তুষার গায়েন
প্রিয় বন্ধুগণ, যে আলোচনাটি আমি এখানে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি তার সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় দেড় মাস আগে। সতীর্থ কবি শাহানা আকতার মহুয়ার একটি ছোট্ট কবিতা ‘রাধিকা পুরান’-এর ছন্দের মাত্রা গণনা নিয়ে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে আমার বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্ক অচিরেই আর মাত্রা গণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা তেজস্ক্রিয়তার মত ছড়িয়ে পড়ে ছন্দ সম্বন্ধীয় অন্যান্য সংজ্ঞা ও প্রচলিত প্রত্যয় সমূহের কেন্দ্রেঃ সিলেবল কি? সিলেবলের বাংলা নাম কি? সিলেবল ও অক্ষর কি সমার্থক? সিলেবলের পরিমাপ কি? ইত্যাদি... ইত্যাদি...। আলোচনার এক পর্যায়ে কবি সোহেল হাসান গালিব অংশগ্রহণ করেন এবং বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। গালিব তার বক্তব্যের সপক্ষে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে দু’টো বই (ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় / ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই) হাজির করেন এবং দাবী করেন যে, যদি আমাকে যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা চালিয়ে যেতে হয় তাহলে, উপরোক্ত বই দুটো আমার পড়া ও অনুধাবনে থাকা আবশ্যিক। অগত্যা আমাকে বই দু’টো জোগাড় করে পড়তে হল। প্রবাসে বসে এইসব বইপত্র জোগাড় করা দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ, তবু আলোচনার স্বার্থে এই বই দু’টোই শুধু নয়, আরো অনেক কিছুই নতুন করে পড়তে হ’ল এবং বোঝা গেল যে, আমরা বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এবং কেন আমাদের মধ্যে এই মতপার্থক্য হচ্ছে। এই লেখাটি উন্মোচন করবে বাংলাভাষার এমন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা, যার সাথে অনেকেই অপরিচিত অথচ যার পরাক্রান্ত আহ্বান আমরা কেউ উপেক্ষা করতে পারি না। আলোচনাটি ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করার সুবিধার্থে, আমি পূর্বের আলোচনার লিঙ্ক শুরুতেই দিয়ে দিচ্ছিঃ
1.http://www.facebook.com/profile.php?id=1123716726#/note.php?note_id=208314290124
2.http://www.facebook.com/profile.php?id=1123716726&ref=ts#/note.php?note_id=80303980417
গালিব, যে বিষয়গুলো নিয়ে আপনার ও কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে আমার মতপার্থক্য হচ্ছে, যেমনঃ অক্ষর, সিলেবল, ছন্দের মাত্রা এবং প্রাসঙ্গিক আরো কিছু যা এই আলোচনার উপজাত, সে-সব বিষয় নিয়ে নির্দিষ্টভাবে ব্যাখা-বিশ্লেষণ হাজির করার আগে, প্রাথমিক কিছু কথা সেরে নিতে হবে। বাংলাভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে কোনো দূরদর্শী ও পরিণত আলোচনা করতে গেলে, সেটা বাংলাভাষার সমগ্র ইতিহাস(অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত) -এর উপর দাঁড়িয়ে করতে হবে, না হলে সে আলোচনা খণ্ডিত হতে বাধ্য। বাংলাভাষার বিবর্তনের একপর্যায়ে, ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে, বিশেষতঃ ইংরেজ আমলে ইংরেজি জানা বাঙালি পণ্ডিতরা বাংলাভাষাকে ইংরেজির আদলে গড়তে গিয়ে, ভাষার যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন করেছিলেন, অর্থগত ও কাঠামোগতভাবে, তার রেশ আমাদের এখনও বহন করতে হচ্ছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলাভাষার যে ব্যাকরণ প্রণয়ন করেছিলেন (যে ধারাতে পরে আরো অনেকেই এসেছেন যেখানে আবদুল হাই-ও অন্তর্ভূক্ত) যার উপর ভিত্তি করে আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ভাষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে, তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।
পৃথিবীর ভাষা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, বাক্যে ব্যবহূত শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করার দু’টো পদ্ধতি রয়েছে। তার একটি হচ্ছে, শব্দের বাইরে থেকে শব্দের অর্থ পাওয়া, যেখানে শব্দটি একটি আরোপিত অর্থ বহন করে এবং যে ধ্বনি সমবায়ে ঐ শব্দটির জন্ম, ঐ ধ্বনিগুলো আলাদাভাবে কোনো অর্থ বহন করে না। ভাষার এই ধারাটিকে প্রতীকী ভাষা (logocentric) বলা হয়। অন্য পদ্ধতি হচ্ছে, ক্রিয়াভিত্তিক (verb-based) শব্দার্থবিধি, যেখানে কোনো একটি শব্দের ভেতর থেকে শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করা হয় অর্থাৎ যে ধ্বনি সমবায়ে ঐ শব্দের জন্ম, ঐ ধ্বনিগুলির সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে এবং ধ্বনিগুলির সম্মিলনেই শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয়। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দ প্রায়শই অনেক অর্থ বহন করে। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার বিলুপ্তি হলেও, বাংলাভাষায় ক্রিয়াভিত্তিক ও প্রতীকী, উভয় ধারার চর্চাই ইংরেজ আগমনের আগ পর্যন্ত বহাল ছিল, যখন অনেক প্রাচীন রচনাকে একই সাথে প্রতীকী ও ক্রিয়াভিত্তিক উপায়ে পাঠ করার নিয়ম চালু ছিল। একটি উদাহরণ এখনও আমাদের হাতের কাছে রয়েছে, তা হ’ল চর্যাপদ। ঐতিহাসিকভাবে, ক্রিয়াভিত্তিক বাংলাভাষাকে যা ধারণ করে রেখেছে তার মধ্যে বিশ্বের আদি শব্দকোষ যাস্কের ‘নিরুক্ত’ (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০), বৌদ্ধযুগের ‘অমরকোষ’ (৭০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (১৯০০ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখযোগ্য। এই ধারাকেই সম্প্রতি কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী বিকশিত করে চলেছেন। অপরদিকে বাংলা ভাষার প্রতীকী ধারা নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ করেন পাণিনি, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির ধারাকে পাশাপাশি বহাল রেখেই। ইংরেজ আমলে, ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি পণ্ডিত ইংরেজি ভাষার জ্ঞান দিয়ে যখন বাংলাকে বুঝতে ও সে অনুযায়ী সংস্কার করতে গেলেন, বাংলাভাষা তার স্বভাব ও বৈচিত্র্য থেকেই শুধু বিচ্যুত হ’ল না, শব্দের ভয়াবহ অর্থ সংকোচন ঘটে গেল, একটি সংকর বা জগাখিচূড়ী ব্যাকরণের অধিকারী হল’ এবং প্রতীকী ইংরেজি ভাষার আদলে প্রতীকী বাংলাভাষার সূত্রপাত ঘটে গেল। সুনীতিবাবুই সেই কর্মটি প্রথম সম্পাদন করেন।
এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী তাঁদের যৌথ আলোচনা ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’-য়, যা পাওয়া যাবে তাঁদের ওয়েবসাইট www.banglasemantics.net-এ, যার লিংক আমি আলোচনার শেষে দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দ নিয়ে যে শব্দকোষ তৈরী করেন (বঙ্গীয় শব্দকোষ), সেই ধারাকেই সম্প্রতি ভাষাতাত্ত্বিক ও লেখক কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী বিপুল সমারোহে বিকশিত করে চলেছেন নব নব আবিষ্কার ও অর্থদ্যোতনা যোগ করে। তাঁদের এই বিপুল শ্রম ও আবিস্কারের ফসল নতুন ‘বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ’-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হবে এ বছর অক্টোবর মাসে। আমাদের আলোচনায় যে-সব শব্দের সংজ্ঞা ও তার কলকব্জা নিয়ে আমরা বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছি, আমার বিশ্বাস এ বিষয়ে কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীর গবেষনা ও আবিস্কারের সহায়তা নিয়ে আমরা তার অনেক যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছুতে পারব। এক্ষেত্রে www.banglasemantics.net-এ প্রকাশিত তাঁদের নিবন্ধ ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’ হবে আমার অন্যতম উৎস।
