শান্তনু কায়সার
পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্থপতি জিন্নাহ বলেছিলেন, পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের শুরু এবং পাকিস্তান জন্মলাভের এক বছরের মধ্যে, ১৯৪৮-এই বোঝা গিয়েছিল পূর্বাংশে এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত অর্থাৎ এখানে তা ‘স্টে’ করছে না। দ্য সিড অব ডেস্ট্রাকশন লাইজ ইন দ্য স্টেট ইটসেলফ। এই সময়পর্বে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নও খুব সুস্থির হয়ে ওঠেনি। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগের প্রসঙ্গে হত্যাকাণ্ডের এক বার্ষিকীতে জিন্নাহও কবিকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রপরিবারে পোশাকের ধরন, সেখানে ফার্সি ও মোগল সংস্কৃতির অনুশীলন প্রভৃতি রবীন্দ্রনাথকে প্রায় মুসলিম কিংবা সুফি ঘরানার মানুষ বলে একসময় পাকিস্তানিদের কাছে গ্রাহ্য ও গ্রহণীয় করে তুলেছিল।কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের যেমন মুখোশ উন্মোচিত হয়, তেমনি রবীন্দ্রনাথও একসময় আর গ্রহণীয় অথবা গ্রাহ্য থাকেন না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এবং প্রথম পর্বে একজন বুদ্ধিজীবী যে বলেছিলেন তামুদ্দনিক প্রয়োজনে দরকার হলে তাঁরা রবীন্দ্রনাথকেও বর্জন করবেন সেই ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েসে’ পাকিস্তানি শাসকদের প্রকৃত মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল। এর আরও পরে পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের পর বেতারে যখন রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ হয়, তখন শান্তিনিকেতনের ছাত্র হয়েও রবীন্দ্রনাথ আমাদের তমুদ্দুনের পরিপন্থী বিবৃতিতে আরেক শিক্ষক ও লেখক স্বাক্ষর দিতে একটুও দ্বিধা করেননি। তোপখানা রোডে অবস্থিত তৎকালীন পাকিস্তান কাউন্সিলের ঢাকা কেন্দ্রে মুজিবুর রহমান খাঁ বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ যে ‘হিন্দু’ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক সেটা তাঁর জন্য স্বাভাবিক, একই কারণে আমাদেরও নিজেদের অর্থাৎ মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে।” উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই সরলীকরণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যথেষ্ট শক্তিশালী ও কার্যকর ছিল।
এই সময়ের একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আমি তখন ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। সেই সময় আমার হাতে একটি পুস্তিকা আসে রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ববাংলার বিক্ষুব্ধ মুসলমান। হ্যাঁ, ‘পূর্ববাংলা’র, এখানেও চালাকি। নানা বিষয়ের মধ্যে গোরা উপন্যাস থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, ‘ভালো মানুষি ধর্ম নয়। তোমাদের মহম্মদ সে কথা জানতেন, তাই তিনি ভালো মানুষ সেজে ধর্ম প্রচার করেননি।’ পাঠককে বিভ্রান্ত করার খুবই ধূর্ত প্রয়াস।
কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, কোনো এক বৃদ্ধ মুসলমান সবজি-রুটি ইত্যাদি নিয়ে সড়কপথে যাচ্ছিলেন। জনৈক চেনপরা বাবুর মনে হয় এই ব্যক্তি তার সোজা পথে যাওয়ার বাধা। ফলে বাবুটি তাকে ‘ড্যাম-শুওর’ গালি দিয়ে, তার জিনিসপত্র নষ্ট করে এবং তাকে চাবুক মেরে দ্রুতবেগে তার বাহনে চলে যায়। অতঃপর গোরা (গৌরমোহন) তার নষ্ট হওয়া সবকিছু কুড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘তুমি কথাটি না বলে যে অপমান সহ্য করলে আল্লা তোমাকে এ জন্য মাপ করবেন না।’ ‘মুসলমান কহিল, ‘যে দোষী আল্লা তাকেই শাস্তি দেবেন, আমাকে কেন দেবেন?’ এর উত্তরে গোরা বলে, ‘যে সহ্য করে সেও দোষী। কেননা সে জগতে অন্যায়ের সৃষ্টি করে।’ তারপরই ‘ভালো মানুষি ধর্ম নয়’ ইত্যাদি কথা সে বলে। তথ্য ও সত্যকে বিকৃত এবং সমস্ত পরিপ্রেক্ষিতকে অগ্রাহ্য করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই উদ্ধৃতির লক্ষ্য ছিল, কবির মুসলমান পাঠককে বিভ্রান্ত এবং তাকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিদ্বিষ্ট কিংবা অন্তত বিক্ষুব্ধ করে তোলা।
