ফরহাদ মুস্তফা
(*উত্তরমালঞ্চ কবিতাটি আলোচনার নীচে দেওয়া হয়েছে)
‘রূপকথার সৌন্দর্য সম্ভার তাহার জন্য, যে পৃথিবীর সংকীর্ণ আয়তনের মাঝে নিজ আশা ও কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে নাই’।– শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
১.
ঠাকুরদাদার ঝুলির রূপকথা ছেলেবেলায় পড়েছি। এর মধ্যে ‘মালঞ্চমালা’ কাহিনীটি অন্যরকম। যখন দাদাজানের কাছে শুনেছি, অবাক ঘুরে বেড়িয়েছি রূপের জগতে। শুনতে শুনতে ঘুম এসে যেত। ঘুমের মধ্যে দেখতাম- একটি মেয়ে বনে বনে ঘুরছে, কোলে তার শিশু। তার সঙ্গে কথা বলে বাঘ, বনের পাখি, গাছপালা, নদী-নালা। আরেকটু বড়ো হয়ে শুনেছি, রূপবান যাত্রাপালাটি। মালঞ্চমালারই কাহিনী। শেষদিকে একটু বদলে দেওয়া। চরিত্রগুলোর নাম ভিন্ন, কিন্তু সুর অভিন্ন। অভিন্ন বলেই হিন্দু-মুসলমান এই কথাবস্তু ও ভাববস্তুর মধ্যে নিজস্ব আত্মার ধ্বনি চিনতে পেরেছে। উভয়ের নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠেছে । এই পালাটির গানগুলির মধ্যে একটি সতীনারীর সমগ্র জীবনের চোখের জলে ভাসানো জীবন-সংগ্রাম যে করুণ আবেদন সৃষ্টি করে, মনে হয়, এই কান্না বাতাসের, ঐ আকাশের, প্রকৃতি আর অখণ্ড সত্তার। খণ্ড খণ্ড হয়ে যে সত্তাটি জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে কেঁদে ফেরে-‘আমার মিলন লাগি আসছ তুমি কবে’- অখণ্ডের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার আকাঙ্খারই আর্তি এই সব।
২.
গল্পটির দিকে একটু ফেরা যাক। এক রাজার পুত্র-সন্তান হলে রাজজ্যোতিষী বললেন, এর আয়ূ মাত্র ১২ দিন। তাকে বাঁচাতে হলে ১২ বছরের কন্যার সাথে বিয়ে দিতে হবে। রাজা খুঁজে পেলেন- কোটাল কন্যা মালঞ্চমালা। মালঞ্চর বয়স বারো। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মালঞ্চর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হল ১২ দিনের শিশু রাজপুত্রের এবং বিয়ের রাতেই শিশুটি মারা গেল। কিন্তু গল্পটি মারা যায় নাই। রাজা ক্রুদ্ধ হলেন ও শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী করলেন নিষ্পাপ মেয়েটিকে। বললেন, মেয়েটি ডাইনি, ওকে আগুনে পোড়াও। মৃত রাজপুত্রের সঙ্গে মালঞ্চমালাকেও চিতায় তোলা হল। আগুন জ্বলে উঠল।
বৃষ্টি এসে নিভিয়ে দিল সে আগুন। বেঁচে গেল মেয়েটি সতীদাহ থেকে। প্রকৃতি ঘোষণা করল মেয়েটি ডাইনি নয়, সতী নারী। সতী নারীর কোলে শিশু স্বামী- মৃত রাজকুমার। রাতে ভূত-প্রেত এসে মৃতদেহটিকে খেতে চায়। মালঞ্চমালা তাকে আগলে রাখে, ভুতপ্রেত ফিরে যায়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই মালঞ্চমালা শিশু স্বামীটির প্রাণ ফিরে পায়। এইখানে গল্পটি শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু রূপের কথা শেষ হয় না। রাতে ভূত- দিনে বাঘ। কে বলে তাদের ভাগ।
বনের বাঘ এসে কচি শিশুটিকে খেতে চাইল। মালঞ্চমালার ব্যবহারে বাঘ মুগ্ধ হয়, বশ মানে। তারা আর ব্যাঘ্র নয়- হয়ে ওঠে বাঘ মামা, বাঘ মামী। কোনো মানুষ নয়- বাঘই এই একাকিনী মেয়েটির আত্মীয়-বান্ধব হয়ে ওঠে। বনের গভীরে বাসা বানায় মেয়েটি। দুধ আর মধু জোগাড় করে আনে এই বাঘ মামা-মামী।
রাজপুত্র বড়ো হলে বিদ্যালয়ে পাঠাল তাকে মালঞ্চমালা। সেখানে রাজপুত্রের সঙ্গে পরিচয় হল ভিন দেশী রাজকন্যা কাঞ্চীর সঙ্গে। গড়ে ওঠে প্রেম। এর পর অনেক ঘটনা। একটু সংক্ষেপে বলি।
রাজপুত্রের বাবা মালঞ্চমালার শ্বশুর বিপদে পড়ে বনে এলো। তখন জীবন বাঁচায় মালঞ্চমালা। রাজা মালঞ্চমালাকে চিনতে পারে। জানতে পারে তার পুত্র জীবিত। রাজপুত্রকে নিয়ে রাজা ফিরে যায় রাজ্যে। বনের মেয়ে বনে থাকে একা। কোটালকন্যা রাজার বাড়িতে যাওয়ার যোগ্য নয়। শাস্ত্র তাকে দিয়েছে নীচু জাত। বিয়ে হয় রাজকন্যা কাঞ্চির সঙ্গে রাজপুত্রের।
এরপর ভীন দেশের রাজা আক্রমণ করে রাজা ও রাজকুমারকে বন্দী করে। মালঞ্চমালা খবর পেয়ে বাঘবাহিনী নিয়ে তাদের উদ্ধার করে। নিজের দাঁত দিয়ে শিকল কেটে কেটে স্বামীকে মুক্ত করে। বাঘেরা মালঞ্চমালার প্রতি তার শ্বশুর শ্বাশুড়ীর অন্যায় অবজ্ঞা, অবহেলার কারণে খেতে চায়। মালঞ্চ তাদের বাঁচায়। রাজা কৃতজ্ঞতাস্বরুপ মালঞ্চমালাকে স্বীকার করে নেয়। রাজকন্যা কাঞ্চী হয় রানী, আর মালঞ্চমালা পাটরানী।
এইখানে মূল রূপকথাটির নটেগাছটি মুড়োলো। কিন্তু কবি তুষার গায়েনের ভাবের কথাটি ফুরায়নি।
৩.