এখন দেখা যাক, আমাদের বির্তকের বিষয়গুলো নিয়ে। এর একটি ছিল সিলেবল, যার দুটি বিষয় নিয়ে আমাদের ভেতর মতপার্থক্যঃ সিলেবল কি অক্ষর? উচ্চারণের কোন পরিমাপকে আমরা একটি সিলেবল বলে গন্য করব? প্রথম কথা হলো, সিলেবল বাংলা ভাষার নিজস্ব বিষয় নয়। এটা ইংরেজি ব্যাকরণ থেকে আমদানী করা হয়েছে যা বাংলাভাষার স্বভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ ইংরেজি ভাষায় সিলেবল যে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, সেই ধারণাই বাংলাভাষার সাথে বিরোধাত্মক। কোনো শব্দ যে-সব ধ্বনি সমবায়ে তৈরী হয়, সেই ধ্বনি সমূহের কোনো একটা পরিমাপকে সিলেবল বলে (কি সেই পরিমাপ, সেই তর্কে পরে আসছি)। এখন ইংরেজি ভাষায় ধ্বনির ধারণা বাংলা ভাষায় ধ্বনির ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। দেখুন এ বিষয়ে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বক্তব্যঃ “কলকাতার সংসদ বাংলা অভিধান (স.বা.অ.) ‘ধ্বনি’ শব্দটির অর্থ দিয়েছে – শব্দ, রব ... ইত্যাদি। ঢাকার ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বা. বা. অ.) শব্দটির অর্থ দিয়েছে - শব্দ, কণ্ঠস্বর, রব ... ইত্যাদি। অর্থাৎ, এই অভিধানগুলি ‘ধ্বনি’ বলতে প্রধানত ‘আওয়াজ’ বা sound বোঝে। তাদের এই ধারণা সমর্থিত হয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ সাম্প্রতিক কালের সমস্ত ভাষাতাত্বিক, বাংলাভাষী grammarian ও phonologist-দের লেখাজোখা থেকে। তাছাড়া, সুনীতিবাবু তাঁর ‘ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে ধ্বনির সংজ্ঞা লিখে গেছেন, ‘কোনও ভাষার উচ্চারিত শব্দকে (word) বিশ্লেষণ করিলে, আমরা কতকগুলি ধ্বনি (sound)পাই।’ (২.১.১.১)
এদিকে আমরা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে ‘ধ্বনি’ শব্দের অর্থ পেয়েছি ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় আওয়াজ’ বা ‘meaningful active sound’। সুনীতিবাবু ইংরেজি sound শব্দের প্রতিশব্দ করে দিয়েছেন আমাদের ‘ধ্বনি’-কে এবং এর ভিতরে যে ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় বা ‘meaningful active’ ব্যাপারটি ছিল, তা বর্জন করেছেন। অন্যেরা তাঁকেই অনুসরণ করেছেন। তাঁর এরকম সিদ্ধান্তের ফলে ‘ধ্বনি’ শব্দটি রাতারাতি অর্থহীন নিষ্ক্রিয় sound মাত্রে পর্যবসিত হয়েছে, ‘ধ্বনি’ নির্ধন হয়ে গেছে। ক্ষতিটা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এরপর আধুনিক বাঙালিরা গেছেন পাশ্চাত্যের Phonetics, Phonology ইত্যাদি শিখে বাংলাভাষায় ধ্বনিতত্ত্বের চর্চা করতে। ফল আরও মন্দ হয়েছে। বহুকালক্রমাগত আমাদের ‘অর্থপূর্ণ সজীব আওয়াজ’–এর চর্চা পরিণত হয়েছে ‘অর্থহীন সজীব আওয়াজ’-এর চর্চায়। ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে সুনীতি পরবর্তীকালে রচিত সমস্ত বাংলা গ্রন্থ এভাবেই দূষিত হয়ে গেছে। ... ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির অর্থ নিষ্কাশনের যে রীতি, তাতে প্রতিটি বর্ণের একপ্রকার সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকে এবং তা সমস্ত শব্দের ক্ষেত্রেই একই ভাবে প্রযুক্ত হয়। আমরা সেই সর্ব শাব্দিক বর্ণার্থের নীতিই অনুসরণ করেছি। তাতে প্রতিটি বর্ণের যেমন যেমন অর্থ আমরা পেয়েছি, তাই ধরে ধরেই শব্দগুলির অর্থ নিষ্কাশন করছিলাম। সেই নিয়মেই শব্দের গভীরে অব্যক্ত, আধা-অব্যক্ত, প্রায়-ব্যক্ত যেসব অর্থ পাচ্ছিলাম, তাকেই সম্পূর্ণ ব্যক্তরূপে তুলে প্রকাশ করছিলাম; সে রকমই করে গেছেন আমাদের পূর্বসূরী হরিচরণ, অমরকোষ, যাস্ক, প্রমুখ পূর্বাচার্যগণ। সে নিয়মেই ‘ধ্বনি’ শব্দের আধা-অব্যক্ত অর্থ পেয়েছিলাম, ‘ধ্ব-এর(=ধারণবাহীর)ন্ (-রহস্য রুপ) া -কার (-গতিশীল যাহাতে)। তাকে ব্যক্তরূপে তুলে আনলে অর্থটি দাঁড়ায় ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় আওয়াজ’ বা ‘meaningful active sound’। আমাদের ইচ্ছা- অনিচ্ছা থেকে ‘ধ্বনি’ শব্দের এরকম অর্থ হয়নি। ‘ধ্ব’-এর যা মানে, তাকে কেবল ‘ধ্বনি’-র ক্ষেত্রে বিরাজিত ভাবলে চলবে না, একই সঙ্গে ‘ধ্বজা’ বা ‘ধ্বংস’ শব্দের অর্থের সঙ্গেও খাপ খেয়ে যেতে হবে। আমাদের নিষ্কাশিত ‘ধ্ব’-এর মানে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছিল।’’ সুতরাং, ইংরেজি ভাষায় যে বিষয়ের (ধ্বনি)-র উপর সিলেবল-এর সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত, তাই যেহেতু বাংলাভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাই এর প্রথম প্রত্যয় নিষ্ক্রিয় করা গেল।
এবার আসুন দেখা যাক, সিলেবলের পরিমাপ নিয়ে আমাদের ভিতর কি তর্ক হয়েছিল। কবি, ছান্দসিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে আমি বলেছিলাম, “এক কথায় বলতে পারি, কোনও-কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে নূন্যতম চেষ্টায় যেটুকু আমরা বলতে পারি, তাই হচ্ছে সিলেবল। সেই দিক থেকে এক-একটি সিলেবল হচ্ছে আমাদের উচ্চারণের এক-একটি ইউনিট কিংবা একক।’’ কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ এর সমালোচনা করে বলেছিলেন, “এই ডেফিনিশনে “কোনো-কিছু’’ কোনো অর্থ বহন করে না। সিলাবল হল: একটা “স্বরধ্বনি’’ উচ্চারণের কাল, যে স্বরধ্বনির আগেপিছে যে-কোনো-সংখ্যক ব্যঞ্জনধ্বনি থাকতে পারে।’’ আর আপনি বলেছিলেন, “আমি সংজ্ঞাটিকে এভাবে ভাবি : দুইটি পূর্ণ স্বরধ্বনি উচ্চারণের আগ পর্যন্ত যা কিছু উচ্চারণ করা হয় তাই একটি সিলেবল বা অক্ষর।’’
এখন syllable-এর ধারণা যেহেতু ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে, সুতরাং খোদ ইংরেজি অভিধান ও ব্যাকরণবিদগণ একে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেন এবং এর পরিমাপ সম্পর্কে কি ব্যাখা দেন, চলুন তার খোঁজ-খবর করি। “Syllable শব্দটি (তার আদি গ্রীক রূপ syllabe-এর ব্যুৎপত্তি অনুসারে) ‘কয়েকটির- সমষ্টিকে’ বোঝায়, ইংরেজিতে যাকে few বা some বলা হয়। যে অর্থে syllable শব্দটি ইংরেজিতে ব্যবহার হয়, তার কোনো সুস্পষ্ট অর্থ নেই। Chambers Dictionary ‘syllable’ শব্দের অর্থ দিয়েছে ‘a word or part of a word uttered by a (more or less) single effort of the voice, and into which a word can be divided for the purposes of linguistic analysis’। ‘more or less’- এই phrase-টিতে অস্পষ্টতার ছায়া সুস্পষ্ট। তাছাড়া vowel-এর ঠিক কতটা উপস্থিতি আবশ্যিক তারও ইঙ্গিত নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় marble, hurtle, chuckle প্রভৃতি শব্দে -ble, -tle,-ckle প্রভৃতিকে তত্তদ্ শব্দের দ্বিতীয় syllable হিসেবে ধরতে হয় metre (মাত্রা/ ছন্দ) বিচারের কালে, যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘e’ অনুচ্চারিত এবং vowel-এর উপস্থিতি প্রায় শূন্যমাত্রায়। Oxford University Press-এর ছাপা Advanced Dictionary of Current English, 2nd Edition (1963)- র মতো গ্রন্থ পর্যন্ত ঠিক এইরকম syllable ভাগ দেখিয়েছে। Princeton Encyclopedia of Poetry and Poetics, Enlarged Edition 1975-তে syllable-এর সংজ্ঞা দেওয়া আছে এই রকম – “Linguistically, the domain of any degree of accent in spoken utterance, the syllable is the smallest measurable unit of poetic sound, the fundamental building-block of metrical structure...’ (p. 832) গ্রন্থটি অন্যত্র আরও জানায় – ‘In most languages the syllabic center is typically a vowel (v), which may or may not have consonant (c) accompaniment before and (less generally) after. In such languages it is exceptional, but in most not impossible, that syllabic centers be consonantal (Psst!); but in some languages, like the Japanese, a single consonant may be a syllable (pp. 673-4)”। অথচ ঐ syllable যেন একটি সুনির্দিষ্ট আওয়াজ বা শব্দখণ্ড, এমন ধরে নিয়ে বাংলা ব্যাকরণের সুনির্দিষ্ট ক্রিয়াভিত্তিক (বর্ণভিত্তিক) পরিভাষাকে, এক্ষেত্রে ‘অক্ষর’-কে, অনির্দিষ্ট ইংরেজি পারিভাষিক অর্থে পরিণত করে দিতে সুনীতিবাবুর কষ্ট হয়নি। এমনকি sound laboratory-তে যদি যন্ত্রের সাহায্যে কবিতাপাঠের প্রতিকৃতি নেওয়া হয়, তবে প্রায়ই মনে হবে syllable বলে কিছু নেই; কেননা যেখানে ভাবা হয়েছিল syllable-এর শেষ, অন্য syllable-এর আরম্ভ, সেখানে পাওয়া যায় ‘a continuum of voice’।’’ (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে এবার আসা যাক, সিলেবল-কে ‘অক্ষর’ বলে মানতে বাধা কোথায়?“স.বা. অভিধানে দেখা যায়, ‘অক্ষর’ শব্দটির মানে দেওয়া আছে – বর্ণ, যার ক্ষরণ নেই অর্থাৎ ব্রহ্ম, পরমাত্মা, শিব, বিষ্ণু, আকাশ, (ছন্দে) একেবারে উচ্চারণসাধ্য শব্দের ক্ষুদ্রতম অংশ, syllable, (বীজগনিতে) অঙ্কের প্রতীকরূপে ব্যবহূত বর্ণ, ক্ষরণহীন। বা. বা. অভিধান ‘অক্ষর’-এর মানে দিয়েছে এই রকম – ক্ষরণশূন্য, স্থিতিশীল, বর্ণ, হরফ, letter,(ছন্দে) একেবারে উচ্চারণযোগ্য শব্দের ক্ষুদ্রতম অংশ, syllable, সিসা নির্মিত হরফ, type। এমনকি বামন শিবরাম আপ্তে-র ‘Sanskrit English Dictionary’ -তেও ‘অক্ষর’ শব্দের মানে দেওয়া হয়েছে -- imperishable, fixed, Siva, Vishnu, letter of alphabet, syllable, word of words … ইত্যাদি।
হরিচরণ কিন্তু তা করেন নি। তিনি ‘অক্ষর’ শব্দটিকে – অ-ক্ষর, অক্ষ-র – দুরকমভাবে বুঝেছেন এবং আমাদের বিচারে ঠিকই বুঝেছেন। প্রথমটির মূলে রয়েছে ‘ক্ষ’ ক্রিয়া (ক্ষইয়ে দেওয়া, ক্ষরিত হওয়া), দ্বিতীয়টির মূলে রয়েছে ‘অশ্’ ক্রিয়া (সর্বদিকে সমভাবে শক্তিবিচ্ছুরণ ক্রিয়া বা ছড়িয়ে পড়া)। তাই, তাঁর কোষগ্রন্থে ‘অক্ষর’ শব্দটির ভুক্তি ঘটেছে দুবার। প্রথমবারে সেটি অ-ক্ষর। তাই তিনি তার ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিয়েছেন – ‘যাহা ক্ষরিত বা নষ্ট হয় না’; এবং প্রতীকী অর্থ দিয়েছেন স্থির, ধ্রুব, ক্রিয়াশূন্য, কূটস্থ, শিব, বিষ্ণু …ইত্যাদি ১০ টি। আর দ্বিতীয়বারে সেটি অক্ষ-র। তাই তার ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিয়েছেন – ‘যাহা বেদাদি ব্যাপ্ত করে’ (ছড়িয়ে দেয়); এবং প্রতীকী অর্থ দিয়েছেন স্বরবর্ণ, স্বর বা স্বরসহিতব্যঞ্জন, বর্ণনির্মাণ ... ইত্যাদি পাঁচটি। আজ আমরা জানি, ‘যাহার দ্বারা বিদিত হওয়া যায়’, তেমন ‘দিশামুখী জ্ঞান’কে বেদ বলে এবং সেই বেদকে ব্যাপ্ত করে ‘অশ্-কারী’ অক্ষর। এই ‘অক্ষর’ স্বভাবতই মানুষের কথিত জ্ঞানপূর্ণ বয়ানের স্বর, যার ভিতরে মানুষের ‘স্ব’ বা আমিত্ব ‘রহে’ (র)। এই ‘অক্ষর’-কে হরিচরণ সেকারণেই ‘স্বরবর্ণ ... ইত্যাদি বলেছেন।” (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)
আমরা যে ‘অক্ষর’ নিয়ে তর্ক করছি তা’হল অক্ষ-র, অ-ক্ষর নয়। তাই ‘অক্ষর’ মানে ‘যাহা ক্ষরিত বা নষ্ট হয় না’ অথবা ‘ক্ষরণ নাই যাহাতে’ এইসব অর্থ এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু যে কথা প্রাসঙ্গিক তা’হল, যে ‘অর্থহীন ধ্বনিসমষ্টির মৃত আওয়াজ’- কে ইংরেজ পণ্ডিত এবং তার অন্ধ অনুসারী সুনীতিবাবু syllable নামে সংজ্ঞায়িত করেন, তা কিভাবে বাংলা ভাষার ‘অক্ষর’ নামক সুনির্দিষ্ট অর্থবহনকারী শব্দের সমার্থক হবে? এসম্পর্কে সিদ্ধান্তসূচক উপসংহার তাই কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বক্তব্য উপস্থাপন করে সারতে চাইঃ “ syllable ধারণাটি পশ্চিমে গড়ে উঠেছে, শব্দাবলীকে অর্থরহিত ক’রে, শুধু আওয়াজ হিসেবে তাদের খণ্ড খণ্ড করে দেখার মধ্যে দিয়ে। আমাদের বাংলা ভাষায় ‘শব্দাংশ’ কথাটিই এর অনুষঙ্গে যথার্থ হবে; কেননা; ‘শব্দ’-এর ভিতরে ঘটনার ‘শব’ থাকে, যা মৃতদেহ মাত্র। হরিচরণও syllable-এর প্রতিশব্দ রূপে ‘শব্দাংশ’ই ব্যবহার করেছেন এবং ঠিক করেছেন। কিন্তু তা না করে, আমাদের অবিনশ্বরাত্মক বা ব্যাপকার্থক ‘অক্ষর’- কে ওদের syllable-এর সঙ্গে জোর করে মিলিয়ে ছেড়ে দিলে syllable টিকে যেতে পারে, কিন্তু ‘অক্ষর’ প্রাণে বাঁচে না।’’ (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)
আমি এর সাথে শুধু এটুকুই যোগ করতে চাই যে, ‘শব্দাংশ’ যদি syllable হয়, তা’হলে ‘পদাংশ’ বা ‘দল’ ইত্যাদিও যুক্তিসঙ্গত কারণেই পাশাপাশি গৃহীত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
এবার আসা যাক উচ্চারণ এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে। গালিব বলছেন, “উপরন্তু, আপনি যখন ঈ=ই+ই বলে ‘ঈ’-এর মধ্যে দুইটি স্বরধ্বনি সন্ধান করেন, তখন আরেকবার মূর্খতা অট্টহাস্য দিয়ে ওঠে।ওটা পৃথক দুইটি স্বরধ্বনির যোগফল নয়, উচ্চারণের হ্রস্বতা ও দীর্ঘতার মামলা। আবদুল হাই মনোযোগ দিয়ে পড়েন, ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।” আপনার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, বিষয়টা শুধু উচ্চারণের হ্রস্বতা ও দীর্ঘতার মামলাই নয়, অর্থের মামলাও বটে। কিভাবে তা অর্থের মামলা সে উদাহরণ দেবার আগে, দেখা যাক হাই সাহেব ইংরেজি শিক্ষার কুপ্রভাবে বাংলা ভাষায় এই দীর্ঘ ও হ্রস্ব স্বরের কি ব্যাখা করেছিলেন এবং তা কেন ত্রুটিপূর্ণ। উদ্ধৃতিঃ ‘... মূলধ্বনি হিসেবে ইংরেজির feel, seed, seat প্রভৃতি শব্দে দীর্ঘ ‘i’ (ঈ) এবং fool, cool প্রভৃতি শব্দের দীর্ঘ ‘u’ (ঊ)-র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইংরেজিতে আভিধানিক পর্যায়ে দীর্ঘ ‘i’ এবং দীর্ঘ ‘u’ হ্রস্ব ‘i’ এবং হ্রস্ব ‘u’ সমন্বিত শব্দকে অর্থের দিক থেকে পৃথক করে দেয়। তুলণীয় feel এবং fill, fool এবং full শব্দাবলী। বাংলা হরফে হ্রস্ব ই এবং দীর্ঘ ঈ, হ্রস্ব উ এবং দীর্ঘ ঊ আমরা লিখলে মূলধ্বনি হিসেবে ঈ এবং ঊ-এর স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ ইংরেজির মত বাংলার হ্রস্ব ই এবং দীর্ঘ ঈ কিংবা হ্রস্ব উ এবং দীর্ঘ ঊ দিয়ে অন্যান্য ধ্বনি ঠিক রেখে দুটো স্বতন্ত্র শব্দ পাই না। বাংলা স্বরধ্বনিতে মূলস্বরধ্বনি হিসেবে হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ ই এবং হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ উ-এর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। প্রশ্ন ওঠে শুধু ই-জাতীয় একটি ধ্বনির এবং উ-জাতীয় একটি ধ্বনির। বাংলায় মূলধ্বনি হিসেবে ই এবং উ-এর দীর্ঘত্ব কোনো স্বতন্ত্র ধ্বনিগুলোর সৃষ্টি করে না।...’’ (ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই, পৃষ্ঠা ২৩২)
এবার আসুন দেখা যাক, নিম্নের উদাহরণগুলো কি বলে?
