Thursday, October 21, 2010

সরদার ফজলুল করিমের গ্রহণকৃত সাক্ষাৎকার : বিষয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক

সাক্ষাৎকারে সরদার ফজলুল করিম

বিষয়: অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক

মোহাম্মদ আলী | ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১১:১৪ পূর্বাহ্ন 
razzak-1.jpg
আবদুর রাজ্জাক (জন্ম. নবাবগঞ্জ, ঢাকা ১৯১৪- মৃত্যু. ঢাকা ২৮/১১/১৯৯৯), ছবি. ব্রাত্য রাইসু ১৯৯৫
আবদুর রাজ্জাক প্রসঙ্গে এই সাক্ষাৎকারটি সরদার ফজলুল করিমের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের অংশ। যেটি নেওয়া হয়েছে প্রধানত শাহবাগ আজিজ মার্কেটের প্রকাশনা সংস্থা নন্দিতর কার্যালয়ে। সচরাচর সকাল এগারোটার দিকে সরদার স্যার সেখানে যান। মাসে একবার দুইবার।

sarder.jpg
…….
সরদার ফজলুল করিম (জন্ম. আটিপাড়া, বরিশাল, মে ১৯২৫), ছবি. নাসির আলী মামুন ১৯৯৯
…….
এভাবে চার পাঁচ বছর ধরে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোহাম্মদ আলী। মাঝে মাঝে তার বাসায়ও গিয়েছেন। অন্য দুয়েক জায়গায়ও তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছে। মোহাম্মদ আলীর নেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে আবদুর রাজ্জাক ছাড়াও বিবিধ প্রসঙ্গ এসেছে। নিজেকে সক্রেটিসের নয় বরং প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের শিষ্য পরিচয় দিতে পছন্দ করেন সরদার ফজলুল করিম। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে অনেক বছর আগে সরদার তার বই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ/অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতা রচনা করেছেন। এ আলোচনায় সে বইয়ের প্রসঙ্গ এসে গিয়ে থাকবে। নন্দিত থেকে প্রকাশিতব্য গ্রন্থ সরদার ফজলুল করিম: জীবনজিজ্ঞাসা থেকে সাক্ষাৎকারের ‘আবদুর রাজ্জাক’ অংশটুকু এখানে প্রকাশিত হলো। বি. স.

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মোহাম্মদ আলী

অনেকদিন ধরে মনে মনে ছিল, একদিন সরদার স্যারকে জিগ্যেশ করলাম, আচ্ছা, আপনি তো অধ্যাপক রাজ্জাকের ভাবশিষ্য ছিলেন। তাঁর জীবন-যাপন, চালচলন, আচার-ব্যবহার ও পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে কোথাও কিছু বলেন নি। এ বিষয়ে একটু বলুন না?
আবার তুমি প্রফেসর রাজ্জাকের কথা শুনবা? বলেই এক গাল হাসি দিলেন। তিনি অকৃতদার ছিলেন। খুব ভালো রান্না করতে পারতেন। পারতেন ভালো দাবা খেলতে। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। অন্যদের পড়ার জন্য নিজের লাইব্রেরি থেকে বই বের করে দিতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো শিক্ষক সংগ্রহ করা ছিল তাঁর কাজের অন্যতম অংশ। আবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি পড়াতেন না। “রাজ্জাক স্যারের কল্লা চাই” বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলও হয়েছে। আবার তিনি এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় অধ্যাপকও হয়েছিলেন।
sarder-mali.jpg
সরদার ফজলুল করিম ও মোহাম্মদ আলী, নন্দিত, শাহবাগ আজিজ মার্কেট, দোতলা
আমি স্যারকে বললাম, যতদূর জানি রাজ্জাক স্যারের মোট তিনটি সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে। যার একটি সাক্ষাৎকার আপনি নিয়েছেন এবং তার ভিত্তিতে একটি বইও লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ। অন্য দুটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ ও সেলিনা শিরীন সিকদার। তাঁর একমাত্র বক্তৃতা লিখিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে, এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে তাঁর অসম্পূর্ণ পিএইচডি থিসিস। তাছাড়া আহমদ ছফা তাঁকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন, বইটির নাম যদ্যপি আমার গুরু। সলিমুল্লাহ খান তাঁর বক্তৃতা নিয়ে সমালোচনামূলক একটি বই লিখেছেন। এ ছাড়া তাঁকে মূল্যায়ন করার মতো তেমন কিছু হাতের কাছে পাওয়া যায় না। তিনি এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখে যান নি, যা দিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করা যায়? তাহলে আপনার কাছে রাজ্জাক স্যার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব?
তাহলে মজার একটা গল্প শোনো। সলিমুল্লাহ যখন বাইরে পড়তে যাবে, তখন প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে এসেছে টাকার জন্য। এ কথা শুনে হামিদা [হামিদা হোসেন] বলেছে, ও তো আপনার লেখার সমালোচনা করেছে, ওকে আপনি টাকা দেবেন কেন? উনি তখন বলেছেন, সমালোচনা করেছে তাতে কী, তাই বলে ছেলেটাকে আমি সাহায্য করব না, সেটা কেমন কথা? এই হল প্রফেসর রাজ্জাক, বুঝলা।
আপনি তাঁর প্রধান শিষ্য হিসেবে এখনো বেঁচে আছেন। তাঁকে আপনি কাছ থেকে দেখেছেন, আপনার এখনকার উপলব্ধি আমাদেরকে একটু জানাবেন?
তুমি আমাকে যত বড় দায়িত্ব দিলে আসলে আমি অত বড় নই। তবে আমি যা জানি সেইটুকু তোমাকে অবহিত করতে পারি। আমরা তখন সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। একদিন তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, আর একজন ডাইকা বলছে, ভাইসাব, অমুক জায়গাটা কোথায়? তিনি উত্তর দিলেন, আমি এখানকার কর্মচারি না, আমি একজন মাষ্টোর। এভাবেই কথা বলা ছিল তাঁর স্বভাব। ওই যে বলেছিলাম, ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে, উনি কখনো ক্লাস নিতেন না। আমরা যে অর্থে ক্লাস নেওয়া বলি।
একটু বলবেন, কখন কোথায় রাজ্জাক স্যারের সাথে আপনার পরিচয় হল? সেইটা শুনব।
রাজ্জাক সাহেবের সাথে আমার পরিচয় হয় ১৯৩৪-৩৫ সালে। টিচার্স রুমে আরও স্যার আছেন, তার ভেতরে আমরা গেলে পরে বলতেন, এই সরদার বয়েন। এইভাবে টিচার্স রুমেই তাঁর সাথে আমাদের পরিচয় ও সম্পর্ক। আমরা তখন ছাত্র। তখনই তিনি সবাইকে জ্ঞানের কথা বলে আকৃষ্ট করতেন। এটা প্রফেসর রাজ্জাকের একটা বিশেষ গুণ। তাঁর কোনো বাছ-বিচার ছিল না, তিনি সাজ্জাদ হোসেনরে ভালোবাসতেন — মুনীর চৌধুরী, রবি গুহ ও সরদার ফজলুল করিমকেও ভালোবাসতেন। তাহলে শোনো, আমি, রবি গুহ — ওঁর বাড়ি ছিল মুন্সিগঞ্জ, আমি রবিদা বলে ডাকতাম। রবি গুহের বাড়িতে আমাকে বাদ দিয়ে কোনো ফাংশন হত না — আর নাজমুল করিম এই তিনজন ছিলাম হরিহর আত্মা। প্রফেসর রাজ্জাকের বাড়ি যাবার জন্য আমরা কোথায় মিট করব তা আগেই ঠিক করা থাকত। তখন তো ছুটি ছিল রোববারে। তখন আমাদের একটা কথা ছিল, “রাজ্জাক স্যারের বাসায় যাইবেন নাকি আজকে?” রবি গুহ ও নাজমুল করিম বলতেন, সরদার চলেন যাই, কিছু খাইয়া আসি। রাজ্জাক সাহেব নিজে বাজার করতেন। মাছ, মাংস যা যা দরকার সব কিছুই কিনে আনতেন। উনি নিজ হাতে রান্নাও করতেন। এখন যেখানে লাইব্রেরি হইছে ওখানে উনার বাসা ছিল। ভিসির বাসার উল্টো দিকে চায়নিজ প্যাটার্নের একটা বিল্ডিং ছিল, ওখানে উনি থাকতেন। আর উনি রিটায়ার করার পর থাকতেন বনানীতে। সেখানে ভাতিজা-ভাতিজী আর তাঁর ভাবিও থাকতেন।
আপনি রাজ্জাক স্যারের চলাফেরা, পোশাক-আশাক সম্পর্কে বলতে চাইছিলেন, বললেন না তো। তিনি বাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি খুব সাধারণ পোশাক পরতেন?
এত খুঁটিনাটি জেনে তোমার লাভ কী? উনি বাসায় লুঙ্গির সাথে শার্ট পরতেন। গামছা ব্যবহার করতেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আসতেন। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
আচ্ছা, রাজ্জাক স্যারের বিয়ে-সাদীর ব্যাপারে কোনো আলাপ-আলোচনা হত না? আপনি তাঁকে খুব ভয় পেতেন? না কি এসব ব্যাপারে উনি আপনাকে বা কাউকেই পাত্তা দিতেন না?
না, না, বল কী? পাত্তা দেবেন না কেন? বিয়ের কথা বললে তিনি এড়িয়ে যেতেন। কোনো কথা বলতেন না। এটাই ছিল তাঁর স্বভাব।
আমার খুব অবাক লাগে, আপনাকে কেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকালেন? আপনি তো দর্শনের ছাত্র এবং এক সময় শিক্ষকও ছিলেন! আবার অন্যভাবে বলা যায়, এটা তো এক ধরনের স্বজনপ্রীতিও বটে।
সরদার স্যার একটু অন্যভাবে বললেন, তোমরা এসব ব্যাপার বুঝবা না। সেকালের ব্যাপারই ছিল অন্য রকম। তিনি বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক সংগ্রহ করে বেড়াইতেন। প্রফেসর রাজ্জাক ছিলেন জ্ঞানী মানুষ। তাঁর বইয়ের অভাব ছিল না। তাঁর বইয়ের একটা পারসোনাল লাইব্রেরি ছিল। যখন যেটা প্রয়োজন সেটা নিয়ে পড়তে পারতেন। মনে করতেন, ফিলোসফি না বুঝলে, মাথা ক্লিয়ার না হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াবে কীভাবে?
ঘরে উনি খুব সাধারণ জিনিস ব্যবহার করতেন, আপনি নিশ্চয় সেগুলোর প্রতি খেয়াল করেছেন?