কিন্তু ওরা যত অপপ্রচার করে জনচিত্তে কবির আসন তত পাকা হয়, কারণ পরিপ্রেক্ষিতসহ সৎভাবে রবীন্দ্ররচনা পড়লে এবং তাতে প্রবেশ করলে পাঠকের মনে ওই ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টির কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু দুর্জনের ছলের অভাব নেই। ফলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অন্যায় ও অসমভাবে এমনকি নজরুলের চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে সে বা তারা তাদের পরস্পরের সঙ্গে অথবা বিরুদ্ধে যেভাবে তুলনা করে তাতেও একই রকম দাস্য মনোবৃত্তির পরিচয় মেলে। পাকিস্তান-উত্তরকালে যারা নজরুলকে ‘পাকিস্তানি’ বানিয়ে ও ‘সংশোধন’ করে গ্রহণ করার কথা বলেছিল তারা যে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, তা খুবই স্বাভাবিক। কবি যতই ব্রাহ্ম হন, তারা তাঁকে হিন্দু না বানিয়ে শান্তি ও স্বস্তি পায় না, কারণ তাতেই অপপ্রচারের সুযোগ ও সুবিধা বেশি। আর সংস্কৃতির যে অবিভাজ্যতায় তারা নজরুলকেই গ্রহণ ও গ্রাহ্য করতে রাজি নয়, সেই বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ যে বর্জিত হবেন তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই ভাবনাও ছিল খুবই সংগত।
কিন্তু কবির মৃত্যুর দুই দশক পর ১৯৬১-তে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের নেতৃত্বে যে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালিত হয়, ষাটের দশকের মধ্যভাগের পরেও মানুষের স্মৃতিতে তা অমলিন ও জাগ্রত থাকে। ১৯৪৮-এ বা ঊনপঞ্চাশের একেবারে শুরুতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং বায়ান্নতে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতো মনীষী যেমন অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার ওপর মূল গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, তেমনি তার (প্রায়) দেড় দশক পর ১৯৬৬-তে সুফিয়া কামাল বা আবুল হাশিম রবীন্দ্রবিরোধী অপপ্রচারের জবাব দিতে গিয়ে একইভাবে আমাদের জাতিসত্তাগত অগ্রসর পরিচয়টিকে সামনে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। ফলে চাষা ও রাখালকে অর্থাৎ তৃণমূলের মানুষকে প্রধান গুরুত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে অসাধারণ গান ‘আমার সোনার বাংলা’ লিখেছিলেন তার ধারাবাহিকতায় ঋদ্ধ কিন্তু নবসৃষ্ট রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত করা অনিবার্য হয়ে ওঠে সেটিকেই।
দুই.
এভাবে এই ভূখণ্ডে পাকিস্তানের সমস্তটা সময় রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অস্ত্র হয়ে ওঠেন। পাকিস্তান পর্বে তো বটেই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালেও রবীন্দ্রনাথের নিম্নোদ্ধৃত পঙিক্তদ্বয় আমরা কতবার কতভাবে ব্যবহার করেছি সে কথা কি গুনে বলা সম্ভব?
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
কিন্তু এই পর্বে আমরা কি তাঁকে প্রথাও বানিয়ে তুলিনি? ‘প্রতিরোধের অস্ত্র’ করতে গিয়ে আমাদের কি তাঁকে একটু বা অনেকটাই কম পড়া হয়নি? পাকিস্তান পর্বে যিনি রবীন্দ্র-বর্জনেও প্রস্তুত ছিলেন কিংবা রবীন্দ্রবিতর্কে তাঁর বিপক্ষে যিনি স্বাক্ষর করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরপর্বে তাদের অত্যুৎসাহের মতো কোথাও কোথাও রবীন্দ্রনাথ কি ব্যবহূতও হননি? তাঁর চেতনা ও মর্মকে হত্যা কিংবা অন্তত ক্ষুণ্ন করে আমরা কি তাঁকে নিয়ে কেবল বর্ণোজ্জ্বল সামাজিক উৎসব ও হইচইয়ে মেতে উঠিনি? কবিরই গানের ভাষায়:
‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।
বুঝতে পারি কখন তুমি দাও-যে ফাঁকি \
স্তবের বাণীর আড়াল টানি তোমায় ঢাকি \’
আড়ম্বর আমাদের অর্জনকে পেছনে ফেলে তাকে যেমন কার্যত মিথ্যা অথবা হত্যা করে, স্তুতি ও বিশেষণে তাকে ঢেকে ফেলাও তেমনি কোনো কাজের কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ একটি প্রসঙ্গে যে বলেছিলেন, ‘আজকাল দোকানদারিই সবচেয়ে নিদারুণ হইয়া দয়াধর্ম গ্রাস করিতে উদ্যত হইয়াছে’ সেকথা আমরা যেন কখনো বিশেষত দোকানদারির এই বাস্তবতায়, একেবারেই না ভুলি।
তিন
প্রায় চার দশকের বর্তমান বাংলাদেশে দৃশ্যত ও প্রত্যক্ষত কবির কোনো শত্রু নেই। কিন্তু অন্তর্গত শত্রুর কি অভাব আছে? একটি উদাহরণ।
প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ আমাদের পাঠ্য। সেটা কতটা কীভাবে সেই বিতর্কে আপাতত যাব না। কিন্তু জিজ্ঞেস অবশ্যই করব, তাঁকে পড়া হয় তো? শেকসিপয়রের চতুর্থ জন্মশতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ প্রকাশিত হোমেজ টু শেক্সপীয়র-এর একটি প্রবন্ধে আর এ গোমেজ বলেছিলেন, শিক্ষার্থীরা শেকসিপয়ার না পড়ে তাঁর ওপর সমালোচনা পড়তেই আগ্রহী বেশি, কারণ তা পরীক্ষায় খুব কাজ দেয়। অন্তঃসারশূন্য ও ফাঁপানো উত্তরের উপযোগী লেখায় বিরক্ত হয়ে জীবনানন্দ একে বলেছিলেন ‘ফাজিল নোট’। রবীন্দ্রনাথকেও আমরা সেভাবে কিংবা অধঃপতিত হতে হতে একেবারেই না পড়ে কেজো ও কার্যোদ্ধারের উপায় করে ফেলিনি তো?
এভাবে রবীন্দ্রনাথের ক্ষতি যা-ই হোক, আমাদের ক্ষতি তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৭, ২০১০
http://banglalibrary.evergreenbangla.com/blog/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC-%E0%A6%93-%E0%A6%89%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%AC/
No comments:
Post a Comment