউদ্দিন সেই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন। কার্লোস ফুয়েন্তেসকে তিনি তার সম্পাদিত 'মেহিকান মনীষা' বইটি উপহার দিয়েছেন। ফুয়েন্তেস এক বর্ণ বুঝতে পারবেন না, তারপরও তার সংগ্রহে একটি বাংলা বই রাজু আলাউদ্দিনএর সৌজন্যে থেকে গেল এটা বাঙালি হিসেবে আমার কাছে একটা আনন্দ ও গর্বের বিষয়।
রাজু আলাউদ্দিন এর 'বিশ্বায়ন সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেস' শীর্ষক লেখাটি বস্তুত একটা ভ্রমণ কাহিনী। তবে রচনাশৈলীর গুণে তা নিছক ভ্রমণলগ হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমকালীন সাহিত্য, ফুয়েন্তেসের সক্রিয় জীবন, রাজনীতি, ভ্রমণ বর্ণনা, সান দিয়েগো ইউনিভার্সিটির বর্ণনা প্রভৃতি বিষয়ে রাজু আলাউদ্দিনের সরস ও বিস্তারিত বর্ণনা একটি নিবন্ধ পাঠের অনুভূতি এনে দেয়। লেখাটি পাঠ করতে করতে মনে হল এর কিছু অংশ বারবার পড়ার মত। অংশটুকু নিচে পুন:প্রকাশ করলাম। রাজু আলাউদ্দিন এর লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সমকাল এর ২৭ জুন ২০০৮ সংখ্যার কালের খেয়াতে।
..................................................................
বিশ্বায়ন সম্পর্কে কার্লোস ফুয়েন্তেস
রাজু আলাউদ্দিন
ফুয়েন্তেসের মতে, ‘বিশ্বায়ন’ ধারণাটি সাম্প্রতিককালের। ২০ শতকের সর্বশেষ ধারণা হিসেবে এর জন্ম হলেও এর বিস্তৃতি আজকের একুশ শতকে। বিশ্বায়ন আসলে কী? ফুয়েন্তেসের মতে, এটি ক্ষমতারই এক কাঠামো (Power System)। অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য এ বিশ্বায়ন নামক দানবীয় ধারণাটি হয়ে উঠতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ, যদি তাকে অনুন্নত দেশের অর্থনীতি বিকাশের অনুকূলে গ্রহণ না করা হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছেন, মুক্তবাজার এবং প্রতিযোগিতাপ্রবণ করপোরেশনগুলো ছোট এবং মাঝারি আয়তনের শিল্প-কারখানাগুলোকে গিলে খেয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান এবং বেতন সংকট তৈরি করবে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নে এক বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আখেরে তা কেবল ধনী এবং গরিবের মধ্যে দূরত্বকে ক্রমেই প্রসারিত করবে। আর একথা তো আমরা সবাই জানি যে, বিশ্বায়নের ধারণাটি এসেছে উন্নত দেশগুলোর মাথা থেকে। তারা মানবজাতির মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ না করে যখন বিশ্বায়নের পক্ষে ওকালতি করে তখন সেটা করে নিতান্তই তাদের অর্থনৈতিক বিকাশকে এক দানবীয় রূপ দেওয়ার জন্যই। এর পেছনে আদৌ কোনো সদিচ্ছা আছে কি-না তা নিয়ে গভীর সন্দেহ পোষণ করা যেতে পারে, যদি আমরা ফুয়েন্তেসের দেওয়া এ তথ্যগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি : উন্নয়নশীল দেশগুলোর মৌলিক শিক্ষা-চাহিদা পূরণের জন্য ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারই যথেষ্ট, অন্যদিকে কেবল আমেরিকাতেই সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় প্রসাধন সামগ্রীর পেছনে। এটা কী করে মেনে নেওয়া সম্ভব?
আজকের পৃথিবীতে, গরিব দেশগুলোর খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং পানি সমস্যা সমাধানের জন্য তের বিলিয়ন মার্কিন ডলারই যথেষ্ট। অন্যদিকে কেবল ইউরোপে সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় আইসক্রিমের পেছনে। এও কি গ্রহণযোগ্য? ইউনেস্কোর সাবেক মহাপরিচালক ফেদেরিকো মাইয়র এবং বিশ্বব্যাংকের (সাবেক) পরিচালক জেমস উলফেনসনের পক্ষে ‘এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব, যে পৃথিবী অস্ত্রের পেছনে বছরে আনুমানিক ৮০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে পারে সে কি-না প্রতিটি শিশুকে স্কুলে শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার জোগাড় করতে পারে না।’ বিশ্বব্যাপী সামরিক খাতে ব্যয়ের মাত্র এক শতাংশ অর্থ দিয়ে পৃথিবীর প্রত্যেক শিশুকে ব্লাকবোর্ডের সামনে দাঁড় করানো সম্ভব।
তবে এও সত্য যে, উন্নত দেশগুলোর অপকর্মের খতিয়ান এবং পরিসংখ্যান হাজির করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বিশ্বায়নকে ইতিবাচক করতে হলে আমাদের করণীয় আছে অনেক কিছু। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তীয় অঞ্চলের দেশগুলোর যদি স্থানীয় সরকার, পাবলিক সেক্টর, প্রশাসন ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে বিশ্বায়ন কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে না। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রবণতাকে ইতিবাচক প্রবণতায় রূপান্তরিত করা সম্ভব।
বিল ক্লিনটনের বক্তৃতা থেকে একটি উদ্ধৃতি ফুয়েন্তেস জানিয়েছেন, ১৯৯৩ সালে ক্লিনটন যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন তখন বিশ্বব্যাপী ওয়েবসাইটের সংখ্যা ছিল মাত্র পঞ্চাশটি। আর আট বছর পর তিনি যখন ক্ষমতা ত্যাগ করেন ততদিনে ওয়েবসাইটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন এবং তা ক্রমেই বাড়ছে দ্রুতগতিতে। অতএব প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার কি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবে? সরকার যদি এগুলোকে গণমুখী কর্মকাণ্ডে পরিচালিত করতে পারে তাহলে সম্ভব। মোটামুটি এই-ই ছিল বিশ্বায়ন সম্পর্কে ফুয়েন্তেসের বক্তৃতার সারসংক্ষেপ। বক্তৃতা শেষে শুরু হলো প্রশ্ন-উত্তরের পালা। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে উৎসাহী সাত-আটজন সাধারণ কিছু প্রশ্নবাণে আক্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন ফুয়েন্তেসকে। বিপুল পাণ্ডিত্য আর প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিয়ে সেসব প্রশ্ন তিনি মোকাবেলা করেছেন সাবলীলতার সঙ্গে।
No comments:
Post a Comment