তার আগে মূল কাহিনীর মালঞ্চমালাকে একটু ফিরে দেখা যাক। মালাঞ্চমালা নিম্নবর্ণের মেয়ে- কোটালকন্যা। শাস্ত্রমানা নারী। একটি মেয়ে যখন নারী হয়ে ওঠে – কারো স্ত্রী হয়ে ওঠে, তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারিত হয়- সতী নারী হয়ে ওঠা। তার নিজের জীবন বলে কিছু নেই। নিজের জীবন বিপন্ন করে তার স্বামী সংসারকে বাঁচাতে সবকিছু করে যায়।
এই কাহিনী সেই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, পতি পরম দেবতা। স্বামী দেবতাটি যে রকমই হোক না কেন, তার সেবা করাই স্ত্রীর একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। নারীর কোনো ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। নারী এখানে কোনো ব্যক্তি নয়। নিতান্তই পুরুষের সেবিকা। এটাই তার জীবনের চরম সার্থকতা।
৪.
এই প্রচলিত ধারণাটিকে ভেঙ্গে দিয়েছেন কবি তুষার গায়েন তার বিনির্মিত উত্তর মালঞ্চ কবিতায়। তার কাছে মালঞ্চমালা রক্তমাংসের মানুষ। একই সঙ্গে তিনি নারী এবং ব্যক্তি। মালঞ্চমালার মানসিক দ্বন্দ্ব ও তার রক্তক্ষরণের ইতিহাস যেমন এই কবিতায় দেখি, তেমনি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো কিভাবে প্রজাদের সঙ্গে আচরণ করত তার পরিচয় পাওয়া যায় এবং ঐতিহাসিকভাবে ভারত সমাজে কিভাবে জাতপাতের বিভক্তি শুরু হয়েছে তার উল্লেখও পাওয়া যায়। এটা একজন নারীর, ব্যক্তির, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বোপরি আমাদের বাংলা তথা উপমহাদেশের ইতিহাসের এক অনু-মহাকাব্য গাথা যা সমগ্রতা তৈরি করে, এক অখণ্ড বোধে উপনীত হতে সাহায্য করে।
৫.
‘রূপকথা আমাদের দেশের অন্যতম প্রাচীন লোকসাহিত্যের ধারা, যাতে আমাদের দেশজ ও লোকজ ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ আমাদের মূল্যবোধ, দেশ ও জাতির অন্তরাত্মা এবং তার স্বরূপ: রূপকথার রাজকন্যা-রাজপুত্র ও রাক্ষস-খোক্কোসময় কাহিনীতে সম্পৃক্ত। এইসব ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিকতার সম্পৃক্তিকরণ বর্তমান দিনের সাহিত্য সংস্কৃতির বড়ো লক্ষ্য।‘
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছেন, রূপকথার নির্দিষ্ট কোনো রচনাকার নেই। তা জাতির অন্তরাত্মার প্রতিফলন। রূপকথাতে ব্যক্তি বিশেষের কোনো কথা নেই, সমগ্র জাতিরই প্রাণের কথা, অন্তরতম আশা-আকাঙ্খা এতে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। মহাকাব্যের বিশালদেহে যেমন ব্যক্তি নিরপেক্ষ জাতির আত্মকথা বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশিত হয়ে ওঠে- রূপকথার রাজ্যেও সেই একই নিয়ম। কোথাও লেখকের নিজের এতটুকু কোনো ছাপ নেই। সর্বত্র একটা উদার বিশাল অনাসক্ত ভাবের লক্ষণ প্রস্ফুটিত হয়েছে।
আধুনিক কবি এই ভাবটিকেই পাল্টে দিতে চান। ব্যক্তিহীনতার বদলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মানুষের অধিকার, মর্যাদাবোধ এবং ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বকে স্থাপিত করেন কথাবস্তুর মধ্যে। এইভাবে পাল্টে যায় রূপকথার জগৎটি আধুনিক কালের কবির কাছে। কথাবস্তু বলতে কোনো লেখার আক্ষরিক অর্থকে বোঝায়। আর এই লেখার মাধ্যমে যে অন্তর্নিহিত গভীর ভাবনার প্রতিফলন হয়, তাই হল ভাববস্তু। কালে কালে মানুষের বিচার বুদ্ধি পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে মানুষের মূল্যবোধ। তাই ভাববস্তুরও পরিবর্তন ঘটছে।