জানব না কেন? সত্যি বলতে কী, বই ছাড়া তেমন আর কিছু ছিল না। তিনি সরল জীবনযাপন করতেন। তাঁর ঘরে একটি মাত্র চকি ছিল, চকির ওপর শুধু একটা চাদর ব্যবহার করতেন। কোনো তোশক ছিল না।
রাজ্জাক স্যার নাকি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ মানুষ হিসেবে বিদ্যাসাগর কিংবা তাঁর মতো মানুষদের ধারেকাছে আসতে পারবে না। বড় লেখক আর বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থাকে। বড় মানুষেরা আসলেই বড় মানুষ। এ বিষয়ে আপনার ভাবনাটা যদি বলতেন।
এবার সরদার স্যারের মুখ দিয়ে একটা গুরুগম্ভীর উত্তর এল। লেখক ও কবিরা যা বলে সে রকম আচরণ না করলেও চলে। এ জন্যে প্লেটো তাঁর রিপাবলিক বইয়ে কবিদের নির্বাসনে পাঠাবার কথা বলছেন। এ সব জ্ঞানের কথা — তাৎপর্যম-িত কথা, সরাসরি তাৎপর্য অনুধাবন করা কঠিন। সোজা কথা, অনেক জিনিস আছে, আমাদের বুঝে নিতে হয়। তোমরা তো সব কিছুরই সরাসরি মানে খুঁজতে চাও। সব সময় সব কিছুর সরাসরি অর্থ পাওয়া যায় না।
রাজ্জাক স্যার তো বিদ্যাসাগরকে গুরুত্ব দিতেন। আপনার সাথে তাঁর সাহিত্যিক আলাপ হত?
এটা ঠিক, উনি বিদ্যাসাগরকে মূল্যায়ন করতেন। রাজ্জাক সাহেব সাহিত্যিক ছিলেন না। সাহিত্যিকদের নিয়ে আলোচনা করাও তাঁর অভ্যাস ছিল না। তিনি মাষ্টারির চাকরি করতেন, তিনি একজন মাষ্টার ছিলেন। তিনি নিজেই বলতেন, ‘আমি একজন মাষ্টোর মানুষ।’ পড়াতেন না এমন একজন মাষ্টার।
***
কয়েকদিন পর সরদার স্যার এলেন আবার আজিজ সুপার মার্কেটে আমার কার্যালয় নন্দনে আড্ডা দিতে। কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে স্যারকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে তার পরিচয় দিলেন, তিনি উত্তরায় থাকেন। পেশায় ডাক্তার। তিনি তাঁর সব বই পড়েছেন। ডাক্তার সাহেব তার কাজে চলে গেলেন। আমি জিগেশ করলাম, আপনি কি আহমদ ছফার যদ্যাপি আমার গুরু বইটি পড়েছেন? উনি বললেন, এ মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না। কেন বলো তো? আমি তখন অধ্যাপক রাজ্জাক সম্পর্কে ছফা ভাইয়ের মন্তব্যটি তুলে ধরলাম। বললাম, ছফা ভাই তো রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে মারাত্মক একটি উক্তি করেছেন।
স্যার বললেন, বলো তো কী?
আমি তখন যদ্যাপি আমার গুরু বইটি বের করে দেখালাম, ছফা ভাই লিখেছেন, “অনেক সময় উৎকৃষ্ট বীজও পাথরের নিচে পড়ে নষ্ট হয়। আমার ধারণা রাজ্জাক সাহেবের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে।”
সরদার স্যার একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, এ রকম কথা ছফা বললে বলতে পারে, এটা তাঁর কথা। তবু আমি বলব, প্রফেসর রাজ্জাকের কথা ইম্পর্ট্যান্ট, ছফার কথা ইম্পর্ট্যান্ট নয়। হতে পারে, পাথরের নিচে একটা বীজ পড়ে বীজটা নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু প্রফেসর রাজ্জাকের ব্যাপারে কী সেটা তুমি দেখাও? প্রফেসর রাজ্জাক পাথরচাপা পড়েছেন, ছফা কী এমন বড় হইছে? এই যে কথাটা ছফা বলেছে, প্রফেসর রাজ্জাক পাথরচাপা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে — এভাবে তো মানুষকে দেখা উচিত না। আমি কোনো মানুষকে এভাবে খাটো করে দেখি না। আর প্রফেসর রাজ্জাককে এভাবে ছফা দেখতে পারে, আমি তো তাঁকে এমন করে ভাবতে পারি না।
razzak-sofa.jpg
শিষ্য আহমদ ছফার সঙ্গে আবদুর রাজ্জাক, গুলশান ২-এর বাসায়; ছবি. ব্রাত্য রাইসু ১৯৯৫
আমি বুঝতে পারলাম, রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে এ রকম মন্তব্য শুনে তিনি মনে মনে আহত হয়েছেন। ছফা ভাই কথাটা বললেও আমার মতো এত ছোট মানুষের পক্ষে এ প্রসঙ্গ টানা ঠিক হয় নি। আমি তখনো জানি প্রফেসর রাজ্জাক কিছু লেখেন নি, শুদ্ধ করে বাংলা বলতে পারতেন না, অথচ তাঁকে সরদার স্যার এত গুরুত্ব কেন দেন? চট করে আবার বললাম, আচ্ছা, প্রফেসর রাজ্জাক তো তেমন কিছুই লেখেন নি, এই ব্যাপারে আপনি কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেন নি, কখনো বলেন নি — স্যার, আপনি লেখেন না কেন?
হ্যাঁ, বলতাম। তিনি বলতেন কী লিখব, আপনারা আছেন কী করতে? আপনারা কী লেখেন? আপনারা যা লেখেন, তা কি বাংলা হয়, বোঝেন? সহজ বাংলা লেখেন, এত কঠিন করে লেখেন ক্যান? কথাটা বলতে বলতে হাসতে লাগলেন, আর বললেন, তাঁকে তুমি এইভাবে পাইবা না।
উনি যে পণ্ডিত এটা তো বোঝা যায় না। আমার মনে হয়, আপনি রাজ্জাক স্যারকে মাথায় তুলেছেন।
শুধু আমি কেন বলছ? তাঁর গুণে তো অনেকেই মুগ্ধ ছিল। কারণ তিনি তো জ্ঞান ভালোবাসতেন।
রাজ্জাক স্যারের সাথে আপনার অবশ্য অমিলও দেখা যায়।
কেমন, কেমন? এটা কী বল তুমি?
যেমন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে আপনারা পছন্দ করতেন না। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার রাজ্জাক স্যার তাঁকে খুব পছন্দ করতেন।
বুঝছি, তুমি কী বলতে চাও। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে আমরা অপছন্দ করতাম। তিনি পাকিস্তানপন্থী পলিটিকস করতেন, মুসলিম লীগ সমর্থক ছিলেন। কিন্তু প্রফেসর রাজ্জাক তাঁকে সমর্থন করতেন শিক্ষিত লোক হিসেবে, জ্ঞানী মানুষ হিসেবে। এই আর কি।
তখনকার রাজনীতি আমি বুঝি না। আমরা তো বাংলাদেশ পর্বের মানুষ। আগের দিনের মুসলিম লিগ বা যুক্তফ্রন্টের রাজনীতি সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ। আচ্ছা, প্রফেসর রাজ্জাক নাকি মুসলিম লীগের একজন সমর্থক ছিলেন, আর আপনি তো বামপন্থী রাজনীতি করতেন। দুই বিপরীত মেরুর দুইজনের সম্পর্ক হল কেমন করে? দুধ আর তেল তো এক সাথে মিশ খায় না কখনো।
হ্যাঁ, তিনি পাকিস্তান সমর্থন করেছিলেন। প্রফেসর রাজ্জাক মুসলিম লীগের ডিপুটেড লোক ছিলেন। আমরা জানতাম, প্রফেসর রাজ্জাক মুসলিম লীগের পলিটিকসটাকে এক নাম্বার করার চেষ্টা করেছেন। এগুলোতে প্রফেসর রাজ্জাক ইনভলবড হতেন। মুসলিম লীগের পলিটিকসটাকে প্রফেসর রাজ্জাক এগিয়ে নেবার চেষ্টা করতেন। আবার তিনি স্টুডেন্ট ইলেকশন নিয়েও মাথা ঘামাইতেন। একবার রাজ্জাক সাহেব আমাকে বললেন, এই যে স্টুডেন্ট ইলেকশন হলো তার কোনো কাগজপত্র যোগাড় করছেন? মূলত স্টুডেন্ট ইলেকশনের কী ফলাফল হল, সেটা তিনি জানতে চান। আমারও একটা হ্যাবিট ছিল, এই ধরনের ব্যাপারে কে কী বলল, না বলল, সেটা জানার চেষ্টা করতাম। সব কিছু সংগ্রহ করতাম। আর উনি সব সময় এ সব খোঁজ-খবর রাখতেন এবং বলতেন, আপনের কাছে কোনো কাগজ থাকলে আমারে দিবেন।
রাজ্জাক স্যারও তো ক্যানভাস করেছেন!…
কথা বলতে না দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, প্রফেসর রাজ্জাক গামছা মাথায় দিয়ে ফজলুল হকের ইলেকশনের ক্যানভাস করার জন্য সারা ঢাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর রাজ্জাক নিজে ভোট সংগ্রহের জন্য চাঁদপুরের ওদিক গেছেন। কোনখানে ভোটার আছে সেটা খোঁজ করতে।
আপনিও তো একবার হল ইলেকশন করেছিলেন। আপনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন, তবুও হারলেন।
আমি ফজলুল হক ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি তখন ফজলুল হক হলের ছাত্র। তুমি কি জান, ফজলুল হকের আসল নাম ছিল ল্যাংড়া ফজলুল হক। তখন সলিমুল্লাহ হল ও ফজলুল হক হলেও ইলেকশন হত। ইলেকটেড পার্সনরা হলের সবকিছু পরিচালনা করত। আমিও ইলেকশন করেছিলাম, কিন্তু হেরে গিয়েছিলাম। হাসতে হাসতে বললেন, আমি মূলত দাঁড়াই নি। আমাকে দাঁড় করানো হয়েছিল। আমি নিজে দাঁড়াইও নাই, হারিও নাই।
আপনি কথায় কথায় একবার বলেছিলেন, প্রফেসর রাজ্জাক পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না। আজ সেই গল্পটা শুনি।