গিরি + ইন্দ্র = গিরীন্দ্র
গিরি = পর্বত, ইন্দ্র = ইন্দ্র নামের কোনো দেবতা। কিন্তু ‘গিরীন্দ্র’ বলতে আমরা বুঝি গিরিদের ইন্দ্র, অর্থাৎ গিরিশ্রেষ্ঠ বা সর্বোচ্চ পর্বতকে। এখানে গিরি-র ‘ই’ এবং ইন্দ্র-র ‘ই’ স্বরধ্বনি দুটো যুক্ত হয়ে দীর্ঘ ‘ঈ’ স্বরধ্বনি তৈরী করে এবং তা পৃথক দুটো শব্দের মধ্যে সন্ধির ফলাফল হিসেবে বিরাজ করে নতুন শব্দের (গিরীন্দ্র) জন্মকে সম্ভব করে তোলে। একারণেই ‘তির তির’ করে জল বয়ে যাওয়া নদীর দুই পাড়কে ‘তীর’ বলে এবং ‘কুল কুল’ করে জল বয়ে যাওয়া নদীর দুই পাড়কে ‘কূল’ বলে। ‘তির তির’ এবং ‘কুল কুল’ জল(ধ্বনি)র অন্তর্গত ‘ই’ এবং ‘উ’ ধ্বনিকে তাই চাইলেই নিতান্ত উচ্চারণের মামলা বলে দীর্ঘ ‘ঈ’ অথবা দীর্ঘ ‘ঊ’ হিসেবে উচ্চারণ করা যায় না, কেননা তাতে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। বহমান জলপ্রবাহ যাত্রীদের নদী পারাপারে সাহায্য না করে বরং নদীর পারে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখে। আশা করি হাই সাহেবের ভ্রান্তি কোথায়, এবার তা পরিস্কার হয়েছে।
অবশেষে উচ্চারণের প্রসঙ্গ টেনে আপনি ছন্দ বিষয়ে আপনার অভিমত প্রকাশ করেন, “উচ্চারণেই দৈর্ঘ্যের সঙ্গে এর একটি গুপ্ত সম্পর্ক আছে।’’ আপনি অভিনিধানের প্রসঙ্গ টেনে ব্যাখা করতে চেয়েছেন, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী ‘কৃষ্ণের’ এবং ‘উৎসুক’ শব্দ দুটিকে তিন মাত্রার পরিবর্তে কেন উচ্চারণের স্বাধীনতা গ্রহণ করে চারমাত্রা পড়া যায় ... “কবি যখন ‘কৃষ্ণের’ শব্দটা চারমাত্রা গণনা করতে চান, বুঝতে হবে তখন তিনি শব্দের উচ্চারণ আশা করছেন এমন: কৃশশ+নের। অর্থাৎ শিসধ্বনিটার উচ্চারণকে প্রলম্বিত করতে চাইছেন। একইভাবে, উৎ+সুক -- এখানে কবি 'উৎ' বলে পলমাত্র থামতে চাইছেন। এই আর কি।”
প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের উচ্চারণের স্বাভাবিক ঝোঁক অনুযায়ী, ‘কৃষ্ণ’ শব্দের ‘কৃষ্’ উচ্চারিত হবে দ্রুত, তাকে টেনে পড়তে যাব কেন? সেটা কি তাহলে ছন্দে যাতে চারমাত্রা পাওয়া যায়, সে জন্য আরোপ করতে হবে? এবং একইভাবে ‘উৎসুক’ শব্দে ‘উৎ’-এর উচ্চারণের পর পলমাত্র থামারও কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কবি নিজেও তেমন দাবী করেন না। এখন যদি আপনার কথামত আমরা তা বিবেচনায় নিতে যাই, বাংলা ভাষার স্বভাব কি তা অনুমোদন করে? উত্তর – না! মজার ব্যাপার হ’ল হাই সাহেবের বক্তব্য এক্ষেত্রে আমার মতকেই সমর্থন করে। হাই সাহেব ঐতিহ্যগতভাবে সুনীতি অনুসারী হলেও, বহু ক্ষেত্রেই অনেক বেশী সৃজনশীলতা ও দূরদর্শীতার প্রমাণ দিয়েছেন। সে যা হোক, হাই সাহেবের বক্তব্য কিভাবে আমার মতকে সমর্থন করে বোঝার জন্য আসুন দেখি, হাই সাহেব সাধারণভাবে ভাষার স্বভাব-প্রকৃতি এবং বাংলা ভাষায় তার আচরণ সম্পর্কে কি বলেন?
‘... নদীস্রোতে যেমন নানা তরঙ্গ উঠে, মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনিতেও তেমনি সেই তরঙ্গেরই লীলা। তা-ই ভাষা ধ্বনিগুণের সুক্ষ্ম ও জটিলতম দিককে উদ্ঘাটিত করে দেয়। ধ্বনির এ সূক্ষ্ম সুন্দর সামগ্রিক গুণ একদিকে যেমন অনুভূতি সাপেক্ষ, অন্যদিকে তেমনি বিশেষণাতীত। এদিক থেকে সামগ্রিক ধ্বনিপ্রবাহের মধ্যে দৈর্ঘ্য (length), ঝোঁক (stress), শ্রুতদ্যোতকতা (prominence), জোর (emphasis), ধ্বনিতরঙ্গ (intonation) প্রভৃতি গুণই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।’’(ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই, পৃষ্ঠা ২৩১)
অন্যত্র এই length-কে বলা হয়েছে quantity, duration আর stress-কে বলা হয়েছে accent। length -কে দৈর্ঘ্য, সার্থপর্ব, স্থিতিগত, পরিমাপগত ইত্যাদি যেমন বলা হয়, তেমনি stress, accent-কে শ্বাসাঘাত, ঝোঁক, শ্বাসপর্ব, প্রস্বন, প্রচাপন, বল ইত্যাদিও বলেছেন আবদুল হাই। বলেছেন, “বাংলা-বাকপ্রবাহে দুরকম পদবিন্যাস দেখি। একটি সার্থপর্ব এবং অন্যটি শ্বাসপর্ব। (পৃষ্ঠা ২৪২) ... দৈর্ঘ্যের মত stress ধ্বনিকে গুণময় করে। ধ্বনির নানাগুণে বাকপ্রবাহ গুণান্বিত হয়। বাকপ্রবাহের অন্যান্য গুণ থেকে ধ্বনিসংশ্লিষ্ট শ্বাস-প্রক্ষেপণের জোরটুকুকে কোনক্রমে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে যা পাওয়া যায় তাকেই stress বা accent নামে অভিহিত করা যায়। (পৃষ্ঠা ২৪২) ... ইংরেজি, জার্মান, স্পেনিয়, গ্রীক এবং সোয়াহিলী প্রভৃতি ভাষায় বিভিন্ন শব্দে (words in isolation) এ ধরনের শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তনের সাহায্যে একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হওয়ায় এবং পৃথক পৃথক শব্দে শ্বাসাঘাতের বহুল প্রচলন থাকায় এগুলোকে ‘stress language’ বা শ্বাসাঘাতপ্রধান ভাষা বলা হয়। বাক্যে পার্শ্ববর্তী শব্দ কিংবা শব্দাবলীর তুলনায় কোনো শব্দের অর্থে আবেগের গভীরতা কিংবা কোনো বৈপরীত্য (contrast) সৃষ্টির জন্যে সাধারণত শ্বাসাঘাতের ব্যবহার করা হয়। বাক্যের বৃহত্তর প্রয়োজনে সেজন্য শব্দের নির্ধারিত শ্বাসাঘাত কখনও লুপ্ত হয়, কখনও স্থান পরিবর্তন করে আর কখনও বা অক্ষুণ্ন থাকে। ইংরেজির মত বাংলা stress বা শ্বাসাঘাত প্রধান ভাষা নয়। এমন কি বাংলায় একই শব্দে শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তনের ফলে ইংরেজির মত বিভিন্ন অর্থ উদ্রিক্ত করার অবকাশও নেই। সেজন্য জাপানি, হিন্দুস্থানী, মারাঠি প্রভৃতি ভাষার মত বাংলাকে Stressless language তথা শ্বাসাঘাতহীন ভাষা বলা হয়।…” (পৃষ্ঠা ২৪৩)। মোট কথা মুহম্মদ আবদুল হাই এমন অনেক কথা বলেছেন, যাতে বোঝা যায়, তিনি যদি পদার্থবিজ্ঞানের (Physics) কণাতরঙ্গ ব্যাপারটি জানতেন, তাহলে হয়তো তিনিই বলে যেতেন যে, ইংরেজ কণাপ্রধান ভাষাতে কথা বলে, আমরা বাংলাভাষীরা তরঙ্গপ্রধান ভাষাতে কথা বলি।
এজন্য হাই সাহেবের কথার সূত্র ধরেই বলি যে, বাংলা ভাষায় ইচ্ছে করলেই শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তন করতে পারি না, কেননা তার কোনো অর্থ হয় না এবং বাংলা ভাষার স্বভাব তা অনুমোদন করে না। তাই ‘কৃষ্ণের’ এবং ‘উৎসুক’ শব্দ দুটোকে খেয়াল খুশীমত টেনে বা থেমে উচ্চারণ করে চার মাত্রার লাইসেন্স দেয়া যায় না।
এ আলোচনার উদ্দেশ্য অহং-এর বিজয় নয়, বরং কাল পরিক্রমায় পরিবর্তশীল বাংলাভাষার পূর্বাপর ইতিহাসকে বিবেচনায় নিয়ে ভাষার ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে যথাসম্ভব ভ্রান্তিহীন থাকার একান্ত আকাঙ্ক্ষা। সবাইকে এ আলোচনা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’ নিবন্ধটি ও এযাবত কাল পর্যন্ত তাঁদের চিন্তাভাবনার সার সংক্ষেপ যে ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে তার লিঙ্কঃ http://www.banglasemantics.net/works.html
কবি তুষার গায়েনের নোটটির লিংক-
http://www.facebook.com/notes.php?drafts&id=1573787229#/note.php?note_id=234284085124&ref=mf