যেমন প্রাচীন মহাভারতে কর্ণ-কুন্তীর সাক্ষাৎকারের সঙ্গে আধুনিক কালের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ণ-কুন্তীর কথাবস্তু একই। তবে এদের ভাববস্তু আলাদা। মহাভারতে যুদ্ধপরায়ণতাই মূল। মহাভারতের কাহিনীতে কর্ণ-কুন্তীর যে সাক্ষাৎ হয় সেখানে মাতৃস্নেহ ও পুত্রস্নেহকাতরতার পরিবর্তে স্বার্থচিন্তা ও বীরত্ব প্রদর্শনের মেজাজটিই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথে- কুন্তীতে মাতৃস্নেহ আর কর্ণে সেই স্নেহ-বুভূক্ষতা বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে।
রামায়ণের মেঘনাদ পাপী ও কাপুরুষ। মাইকেলের মেঘনাদ একজন বীরযোদ্ধা- নির্ভীক-সাহসী।
আবার প্রয়োজনে কথাবস্তুও পাল্টে যায় আধুনিক কালে। কালকেতুর কাহিনীর ভাববস্তু অচল হয়নি- মানুষের দুঃখ-বেদনার নিয়তি এখন লেখা হচ্ছে গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে। কিন্তু মঙ্গলকাব্য আর লেখা হয় না।
সেই কথাবস্তু একেবারে বদলেছে। সেই প্রকাশ ভঙ্গিও একেবারে বদলেছে। যদিও সে তুলনায় ভাববস্তু বদলেছে কম।
বিষয়বস্তু আর রূপকলা – দুয়ে মিলে সাহিত্য একটি অখণ্ড সৃষ্টি হয়ে ওঠে। এই অখণ্ডতাই চিরন্তন। যামিনী রায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন- বড়ো শিল্পের মর্মকথা হল- চিরন্তনত্ব। শিল্পে এই চিরন্তনত্ব আছে তার বিষয়ে দেশীয় ঐতিহ্যে এবং মিথের সম্পৃক্তিকরণেরর মধ্যে দিয়ে। বিশেষ করে মিথের ব্যবহার, ভাঙন এবং মিথের পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে।
কবি তুষার গায়েন ঠিক এই কাজটিই করেছেন। তার রূপের জগৎ থেকে পাল্টেছেন ভাববস্তুকে- পাল্টেছেন কথাবস্তুকে।
পতিব্রতা নারীর ভিতর থেকে প্রতিবাদী নারীটিকে প্রতিস্থাপন করেছেন আমাদের চৈতন্যের ভিতরে। তুষারের কাহিনী কোনো পাথুরে ভাষ্কর্য নয়- জলরঙে আঁকা একটি মহত্তম ছবি, যেখানে অনেক কিছুই সুপ্ত, ইঙ্গিতময়। পাঠককে শব্দের বাঁকে বাঁকে সে ইঙ্গিতকে দেখতে হয় শুধু চোখ দিয়ে নয়- চৈতন্য দিয়ে।
৬.
মূল ঘটনায় মালঞ্চমালা পাটরানী হয়েছেন। তুষার এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তিনি মালঞ্চকে পাটরানী হবার পরিবর্তে স্বেচ্ছা নির্বাসনে পুনরায় পাঠিয়েছেন বনে। কারণ যে অপমান ব্যক্তি ও নারী হিসাবে মালঞ্চ পেয়েছেন তার প্রতিবাদ হিসাবে এমনটিই যেন মালঞ্চের মতো সাহসী ও গভীর অন্তঃকরণের নারীর সঙ্গে মানানসই। এটা শ্রেণী ও জাতপাতে বিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা তার সাহস ও ব্যক্তিত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ। এছাড়াও যে রাজপুত্রকে সে বড়ো করেছে কোলে-পিঠে, তার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান ও সম্পর্কের জটিলতা (মাতৃ ও স্ত্রী সত্তার দ্বন্দ্ব) তাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে, তাড়া করে ফিরেছে আজীবন দুঃস্বপ্নের মতো । একারণেই এর সহোদর কাহিনী ‘রুপবান’-এ শেষ দৃশ্যে বর্ণিত রহিম ও রুপবানের বিয়ের ঘটনাটিকেও তুষার অনুসরণ করেন নি।
আবার রাজকন্যা কাঞ্চীর সঙ্গে রাজপুত্রের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখা ও তাদের সামনেই সমগ্র বঞ্চিত জীবন পাড়ি দেওয়ার নির্মমতা অনুষ্ঠিত হতে দেয়া স্বাভাবিক জৈব-মানসিক ধর্মের বিরোধী। বনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তই এই সব কিছুকে অতিক্রম করে যায়। রাজপুরী নয়, বনই তার নিজের ভূবন।
এটাই পুরণো মিথের ভিতর থেকে নতুন ভাববস্তুর সন্ধান ও আধুনিক বোধের সমন্বয়। মিথের সার্থক বিনির্মাণ। এরকম অনেক বিনির্মিত ঘটনা এবং উপলদ্ধির সমারোহ রায়েছে তুষারের উত্তরমালঞ্চ কবিতায়।
৭.