আরে, বল কী? প্রফেসর রাজ্জাক সাম্প্রদায়িক হবেন কেন? তিনি তো ভারতবর্ষের কনসেপ্টে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কিন্তু এ কথা ঠিক, তিনি মুসলমানদের বেশি গুরুত্ব দিতেন। সিলেটে মুসলমানদের পাশ করানোর জন্য ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে চাঁদপুরে ভোট সংগ্রহের জন্য গেছেন। উনি বলতেন, ভারতবর্ষে একটা প্রবলেম আছে, সাম্প্রদায়িকতার প্রবলেম। পাকিস্তানেও আমি বলেছি, এখানে সাম্প্রদায়িকতা একটা সমস্যা। ব্যাপারটা কীভাবে দূর করা যায়, এ নিয়ে তিনি মাথা ঘামান নাই। কিন্তু সাধারণ অর্থে আমরা এখানে যে সাম্প্রদায়িকতা দেখি, সেই অর্থে তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তিনি সব ধরনের মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন। এটা ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধানতম গুণ। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন অধ্যাপক রাজ্জাক। গুণী যেই হোক তাঁকে সম্মান দেওয়া, কদর করা তাঁর অভ্যাস ও নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ছফা ভাই যদ্যপি আমার গুরু বইয়ে লিখেছেন, তিনি মুসলমানদের সাবালক করার জন্য কাজ করেছেন।
ছফা বলতে পারে। আমি তাঁকে সেভাবে দেখি না।
(আমি এই প্রসঙ্গটা বোঝার জন্য একদিন আনিসুজ্জামান স্যারের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। ফোন করে প্রশ্নটার উত্তর জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন, ওভাবে বলা যাবে না, তুমি একদিন বাসায় এসো। একদিন ফোন করে সকাল আটটায় আনিসুজ্জামান স্যারের বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, ওহ, তুমি এসেছ? বসো। আমি স্যারকে আমার সেই প্রশ্নটা করলাম। বললাম, স্যার, ছফা ভাই তো রাজ্জাক স্যারকে মুসলমানদের প্রতিনিধি মনে করেন। আপনিও এ ব্যাপারে তাই মনে করেন? তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে নাজমুল করিম, রবি গুহ ও সরদার ফজলুলকে তিনি এত আদর করতেন কেন? কেন তাদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন? কেনই বা নিজের আলমারি থেকে বই দিতেন? মুনীর চৌধুরী গ্রেফতার হবার পর তিনি জেলখানায় দেখতে গেছেন। তিনি তো কমিউনিস্ট ছিলেন। তাহলে মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে তিনি ভাবতে যাবেন কেন? নানা জায়গা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো ভালো শিক্ষক খুঁজে আনতেন? সেখানেও তিনি কোনো সম্প্রদায়ের ধার ধারতেন না। আমার কথা আনিসুজ্জামান স্যার মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তিনি বললেন, তুমি তো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভেবেছ। এমন করে তো কখনো বিষয়টা ভেবে দেখিনি। তাই তো রাজ্জাক স্যারকে সাম্প্রদায়িক ভাবাটা ঠিক হবে না। তিনি কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তাঁকে সম্প্রদায়গতভাবে চিন্তা করা ঠিক হবে না।)
(এবার আড্ডাটা আরও জমল।) আপনি অনেকবার রাজ্জাক স্যারের রান্না খেয়েছেন, তাঁর রান্না কি প্রশংসা করার মতো? তাহলে ভালো রান্না করা ছাড়া তাঁর তেমন তো গুণ ছিল না। আপনি তো রান্না-বান্না করেন না।
না, আমি রান্না করতে পারি না। আমি তো কিছুই করতে পারি না। হ্যাঁ, তিনি খুব ভালো রান্না করতেন। তোমার চোখে তাঁর গুণ ধরা পড়ে নাই, কী করা যাবে? আমি মনে করি, তিনি গুণী ও জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। ও সব তোমরা বুঝবে না। পড়, তাহলে জানতে পারবে, তাঁকে জানার চেষ্টা করো।
তাহলে প্রফেসর রাজ্জাক মানুষ হিসেবে ব্যতিক্রম… ?
তোমাকে কী করে বোঝাব? তাহলে আনিসের (অধ্যাপক আনিসুজ্জামান) কথাটা দিয়েই তোমাকে বোঝাই। আনিস বলেছে, রাজ্জাক স্যারের স্নেহ সূর্যের মতো, সবখানেই পড়ে। যেখানে পড়া উচিত সেখানে পড়ে, যেখানে পড়া উচিত নয়, সেখানেও পড়ে। তাঁর চরিত্রের মেইন দিক হচ্ছে, জ্ঞান তাঁর কাছে খুব প্রিয় ছিল। জ্ঞানীকে নানানভাবে সমাদর করতেন। তাঁর জীবনে আর কোনো কাজ ছিল না। তিনি এ সব নিয়েই থাকতেন।
রাজ্জাক স্যারের বিভিন্ন গুণে আপনি মুগ্ধ। কেন এ রকম রহস্যময় চরিত্র আপনাকে মুগ্ধ করত আমার মাথায় আসে না!
আমি এই বিষয়কে বিষয় হিসেবেই দেখি না। কেননা তাঁর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার ছিল। তিনি নিজে পড়তেন এবং আমাদেরও বই দিতেন, যা সাধারণত কেউ করে না। তিনি ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানী; একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। আমরা সাধারণত যা, তিনি সেই রকম নন।
কেমন?
শোনো, প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে আমি, রবি গুহ ও নাজমুল করিম যেতাম। আমরা গেলে পরে তিনি বলতেন, কী খাইবেন কন? শুটকি মাছের ভর্তাও আছে, মাছ-মাংস সবই আছে, কোনডা খাইবেন খান। উনার বাসায় গেলে পরে বলতেন, এই বইটা পড়েছেন, সরদার?
আমার যখন দর্শনকোষ বের হল, প্রফেসর রাজ্জাক আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন বললেন, মাই ডিয়ার, ইউ হ্যাভ এ গুড জব।
সরদার স্যার ফোকলা দাঁতে একটা স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, তোমরা প্রফেসর রাজ্জাককে বোঝার চেষ্টা কর। ওভাবে তাঁকে পাইবা না। দেখ, ভালো করে জানার ও বোঝার চেষ্টা কর, তাহলে অনেক কিছু পাইবা।
আপনি রাজ্জাক স্যারের সাথে কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে কখনো প্রশ্ন করেন নি? তাঁর সাথে আপনার সম্পর্কটা তো ভয়ের ছিল বলে মনে হয় না।
না, কোনো বিষয়ে আমাদের ডায়ালগ হয় নি। আমি কখনো বলি নি, এটা তো মানি না স্যার, আপনি যেটা বললেন। কেননা আমি যাচ্ছি প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে কোনো ডায়ালগের জন্য নয়, কোনো তর্কের জন্য নয়, শুধু জানার জন্য, জ্ঞানার্জনের জন্য।
razzak-5.jpg
আবদুর রাজ্জাক, ছবি. নাসির আলী মামুন
প্রফেসর রাজ্জাক কিংবদন্তী হলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ক্লাস নেন না, পড়ান না। সেই রকম একজন লোক আপনার প্রিয় শিক্ষক, আশ্চর্য তো!
তোমরা তো এখনকার দিনের ছাত্র। এ সব বুঝবা না। তুমি পড়ানো বলতে কী বোঝো? তবে এটা ঠিক, সাধারণত শিক্ষকরা যেভাবে পড়ান, তিনি সেভাবে পড়াতেন না। তাঁর পড়ানোর ধরন ছিল একেবারেই ভিন্ন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, উনি পড়াতেন না। ওভাবে তাঁকে পাইবা না। তাঁর পড়ানো ছিল এক্সট্রা অর্ডিনারি, তিনি তো আমাদের মতো ক্লাস নিতেন না।… আমরা একবার ভাইবা নিতাছি এবং ভাইবা বোর্ডে প্রফেসর রাজ্জাককে আনা হল। আমরা সবাই প্রশ্ন করতাছি আর ছেলেরা ভয় পাইয়া যাইতাছে। তখন প্রফেসর রাজ্জাক বলতাছেন, আপনারা ছাত্রদের এত কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেন? ওগো কইতে পারেন না যে, তোমাগো কী কী প্রশ্ন আছে হেইডা কও? আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতাছি। উনার কাজই হল ওপর থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া।
ক্লাস নেওয়া বলতে যা বোঝায় আপনিও তো রাজ্জাক স্যারের মতোই অনেকটা।
আমি তো প্রফেসর রাজ্জাকের অক্ষম শিষ্য। আমি তো কিছু জানি না, তিনি অনেক কিছু জানতেন।
রাজ্জাক স্যার তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। সকলেই ছিল তাঁর ভক্ত। বেশ আশ্চর্য হবার মতো ব্যাপারটা।
প্রফেসর রাজ্জাক পলিটিক্যাল সাইন্সের শিক্ষক ছিলেন, সবাই তাঁর ভক্ত ছিল। তাঁকে সবাই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করত। সেই জন্য প্রফেসর রাজ্জাক যা বলতেন, তাই এঁরা করত।
এভাবে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে অনেকেই সালাম করত। এই ব্যাপারটা বেশ অন্য রকম, না?
না, সবাই তাঁর ছাত্র ছিল না। একজনকে অমুক জায়গায় দেওয়া দরকার, সে যাইতে চাইত না। তবু তাকে জোর করে সেখানে দেওয়া হল — এ রকম ব্যাপার ঘটত আরকি। ধর, উনি কোথাও কোনো কনফারেন্সে গেছেন, কনফারেন্স থেকে বাইর হইয়া একটা কথা বললেন, সেটা ঠিক মতো ব্যাখ্যা হচ্ছে না; তিনি তখন বলতেন, আরে, ঘোড়ার কাম কি গাধা দিয়া অয়? তিনি অসম্ভব সুন্দর সুন্দর কথা বলতেন। তিনি খুব হাস্যরস করতে পারতেন। একটা মজার ঘটনা মনে আছে, ড. সাজ্জাদ আহমেদ চৌধুরী একবার বললেন, স্যার, আপনারে আমি প্রফেসর করে ফেলব। তখন উনি বললেন, আর যাই করেন, এইটা কইরেন না। প্রফেসর রাজ্জাক জাতীয় অধ্যাপক হলেন ১৫ মার্চ ১৯৭৫ সালে। সবাই তাঁকে খুব সম্মান করতেন। যেটা সত্য তিনি সেটা বলতেন।
***
একদিন কোথায় যেন দুজন যাচ্ছি, পথের মধ্যেই বললাম, প্রফেসর রাজ্জাক ছাড়া আপনার আর কে কে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন? তাঁদের কথা তো আপনি সাধারণত বলেন না!