প্রিয় বন্ধুগণ, যে আলোচনাটি আমি এখানে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি তার সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় দেড় মাস আগে। সতীর্থ কবি শাহানা আকতার মহুয়ার একটি ছোট্ট কবিতা ‘রাধিকা পুরান’-এর ছন্দের মাত্রা গণনা নিয়ে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে আমার বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্ক অচিরেই আর মাত্রা গণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা তেজস্ক্রিয়তার মত ছড়িয়ে পড়ে ছন্দ সম্বন্ধীয় অন্যান্য সংজ্ঞা ও প্রচলিত প্রত্যয় সমূহের কেন্দ্রেঃ সিলেবল কি? সিলেবলের বাংলা নাম কি? সিলেবল ও অক্ষর কি সমার্থক? সিলেবলের পরিমাপ কি? ইত্যাদি... ইত্যাদি...। আলোচনার এক পর্যায়ে কবি সোহেল হাসান গালিব অংশগ্রহণ করেন এবং বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। গালিব তার বক্তব্যের সপক্ষে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে দু’টো বই (ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় / ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই) হাজির করেন এবং দাবী করেন যে, যদি আমাকে যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা চালিয়ে যেতে হয় তাহলে, উপরোক্ত বই দুটো আমার পড়া ও অনুধাবনে থাকা আবশ্যিক। অগত্যা আমাকে বই দু’টো জোগাড় করে পড়তে হল। প্রবাসে বসে এইসব বইপত্র জোগাড় করা দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ, তবু আলোচনার স্বার্থে এই বই দু’টোই শুধু নয়, আরো অনেক কিছুই নতুন করে পড়তে হ’ল এবং বোঝা গেল যে, আমরা বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এবং কেন আমাদের মধ্যে এই মতপার্থক্য হচ্ছে। এই লেখাটি উন্মোচন করবে বাংলাভাষার এমন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা, যার সাথে অনেকেই অপরিচিত অথচ যার পরাক্রান্ত আহ্বান আমরা কেউ উপেক্ষা করতে পারি না। আলোচনাটি ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করার সুবিধার্থে, আমি পূর্বের আলোচনার লিঙ্ক শুরুতেই দিয়ে দিচ্ছিঃ
1.http://www.facebook.com/profile.php?id=1123716726#/note.php?note_id=208314290124
2.http://www.facebook.com/profile.php?id=1123716726&ref=ts#/note.php?note_id=80303980417
গালিব, যে বিষয়গুলো নিয়ে আপনার ও কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে আমার মতপার্থক্য হচ্ছে, যেমনঃ অক্ষর, সিলেবল, ছন্দের মাত্রা এবং প্রাসঙ্গিক আরো কিছু যা এই আলোচনার উপজাত, সে-সব বিষয় নিয়ে নির্দিষ্টভাবে ব্যাখা-বিশ্লেষণ হাজির করার আগে, প্রাথমিক কিছু কথা সেরে নিতে হবে। বাংলাভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে কোনো দূরদর্শী ও পরিণত আলোচনা করতে গেলে, সেটা বাংলাভাষার সমগ্র ইতিহাস(অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত) -এর উপর দাঁড়িয়ে করতে হবে, না হলে সে আলোচনা খণ্ডিত হতে বাধ্য। বাংলাভাষার বিবর্তনের একপর্যায়ে, ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে, বিশেষতঃ ইংরেজ আমলে ইংরেজি জানা বাঙালি পণ্ডিতরা বাংলাভাষাকে ইংরেজির আদলে গড়তে গিয়ে, ভাষার যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন করেছিলেন, অর্থগত ও কাঠামোগতভাবে, তার রেশ আমাদের এখনও বহন করতে হচ্ছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলাভাষার যে ব্যাকরণ প্রণয়ন করেছিলেন (যে ধারাতে পরে আরো অনেকেই এসেছেন যেখানে আবদুল হাই-ও অন্তর্ভূক্ত) যার উপর ভিত্তি করে আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ভাষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে, তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।
পৃথিবীর ভাষা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, বাক্যে ব্যবহূত শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করার দু’টো পদ্ধতি রয়েছে। তার একটি হচ্ছে, শব্দের বাইরে থেকে শব্দের অর্থ পাওয়া, যেখানে শব্দটি একটি আরোপিত অর্থ বহন করে এবং যে ধ্বনি সমবায়ে ঐ শব্দটির জন্ম, ঐ ধ্বনিগুলো আলাদাভাবে কোনো অর্থ বহন করে না। ভাষার এই ধারাটিকে প্রতীকী ভাষা (logocentric) বলা হয়। অন্য পদ্ধতি হচ্ছে, ক্রিয়াভিত্তিক (verb-based) শব্দার্থবিধি, যেখানে কোনো একটি শব্দের ভেতর থেকে শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করা হয় অর্থাৎ যে ধ্বনি সমবায়ে ঐ শব্দের জন্ম, ঐ ধ্বনিগুলির সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে এবং ধ্বনিগুলির সম্মিলনেই শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয়। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দ প্রায়শই অনেক অর্থ বহন করে। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার বিলুপ্তি হলেও, বাংলাভাষায় ক্রিয়াভিত্তিক ও প্রতীকী, উভয় ধারার চর্চাই ইংরেজ আগমনের আগ পর্যন্ত বহাল ছিল, যখন অনেক প্রাচীন রচনাকে একই সাথে প্রতীকী ও ক্রিয়াভিত্তিক উপায়ে পাঠ করার নিয়ম চালু ছিল। একটি উদাহরণ এখনও আমাদের হাতের কাছে রয়েছে, তা হ’ল চর্যাপদ। ঐতিহাসিকভাবে, ক্রিয়াভিত্তিক বাংলাভাষাকে যা ধারণ করে রেখেছে তার মধ্যে বিশ্বের আদি শব্দকোষ যাস্কের ‘নিরুক্ত’ (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০), বৌদ্ধযুগের ‘অমরকোষ’ (৭০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (১৯০০ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখযোগ্য। এই ধারাকেই সম্প্রতি কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী বিকশিত করে চলেছেন। অপরদিকে বাংলা ভাষার প্রতীকী ধারা নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ করেন পাণিনি, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির ধারাকে পাশাপাশি বহাল রেখেই। ইংরেজ আমলে, ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি পণ্ডিত ইংরেজি ভাষার জ্ঞান দিয়ে যখন বাংলাকে বুঝতে ও সে অনুযায়ী সংস্কার করতে গেলেন, বাংলাভাষা তার স্বভাব ও বৈচিত্র্য থেকেই শুধু বিচ্যুত হ’ল না, শব্দের ভয়াবহ অর্থ সংকোচন ঘটে গেল, একটি সংকর বা জগাখিচূড়ী ব্যাকরণের অধিকারী হল’ এবং প্রতীকী ইংরেজি ভাষার আদলে প্রতীকী বাংলাভাষার সূত্রপাত ঘটে গেল। সুনীতিবাবুই সেই কর্মটি প্রথম সম্পাদন করেন।
এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী তাঁদের যৌথ আলোচনা ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’-য়, যা পাওয়া যাবে তাঁদের ওয়েবসাইট www.banglasemantics.net-এ, যার লিংক আমি আলোচনার শেষে দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দ নিয়ে যে শব্দকোষ তৈরী করেন (বঙ্গীয় শব্দকোষ), সেই ধারাকেই সম্প্রতি ভাষাতাত্ত্বিক ও লেখক কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী বিপুল সমারোহে বিকশিত করে চলেছেন নব নব আবিষ্কার ও অর্থদ্যোতনা যোগ করে। তাঁদের এই বিপুল শ্রম ও আবিস্কারের ফসল নতুন ‘বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ’-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হবে এ বছর অক্টোবর মাসে। আমাদের আলোচনায় যে-সব শব্দের সংজ্ঞা ও তার কলকব্জা নিয়ে আমরা বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছি, আমার বিশ্বাস এ বিষয়ে কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীর গবেষনা ও আবিস্কারের সহায়তা নিয়ে আমরা তার অনেক যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছুতে পারব। এক্ষেত্রে www.banglasemantics.net-এ প্রকাশিত তাঁদের নিবন্ধ ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’ হবে আমার অন্যতম উৎস।