এই অসাধারণ লোকগাথা বা ‘বঙ্গীয় উপন্যাস’ কবি তুষার গায়েন স্থাপন করেছেন এক অনু-মহাকাব্যের আঙ্গিকে। কবিতা গল্প বা উপন্যাস নয়, কবিতা কবিতাই। অনেক গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে কবিতাটিকে শব্দের যাদুতে বিনির্মাণ করেছেন।
তার বিনির্মিত কাহিনীটিকে তিনি সাতটি পর্বে ভাগ করেছেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো করে।
প্রথম পর্ব- বনপ্রস্থান :
মাঘের শীতে একটি বনপথের দৃশ্য ভেসে ওঠে- সেখানে ধানকাটা মাঠে জ্বলছে নাড়ার আগুন। ধুঁয়া আর কুয়াশা মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়াশায়। দৃশ্যকল্প বলে দিচ্ছে এটা এই একান্ত বঙ্গের ছবি। দেখা যায় এই বনপথে একটি সদ্য কিশোরী মেয়েকে, যার কোলে দিন কয়েকের একটি শিশু। এ শিশু মেয়েটির সন্তান নয়- স্বামী, যেন স্বাভাবিক মাতৃস্নেহে তার জন্য দুধ খুঁজছে। হিংস্র বাঘদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার বন্ধন, তার সতীত্বের ঘোষণা, শিশুটির সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ও সম্পর্কের জটিলতা, শিশুটি যেন চিরন্তন শিশুদের মতো তাকে মা বলে ডেকে না ওঠে এই শংকা, এই দূরাগত নির্জন একাকী জীবন, তার ভেতরের নারীটির রক্তমাংসের আকাঙ্খা, মানসিক ও শারীরিক জৈব ধর্ম- এইসব দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির একটি নাটকীয় উপস্থাপনা পাই।
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে
এই পর্বের শেষাংশে দেখতে পাই, রাজপুত্রকে শিক্ষাদানের জন্য মালঞ্চমালা বন ছেড়ে লোকালয়ের দিকে যাত্রা করছে। স্কুলের ঘন্টা ও হ্রেষাধ্বনির উল্লেখ সেই আবহকে তুলে ধরে।
দ্বিতীয় পর্ব- স্মৃতি : বনে বাড়ে রাজার কুমার
ফ্লাশব্যাকে, রাজকুমারের বনে বড়ো হয়ে ওঠার চিত্রটা পাই। বনের উদার আশ্রয়ে বড়ো হয় রাজকুমার, যেখানে নেই লোকালয়ের ক্ষুদ্রতা ও জাতপাতের নিমর্মতা। মালঞ্চ তার শিশু স্বামীকে সন্তানস্নেহে বড়ো করে তোলে। কাজল আঁকে চোখে। এইখানে সেই চিরন্তন বাংলার রমণীকে পাওয়া যায়। মালঞ্চমালা নিজেকে শোনায়-
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর
বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে।
তৃতীয় পর্ব- রাজটিকা :
রাজপুত্র রাজার ছেলে। কিন্তু মালঞ্চমালা কোটালকন্যা, নিচু বর্ণের। তবু নিজ দায়িত্বে তাকে রাজার ছেলের মতো তার বসন-ভূষণ-বাহন জোগাড় করে দেয়। তাকে রাজপুত্রের মতো বড়ো করে তোলে। হয়তো মনে সাধ, কুমার বড়ো হলে তাকে (মালঞ্চমালা) জানবে তার প্রকৃত পরিচয়ে, মূল্য দেবে তার আত্মত্যাগের ।
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!