হাসতে হাসতে বললেন, ছিল, ছিল। হরিদাস ভট্টাচার্য আর একজন ছিলেন, তিনি হলেন এ. কে. সেন। তাঁকে আমি এখনো ভুলতে পারি না। উনি বিখ্যাত সেন পরিবারের লোক, সম্ভবত তিনি কোনো রাজ পরিবার থেকে এসেছিলেন। আমরা তাঁর কাছে টিউটরিয়াল করতাম। উনি সেই টিউটরিয়াল ইংরেজিতে নয়, বাংলাতে কারেকশন করতেন। শুনেছি, উনি ডিপার্টমেন্টের হেডের কাছে চিঠি লিখতেন। এমনকী তাঁর একদিনের ছুটি লাগবে, সেটাও তিনি বাংলাতেই লিখতেন। তখন ইংরেজি বহুল প্রচারিত, তবুও এ. কে. সেন বাংলাতে সব কিছু করতেন — এ বিষয়টা আমাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছিল।
করিডোর থেকে হরিদাস ভট্টাচার্যের বক্তৃতা শুনে তো তাঁর ডিপার্টমেন্টের ছাত্রই হয়ে গেলাম।
আপনি তো জানেন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, সতেরজন ভিসির মধ্যে রমেশচন্দ্র মজুমদার আর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ছাড়া তেমন কেউ পণ্ডিত ছিলেন না।
কী বললা? এ সম্পর্কে তো আমার মতো লোক কিছু বলতে পারে না। আমি এ সব ব্যাপারে তেমন মত দিতে পারব না।
আপনি রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে মন্তব্য করতে ভয় পাচ্ছেন, না অন্য কিছু?
ভয়ের ব্যাপার না। ওসমান গণি থেকে শুরু করে যারাই এসেছেন, তারা তো তেমন পণ্ডিত ছিলেন না। আমি তো এ সব নিয়ে প্রফেসর রাজ্জাকের মতো করে কখনো ভাবি নি, ভাবার প্রয়েজনও হয়নি। আমার জায়গা ওটা না। একটা ঘটনা তোমাদের জানা দরকার। প্রফেসর রাজ্জাক যখন বিলেত গেলেন, তখন প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। কেন না ১৯৪৬-৪৭ সালের পুরো ব্যাপারটা তো হল, সব ভালো টিচাররা চলে যাচ্ছে। এইসব ভালো টিচাররা কলকাতায় বই তৈরি করেছিলেন, আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানকার টিচাররা কলকাতা গিয়ে ওখানে অ্যাসোসিয়েশনও করেন। সেই বইয়ের মধ্যে আর সি মজুমদার থেকে শুরু করে সবার লেখা আছে।
প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক বাস্তব ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। আপনি তো তেমন নন, তাহলে মিল হল কীভাবে?
হ্যাঁ, বাস্তব ব্যাপারে তিনি উদাসীন ছিলেন। তিনি কোনো কাজই করেন নাই — এটা তো সবারই কথা। একবার উনি একটা কথা বলেছিলেন, একজন পুলিশ অফিসার এসে বললেন, অমুক আসতে চায়। তিনি বললেন, এত বড় লোক আমার বাড়িতে আসবে? এত বড় অফিসার যার কথা বলছ, সে আসলে পরে আমি তাঁকে খাতির করি কীভাবে, আর অস্বীকার করি কী করে? প্রফেসর রাজ্জাকের কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তিনি যে কোনো বই দিয়ে দিতেন। আমরা সাধারণত বই দেই না। উনি নিজে উঠে বই দিতেন তাঁর লাইব্রেরি থেকে, লাইব্রেরিটার তখনও ক্যাটালগ হয়নি। কোন বই কোনখানে আছে, সেটা তাঁর মুখস্থ। যেটা দরকার বের করে দিতেন।
আচ্ছা, ছেলেরা যে তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছিল “প্রফেসর রাজ্জাকের কল্লা চাই” — ব্যাপারটা কী?
ভেরি ইন্টারেন্টিং। একবার হইল কী, আমি আর প্রফেসর রাজ্জাক বসে আছি, বাইরে ছেলেরা স্লোগান দিচ্ছে, প্রফেসর রাজ্জাকের কল্লা চাই। আমি হাসতে হাসতে বললাম, স্যার, ওরা কী বলছে শুনছেন? উনি বললেন, কী বলে? তখন আমি বললাম, ওরা বলছে, প্রফেসর রাজ্জাকের কল্লা চাই। রাজ্জাক সাহেব তখন বললেন, আমি কি বলেছি যে, আমার কল্লা এত শক্ত, ওটা কাটা যায় না। তাঁর সম্পর্কে প্রবাদ আছে, উনি তো টাকা মারছেন, একটা ক্লাসও নেন নাই। মানে ক্লাস না নিয়ে বেতন নেওয়া তো টাকা মারার সমান। হাঃ হাঃ!
এখন তো শিক্ষকরা রাজনীতি করেন। তখন শিক্ষক রাজনীতি ছিল? আপনি শিক্ষক রাজনীতির ব্যাপারে একটা ইন্টারেস্টিং গল্প করতে চেয়েছিলেন। আজ সেটা বলবেন?
প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে একজন জিজ্ঞেস করেছে, প্রফেসররা রাজনীতি করে কেন? তখন তিনি বললেন, তুমি জিজ্ঞেস করেছ, তারা কত মাইনে পায়? তাদের কত মাইনে দেয়? আর তুমি কত মাইনে পাও? তারা কী রাজনীতি করে, তারা সুইসাইডের রাজনীতি করতে পারে না?
আপনি প্রায়ই প্রফেসর রাজ্জাকের বাসায় যেতেন, ছফা ভাইও তাঁর বাসায় যেতেন, হাসি-ঠাট্টা করতেন।
তুমি জানলা কেমন করে? আমরা গিয়ে দেখতাম, তিনি ছফার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন, ইয়ার্কি-ঠাট্টা করছেন, তখন আমরা কাইটা পড়তাম। কারণ ছফার সঙ্গে তাঁর আড্ডা ছিল ভিন্ন ধরনের। ছফার সঙ্গে প্রফেসর রাজ্জাক খুব ইন্টিমেট ছিলেন। ছফা তাঁর সাথে ইয়ার্কি-ঠাট্টা করত। হ্যাঁ, ছফা তো প্রফেসর রাজ্জাককে ছাড়ত না। ও মুখের ওপর কিছু বলতে পরোয়া করত না। প্রফেসর রাজ্জাকের সাথে আমরা তেমনভাবে মিশতাম না। ছফা দরকার হলে টাকা চাইত, বলত, আমার এত টাকা লাগবে। আমাদের সাথে এ ধরনের সম্পর্ক ছিল না। আমরা যাইতাম তাঁর কাছে জ্ঞানের কথা-টথা শুনতে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে।
ছফা ভাই তো বেশ রসিক মানুষ ছিলেন। তিনি রাজ্জাক স্যারের সাথে জোকস্‌-টোকস্ করতেন।
হ্যাঁ, ছফা তো প্রফেসর রাজ্জাককে ছাড়ত না। ছফা আর প্রফেসর রাজ্জাক পরস্পর তর্কাতর্কি করতাছে, এমন জায়গাতে আমি যাই নাই। তুমি প্রফেসর রাজ্জাককে নিয়া এত প্রশ্ন করছ ক্যান? প্রশ্ন করো, কিন্তু আমি তাঁর সম্পর্কে তো সব কথা বলতে পারব না। হ্যাঁ, আমি জানি, তাঁর সঙ্গে ছফার ভালো রিলেশন ছিল। আমার সাথে ছফার তেমন কোনো রিলেশন ছিল না। মাঝে-মধ্যে কোনো জায়গায় দেখা-টেখা হত এই যা। কিন্তু আন্তরিক টানে ছফার সাথে আমরা দুজন কোথাও গেছি, এমনটি মনে পড়ে না। যে রিলেশনটা ছফার সঙ্গে রাজ্জাক সাহেবের ছিল এবং রাজ্জাক সাহেবের কাছে ছফা টাকা চাইত, স্যার কিছু লাগবে…। কত টাকা লাগবে? এত লাগবে…। আচ্ছা, দিই। এ ধরনের সম্পর্ক ছিল পরস্পরের।
আপনি নিজে কি এর সাক্ষী?। আপনি ছফা ভাইকে টাকা নিতে বা চাইতে দেখেছেন?
হ্যাঁ, ছফার এ সব ব্যাপারে লজ্জা-শরম বলতে কিছু ছিল না।
আপনি লজ্জা-শরমের কথা কেন তুললেন? এটা তো বন্ধুত্বের ব্যাপার, সম্পর্কের ব্যাপার। আপনাকে রাজ্জাক স্যার টাকা-পয়সা দিত না বলে এ সব বলছেন?
আমার লাগত না। আমি স্টাইপেন্ড পেতাম, বড় ভাইও দিত। ধর, ছফার পকেটে কিছুই নেই। ও লজ্জা করত না, বলত আমার এত টাকা লাগবে। ছফা প্রফেসর রাজ্জাকের কাছ থেকে প্রয়োজনেও টাকা নিত, এমনিতেও নিত। বলত আমার লাগবে। ছফা চলত ঐ রকমভাবেই। আবার তুমি শুনে আশ্চর্য হবে, ছফা প্রফেসর রাজ্জাককে সামনে বসাইয়া কাঁদামাটি জোগাড় কইরা তাঁর মূর্তি তৈরি করতাছে, এই অদ্ভুত কা- করতেও ছফাকে আমি দেখেছি। ছফার এসব পাগলামি ভালোই লাগত, বেশ ইন্টারেস্টিংও বটে। এ সব অনেক ব্যাপার আছে, যার ব্যাখ্যা তুমি পাইবা না। প্রফেসর রাজ্জাকও কোনো আপত্তি করতাছে না। সেটাও ছফার সাংঘাতিক গুণ। অন্যরা হলে যা করতে সাহস পেত না, ছফা অনায়াসেই তা করতে পারত।
আচ্ছা, আজিজে (শাহবাগ আজিজ মার্কেট) ছফা ভাইয়ের একটা আড্ডা ছিল। আপনাকে তো এখানে কখনো দেখিনি। কিন্তু এক সময় তো আপনারা বাংলা বাজারে সত্যেন দা’র — সত্যেন দা তো অর্মত্য সেনের কাকা — কাগজের দোকান কালিকলম-এ একসাথে আড্ডা মারতেন। সেখানে আপনি, রবি গুহ, মুনীর চৌধুরী ছাড়াও আহমদ ছফা থাকতেন।
তাহলে মজার একটা ঘটনা শোন, সত্যেন দা আর ছফা আড্ডা দিচ্ছে। আমি ওখানে গেলে পরে সত্যেন দা আমাকে দেখিয়ে ছফাকে বললেন, ছফা তুমি কি জান, এই আমাদের ‘মানিক’? সত্যেনদা ছফার কাছে আমাকে এইভাবে ইন্ট্রুডিউস করেছেন। আর ছফা তো আর এক পাগল। সাথে সাথে ছফা আমাকে একেবারে মাথায় তুলে নিয়েছে। আমি বললাম, মাথায় ওঠাইছেন ভালো, কিন্তু ফেলাইবার সময় একটু আস্তে ফেলাইবেন। ছফা হাসতে লাগল। ও আমাকে আমাকে খুব ভালোবাসত। (স্মিত হাসি)
তাহলে দুজনের সম্পর্ক ভিন্ন ধরনের ছিল অনেকটাই।
হ্যাঁ, তা তো ছিলই কিছুটা। তবে ছফা আর প্রফেসর রাজ্জাক পরস্পর তর্কাতর্কি করতাছে, এমন জায়গাতে আমি যাই নাই। ছফার সঙ্গে প্রফেসর রাজ্জাক-এর ভালো রিলেশন ছিল। আমার সাথে ছফার তেমন কোনো রিলেশন ছিল না। অনেকেই প্রফেসর রাজ্জাক-এর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ত। এক-একজনের সাথে তাঁর এক এক রকম রিলেশন। সেগুলো তিনি মেনটেন করে চলতেন।
আপনি তো রাজ্জাক স্যারকে কোনো ব্যাপারে ঘাটাতেন না। ছফা ভাই কিন্তু কোনো ফাঁক-ফোকর পাইলে স্যারকে ‘তুলোধুনা’ করার চেষ্টা করতেন।
হাসতে হাসতে বললেন, ওর পাগলামি বাদ দাও। ও যা পারে, আমি তো তা পারি না।
আপনি পাকিস্তান এত অপছন্দ করতেন, অথচ চান্স পাইয়াও রাজ্জাক স্যারকে কিছু জিগেস করলেন না? বড় অদ্ভুত লাগে! আপনি তো জানেন, ছফা ভাই প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি পাকিস্তান আন্দোলন কেন সমর্থন করলেন? এটা তো খুব খারাপ কাজ করছেন। রাজ্জাক স্যার তখন বলতেন, আমি হিন্দু লেখকদের যত লেখা পড়ছি, যত সাহিত্য পড়ছি, তাতে দেখা গেছে শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লেখা হিন্দু চরিত্র নিয়ে। এখানে যে মুসলমান সম্প্রদায় আছে, এটা তাদের লেখায় আসেই নাই।
সরদার স্যার বেশি দূর আগাইলেন না। শুধু বললেন, প্রফেসর রাজ্জাক তো ঠিকই বলেছেন; এটা কারেক্ট তো। এমন ঘটনা তো ঘটেছে সত্যি সত্যি। তুমি কি তা অস্বীকার করতে চাও?