এখন দেখা যাক, আমাদের বির্তকের বিষয়গুলো নিয়ে। এর একটি ছিল সিলেবল, যার দুটি বিষয় নিয়ে আমাদের ভেতর মতপার্থক্যঃ সিলেবল কি অক্ষর? উচ্চারণের কোন পরিমাপকে আমরা একটি সিলেবল বলে গন্য করব? প্রথম কথা হলো, সিলেবল বাংলা ভাষার নিজস্ব বিষয় নয়। এটা ইংরেজি ব্যাকরণ থেকে আমদানী করা হয়েছে যা বাংলাভাষার স্বভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ ইংরেজি ভাষায় সিলেবল যে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, সেই ধারণাই বাংলাভাষার সাথে বিরোধাত্মক। কোনো শব্দ যে-সব ধ্বনি সমবায়ে তৈরী হয়, সেই ধ্বনি সমূহের কোনো একটা পরিমাপকে সিলেবল বলে (কি সেই পরিমাপ, সেই তর্কে পরে আসছি)। এখন ইংরেজি ভাষায় ধ্বনির ধারণা বাংলা ভাষায় ধ্বনির ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। দেখুন এ বিষয়ে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বক্তব্যঃ “কলকাতার সংসদ বাংলা অভিধান (স.বা.অ.) ‘ধ্বনি’ শব্দটির অর্থ দিয়েছে – শব্দ, রব ... ইত্যাদি। ঢাকার ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বা. বা. অ.) শব্দটির অর্থ দিয়েছে - শব্দ, কণ্ঠস্বর, রব ... ইত্যাদি। অর্থাৎ, এই অভিধানগুলি ‘ধ্বনি’ বলতে প্রধানত ‘আওয়াজ’ বা sound বোঝে। তাদের এই ধারণা সমর্থিত হয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ সাম্প্রতিক কালের সমস্ত ভাষাতাত্বিক, বাংলাভাষী grammarian ও phonologist-দের লেখাজোখা থেকে। তাছাড়া, সুনীতিবাবু তাঁর ‘ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে ধ্বনির সংজ্ঞা লিখে গেছেন, ‘কোনও ভাষার উচ্চারিত শব্দকে (word) বিশ্লেষণ করিলে, আমরা কতকগুলি ধ্বনি (sound)পাই।’ (২.১.১.১)
এদিকে আমরা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে ‘ধ্বনি’ শব্দের অর্থ পেয়েছি ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় আওয়াজ’ বা ‘meaningful active sound’। সুনীতিবাবু ইংরেজি sound শব্দের প্রতিশব্দ করে দিয়েছেন আমাদের ‘ধ্বনি’-কে এবং এর ভিতরে যে ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় বা ‘meaningful active’ ব্যাপারটি ছিল, তা বর্জন করেছেন। অন্যেরা তাঁকেই অনুসরণ করেছেন। তাঁর এরকম সিদ্ধান্তের ফলে ‘ধ্বনি’ শব্দটি রাতারাতি অর্থহীন নিষ্ক্রিয় sound মাত্রে পর্যবসিত হয়েছে, ‘ধ্বনি’ নির্ধন হয়ে গেছে। ক্ষতিটা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এরপর আধুনিক বাঙালিরা গেছেন পাশ্চাত্যের Phonetics, Phonology ইত্যাদি শিখে বাংলাভাষায় ধ্বনিতত্ত্বের চর্চা করতে। ফল আরও মন্দ হয়েছে। বহুকালক্রমাগত আমাদের ‘অর্থপূর্ণ সজীব আওয়াজ’–এর চর্চা পরিণত হয়েছে ‘অর্থহীন সজীব আওয়াজ’-এর চর্চায়। ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে সুনীতি পরবর্তীকালে রচিত সমস্ত বাংলা গ্রন্থ এভাবেই দূষিত হয়ে গেছে। ... ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির অর্থ নিষ্কাশনের যে রীতি, তাতে প্রতিটি বর্ণের একপ্রকার সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকে এবং তা সমস্ত শব্দের ক্ষেত্রেই একই ভাবে প্রযুক্ত হয়। আমরা সেই সর্ব শাব্দিক বর্ণার্থের নীতিই অনুসরণ করেছি। তাতে প্রতিটি বর্ণের যেমন যেমন অর্থ আমরা পেয়েছি, তাই ধরে ধরেই শব্দগুলির অর্থ নিষ্কাশন করছিলাম। সেই নিয়মেই শব্দের গভীরে অব্যক্ত, আধা-অব্যক্ত, প্রায়-ব্যক্ত যেসব অর্থ পাচ্ছিলাম, তাকেই সম্পূর্ণ ব্যক্তরূপে তুলে প্রকাশ করছিলাম; সে রকমই করে গেছেন আমাদের পূর্বসূরী হরিচরণ, অমরকোষ, যাস্ক, প্রমুখ পূর্বাচার্যগণ। সে নিয়মেই ‘ধ্বনি’ শব্দের আধা-অব্যক্ত অর্থ পেয়েছিলাম, ‘ধ্ব-এর(=ধারণবাহীর)ন্ (-রহস্য রুপ) া -কার (-গতিশীল যাহাতে)। তাকে ব্যক্তরূপে তুলে আনলে অর্থটি দাঁড়ায় ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় আওয়াজ’ বা ‘meaningful active sound’। আমাদের ইচ্ছা- অনিচ্ছা থেকে ‘ধ্বনি’ শব্দের এরকম অর্থ হয়নি। ‘ধ্ব’-এর যা মানে, তাকে কেবল ‘ধ্বনি’-র ক্ষেত্রে বিরাজিত ভাবলে চলবে না, একই সঙ্গে ‘ধ্বজা’ বা ‘ধ্বংস’ শব্দের অর্থের সঙ্গেও খাপ খেয়ে যেতে হবে। আমাদের নিষ্কাশিত ‘ধ্ব’-এর মানে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছিল।’’ সুতরাং, ইংরেজি ভাষায় যে বিষয়ের (ধ্বনি)-র উপর সিলেবল-এর সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত, তাই যেহেতু বাংলাভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাই এর প্রথম প্রত্যয় নিষ্ক্রিয় করা গেল।
এবার আসুন দেখা যাক, সিলেবলের পরিমাপ নিয়ে আমাদের ভিতর কি তর্ক হয়েছিল। কবি, ছান্দসিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে আমি বলেছিলাম, “এক কথায় বলতে পারি, কোনও-কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে নূন্যতম চেষ্টায় যেটুকু আমরা বলতে পারি, তাই হচ্ছে সিলেবল। সেই দিক থেকে এক-একটি সিলেবল হচ্ছে আমাদের উচ্চারণের এক-একটি ইউনিট কিংবা একক।’’ কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ এর সমালোচনা করে বলেছিলেন, “এই ডেফিনিশনে “কোনো-কিছু’’ কোনো অর্থ বহন করে না। সিলাবল হল: একটা “স্বরধ্বনি’’ উচ্চারণের কাল, যে স্বরধ্বনির আগেপিছে যে-কোনো-সংখ্যক ব্যঞ্জনধ্বনি থাকতে পারে।’’ আর আপনি বলেছিলেন, “আমি সংজ্ঞাটিকে এভাবে ভাবি : দুইটি পূর্ণ স্বরধ্বনি উচ্চারণের আগ পর্যন্ত যা কিছু উচ্চারণ করা হয় তাই একটি সিলেবল বা অক্ষর।’’
এখন syllable-এর ধারণা যেহেতু ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে, সুতরাং খোদ ইংরেজি অভিধান ও ব্যাকরণবিদগণ একে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেন এবং এর পরিমাপ সম্পর্কে কি ব্যাখা দেন, চলুন তার খোঁজ-খবর করি। “Syllable শব্দটি (তার আদি গ্রীক রূপ syllabe-এর ব্যুৎপত্তি অনুসারে) ‘কয়েকটির- সমষ্টিকে’ বোঝায়, ইংরেজিতে যাকে few বা some বলা হয়। যে অর্থে syllable শব্দটি ইংরেজিতে ব্যবহার হয়, তার কোনো সুস্পষ্ট অর্থ নেই। Chambers Dictionary ‘syllable’ শব্দের অর্থ দিয়েছে ‘a word or part of a word uttered by a (more or less) single effort of the voice, and into which a word can be divided for the purposes of linguistic analysis’। ‘more or less’- এই phrase-টিতে অস্পষ্টতার ছায়া সুস্পষ্ট। তাছাড়া vowel-এর ঠিক কতটা উপস্থিতি আবশ্যিক তারও ইঙ্গিত নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় marble, hurtle, chuckle প্রভৃতি শব্দে -ble, -tle,-ckle প্রভৃতিকে তত্তদ্ শব্দের দ্বিতীয় syllable হিসেবে ধরতে হয় metre (মাত্রা/ ছন্দ) বিচারের কালে, যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘e’ অনুচ্চারিত এবং vowel-এর উপস্থিতি প্রায় শূন্যমাত্রায়। Oxford University Press-এর ছাপা Advanced Dictionary of Current English, 2nd Edition (1963)- র মতো গ্রন্থ পর্যন্ত ঠিক এইরকম syllable ভাগ দেখিয়েছে। Princeton Encyclopedia of Poetry and Poetics, Enlarged Edition 1975-তে syllable-এর সংজ্ঞা দেওয়া আছে এই রকম – “Linguistically, the domain of any degree of accent in spoken utterance, the syllable is the smallest measurable unit of poetic sound, the fundamental building-block of metrical structure...’ (p. 832) গ্রন্থটি অন্যত্র আরও জানায় – ‘In most languages the syllabic center is typically a vowel (v), which may or may not have consonant (c) accompaniment before and (less generally) after. In such languages it is exceptional, but in most not impossible, that syllabic centers be consonantal (Psst!); but in some languages, like the Japanese, a single consonant may be a syllable (pp. 673-4)”। অথচ ঐ syllable যেন একটি সুনির্দিষ্ট আওয়াজ বা শব্দখণ্ড, এমন ধরে নিয়ে বাংলা ব্যাকরণের সুনির্দিষ্ট ক্রিয়াভিত্তিক (বর্ণভিত্তিক) পরিভাষাকে, এক্ষেত্রে ‘অক্ষর’-কে, অনির্দিষ্ট ইংরেজি পারিভাষিক অর্থে পরিণত করে দিতে সুনীতিবাবুর কষ্ট হয়নি। এমনকি sound laboratory-তে যদি যন্ত্রের সাহায্যে কবিতাপাঠের প্রতিকৃতি নেওয়া হয়, তবে প্রায়ই মনে হবে syllable বলে কিছু নেই; কেননা যেখানে ভাবা হয়েছিল syllable-এর শেষ, অন্য syllable-এর আরম্ভ, সেখানে পাওয়া যায় ‘a continuum of voice’।’’ (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে এবার আসা যাক, সিলেবল-কে ‘অক্ষর’ বলে মানতে বাধা কোথায়?“স.বা. অভিধানে দেখা যায়, ‘অক্ষর’ শব্দটির মানে দেওয়া আছে – বর্ণ, যার ক্ষরণ নেই অর্থাৎ ব্রহ্ম, পরমাত্মা, শিব, বিষ্ণু, আকাশ, (ছন্দে) একেবারে উচ্চারণসাধ্য শব্দের ক্ষুদ্রতম অংশ, syllable, (বীজগনিতে) অঙ্কের প্রতীকরূপে ব্যবহূত বর্ণ, ক্ষরণহীন। বা. বা. অভিধান ‘অক্ষর’-এর মানে দিয়েছে এই রকম – ক্ষরণশূন্য, স্থিতিশীল, বর্ণ, হরফ, letter,(ছন্দে) একেবারে উচ্চারণযোগ্য শব্দের ক্ষুদ্রতম অংশ, syllable, সিসা নির্মিত হরফ, type। এমনকি বামন শিবরাম আপ্তে-র ‘Sanskrit English Dictionary’ -তেও ‘অক্ষর’ শব্দের মানে দেওয়া হয়েছে -- imperishable, fixed, Siva, Vishnu, letter of alphabet, syllable, word of words … ইত্যাদি।
হরিচরণ কিন্তু তা করেন নি। তিনি ‘অক্ষর’ শব্দটিকে – অ-ক্ষর, অক্ষ-র – দুরকমভাবে বুঝেছেন এবং আমাদের বিচারে ঠিকই বুঝেছেন। প্রথমটির মূলে রয়েছে ‘ক্ষ’ ক্রিয়া (ক্ষইয়ে দেওয়া, ক্ষরিত হওয়া), দ্বিতীয়টির মূলে রয়েছে ‘অশ্’ ক্রিয়া (সর্বদিকে সমভাবে শক্তিবিচ্ছুরণ ক্রিয়া বা ছড়িয়ে পড়া)। তাই, তাঁর কোষগ্রন্থে ‘অক্ষর’ শব্দটির ভুক্তি ঘটেছে দুবার। প্রথমবারে সেটি অ-ক্ষর। তাই তিনি তার ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিয়েছেন – ‘যাহা ক্ষরিত বা নষ্ট হয় না’; এবং প্রতীকী অর্থ দিয়েছেন স্থির, ধ্রুব, ক্রিয়াশূন্য, কূটস্থ, শিব, বিষ্ণু …ইত্যাদি ১০ টি। আর দ্বিতীয়বারে সেটি অক্ষ-র। তাই তার ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিয়েছেন – ‘যাহা বেদাদি ব্যাপ্ত করে’ (ছড়িয়ে দেয়); এবং প্রতীকী অর্থ দিয়েছেন স্বরবর্ণ, স্বর বা স্বরসহিতব্যঞ্জন, বর্ণনির্মাণ ... ইত্যাদি পাঁচটি। আজ আমরা জানি, ‘যাহার দ্বারা বিদিত হওয়া যায়’, তেমন ‘দিশামুখী জ্ঞান’কে বেদ বলে এবং সেই বেদকে ব্যাপ্ত করে ‘অশ্-কারী’ অক্ষর। এই ‘অক্ষর’ স্বভাবতই মানুষের কথিত জ্ঞানপূর্ণ বয়ানের স্বর, যার ভিতরে মানুষের ‘স্ব’ বা আমিত্ব ‘রহে’ (র)। এই ‘অক্ষর’-কে হরিচরণ সেকারণেই ‘স্বরবর্ণ ... ইত্যাদি বলেছেন।” (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)
আমরা যে ‘অক্ষর’ নিয়ে তর্ক করছি তা’হল অক্ষ-র, অ-ক্ষর নয়। তাই ‘অক্ষর’ মানে ‘যাহা ক্ষরিত বা নষ্ট হয় না’ অথবা ‘ক্ষরণ নাই যাহাতে’ এইসব অর্থ এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু যে কথা প্রাসঙ্গিক তা’হল, যে ‘অর্থহীন ধ্বনিসমষ্টির মৃত আওয়াজ’- কে ইংরেজ পণ্ডিত এবং তার অন্ধ অনুসারী সুনীতিবাবু syllable নামে সংজ্ঞায়িত করেন, তা কিভাবে বাংলা ভাষার ‘অক্ষর’ নামক সুনির্দিষ্ট অর্থবহনকারী শব্দের সমার্থক হবে? এসম্পর্কে সিদ্ধান্তসূচক উপসংহার তাই কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বক্তব্য উপস্থাপন করে সারতে চাইঃ “ syllable ধারণাটি পশ্চিমে গড়ে উঠেছে, শব্দাবলীকে অর্থরহিত ক’রে, শুধু আওয়াজ হিসেবে তাদের খণ্ড খণ্ড করে দেখার মধ্যে দিয়ে। আমাদের বাংলা ভাষায় ‘শব্দাংশ’ কথাটিই এর অনুষঙ্গে যথার্থ হবে; কেননা; ‘শব্দ’-এর ভিতরে ঘটনার ‘শব’ থাকে, যা মৃতদেহ মাত্র। হরিচরণও syllable-এর প্রতিশব্দ রূপে ‘শব্দাংশ’ই ব্যবহার করেছেন এবং ঠিক করেছেন। কিন্তু তা না করে, আমাদের অবিনশ্বরাত্মক বা ব্যাপকার্থক ‘অক্ষর’- কে ওদের syllable-এর সঙ্গে জোর করে মিলিয়ে ছেড়ে দিলে syllable টিকে যেতে পারে, কিন্তু ‘অক্ষর’ প্রাণে বাঁচে না।’’ (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)
আমি এর সাথে শুধু এটুকুই যোগ করতে চাই যে, ‘শব্দাংশ’ যদি syllable হয়, তা’হলে ‘পদাংশ’ বা ‘দল’ ইত্যাদিও যুক্তিসঙ্গত কারণেই পাশাপাশি গৃহীত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
এবার আসা যাক উচ্চারণ এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে। গালিব বলছেন, “উপরন্তু, আপনি যখন ঈ=ই+ই বলে ‘ঈ’-এর মধ্যে দুইটি স্বরধ্বনি সন্ধান করেন, তখন আরেকবার মূর্খতা অট্টহাস্য দিয়ে ওঠে।ওটা পৃথক দুইটি স্বরধ্বনির যোগফল নয়, উচ্চারণের হ্রস্বতা ও দীর্ঘতার মামলা। আবদুল হাই মনোযোগ দিয়ে পড়েন, ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।” আপনার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, বিষয়টা শুধু উচ্চারণের হ্রস্বতা ও দীর্ঘতার মামলাই নয়, অর্থের মামলাও বটে। কিভাবে তা অর্থের মামলা সে উদাহরণ দেবার আগে, দেখা যাক হাই সাহেব ইংরেজি শিক্ষার কুপ্রভাবে বাংলা ভাষায় এই দীর্ঘ ও হ্রস্ব স্বরের কি ব্যাখা করেছিলেন এবং তা কেন ত্রুটিপূর্ণ। উদ্ধৃতিঃ ‘... মূলধ্বনি হিসেবে ইংরেজির feel, seed, seat প্রভৃতি শব্দে দীর্ঘ ‘i’ (ঈ) এবং fool, cool প্রভৃতি শব্দের দীর্ঘ ‘u’ (ঊ)-র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইংরেজিতে আভিধানিক পর্যায়ে দীর্ঘ ‘i’ এবং দীর্ঘ ‘u’ হ্রস্ব ‘i’ এবং হ্রস্ব ‘u’ সমন্বিত শব্দকে অর্থের দিক থেকে পৃথক করে দেয়। তুলণীয় feel এবং fill, fool এবং full শব্দাবলী। বাংলা হরফে হ্রস্ব ই এবং দীর্ঘ ঈ, হ্রস্ব উ এবং দীর্ঘ ঊ আমরা লিখলে মূলধ্বনি হিসেবে ঈ এবং ঊ-এর স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ ইংরেজির মত বাংলার হ্রস্ব ই এবং দীর্ঘ ঈ কিংবা হ্রস্ব উ এবং দীর্ঘ ঊ দিয়ে অন্যান্য ধ্বনি ঠিক রেখে দুটো স্বতন্ত্র শব্দ পাই না। বাংলা স্বরধ্বনিতে মূলস্বরধ্বনি হিসেবে হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ ই এবং হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ উ-এর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। প্রশ্ন ওঠে শুধু ই-জাতীয় একটি ধ্বনির এবং উ-জাতীয় একটি ধ্বনির। বাংলায় মূলধ্বনি হিসেবে ই এবং উ-এর দীর্ঘত্ব কোনো স্বতন্ত্র ধ্বনিগুলোর সৃষ্টি করে না।...’’ (ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই, পৃষ্ঠা ২৩২)
এবার আসুন দেখা যাক, নিম্নের উদাহরণগুলো কি বলে?