চতুর্থ পর্ব- পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি :
আরেকটি ফ্লাশব্যাক দেখি। সেই প্রথম দিনের ঘটনা যা ছিল মালঞ্চের জন্য ও তার পিতার জন্য অনিয়ন্ত্রিত। রাজার আদেশে একটি নিম্নবর্ণের ১২ বছরের মেয়ের সাথে ১২ দিনের রাজপুত্রের বিয়ে হল। শিশুর মৃত্যু, এই মৃত্যুর জন্য নিয়তিকে নয় মেয়েটিকে দায়ী করা, তাকে ডাইনী বলে ঘোষণা দেওয়া, চিতায় তোলা, বৃষ্টির কারণে আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া মৃত শিশুটিকে ভূত-প্রেতের ছোবল থেকে বাঁচানো ও তাকে নিয়ে গোপনে বনে চলে যাওয়া - এই যে একটি সামাজিক, শাস্ত্রীয় ও ক্ষমতার শিকার হয়ে একটি মেয়ে অসহায় হয়ে লোকালয় ছেড়ে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিল - তার চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খার কোনো মূল্য নেই। এর কারণটির পেছনে রয়েছে ইতিহাসের কুটিল ছায়া। সেই ইতিহাসটি এসেছে ভারতে আর্যদের আগমনের সঙ্গে, যারা ঘোড়ায় চড়ে নেমে এসেছিল পাহাড় থেকে পলি সমতলে। সমগ্র সমাজ শ্রেণী বিভক্ত হয়ে যায় এই বিদেশী আর্যদের আগমন ও তাদের শাস্ত্র প্রণয়নের মাধ্যমে। এই ঘোড়ার প্রতীকটির সঙ্গে অনার্যদের সামাজিক অবস্থানের পতন – পতনের কারণ হিসাবে শাস্ত্রের উত্থান - এই ইতিহাসটাই এই পর্বে বর্ণিত হয়েছে।
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে …
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।
পঞ্চম পর্ব- ধল প্রহরের গান :
রাজপুত্রকে বিদ্যালয়ে পাঠায় মালঞ্চমালা। সেখানে কেবল রাজসন্তান ও উচ্চবর্গীয়রাই যায় শিক্ষা নিতে। সেজন্য রাজপুত্রকে রাজার বসন-ভূষণে-বাহনে পাঠানো হয়। সেখানে রাজপুত্রের সাথে দেখা হয় এক রাজকন্যার। দুধবর্ন তার গায়ের বরণ এবং মর্যাদায় সমবংশীয়। মালঞ্চ নিজেকে আড়াল করে রাখে, যেন বেড়ে ওঠা রাজকুমার তাকে ভুল করে মা বলে না ডাকে। তবুও মালঞ্চের গোপন আকাঙ্খা যেন রাজকুমার একদিন জানতে পারে যে সে তার স্ত্রী - যে একাই সমাজ, শাস্ত্র, দুর্যোগ ও সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রাণপন সংগ্রাম করে তাকে বড়ো করে তুলেছে এবং এই নারীটিকে তার নিজস্ব নারী হিসাবেই যেন অন্তত একবার হলেও রাজকুমার মূল্য দেয়।
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে !
ষষ্ঠ পর্ব – দাঁতে কাটি কারাগার :
ভিনদেশী রাজার আক্রমণে পরাজিত শ্বশুর-রাজা ও স্বামী বন্দী রাজপুত্রকে উদ্ধারের সেই ঘটনাটি দেখতে পাওয়া যায়। বনে একা থাকা মালঞ্চমালা খবর পেয়ে তার স্বামী ও শ্বশুরকে উদ্ধার করে বাঘ বাহিনী নিয়ে। নিজের দাঁত দিয়ে স্বামীর শিকল কেটে তাকে মুক্ত করে। এক একটি দাঁতের বিনিময়ে এক একটি শিকলের বন্ধন কাটে মালঞ্চ। তাতে যে রক্তদর্শন ঘটে, তা এক ভিন্ন অনুভবে মালঞ্চের মনে সুপ্ত মিলনের আকাঙ্খা জাগিয়ে যায়। কেননা সতী নারী রক্তপাতের মধ্য দিয়েই প্রথম স্বামী মিলনের তৃপ্তি ও সুখ পায়। মালঞ্চ এইখানে তার স্বপ্ন- আকাঙ্খার কথা বলছে –
দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
সপ্তম পর্ব – বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল :
এই শেষ পর্বে গল্পের পরিণতি ঘুরে যায়। যে বিপুল আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে মালঞ্চমালা তার অসম বয়সী স্বামীটিকে বাঁচিয়েছে, তার শ্বশুরকে বাঁচিয়েছে - তার বিনিময়ে সে পায়নি তার প্রাপ্য অধিকার, সম্মানিত স্ত্রী ও আকাঙ্খিত ঘর সংসার। বরং পেল বনবাস যার চেয়ে মৃত্যুকেও তার প্রিয় মনে হয়। তাই তার আর্ত উপলব্ধি শুনি যে, ভালবেসে দাঁত দিয়ে শিকল কাটা যায়, কিন্তু মনের দেয়াল কাটা যায় না।
দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট
কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস
আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…
এইখানে এসে চোখে জল আসে। এই বঞ্চিত নারীর জন্য আমাদের হৃদয় ভেঙ্গে পড়ে। শাস্ত্রের প্রতি জমে ওঠে ক্রোধ। আমরাও তাই সমর্থন করি তার বনে ফেরা- যেখানে জাতপাতের বিভাজন নেই, আছে ভালবাসা- যা উন্মুক্ত, উদার, অখণ্ড-
তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।
৮.