আগেকার দিনের ‘হিন্দু লেখকরা’ সা¤প্রদায়িক হলে আমরাও কি সাম্প্রদায়িক হব? তা তো হতে পারে না। অনেক মুসলমান লেখকও সা¤প্রদায়িক তাই বলে কি আমরা তাকে সমর্থন করি।
এইটা সমর্থন-অসমথর্নের ব্যাপার না। তুমি তো জান, আমি সাম্প্রদায়িকতা বিশ্বাস করি না। সেই কারণে আমার লেখার মধ্যে একটি উক্তি আছে — ‘একজন মুসলমান ছেলের হিন্দু মা।’ এটা আমার বড় ভাইকে নিয়া লেখা। তার জীবনের সত্যিই এ রকম ঘটনা ঘটেছে।
আমি হিন্দু-মুসলমানকে মানুষ হিসেবে দেখি। একই বাগানের ফুলের মতো হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃস্টান। একটা বাগানে কেবল একটাই ফুলগাছ থাকলে তো তাকে বাগান বলা যায় না।
স্যারের মনটা হঠাৎ আষাঢ়ে মেঘের মতো ভারি হয়ে উঠল। তিনি বললেন, এখানকার ভালো ভালো শিক্ষকরা ও কমিউনিস্ট নেতারা দেশবিভাগের পর ভারতে পাড়ি জমালেন! আমাদের এই দেশটা মেধাশূন্য হয়ে গেল। তোমাদের বয়স কম, তোমরা এ সব সমস্যা বুঝবা না, এ ক্ষতি কোনো কিছুরই বিনিময়ে পূরণ হবে না।
আমি মনে মনে নিজেকে দোষী অনুভব করলাম। হায়! স্যারের মনটা বুঝি আমিই খারাপ করে দিলাম। পরিস্থিতি সামলে নেবার জন্য বললাম, একটু নুডুলস খাবেন নাকি? তিনি বললেন, আমাকে এখন ছাড়ো। আমি বাসা থেকে না বলে বেরিয়েছি। বুয়াকে বলেছি, আমি সোবহানবাগ যাচ্ছি, একটা জিনিস ফটোকপি করার জন্য। তাই বলে পালাইয়া আইছি। মুহূর্তে আমার মাথায় বুঝি আকাশ ভেঙে পড়ল। বললাম, আপনি এ কী কাণ্ড করেছেন? তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। বললেন, তুমি বোঝ না কেন আর কতদিন ঘরে বন্দি থাকব? বন্দি থাইকা কিছু লেখা যায় নাকি? স্যার, তাড়াহুড়া করতে লাগলেন, বললেন, বল, বল, তোমার আর কী কী প্রশ্ন আছে? আমি এবার বললাম, আপনি কি মনে করেন রাজ্জাক স্যার মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করতেন?
হাসতে হাসতে বললেন, অনেকেই তো এ সব জানে না। এই কথা বলতে বলতে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। চোখের কোণে যেন কচুপাতার মাঝখানটার মতো জল চিক চিক করছে। আমি পাশে বসে সব দেখছি। আমি যেন এক গরু হারানো রাখালের মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। এক মুহূর্তের জন্য রুমের পরিবেশটা থমথমে আকাশের মতো ভারি হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব। আমি বললাম, আমার তো মনে হয়, ছফা ভাই নানাভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, অধ্যাপক রাজ্জাক মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি। আমি তো বুঝি না, তাহলে তিনি বিদ্যাসাগরকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন কেন? কেনই বা উনি প্রফেসর লাস্কিকে এত সমাদর করেছেন? তিনি যাকেই যোগ্য মনে করতেন তাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকতেন কেন? বড় হৃদয় না থাকলে কেউ এমনটি করতে পারে?
আমি মনে করি, ছফা দেখেছে, এটা তার দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে। আমি বলছি, সেটা তা নয়। কমিউনিস্ট বলে তিনি আমাকে অপছন্দ করেন নাই। তিনি নিজের ক্লাস বন্ধ করে ছেলেদের বলেছেন, ‘আমার বক্তৃতা হুনে কী হইবো, ঐ যে পুকুর পাড়ে বক্তৃতা দেয়, হেই বক্তৃতা হুনেন কাজ দিবো।’ আমি তখন বক্তৃতা দিচ্ছিলাম ইলেকশনের ব্যাপারে, ক্লাস থেকে আমার বক্তৃতা শোনা যাচ্ছিল; তখন তিনি এটা বলেন। আরও ইন্টারেস্টিং, আমাকে পলিটিক্যাল সাইন্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হিসেবে প্রফেসর রাজ্জাকই ডেকে নেন। অবশ্য তখন আমি প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে গিয়ে বললাম, স্যার, আমি তো ফিলোসফির লোক, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াব কী করে? রাজ্জাক স্যার বললেন, আরে, মাথা পরিষ্কার না থাকলে কি রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানো যায়? প্রফেসর রাজ্জাক এভাবেই সব কিছু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন। তাঁর সিদ্ধান্তের বাইরে যাবার উপায় থাকত না। তিনি কী বলতেন জান? মাথা ক্লিয়ার না থাকলে পলিটিক্যাল সাইন্স পড়ানো যায় না। যদি আমার কিছু গুণ থেকে থাকে, সেই জন্যই রাজ্জাক সাহেব আমাকে পছন্দ করতেন। একদিনে সব কথা বলা যাবে না। আজ আমাকে ছাড়ো।
আর একটা কথা শুনব। বলুন তো, প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে জিন্নাহ এত প্রশংসনীয় ছিলেন কেন?
প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে জিন্নাহ গুণী মানুষ ছিলেন, বড় এডভোকেট ছিলেন। তিনি তাঁকে রাজনীতিক হিসেবে স্টেটমেন্ট করেন নি। নেহেরু সম্পর্কে তাঁর এলার্জি ছিল। তিনি বলতেন, জিন্নাহ মোর দ্যান নেহেরু। প্রফেসর রাজ্জাকের কথায় নেহেরু কোনো মতেই জিন্নাহর সমকক্ষ ছিলেন না। তিনি জিন্নাহকে নেহেরুর চেয়ে অনেক বড় মনে করতেন। তবে তিনি নেহেরুকে লোক হিসেবে ভালো মানুষ মনে করতেন। কিন্তু বুদ্ধিতে নেহেরুর চাইতে অনেক বড় মনে করতেন জিন্নাহকে।
সরদার স্যার বললেন, চল, আমাকে রিকশায় তুলে দাও।
* * *
আমি মতিঝিল যাব, জরুরি একটা কাজ আছে। বাসা থেকে তাড়াতাড়ি করে আজিজে এলাম। ও মা, পৌঁছে দেখি, সরদার স্যার বসে আছেন। এ যেন না চাইতেই হাতের কাছে চাঁদ পাওয়া। সকাল আটটায়ও ফোনে কথা হল, তখনও তিনি বললেন, আজ থাক, অন্য একদিন দেখা যাবে। তুমি পরে ফোন করো, পরে একদিন যাব। আমার মুখের কথাটা যেন ক্রিকেটের ঘূর্ণিবলের মতো থামিয়ে দিয়ে বললেন, চলে আসলাম। তোমার কাজের ক্ষতি হবে না তো? আমি বললাম, না, না, ক্ষতি হবে কেন? তিনি তখন বললেন, টিকাটুলি ওয়েম্যান কলেজে যেতে চেয়েছিলাম, ভালো লাগল না, তাই চলে এলাম।
চা মুখে দিতে দিতে বললাম, আপনার থলিতে রাজ্জাক স্যার আছে নাকি? তিনি যেন বারুদের মতো মুহূর্তে জ্বলে উঠলেন। বললেন, বলো, বলো, কী জানতে চাও তাঁর সম্পর্কে?