গিরি + ইন্দ্র = গিরীন্দ্র
গিরি = পর্বত, ইন্দ্র = ইন্দ্র নামের কোনো দেবতা। কিন্তু ‘গিরীন্দ্র’ বলতে আমরা বুঝি গিরিদের ইন্দ্র, অর্থাৎ গিরিশ্রেষ্ঠ বা সর্বোচ্চ পর্বতকে। এখানে গিরি-র ‘ই’ এবং ইন্দ্র-র ‘ই’ স্বরধ্বনি দুটো যুক্ত হয়ে দীর্ঘ ‘ঈ’ স্বরধ্বনি তৈরী করে এবং তা পৃথক দুটো শব্দের মধ্যে সন্ধির ফলাফল হিসেবে বিরাজ করে নতুন শব্দের (গিরীন্দ্র) জন্মকে সম্ভব করে তোলে। একারণেই ‘তির তির’ করে জল বয়ে যাওয়া নদীর দুই পাড়কে ‘তীর’ বলে এবং ‘কুল কুল’ করে জল বয়ে যাওয়া নদীর দুই পাড়কে ‘কূল’ বলে। ‘তির তির’ এবং ‘কুল কুল’ জল(ধ্বনি)র অন্তর্গত ‘ই’ এবং ‘উ’ ধ্বনিকে তাই চাইলেই নিতান্ত উচ্চারণের মামলা বলে দীর্ঘ ‘ঈ’ অথবা দীর্ঘ ‘ঊ’ হিসেবে উচ্চারণ করা যায় না, কেননা তাতে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। বহমান জলপ্রবাহ যাত্রীদের নদী পারাপারে সাহায্য না করে বরং নদীর পারে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখে। আশা করি হাই সাহেবের ভ্রান্তি কোথায়, এবার তা পরিস্কার হয়েছে।
অবশেষে উচ্চারণের প্রসঙ্গ টেনে আপনি ছন্দ বিষয়ে আপনার অভিমত প্রকাশ করেন, “উচ্চারণেই দৈর্ঘ্যের সঙ্গে এর একটি গুপ্ত সম্পর্ক আছে।’’ আপনি অভিনিধানের প্রসঙ্গ টেনে ব্যাখা করতে চেয়েছেন, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী ‘কৃষ্ণের’ এবং ‘উৎসুক’ শব্দ দুটিকে তিন মাত্রার পরিবর্তে কেন উচ্চারণের স্বাধীনতা গ্রহণ করে চারমাত্রা পড়া যায় ... “কবি যখন ‘কৃষ্ণের’ শব্দটা চারমাত্রা গণনা করতে চান, বুঝতে হবে তখন তিনি শব্দের উচ্চারণ আশা করছেন এমন: কৃশশ+নের। অর্থাৎ শিসধ্বনিটার উচ্চারণকে প্রলম্বিত করতে চাইছেন। একইভাবে, উৎ+সুক -- এখানে কবি 'উৎ' বলে পলমাত্র থামতে চাইছেন। এই আর কি।”
প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের উচ্চারণের স্বাভাবিক ঝোঁক অনুযায়ী, ‘কৃষ্ণ’ শব্দের ‘কৃষ্’ উচ্চারিত হবে দ্রুত, তাকে টেনে পড়তে যাব কেন? সেটা কি তাহলে ছন্দে যাতে চারমাত্রা পাওয়া যায়, সে জন্য আরোপ করতে হবে? এবং একইভাবে ‘উৎসুক’ শব্দে ‘উৎ’-এর উচ্চারণের পর পলমাত্র থামারও কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কবি নিজেও তেমন দাবী করেন না। এখন যদি আপনার কথামত আমরা তা বিবেচনায় নিতে যাই, বাংলা ভাষার স্বভাব কি তা অনুমোদন করে? উত্তর – না! মজার ব্যাপার হ’ল হাই সাহেবের বক্তব্য এক্ষেত্রে আমার মতকেই সমর্থন করে। হাই সাহেব ঐতিহ্যগতভাবে সুনীতি অনুসারী হলেও, বহু ক্ষেত্রেই অনেক বেশী সৃজনশীলতা ও দূরদর্শীতার প্রমাণ দিয়েছেন। সে যা হোক, হাই সাহেবের বক্তব্য কিভাবে আমার মতকে সমর্থন করে বোঝার জন্য আসুন দেখি, হাই সাহেব সাধারণভাবে ভাষার স্বভাব-প্রকৃতি এবং বাংলা ভাষায় তার আচরণ সম্পর্কে কি বলেন?
‘... নদীস্রোতে যেমন নানা তরঙ্গ উঠে, মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনিতেও তেমনি সেই তরঙ্গেরই লীলা। তা-ই ভাষা ধ্বনিগুণের সুক্ষ্ম ও জটিলতম দিককে উদ্ঘাটিত করে দেয়। ধ্বনির এ সূক্ষ্ম সুন্দর সামগ্রিক গুণ একদিকে যেমন অনুভূতি সাপেক্ষ, অন্যদিকে তেমনি বিশেষণাতীত। এদিক থেকে সামগ্রিক ধ্বনিপ্রবাহের মধ্যে দৈর্ঘ্য (length), ঝোঁক (stress), শ্রুতদ্যোতকতা (prominence), জোর (emphasis), ধ্বনিতরঙ্গ (intonation) প্রভৃতি গুণই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।’’(ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই, পৃষ্ঠা ২৩১)
অন্যত্র এই length-কে বলা হয়েছে quantity, duration আর stress-কে বলা হয়েছে accent। length -কে দৈর্ঘ্য, সার্থপর্ব, স্থিতিগত, পরিমাপগত ইত্যাদি যেমন বলা হয়, তেমনি stress, accent-কে শ্বাসাঘাত, ঝোঁক, শ্বাসপর্ব, প্রস্বন, প্রচাপন, বল ইত্যাদিও বলেছেন আবদুল হাই। বলেছেন, “বাংলা-বাকপ্রবাহে দুরকম পদবিন্যাস দেখি। একটি সার্থপর্ব এবং অন্যটি শ্বাসপর্ব। (পৃষ্ঠা ২৪২) ... দৈর্ঘ্যের মত stress ধ্বনিকে গুণময় করে। ধ্বনির নানাগুণে বাকপ্রবাহ গুণান্বিত হয়। বাকপ্রবাহের অন্যান্য গুণ থেকে ধ্বনিসংশ্লিষ্ট শ্বাস-প্রক্ষেপণের জোরটুকুকে কোনক্রমে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে যা পাওয়া যায় তাকেই stress বা accent নামে অভিহিত করা যায়। (পৃষ্ঠা ২৪২) ... ইংরেজি, জার্মান, স্পেনিয়, গ্রীক এবং সোয়াহিলী প্রভৃতি ভাষায় বিভিন্ন শব্দে (words in isolation) এ ধরনের শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তনের সাহায্যে একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হওয়ায় এবং পৃথক পৃথক শব্দে শ্বাসাঘাতের বহুল প্রচলন থাকায় এগুলোকে ‘stress language’ বা শ্বাসাঘাতপ্রধান ভাষা বলা হয়। বাক্যে পার্শ্ববর্তী শব্দ কিংবা শব্দাবলীর তুলনায় কোনো শব্দের অর্থে আবেগের গভীরতা কিংবা কোনো বৈপরীত্য (contrast) সৃষ্টির জন্যে সাধারণত শ্বাসাঘাতের ব্যবহার করা হয়। বাক্যের বৃহত্তর প্রয়োজনে সেজন্য শব্দের নির্ধারিত শ্বাসাঘাত কখনও লুপ্ত হয়, কখনও স্থান পরিবর্তন করে আর কখনও বা অক্ষুণ্ন থাকে। ইংরেজির মত বাংলা stress বা শ্বাসাঘাত প্রধান ভাষা নয়। এমন কি বাংলায় একই শব্দে শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তনের ফলে ইংরেজির মত বিভিন্ন অর্থ উদ্রিক্ত করার অবকাশও নেই। সেজন্য জাপানি, হিন্দুস্থানী, মারাঠি প্রভৃতি ভাষার মত বাংলাকে Stressless language তথা শ্বাসাঘাতহীন ভাষা বলা হয়।…” (পৃষ্ঠা ২৪৩)। মোট কথা মুহম্মদ আবদুল হাই এমন অনেক কথা বলেছেন, যাতে বোঝা যায়, তিনি যদি পদার্থবিজ্ঞানের (Physics) কণাতরঙ্গ ব্যাপারটি জানতেন, তাহলে হয়তো তিনিই বলে যেতেন যে, ইংরেজ কণাপ্রধান ভাষাতে কথা বলে, আমরা বাংলাভাষীরা তরঙ্গপ্রধান ভাষাতে কথা বলি।
এজন্য হাই সাহেবের কথার সূত্র ধরেই বলি যে, বাংলা ভাষায় ইচ্ছে করলেই শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তন করতে পারি না, কেননা তার কোনো অর্থ হয় না এবং বাংলা ভাষার স্বভাব তা অনুমোদন করে না। তাই ‘কৃষ্ণের’ এবং ‘উৎসুক’ শব্দ দুটোকে খেয়াল খুশীমত টেনে বা থেমে উচ্চারণ করে চার মাত্রার লাইসেন্স দেয়া যায় না।
এ আলোচনার উদ্দেশ্য অহং-এর বিজয় নয়, বরং কাল পরিক্রমায় পরিবর্তশীল বাংলাভাষার পূর্বাপর ইতিহাসকে বিবেচনায় নিয়ে ভাষার ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে যথাসম্ভব ভ্রান্তিহীন থাকার একান্ত আকাঙ্ক্ষা। সবাইকে এ আলোচনা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’ নিবন্ধটি ও এযাবত কাল পর্যন্ত তাঁদের চিন্তাভাবনার সার সংক্ষেপ যে ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে তার লিঙ্কঃ http://www.banglasemantics.net/works.html
কবি তুষার গায়েনের নোটটির লিংক-
http://www.facebook.com/notes.php?drafts&id=1573787229#/note.php?note_id=234284085124&ref=mf
No comments:
Post a Comment