কবিতার শুরু বনে। শেষও বনে। বনমর্মর শোনা যায় কবিতার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বাক্যে- কথাবস্তু ও ভাববস্তুতে। এই বন সহজ সরল, স্বাভাবিক, সপ্রাণ ও সবুজ। এখানে গাছপালা, পশুপাখি, নদীজল- আকাশবাতাস, মেঘ ও মাটি- একীভূত। অখণ্ড সত্তা। স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই। নেই বিভাজন। আছে উদার ঐক্য। অখণ্ড একাকার হয়ে যাওয়ার টান। শুভর সঙ্গে মিলনের বোধ।
যে কারণে শাস্ত্রবদ্ধ মানব কখনো কখনো বনবাসীর সন্দেহর কারণ হয়ে ওঠে। আবার যখন বোঝে, যে মানুষ শাস্ত্রবিহীন, প্রকৃতির মত সৎ বনে আশ্রয়প্রার্থী- তাকে আশ্রয় দেয় মায়ের মতন। বন যেন মা। আদিমাতা। তার অধিবাসী গাছপালা, পশুপাখিও এই মাতৃস্নেহ জানে – মাতৃস্নেহ মানে। সবাইকে কোলের আশ্রয়ে ধরে রাখে। কাউকে বিমুখ করে না। যে কারণে দেখি, বাঘ রাজপুত্রকে খেতে চায়। কিন্তু ব্যাঘ্রসমাজ মালঞ্চমালার সত্য কথনে মুগ্ধ। তারা শিশুটির জন্য গাছে গাছে যায় খাবার আনতে। গাছও তাদের দেয় অবারিত মধু। পথে পথে মেলে দুধ। এবং মেয়েটির জন্য তারা লড়াই করে বিভাজনকামী মানুষের বিরুদ্ধে। আক্রান্তদের বাঁচায়। আবার ন্যায়বোধে অন্যায়কারী শ্বশুরশ্বাশুড়ীকে খেতে চায়। মেয়েটির অনুরোধে তাদের ক্ষমাও করে দেয়। এই যে বাঘের ভেতরে দেখি সেই মহৎপ্রাণের উৎসারণ- যার ভেতরে নেই অশুভ ভাবনা। আছে ন্যায়বোধ ও মমতার সঘন হৃদয়।
আর গাছ প্রকৃতির অখণ্ড প্রতীক। গাছ তার ভিতরে ধরে রাখে প্রকৃতির বিশালতা। দানধর্ম। সুন্দরের আকাঙ্খা। কাউকে সে দূরে ঠেলে দেয় না। দেহ ও মনের খাদ্য সে যোগায় মায়ের মতোন। তার পাতাটি, ফুলটি, ফলটি, শাখাটি দানধর্মে প্রবল। আর শেকড় যেভাবে আকড়ে ধরে মাটিকে- কালের করাল গ্রাস থেকে ফেরায় মাটিকে, বাতাসকে, আলোকে- সে রকম আমরা দেখি গাছ সমগ্রকে ধরে রাখে। ছায়াটিকে ধরে রাখে। ছায়াটি হারিয়ে গেলে তার কঙ্কালটিকেও ধরে রাখে। কাউকে সে হারায় না। একাত্ম করে রাখে। এই খণ্ড- খণ্ডের সঙ্গে অখণ্ডের মিলনের খেলা তাই অতি স্বাভাবিক ও মহত্বের ইঙ্গিত।
প্রকৃতির শান্ত সুরটিই এ কবিতার প্রাণের সঙ্গীত। প্রকৃতির অখণ্ড বোধই এ কবিতার প্রাণ।
৯.
এই মর জর্জর, ষড়যন্ত্রময় জগৎ থেকে আমাদের ফেরায় এ কবিতাটি সেই দীর্ঘ শমিত অভিযাত্রায়- মাঘশীতে, ডোরাকাটা বনপথে, নাড়ার আগুনে, কাঁপা কাঁপা ছায়ার ভেতরে, অতল রাত্রিতে, জলে ভেসে যাওয়ার মধ্যে, পানকৌড়ির উড়ে যাওয়ায়, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে, মেঘে,মেঘের পালঙ্কে, বনমধুতে, আকাশময় আকাশে, কচুপাতায়, স্নিগ্ধ পলি সমতলে, শ্বেতপঙ্খীতে, পাহাড়ের ক্ষতে, জলের আর্তিতে, একটি বা দুটি তারায়, সরোবরে, পাতাস্রোতে, রোদ এবং ছায়ার কঙ্কালের ভেতরে, রূপের ভেতরে, প্রাণের ভেতরে। জীবনের প্রাণবন্ত অস্তিতে।
এ কবিতার আয়োজন যে শব্দে নির্মিত হয়- তারা সব সত্য শব্দ, সপ্রাণ এবং আত্মার ধ্বণিতে মুখর। তারা পাতার মতো মর্মরিত, আলোর স্পর্শে পুষ্টি যোগায় কবিতার গাছটিকে। শব্দগুলি ফুলের পাপড়ির মতো লাবণ্যময়, সুবিন্যস্ত। রচনা করে একটি ফুলজীবন- তার আছে ঘ্রাণ- আছে রঙের ইশারা, যা প্রজন্মকে ডেকে আনে। আরেকটি ফুলের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। জাগিয়ে তোলে আছে সৃজনের সক্ষম সামর্থ্য। অপ্রয়োজনের ভার কোনো শব্দ কাঠামোর ভেতরে ও বাইরে চিহ্ণিত হয় না।
কবি তুষার বলেছেন একটি রূপকথা- রূপের জগতের ভেতরে রূপের কথা, আরও গভীরে লুকিয়ে থাকা চুপকথা। এজন্য তিনি নির্মাণ করেছেন একটি পৃথক কাব্যভাষা। যা শান্ত, মন্দ্র এবং প্রাণোৎসারিত। যেমন আমরা দেখতে পাই-
মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