আপনি না একদিন বলেছিলেন, প্রফেসর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে সেøাগান দিয়েছিল ছাত্ররা। গল্পটা…।
উনি আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, লীগের ছেলেরা, লীগের ছেলেরা প্রফেসর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে সেøাগান দিয়েছিল। উনি আওয়ামি লিগের সুনজরে ছিলেন না। ছাত্রলীগের ছেলেরা তাঁর বিরোধিতা করত।
উনার কতকগুলো পছন্দ ছিল। তার বাইরে উনি যেতেন না। আপনি একবার বলেছিলেন, সকলেই উনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। কথাটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছিল। আপনি সেদিন বললেন, অন্যদিন বলবেন।
হ্যাঁ, তাঁকে অনেকেই সম্মান করত, এর মধ্যে অনেকে তাঁর ছাত্রও ছিল, আবার ছাত্র ছাড়াও অনেকে তাঁকে সমীহ করত। প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী প্রফেসর রাজ্জাকের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। ওপর মহলে তাঁর খুব প্রভাবও ছিল, সুনামও ছিল। যেই জন্য তিনি এত দূর যেতে পেরেছিলেন। তাঁকে সকলেই মান্য-গণ্য করত। তাঁদের পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল। তিনি নানান অনুষ্ঠানে যেতেন, সেখানে খানাপিনার ব্যবস্থা থাকত, এইসবের মধ্যে কথা ওঠাতেন। তখন হয়ত বলতেন, আপনি সাজ্জাদ হোসেনরে কী মনে করেন? তখন তিনি তাঁর বক্তব্য বলতেন। সূর্যের আলোর যেমন ডিসক্রিমিনেশন নেই, সবার ওপরে পড়ে, প্রফেসর রাজ্জাকও সে রকম একজন।
আপনার সাথে এত বিষয়ে আলাপ হত, আপনি কখনো রাজ্জাক সাহেবকে প্রশ্ন করেন নি, উনি কেন পিএইচডি না করে ফিরে আসলেন?
স্মিত এক টুকরো হাসি ছিটিয়ে বললেন, হ্যাঁ, বলেছি। প্রফেসর রাজ্জাক হাসতে হাসতে বললেন, ফির‌্যা আইছি, তাতে আর কী? আমি তো তখন দেখি নাই, আমি কী লিখছি, কী লিখি নাই। তাঁর গাইড লাস্কি বলেছিলেন, আরও ছয় মাস থেকে তুমি কাজ শেষ করো। তিনি বলেছিলেন, আমি আর ছয়দিনও থাকতে পারব না।
কেন, কেন?
তাঁর কাছে পিএইচডি কিচ্ছু না।
আপনি তো জানেন, তাঁর পিএইচডি-র বিষয় ছিল কী?
জানি, জানি, উনি পিএইচডি করতে চেয়েছিলেন ইন্ডিয়ান পলিটিক্সের ওপর। পিএইচডি করার জন্য উনি লেখাপড়া করেন নাই, তাঁর কাজ ছিল এক্সট্রা অর্ডিনারি জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান দান করা। অন্যদের সাথে প্রফেসর রাজ্জাক-এর বিস্তর পার্থক্য ছিল, যা সাধারণভাবে বোঝা যেত না। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা কিছু বুঝি, তা হল প্রফেসর রাজ্জাক একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু কেন তিনি কোনো বই লেখেন নাই, এটা আমার কাছে বোধগম্য নয়? অনেকটা কৌতুক করে বললেন, প্রফেসর রাজ্জাক বেঁচে থাকলে তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতাম; তুমি সব জেনে আসতে পারতে।
জ্ঞানী মানুষের হাসির প্রভা অন্য রকম। আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। ভাবলাম, আমি কোনো ভুল করলাম নাকি? তিনি আমাকে আর সময় না দিয়ে বললেন, এই রকম প্রশ্ন যদি করা হয়, প্রফেসর রাজ্জাক তো কোনো বই লেখেন নাই, তবু তাঁকে কেন সম্মান করা হয়? এর জবাব হচ্ছে, বই লেখা, প্রফেসর হওয়া, এটাকে তিনি সিরিয়াস কিছু মনে করতেন না। এই জন্যই তিনি সব সময় ভালো ভালো টিচারদের খুঁজে এনে চাকরি দিতেন।
আচ্ছা, রাজ্জাক স্যার একটা পিকিউলিয়ার কথা বলছেন, তাঁর শিক্ষক লাস্কি আর মওলানা আবুল কালাম আজাদ এঁরা নাকি সব সময় সত্যি কথা বলতেন না!
(একটু বিব্রত হয়ে) এই রকম কথা আমি মনে রাখার মতো করে শুনি নাই কিংবা শোনার মতো করে শুনেছি।
আপনি তো সব ব্যাপারে যুক্তি দেখান। প্রফেসর রাজ্জাকের সঙ্গে কোনো বিষয়ে দ্বিমত হয়নি?
না, এমন কোনো ডায়ালগ হয়নি যে এটা আমি মানি না স্যার, আপনি যেটা বললেন, এটা আমি স্বীকার করি না। কেননা, আমি যাচ্ছি, প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে কোনো ডায়ালগের জন্য নয়, কোনো তর্কের জন্য নয়। আমি জ্ঞান অর্জনের জন্য তাঁর কাছে যেতাম।
রাজ্জাক স্যার ক্লাসের বাইরে কী রকম আচরণ করতেন? আপনি কি তাঁর কাছ থেকে বিনয় শিখেছেন? আপনার বিনয়ের উৎসটা বলবেন।
হাসতে হাসতে বললেন, তুমি এ প্রশ্নটা বাদ দাও। আমার প্রসঙ্গ থাক না। তিনি ছোট-খাটো মানুষ তো। তাঁর সব কিছুর মধ্যেই খুব সাধারণত্ব ছিল। তিনি খুব সরল ও সাদামাটা জীবনযাপন করতেন।
সেদিন আপনি বলেছিলেন, তোমাকে একটা মজার ঘটনা বলব। ঘটনাটা আজ বলুন।
কী যেন? তোমার এত কথা মনে থাকে। আমি তো সব ভুলে যাই।
বলেছিলেন আপনি একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলবেন রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে। সেটা তো আর বললেন না। কী যেন? ঘটনাটা সম্ভবত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে প্রফেসর রাজ্জাক কোনো কথা বলেন নাই। একবার বলেছিলেন, আমি ভালো করে দেখি নাই, শুনলাম গুলি হয়েছে, শুধু গুলির কথাটা বলেছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রফেসর রাজ্জাকের মুখে আমি কখনো কিছুই শুনি নাই।
তাহলে কি আপনি বলতে চান রাজ্জাক স্যার ভাষা-আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন?
না, ভাষা-আন্দোলনের বিরোধী নন তিনি। ভাষা-আন্দোলনের সময় মুনির চৌধুরী জেলে গেল, তখন উনি তাঁর ফ্যামিলিকে পেট্রোনাইজ করেছেন। মুনিরের স্ত্রী লিলিকে তিনি নানাভাবে সাহায্য করেছেন। লিলি তখন তো বাসায় থাকত। কাজেই তিনি যদি ভাষা-আন্দোলনের বিরোধী লোক হন, তাহলে মুনিরের ফ্যামিলির লোকের সাথে এভাবে কানেকশন রাখতে যাবেন কেন?
ওই যে শহীদ, শহীদ বরকত…?
কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন, ও বুঝেছি, বুঝেছি। আমার নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রফেসর রাজ্জাক একটা কথা বলেছিলেন। এটা নিয়ে খুব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। একজন পুলিশ অফিসার নাকি তাঁকে বলেছিল, বরকতরে নিয়া আপনারা ক্যান এত লাফালাফি করেন? হে তো পুলিশের ইনফর্মার ছিল। আমি তাঁর সেই কথা রেকর্ড করেছি। ঐ যে…, ঘটনাটা তো আমি অনেক জায়গায় বলেছি, আমার একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। উনার কথাকে ধরে রাখার জন্য কিনেছিলাম। ১৯৭৬ সালে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রফেসর রাজ্জাকের একটা ডায়লগ ছাপা হয়েছিল। বিরাট এই ডায়ালগটা শাহাদৎ চৌধুরী ছেপেছিল। আমি তখন বিচিত্রায় যাতায়াত করতাম। ডায়ালগটা ছাপা হওয়া মাত্রই সারা দেশে একেবারে শোরগোল পড়ে যায়। রাজ্জাক সাহেব এক জায়গায় বলেছিলেন, একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন, এই মিয়া, আপনারা বরকতকে নিয়া ক্যান এত নাচানাচি করেন? তখন প্রফেসর রাজ্জাকের এই কথাটা আমি টেপ করেছিলাম। তিনি পুলিশ অফিসারকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাদের লোক মানে কী? তখন পুলিশ অফিসার বলেছিলেন, বরকত পুলিশের ইনফরমার। বরকত রাস্তায় যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে সে গুলি খায়, তখন সে শহীদ হয়। এই রেফারেন্সটা আমি রেকর্ড করি। তখন রাজ্জাক সাহেব আমাকে বলেছিলেন, আপনার হাতে যেটা বাজাইতেছেন রেকর্ডারটা বন্ধ করেন। কিন্তু আমি রেকর্ডার বন্ধ করি নাই। ঘটনাটা আমি ধরে রেখেছিলাম, কিন্তু ছাপাবার কথা চিন্তাও করি নাই, সিদ্ধান্তও নেই নাই, শাহাদৎ চৌধুরী আমার সঙ্গে আলাপ না করে ডায়লগটা বিচিত্রায় ছেপেছিল। ওরই মধ্যে একটা জিনিস আলাপ না করে ছাপা উচিত হয় নাই। রাজ্জাক সাহেবকে অবশ্য জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি এই কথা বলেছেন? তিনি হ্যাঁও বলতে পারেন নাই, নাও বলতে পারেন নাই, এই রকম একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। আর না বলবেন কী করে যেখানে তিনি বলেছেন।
আপনি তো কাজটা ভালো করেন নাই। তাঁকে একটা অ্যামবারেসিং অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। নিকটজন হয়ে এমন করাটা কি ঠিক করেছিলেন বলে মনে করেন?
আরে তা না। শাহাদৎ চৌধুরী আমার সঙ্গে আলাপ না করে কাজটা করেছে। আর আমি তো মনে করি, শহীদ শহীদই। তাঁকে কোনোভাবেই খাটো করার কিছু নেই। আন্দোলন করতে গিয়া কেউ পুলিশের গুলি খাইলেই শহীদ হয়, কে মরছে সেটা দেখার বিষয় না।
ছফা ভাই যখন বই লিখেছেন, তখন অধ্যাপক রাজ্জাকের কাছে বঙ্কিম সম্পর্কে মতামত চাইলে তিনি কী করেছিলেন জানেন? তিনি বলেছিলেন, একটা কবিতা আছে না — ‘আমি থাকি ছোট ঘরে/ বড় মন লয়ে, নিজের দুঃখের অন্ন/ খাই সুখী হয়ে।’ বঙ্কিমের ব্যাপারে জিনিসটা হল একেবারে উল্টো। অর্থাৎ ‘আমি থাকি বড় ঘরে/ ছোট মন লয়ে।’ মানে বঙ্কিম প্রসঙ্গে রাজ্জাক স্যার পাত্তাই দিতে চান নি।
না, রাজ্জাক স্যার তো সাহিত্যিক ছিলেন না। অধ্যাপক রাজ্জাকের কাছ থেকে আমরা কোনো সাহিত্যিকের মূল্যায়ন পাই নাই। এমনকি তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও আমাদের কিছু বলেন নাই।
সাহিত্যিক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের এত নাম। অথচ বঙ্কিমের সম্পর্কে এই রকম একটি গল্প চালু আছে, বিদ্যাসাগর বিএ-তে বাংলায় প্রশ্নপত্র তৈরি করেছিলেন। প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছিল। সেই কারণে বঙ্কিমচন্দ্র কম নম্বর পেয়েছিলেন এবং গ্রেজ মার্ক দিয়ে তাঁকে বিএ পাশ করতে হয়েছিল। সেই কারণে তিনি বিদ্যাসাগরের ওপর নাকি খুব খ্যাপা ছিলেন?
হতে পারে। এসব অদ্ভুত তথ্য তুমি কোথায় পাও? আমি তো সাহিত্যের ছাত্র না, এতশত জানব।
আচ্ছা, রাজ্জাক স্যার নাকি বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করেছিলেন, বিদ্যাসাগর সংস্কৃতবহুল বাংলা লিখে, বাংলাভাষাকে সংস্কৃত আক্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন?
বলতে পারেন। আমার স্মৃতিতে নাই। স্মৃতিতে না থাকলে আমি বলি কী করে?
আপনি কমিউনিস্ট ছিলেন। রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে কমিউনিস্ট রাজনীতি নিয়ে কখনো কোনো আলাপ-আলোচনা হত?
হাসতে হাসতে এভাবে কথা হয়েছে যে, “আপনারা কমিউনিস্টরা তো বুঝেন এই…। আমি তো বুঝি না। আপনারা কমিউনিস্টরা বুঝেন…।” এরকম কথা হয়েছে। তিনি এ রকম করে কখনো কখনো কথা বলতেন।
রাজ্জাক স্যার দুটো বই অনুবাদ করেছিলেন, জানেন? অবশ্য পরে সেগুলো হারিয়ে যায়।
না, সেটা আমি জানি না, তাঁর অনুবাদ তো আমি দেখি নাই।
রাজ্জাক সাহেবের থিসিসের পাণ্ডুলিপিটা আপনি প্রকাশের উদ্যোগ দিতে পারতেন…?
উনার নিজের পাণ্ডুলিপিটা, সেটা তো আমি দেখি নাই। উনি তো নিজেই কারেকশন করেন নাই, নিজেই প্রিন্ট করেন নাই এবং প্রিন্ট করতেও দেন নাই। উনার থিসিসটা কাউকে দেখতেও দেন নাই। রাজ্জাক সাহেব কাউকে পড়তেও দেন নাই এবং জ্যাতা অবস্থাতে উনি ওটা বারও করেন নাই। থিসিসটা এখন সম্ভবত তাঁর ভাতিজাদের কাছে আছে।
রাজ্জাক স্যার তাঁর থিসিসটা প্রকাশ করলেন না, এই ব্যাপারে আপনার সাথে কোনো আলোচনা হয় নাই?
কথা হয়েছে। চেষ্টাও করেছি আমরা। উনি কোনো গুরুত্ব দেন নাই। এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বারবার।
থিসিসটা সম্পন্ন করার ব্যাপারে আপনারা উদ্যোগ নিতে পারতেন…।
হ্যাঁ বলেছি, স্যার থিসিসটা একটু দেখি। স্যার, একটু কারেকশন করি। থিসিসটাকে তিনি মূল্যবান মনে করেন নাই। একটা গল্প আছে যে একজন ব্রিটিশ প্রফেসর নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিট করতে এসেছিলেন। রাজ্জাক সাহেব এবং সেই ব্রিটিশ প্রফেসর মুখোমুখি বসেছিলেন। তখন প্রফেসর রাজ্জাক নাকি বলেছিলেন, আপনি তো আমার এক্সামিনেশন কমিটিতে ছিলেন। তখন ঐ ব্রিটিশ প্রফেসর বলেছিলেন, তুমি তো নোট দাও নাই, তোমার থিসিস তো কমপ্লিট হয় নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। তুমি বরঞ্চ আরও কিছুদিন কাজ করো। তখন প্রফেসর রাজ্জাক বলেছিলেন, আমি কি এটাকে এত মূল্যবান মনে করি? আমি আরও ছয় মাস অপেক্ষা করব? আবার তোমাদের সামনে হাজির হব? এভাবে কথাটা ব্রিটিশ প্রফেসর আর আমাদের শুনিয়েছিলেন।
আচ্ছা, রওনক জাহান একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন রাজ্জাক স্যারের ওপর, ওটা কি আপনি পড়েছেন?
শুনেছি লিখেছেন, কিন্তু আমি ঐ প্রবন্ধ সম্পর্কে জানি না।
প্রফেসর রওনক জাহানও তো প্রফেসর রাজ্জাকের উপর খুব জাস্টিস করেন নাই, করতে পারেন নাই। উনি তাঁর থিসিসটা প্রকাশ করতে পারেন নাই। প্রফেসর রাজ্জাককে জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারতেন, রওনক জাহান তা করেন নাই। রওনক জাহান নিজে খুব বিদ্যান ছিলেন, ইন্টারন্যাশন্যাল প্রফেসরও ছিলেন। আপনি তো রাজ্জাক স্যারকে সব সময় মাথার ওপরে রাখেন। এটা কি আপনার স্বভাব, কাউকে ছোট না করা?
না, না, তা হবে কেন? হাসতে লাগলেন। কয়েক মিনিট নিরবতার পর বললেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিষয় সাধনায় বশীভূত হয়ে, অনুগত হয়ে কাজ করা প্রয়োজন, এ রকম কোনো কাজ প্রফেসর রাজ্জাক করেন নাই। কোনো কিছু কেউ বললে বলতেন, সরদার, হে সব বলতে পারে। (বিনয়ের হাসি)
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে রাজ্জাক স্যার বলেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও শহীদুল্লাহর মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষও কোনো রকম গবেষণামূলক কর্মে আত্মনিয়োগ করে নাই। তিনি বিয়ে পড়িয়ে এবং মিলাদ শরিফ পড়িয়ে সময় কাটাতেন। কথাটা কতটুকু সত্য?
প্রফেসর রাজ্জাক একবার শহীদুল্লাহ সাহেবের প্রশংসা করেছিলেন। আঞ্চলিক ভাষার অভিধানটা সম্পর্কে বলেছিলেন, দিস ওয়াজ দি ক্রিয়েশন অব ড. শহীদুল্লাহ। তিনি কারো কোনো গুণ দেখলে প্রশংসা করতে কার্পণ্য করতেন না। এটা ছিল তাঁর চরিত্রের বড় গুণ।
রাজ্জাক স্যার আপনার কাছে এত অ্যাট্রাকশনের ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন কীভাবে? তিনি সুন্দর সুন্দর কথা বলতেন, তিনি নতুন নতুন সব কথা বলতেন, তাঁর কথায় হিউমার থাকত — সেই জন্য বুঝি?
সরদার স্যার বললেন, তুমি যত প্রশ্ন করছ, আমি জীবনেও এত প্রশ্নের জবাব দেই নাই। (হাসি) আমি বলব, তিনি সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারতেন। উনি বাংলাদেশের হিস্ট্রির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, আপনারা যে রাজা রামমোহনরে নিয়া এত নাচানাচি করেন, রামমোহন কী করেছিলেন, জানেন? তাদের কখনো জিজ্ঞেস করছেন, তিনি বিলেত গেছিলেন ক্যান? তিনি বিলেত গেছিলেন, ‘বাপের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করতে, হেইডা তো আপনারা কন না? রাজা রামমোহন বাংলায় লিখেছেন, বাংলায় লেখার তো কোনো দরকার ছিল না।
সরদার স্যার হাসতে হাসতে বললেন, আমি বলি, দিস ওয়াজ কন্ট্রিবিউশন, নাইনটিনথ সেঞ্চুরিতে রামমোহন বাংলাভাষাকে ইন্ট্রোডিউস করেছেন, ডেভেলাপমেন্ট এনেছেন। প্রফেসর রাজ্জাক আমাদের কাছে ছিলেন অ্যাট্রাকশন, কারণ তিনি যে কোনো বিষয়ে নিজস্ব মত দিতে পারতেন। তা কেউ পছন্দ করুক আর না করুক! বিরুদ্ধ মতও তিনি গুছাইয়া সুন্দরভাবে পরিবেশন করতেন। কী অসাধারণ ক্ষমতায় সব বিষয়ে প্রবেশ করতেন, তাঁর মধ্যে পাণ্ডিত্যের ছাপ পাওয়া যেত। লোকটার কাছে গেলে পরে ভালো ভালো কথা শোনা যেত।
আচ্ছা, একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলির সময় রাজ্জাক স্যার কোথায় ছিলেন? এ সব নিয়ে বিভিন্ন রকম কথা শোনা যায়?
উদাসভাবে সরদার বললেন, গুলির সময় প্রফেসর রাজ্জাক বাইরে কোথায় যেন ছিলেন। আমি তো তখন জেলে, আমাকে না জিগেশ করে ইতিহাস খোঁজ করো। তোমরা সব কিছু সহজে পেতে চাও।
একাত্তরে তো রাজ্জাক স্যার পালিয়ে ছিলেন, অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাঁর নামে হুলিয়া দিয়েছিল। তাঁর মাথার দাম ঘোষণা কার হয়েছিল কত টাকা যেন…?
আমি তো তখন জেলে ছিলাম। আমিও শুনেছি তাঁর নামে হুলিয়া হয়েছিল।
তিনি ১৯৬৫ সালের সংবিধান রচনা করেছিলেন? আপনি বলেন, আপনার নিজের নামও মনে থাকে না, ভুলে যান। কিন্তু দর্শনের ব্যাপারে আপনার স্মৃতি টনটনে। কোনো প্রশ্ন করার আগেই আপনি বুঝে ফেলেন, এর রহস্যটা কী। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস্, রুশো, মার্কস, এঙ্গেলস এমনকি সার্ত্র পর্যন্ত গড়গড় করে বলতে পারেন। আচ্ছা, আপনি অনেক বছর জেল খেটেছেন, এত সব পড়লেন কখন? দর্শন বিভাগের আব্দুল মতিন স্যার নাকি একবার বলেই বসেছিলেন, আপনি শিক্ষকতা করবেন কেমন করে? জেলে গিয়ে তো সব ভুলে গেছেন!