এ ভাষার মধ্যে সেই প্রাচীন রূপের জগতের মন্দ্রতা বোঝাতে ব্যবহার করেছেন দূরাবহ, রাত্রি, ভ্রম গুরুগম্ভীর শব্দ। আবার সমকালীন করে তুলেছেন- ডোরাকাটা, নাড়া, বাঘমামা- এইসব সহজ সরল প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। এই মন্দ্র ও সরল শব্দ আশ্চর্যভাবে মিলিত ঐক্যতান সৃষ্টি করে- যা তুষারের কাব্য-সামর্থ্যের বিশেষ প্রকাশ।
যে কোনো শব্দের দুটো দিক থাকে। এক. তার অর্থের দিক। দুই. তার রস-প্রতীতির দিক। গদ্য শব্দের আক্ষরিক অর্থকে প্রধানত ধারণ করে। কিন্তু কাব্য উন্মোচন করে শব্দের রস-প্রতীতি বা রহস্য ও ব্যঞ্জনাকে। ‘সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে’- এইখানে শব্দের অসাধারণ যাদুকরী ব্যবহার করেছেন তুষার। মেয়েটি ১২ বছরের। সবে যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে। তার ভেতরের নারীটি জেগে উঠেছে। ঋতুচক্রের যে নম্র লজ্জা এবং নারী হয়ে ওঠার গৌরব- এই দুটি বিষয়কে একই সঙ্গে তুষার ব্যবহার করেছেন ‘সলাজ রক্তের গান’ শব্দবন্ধটি। যে গানটির মাধ্যমে আবেদন জানাচ্ছে পুরুষটিকে- সে শিশুমাত্র। এখন এই সলাজ রক্তের গানের কোনো মানে নেই। কিন্তু একদিন মানে হবে। তার জন্য আছে অপেক্ষা। বহু বছরের প্রতীক্ষা।
এই রকম শব্দের অন্তর্গত আবেগ, সমাবেশ ও ধ্বনি বৈচিত্র্য এবং ছন্দের শোভনতা নিয়ে নির্মিত হয়েছে উত্তরমালঞ্চ কবিতাটির রূপময় ভাষা। হয়ে উঠেছে অনির্বচনীয়।
এবং রূপময় ভাষার অর্ন্তগত প্রতিটি বাক্যে প্রতিটি শব্দের মধ্যে আছে অন্বয় । আছে বাক্যের সঙ্গে বাক্যের অন্বয়। কোনো বাক্যই দুর্বল বোধ হয় না। হাত ধরাধরি করে কবিতার দিকে পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায়।
ক) ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
!
খ) মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
!
গ) বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
!
ঘ) তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
!
ঙ) আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
প্র্রতিটি বাক্যই চমকে দেওয়ার মতো। প্রথম বাক্যে সামন্ত জীবনের বিলাস ব্যসনের অহংকার বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে মেঘের সরল সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। কিন্তু পরের বাক্যে দেখি রাজার কুমার সে কৃত্রিম বৈভবের মধ্যে নেই। তাই মেঘের সরল অলংকার তার পালঙ্ক হয়ে উঠেছে। এই মেঘের সৃজনশীলতার মধ্যে তার বর্তমান বন-বসবাস এবং আনন্দময় বেড়ে ওঠা। সেই বনের অখণ্ড সত্তার মধ্যে বেড়ে ওঠা- যেখানে লোকালয়ের ঈর্ষা-হিংসা-দ্বেষ-স্বার্থপরতা নেই , আছে কল্যাণের, বিস্তার যাকে তুষার বলেছেন- দানধর্ম। এই বাক্যটিকে একটু নিবিড়ভাবে দেখলেই বোঝা যায়- তারা আলাদা আলাদা বাক্য , আলাদা আলাদা চিত্র, কিন্তু একটি অখণ্ড চিত্রের দিকে- সম্পর্কের দিকে আমাদের সঙ্গী করে নিয়ে যায়, গভীর রহস্যের মধ্যে দিয়ে গাথা হচ্ছে একটি মালা। প্রতিটি পঙক্তিই মালাটির সমান লাবণ্যের ফুল। কোনোটি তাজা বা কোনোটি মৃত নয়। সকল শব্দই জীবন্ত। কোনো শিথিলতা নেই।
১০.
কবিতার ছন্দটি কথাবস্তু ও ভাববস্তুর মতোই নিখুঁত।
এ ছন্দ কান ও মনকে স্নিগ্ধ করে। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের ভিতরকার ঋদ্ধ প্রাণের সুরটিকে প্রাণে পৌছে দেয়। বোঝা যায় কাব্য ও ছন্দ অঙ্গাঙ্গীভাবে বাঁধা। কেননা ছন্দ আর আবেগ যমজ। যেমন কবি কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জানান, এই ছন্দ কৃত্রিম গণিত সাপেক্ষ মাত্রা গণনা নয়। তা কুস্তি করে সাজানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তা নাচের তালের মতো স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি। আর আমরাতো এই ভঙ্গিটিকে মুখ্যত দেখি না। ভঙ্গির মধ্যে দিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দকে দেখতে চাই- যে আনন্দ কবিতারই অন্য নাম।
১১.