হ্যাঁ, তাই তো। ওরা ঠিকই বলেছে। (হাসি…)
আপনিও সক্রেটিসের শিষ্য। ঠিক তাঁরই মতো বিনয় দেখালেন।
(হাসতে হাসতে…) আমি তো কিছু মনে রাখতে পারি না। আমি তো আমার নিজের নামই ভুলে যায়।
রাজ্জাক স্যার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়শো টাকার মাইনের চাকরি ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার দুইশো পঞ্চাশ টাকার মাইনেতে ফিরে আসলেন। তিনি এখানকার টানে আসলেন, নাকি অন্য কিছু?
রাজ্জাক স্যার কীভাবে ইন্সটিটিউশনটা — ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় — তৈরি করলেন, সেটা তোমাকে বুঝতে হবে। যখন তাঁকে দিল্লিতে নেওয়া হল নয়শো টাকার মাইনে ছিল, তিনি আবার দুইশো পঞ্চাশ টাকা মাইনেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসলেন। বললেন যে, আমার নয়টা-পাঁচটা করা হবে না। উনার ব্যাপারটাই ছিল ওই রকম। উনি তো নয়টা-পাঁচটার শিক্ষক নন।
রাজ্জাক স্যারের সাথে মুনীর চৌধুরীরও একটা যোগাযোগ ছিল। আপনি, মুনীর চৌধুরী এঁরা কমিউনিস্ট। তিনি তো ভিন্ন লাইনের, তাহলে দাঁড়াচ্ছেটা কী?
(হাসতে হাসতে… ) তিনি মুনীরকে সাংঘাতিকভাবে সাপোর্ট করতেন। মুনীরকে অনেক উঁচুতে স্থান দিয়েছেন। মুনীর জেলে গেছে, তাঁকে তিনি বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। এমনকি তাঁকে অর্থনৈতিক সাহায্যও দিয়েছেন। তিনি মুনীরের স্ত্রী মিলিরও খোঁজ-খবর নিতেন। এ সব সাংঘাতিক ব্যাপার।
আপনি অনেকবার জেলে গেছেন, কখনো রাজ্জাক স্যার জেলখানায় আপনাকে দেখতে গেছেন? কোনো সাহায্য সহযোগিতা করেছেন?
না, এমন কিছু কখনো ঘটেনি। তবে প্রফেসর রাজ্জাক সব সময় আমার খোঁজ-খবর রাখতেন।
ছফা ভাই তো প্রফেসর রাজ্জাক সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন এইভাবে: ‘এক ধাতুতে তৈরি ব্লকের মতো… সম্পূর্ণ মানুষ বাঙালি মুসলমান সমাজে একজনও দেখি নাই। হিন্দু সমাজে সন্ধান করলে হয়ত কতিপয় খুঁজে পাওয়া যাবে।’ আপনি তো প্রফেসর রাজ্জাক সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবেন।
sarder-2.jpg
……..
বই দেখছেন সরদার ফজলুল করিম
……..
সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন, ভালোই তো বলেছে ছফা। কিন্তু এই সব নিয়ে এক কথায় মন্তব্য করতে গেলে পরে সমস্যা হয়। ব্যাপারটা কারো কারো চোখে একপেষে লাগতে পারে। বাঙালি মুসলমানদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সাবালক করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মুক্তির আন্দোলন ও মুসলমান সমাজে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাজ্জাক স্যার পালন করেছিলেন। ছফা বলতে পারত আরও কেউ আছে কিনা? এটা ছফার ব্যক্তিগত অভিমত। বিষয়টি আরও আলোচনামূলক হতে পারত। ছফা সে রকম বুদ্ধিমান হলে তাই করত। ভারতীয় উপমহাদেশে কয়টা সম্প্রদায় আছে, কার কী ভূমিকা তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হওয়া দরকার, এখন তা হতে পারে।
মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে রাজ্জাক স্যার আলোচনা করতেন নাকি?
মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে প্রফেসর রাজ্জাকের কাছ থেকে কোনো আলোচনা শুনেছি, এটা আমার স্মৃতিতে নাই। মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে উনি বলতেন, মহাত্মা গান্ধী একটা ভালো লোক।
গান্ধীজী মরার সময় বলেছেন, “হা রাম…।”
তিনি যদি নিহত না হয়ে নিউমোনিয়াতে মারা যেতেন আরও কিছুদিন বাঁচতেন। আরও পাঁচদিন বাঁচলে তো আরও বেশি উপকারই হত। তিনি ব্যারিস্টার ছিলেন। আস্তে আস্তে কাপড়-চোপড় ছেড়ে একেবারে ন্যাংটিপরা ফকির হয়ে গেলেন! এই ন্যাংটি পরিহিত ফকিরই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রবেশ করেছিলেন। দে হ্যাড টু টক উইথ হিম। উইথ গান্ধিজী। অ্যান্ড দে কল্ড মেইক ইট ফকির। কাজেই আরও পাঁচদিন বাঁচলে আরও বেশি কাজ করতে পারতেন। এই যে তাঁকে মাইরা ফেলল, এজন্য তাঁর কাম হয়ে গেল। তাঁকে মৃত্যু বলে না, তাঁকেই বাঁচা বলে, তাঁকে কাজ বলে। ওইটাই হচ্ছে আসল চিন্তা।
একবার লাস্কি রাজ্জাক স্যারকে বলেছেন, তুমি চেষ্টা করলে নেহেরুর মতো হতে পারবা। তখন রাজ্জাক স্যার বলছেন, আমি নেহেরুর ফলোয়ার হতে যাব কেন?
razzak-4.jpgএটা ভালো তো, একটা মজার গল্প। তিনি বলেছিলেন, আমি নেহেরুর ফলোয়ার হতে যাব কেন? আমি তো জিন্নাহর ফলোয়ার। তিনি নেহেরুকে কখনো জিন্নাহর সমকক্ষ বলে মনে করতেন না। তিনি ঐ মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন, তাই তিনি জিন্নাহকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন।
পরে শুনেছি, প্রফেসর রাজ্জাকের সাথে ডালিমের পরিবারের সম্পর্ক ছিল। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর ডালিম তাঁকে জানিয়েছিল। শুনেছি, তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নি। ডালিম তাঁর কাছে আশ্রয় নিতে গেল না কোনো রিপোর্ট দিতে গেল তা জানা যায় নি। রাজ্জাক সাহেব মারা যাবার পর আওয়ামি লীগের কোনো নেতা তাঁকে দেখতে যান নি।
এ সম্পর্কে আমার অবজার্ভেশন হচ্ছে: টু অবজার্ভ দ্যা সিচুয়েশন — আমেরিকান অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কোনো হায়ার অফিসার কিংবা অ্যাম্বাসেডর হতে পারে, তাঁর গাড়িতে আমেরিকান ফ্লাগ ছিল। গাড়িটা রাজ্জাক স্যারের বাসায় ঢুকছে, পাঁচ মিনিট পর আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এই যে, সিচুয়েশন… আর ব্যাখ্যা করি না… রাজ্জাক স্যারের কোনো কথা নিয়ে আমরা ব্যাখ্যা করতাম না। উনার কথা শুনতাম। আমরা কাউন্টার করতাম না। আমরা কোনো আর্গুমেন্টে যেতাম না। বলতাম না, স্যার, আপনার এই কথা ঠিক না।
ওয়েবলিংক:
একদিন আহমদ ছফার বাসায় আমরা
nanditaali@gmail.comর

প্রতিক্রিয়া (৬) »

    • প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শেহাব BANGLADESH — ফেব্রুয়ারি ১, ২০০৯ @ ৩:১৯ অপরাহ্ন শুরুতে কেমন যেন লাগলেও পরে ভাল লেগেছে।
      - শেহাব
    • প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ফিরোজ আহমেদ BANGLADESH — ফেব্রুয়ারি ১, ২০০৯ @ ৪:২৩ অপরাহ্ন খুব ভালো লাগলো। এরকম লেখা আরও চাই।
      - ফিরোজ আহমেদ
    • প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মুক্তি মণ্ডল BANGLADESH — এপ্রিল ১৪, ২০০৯ @ ১:৪৮ পূর্বাহ্ন আমার কাছে সাক্ষাৎকারটা ভাল লাগলো। অনেক কিছুই জানতাম না। তা জানতে পারলাম।
      - মুক্তি মণ্ডল
    • প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কাজী আফসিন সিরাজী AUSTRALIA — মে ১১, ২০০৯ @ ১০:২২ অপরাহ্ন এমন আরো আলোচনার প্রয়োজন আছে। এমন সমাজ নেতাদের সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানানো উচিৎ। এনারাই তো জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ তৈরির জন্য উত্তম উদাহরণ হিসেবে কাজ করবেন। বেশ ভালো লাগল লিখাটা।
      -কাজী আফসিন সিরাজী
    • প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জাফর ইকবাল BANGLADESH — জুলাই ৪, ২০০৯ @ ৮:২৩ পূর্বাহ্ন সরদার স্যারের অবস্থান মনে হয় শুধুই জ্ঞানের জন্য জ্ঞান। আমরা এটাও জানি, জ্ঞান প্রশ্ন করতে শেখায়, প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে আবার নতুন জ্ঞান তৈরি হয়। পদ্ধতিগতভাবে সরদার স্যারের নিরবচ্ছিন্ন আত্মসমর্পণের কৌশলটা ঠিক নয়। সেদিক থেকে আহমদ ছফা কিছুটা অগ্রসর, কারণ যেভাবেই হোক তিনি ডায়ালগে গেছেন। প্রকৃত সত্যটা বোঝার দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াটা অব্যহত রেখেছেন। যা প্রকৃত সত্য উদঘাটনের একমাত্র পথ। কোনো সন্দেহ নেই রাজ্জাক স্যার, সরদার স্যার এবং ছফা সবাই এক একটি নক্ষত্র যারা দূর আকাশ থেকে আলো দিয়ে যাবেন যুগ যুগান্তরে। এ ধরনের ডায়ালগ অব্যহত রাখা অত্যন্ত জরুরী। প্রত্যাশা করব, ভবিষ্যতে আরো গুণী মানুষের সাথে লেখকের ডায়ালগ পড়তে পারব।
      - জাফর ইকবাল
    • প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিবর্তনবাদী BANGLADESH — অক্টোবর ৫, ২০০৯ @ ১২:৪৫ পূর্বাহ্ন এক টানে পড়ে গেলাম। যদ্যপি আমার গুরু পড়বার পর অধ্যাপক রাজ্জাক নিয়ে একটা মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গেছিলাম। এই লেখাটাও ভাল লাগল। এই মাপের মানুষকে সাধারণ মাপদণ্ডে মাপা যায় না। সাদা-কালোর মাঝেও অনেকগুলো মিশ্র ব্যান্ড থাকে যেটা উপলব্ধি করা শুধু জ্ঞানী মানুষের পক্ষেই সম্ভব।
      - বিবর্তনবাদী

No comments:

Post a Comment