এ সময়ের অনেক কবি শেকড়ের কাছে ফেরার কথা বলেছেন। লিখছেন- মিথ নির্ভর কবিতা। মাটিবর্তী কবিতা। সে সব কবিতার মধ্যে যতো রয়েছে অহংকার আর নির্মাণ-চতুরতা- কিন্তু নেইস্বদেশ শেকড়ের আবিষ্কার। তাই কোনো কোনো কবিতা হয়ে ওঠ শব্দের সম্ভারমাত্র, শব্দের চমক অথবা দুএকটি বাক্যের স্ফূর্তিমাত্র। সেখানে যে আকাশ বর্ণিত হয়, যে জল ও মাটির ভুবন দৃশ্যমান হয়, তার সাথে আমাদের বাংলাদেশের মিল খুঁজে পাওয়া কষ্টকল্প হয়ে ওঠে। শেষমেষ তা হয়ে ওঠে- ঘোড়ার ক্ষুরের ধ্বনির ব্যর্থ অনুকরণ। যে মেয়েটিকে সে সব কবিতায় দেখতে পাই সে ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বিল্ডিং-এর ছাদে উঁকি মারে, যে ছায়াটিকে চোখে পড়ে তা ড্রাগনচিহ্ণিত কোন অপচ্ছায়া মাত্র, যে গাছটিকে লক্ষ্য করি- তা আসলে কোনো গাছ নয়- গাছের কঙ্কাল- বনসাই।
আর প্রকৃত আকাশ দেখা যায় এই ‘উত্তরমালঞ্চ’ কবিতায়। এ কবিতার আকাশ তা আমাদের বাংলাদেশেরই আকাশ, এ কবিতার জল আমাদের নদী ও পুকুরের জল। আমাদের আলো ও হাওয়ার ভিতরের জীবন-নিসর্গের রূপময়তা এ কবিতার ছত্রে ছত্রে। যে গাছটি সবুজ হয়ে ওঠে আমাদের চোখের সামনে, তা আমাদের আত্মার অখণ্ড আশ্রয়। আমাদের জীবন যা প্রকৃতিরই খণ্ডাংশমাত্র- যার মূল প্রবণতা প্রকৃতির অখণ্ড প্রাণের ভিতর ফিরে যাওয়ার- সে প্রাণকে ধারণ করে আছে প্রকৃতই কবি তুষার গায়েনের কবিতা।
http://www.facebook.com/s.php?q=Subrata+Augustine+Gomes&k=100000020&init=ffs#/note.php?note_id=227641105337&ref=mf
তথ্যসূত্র:
. ১.আধুনিক সাহিত্য : গোপাল হালদার। ২. রূপকথা : শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ৩.পটুয়াশিল্পী : যামিনী রায়
৪.কাব্যের মুক্তি : সুধীন দত্ত। ৫. বৃষ্টির অন্তর ত্রাস : তুষার গায়েন, নিসর্গ প্রকাশন, ঢাকা।
মূল কবিতাটি-
উত্তরমালঞ্চ
বনপ্রস্থান
মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে
বাঘমামা, যদি না থাকিতে বনে…এইবার যাই!
পালাই পালাই বন থেকে দূরে লোকালয়, বিদ্যালয়
প্রথম পাঠের ঘণ্টাধ্বনি, হ্রেষা শোনা যায়…
স্মৃতি: বনে বাড়ে রাজার কুমার
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর
বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে!
রাজটিকা
কোটালকন্যার হাতে যদি বাড়ে রাজার কুমার
তবু সে’তো রাজপুত্র, রাজধর্ম তাঁর
একযুগ পার হলে যেন সব চিহ্ণ
সমান স্বরূপে ফুটে ওঠে তাঁর, এই ভার
নিয়েছি নিজের বোধে…কেউ জানে নাই
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!
পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি
মৃতের শরীর থেকে মৃত্যু উড়ে গেছে
জীবন চিৎকার করে নামে সেইরাত
চোখের কোটরে দেখি আবার চোখের জল
ধুয়ে যায় দৃশ্যগাঁথা বন সর্ সর্
বিদেহী ছায়ারা দ্রুত মিশে যায় বাষ্পীভূত
আকাশে আকাশময় জড়ো হয় মেঘ
বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা ধারা হয়ে নেমে আসে
ন’ড়ে চ’ড়ে কচুপাতা কিছু জল ধরে রেখে
বাকিটুকু ফেলে দেয় পতনের প্রেমে:
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে…
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।
ধল প্রহরের গান
ওঠো ওঠো রাজার কুমার বিদ্যালয়ে যাও
বিদ্যালয়ে তোমার সমান রাজকন্যা পাও
দূধের বরণ রাজকন্যা শ্বেতপঙ্খী নায়ে
এনে দেবো পঙ্খীরাজ চিঁহিঁ রবে গায়
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে!
দাঁতে কাটি কারাগার
দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
‘বাঘমামা, খেয়ো না খেয়ো না, এই কাঞ্চী কুমারের নিধি
এত সাধ রক্তপানে যদি, তবে খাও আমাকেই আগে’…
একে একে দাঁতের বিনাশে কাটে শিকলের ভার
কাক ডাকে ভোর হয় ফর্সা আকাশে
নিথর একটি, তবু, দু’টি তারা থাকে!
বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল
দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট
কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস
আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…
রাজা আমায় নিলেন নাকো ঘরে, না দিলেন মৃত্যুপরোয়ানা!
তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।
No comments:
Post a Comment